'পল্লিজননী' কবিতায় সন্তানের জন্য অমঙ্গলের প্রতীক কোনটি? 

Created: 1 year ago | Updated: 1 year ago
Updated: 1 year ago

রাত থম থম স্তব্ধ নিঝুম, ঘোর-ঘোর-আন্ধার,

নিশ্বাস ফেলি তাও শোনা যায় নাই কোথা সাড়া কার ।

রুণ ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা,

করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা ।

শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে,

তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরাণ দোলে ।

ভন ভন ভন জমাট বেঁধেছে বুনো মশকের গান

এঁদো ডোবা হতে বহিছে কঠোর পচান পাতার ঘ্রাণ ।

ছোট কুঁড়েঘর, বেড়ার ফাঁকেতে আসিছে শীতের বায়ু,

শিয়রে বসিয়া মনে মনে মাতা গণিছে ছেলের আয়ু ।

ছেলে কয়, ‘মারে, কত রাত আছে, কখন সকাল হবে,

ভালো যে লাগে না, এমনি করিয়া কেবা শুয়ে থাকে কবে ।’

মা কয়, ‘বাছারে ! চুপটি করিয়া ঘুমো ত একটি বার',

ছেলে রেগে কয়, ‘ঘুম যে আসে না কি করিব আমি তার ।'

পাণ্ডুর গালে চুমো খায় মাতা । সারা গায়ে দেয় হাত,

পারে যদি বুকে যত স্নেহ আছে ঢেলে দেয় তারি সাথ ।

নামাজের ঘরে মোমবাতি মানে, দরগায় মানে দান

, ছেলেরে তাহার ভালো করে দাও কাঁদে জননীর প্রাণ ।

ভালো করে দাও আল্লা-রসুল! ভালো করে দাও পীর,

কহিতে কহিতে মুখখানি ভাসে বহিয়া নয়ন নীর!

বাঁশ বনে বসি ডাকে কানা কুয়ো, রাতের আঁধার ঠেলি,

বাদুড় পাখার বাতাসেতে পড়ে সুপারির বন হেলি ।

চলে বুনো পথে জোনাকি মেয়েরা কুয়াশা কাফন ধরি,

দুঃ ছাই! কিবা শঙ্কায় মার পরাণ উঠিছে ভরি ।

যে কথা ভাবিতে পরাণ শিহরে তাই ভাসে হিয়া কোণে,

বালাই বালাই, ভালো হবে যাদু মনে মনে জাল বোনে ।

ছেলে কয়, ‘মাগো, পায়ে পড়ি বল ভালো যদি হই কাল,

করিমের সাথে খেলিবারে গেলে দিবে নাত তুমি গাল ।

আচ্ছা মা বলো, এমন হয় না রহিম চাচার ঝাড়া,

এখনি আমারে এত রোগ হতে করিতে পারেত খাড়া?'

মা কেবল বসি রুগ্‌ণ ছেলের মুখ পানে আঁখি মেলে,

ভাসা ভাসা তার যত কথা যেন সারা প্রাণ দিয়ে গেলে ।

‘শোন মা, আমার লাটাই কিন্তু রাখিও যতন করে,

রাখিও ঢ্যাপের মোয়া বেঁধে তুমি সাতনরি সিকা ভরে ।

খেজুরে গুড়ের নয়া পাটালিতে হুডুমের কোলা ভরে ।

ফুলঝুরি সিকা সাজাইয়া রেখো আমার সমুখ পরে।'

ছেলে চুপ করে, মাও ধীরে ধীরে মাথায় বুলায় হাত,

বাহিরেতে নাচে জোনাকি আলোয় থম থম কাল রাত ।

রুণ ছেলের শিয়রে বসিয়া কত কথা পড়ে মনে,

কোন দিন সে যে মায়েরে না বলে গিয়াছিল দূর বনে ।

সাঁঝ হয়ে গেল তবু আসে নাকো, আই ঢাই মার প্রাণ,

হঠাৎ শুনিল আসিতেছে ছেলে হর্ষে করিয়া গান ।

এক কোঁচ ভরা বেথুল তাহার ঝামুর ঝুমুর বাজে,

ওরে মুখপোড়া কোথা গিয়াছিলি এমনি এ কালি সাঁঝে ।

কত কথা আজ মনে পড়ে তার, গরীবের ঘর তার,

ছোটখাট কত বায়না ছেলের পারে নাই মিটাবার ।

আড়ঙের দিনে পুতুল কিনিতে পয়সা জোটেনি তাই,

বলেছে আমরা, মুসলমানের আড়ং দেখিতে নাই ।

করিম সে গেল? আজিজ চলিল? এমনি প্ৰশ্ন মালা,

উত্তর দিতে দুখিনী মায়ের দ্বিগুণ বাড়িত জ্বালা ।

আজও রোগে তার পথ্য জোটে নি, ওষুধ হয়নি আনা,

ঝড়ে কাঁপে যেন নীড়ের পাখিটি জড়ায়ে মায়ের ডানা ।

ঘরের চালেতে হুতুম ডাকিছে, অকল্যাণ এ সুর,

মরণের দূত এলো বুঝি হায়, হাঁকে মায়, দূর-দূর ।

পচা ডোবা হতে বিরহিনী ডাক ডাকিতেছে ঝুরি' ঝুরি',

কৃষাণ ছেলেরা কালকে তাহার বাচ্চা করেছে চুরি ।

ফেরে ভন্ ভন্ মশা দলে দলে, বুড়ো পাতা ঝরে বনে,

ফোঁটায় ফোঁটায় পাতা-চোঁয়া জল ঝরিছে তাহার সনে ।

রুণ ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা,

সম্মুখে তার ঘোর কুজ্বটি মহাকাল রাত পাতা ।

পার্শ্বে জ্বলিয়া মাটির প্রদীপ বাতাসে জমায় খেল;

আঁধারের সাথে যুঝিয়া তাহার ফুরায়ে এসেছে তেল ।

Content added || updated By
Promotion