তুমি মহাপ্রজাপতি গৌতমীর মানবীয় গুণের তালিকা তৈরি করেছ, তার মধ্যে কোন গুণগুলো তুমি তোমার পরিবারে সদস্য/সহপাঠীদের পালন বা চর্চা করতে উদ্বুদ্ধ করবে এবং কীভাবে উদ্বুদ্ধ করবে তা লেখো।
যে গুণগুলো পালন/চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে চাই | কীভাবে পালন/চর্চায় উদ্বুদ্ধ করব |
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
বুদ্ধের সময়ে অঙ্গদেশের ভদ্দিয় নগরে মেণ্ডক নামে একজন ধনাঢ্য শ্রেষ্ঠী ছিলেন। ধনঞ্জয় নামে তাঁর এক পুত্র ছিল। ধনঞ্জয়ের স্ত্রীর নাম সুমনাদেবী। বিশাখা, ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠী ও সুমনাদেবীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। বিশাখার সাত বছর বয়সে ভগবান বুদ্ধ ১,২৫০ ভিক্ষুসঙ্ঘসহ ভদ্দিয় নগরে আসেন। তখন মেণ্ডক শ্রেষ্ঠী তাঁর নাতনি বিশাখা ও তাঁর পাঁচ শ সখীসহ বুদ্ধকে অভ্যর্থনা জানাতে যান। বুদ্ধ বিশাখার মানসিক অবস্থা অনুযায়ী ধর্মদেশনা করলেন। ধর্মদেশনা শুনে মেণ্ডক শ্রেষ্ঠী, বিশাখা ও পাঁচশ সখী স্রোতাপত্তি ফল লাভ করেন। বিশাখা সেদিন থেকে টানা আটমাস বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষু সঙ্ঘকে খাদ্যভোজ্য দিয়ে সেবা করেছিলেন।
সে সময় শ্রাবন্তীতে মিগার নামের এক শ্রেষ্ঠী ছিলেন। পুণ্যবর্ধন নামে তাঁর এক বিবাহযোগ্য পুত্র ছিল। তাঁর জন্য সর্বগুণে গুণবতী বিশাখাকে স্ত্রী নির্বাচন করা হয়। বিশাখার বিবাহ উৎসব তাঁর পিতার বাড়িতে চার মাস ধরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় বিশাখার পিতা ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠী তাঁকে দশটি মূল্যবান উপদেশ দিয়েছিলেন। যেমন-
১. ঘরের আগুন বাইরে নিও না; অর্থাৎ শ্বশুরবাড়ির কারো দোষ দেখলে তা কখনো বাইরে কারো কাছে প্রকাশ করবে না।
২. বাইরের আগুন ঘরে আনবে না; অর্থাৎ প্রতিবেশী কেউ তোমার শ্বশুরবাড়ির কারো নিন্দা করলে তা শ্বশুরবাড়ির কারো নিকট প্রকাশ করো না।
৩. যে দেয় তাকে দেবে; অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোনো কিছু ধার নিয়ে ফেরত দেয়, তাকে দেবে।
৪. যে দেয় না তাকে দেবে না; অর্থাৎ যে কোনো কিছু ধার নিয়ে ফেরত দেয় না, তাকে দেবে না;
৫. যে দেয় অথবা দেয় না তাকেও দেবে; অর্থাৎ কোনো দরিদ্র আত্মীয় ধার নিয়ে ফেরত দিতে না পারলেও তাকে ধার দেবে।
৬. সুখে উপবেশন করবে; অর্থাৎ এমন স্থানে উপবেশন করবে যাতে গুরুজন এলে উঠতে না হয়।
৭. সুখে আহার করবে; অর্থাৎ গুরুজনদের আহার শেষে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের খবরাখবর নিয়ে আহার করবে।
৮. সুখে শয়ন করবে; অর্থাৎ যাবতীয় গৃহকাজ শেষ করে গুরুজনদের শয়নের পর নিজে শয়ন করবে।
৯. অগ্নি পরিচর্যা করবে; অর্থাৎ গুরুজনদের সেবা-শুশ্রুষা করবে।
১০. গৃহদেবতাকে নমস্কার করবে অর্থাৎ স্বামী শ্বশুর-শাশুড়িসহ গুরুজনকে দেবতার মতো শ্রদ্ধা করবে।
ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠী পরদিন বিশাখাকে নয় কোটি স্বর্ণমুদ্রা মূল্যের মহালতা প্রসাধন হার, স্নানচূর্ণের ব্যয় নির্বাহের জন্য চুয়ান্ন শকটপূর্ণ অন্যান্য সামগ্রী, পাঁচশ দাসী, একশ অশ্বযান, বহু গাভিসহ গৃহকর্মের সামগ্রী দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পাঠালেন। শ্বশুরবাড়িতে বিশাখা যাবতীয় কাজ নিজে করতেন। তাঁর অমায়িক ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ হলেন।
বিশাখার শ্বশুর এবং পরিবারের সদস্যরা ছিলেন নিগ্রন্থ-সন্ন্যাসীদের অনুসারী। বিশাখার বিবাহ উৎসব মিগার শ্রেষ্ঠীর বাড়িতে এক সপ্তাহ ধরে চলে। সপ্তম দিনে মিগার শ্রেষ্ঠী নিগ্রন্থ-সন্ন্যাসীদের আহ্বান করে পূজা সৎকারের আয়োজন করলেন। বিশাখাকে এসব সন্ন্যাসীকে পূজা বন্দনা করার জন্য বললে, তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বললেন, এসব উলঙ্গ সন্ন্যাসী কি কখনো অর্হৎ হতে পারে? ছিঃ ছিঃ! এরূপ বলে বিশাখা সে স্থান ত্যাগ করলেন। বিশাখার এরকম ব্যবহারে সন্ন্যাসীরা ক্রুদ্ধ হয়ে শ্রেষ্ঠীকে বললেন, আপনার এই পুত্রবধূ শ্রমণ গৌতমের শিষ্য, তাঁকে অচিরে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিন। তা না হলে আপনার মহাসর্বনাশ হবে।একদিন এক অর্হৎ ভিক্ষু মিগার শ্রেষ্ঠীর বাড়িতে ভিক্ষার জন্য বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু কেউ ভিক্ষা দিলেন না। বিশাখা বললেন, প্রভু, আমার শ্বশুর বাসি খাবার খাচ্ছেন; আপনি অন্যত্র ভিক্ষা করুন। বিশাখার কথায় মিগার শ্রেষ্ঠী ভীষণ রুষ্ট হয়ে বললেন, বিশাখা, তুমি আমার কুলগুরুকে অপমান করেছ। বাসি খাবার খাই বলে আজ আমাকে অপমান করেছ; তুমি আমার বাড়ি থেকে চলে যাও।
বিশাখা বললেন, বাবা, আমি ক্রীতদাসী নই। ইচ্ছা করলে আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমার পিতা আটজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে আমার দোষাদোষের বিচার ও প্রতিকার করার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাঁদের আহ্বান করে আমার দোষগুণ বিচার করুন। বিচারে আমি দোষী হলে আমি চলে যাব। এরপর আটজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে আহ্বান করা হলো। তাঁরা এলে বিশাখা বললেন, আমার শ্বশুর বাসি খাবার খাচ্ছেন বলার অর্থ এই যে, তিনি পূর্বজন্মের পুণ্যফলের প্রভাবে এ জন্মে বিপুল ভোগসম্পত্তির অধিকারী হয়েছেন। তিনি এ জন্মে যা ভোগ করছেন তা পূর্বজন্মের কৃতকর্মের ফল এ অর্থে এ জন্মের ভোগসম্পদ সবই বাসি। মিগার শ্রেষ্ঠী জানতে চাইলেন বিশাখার পিতা যে রূপক অর্থে দশটি উপদেশ দিয়েছিলেন, তার ব্যাখ্যা কী। বিশাখা সব কয়টির অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা প্রদান করলে মিগার শ্রেষ্ঠী নিজের ভুল বুঝতে পারেন। তখন বিশাখা বললেন, এখন আমি পিতৃগৃহে চলে যেতে চাই। মিগার শ্রেষ্ঠী নিজের দোষ স্বীকার করে বিশাখাকে থাকতে অনুরোধ করেন। বিশাখা বললেন, আপনি উলঙ্গ সন্ন্যাসীদের পূজারি, আমি অর্হৎ সম্যক সম্বুদ্ধ ও সুসমাহিত ভিক্ষুসঙ্ঘের উপাসিকা। যদি আমাকে ইচ্ছামতো বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসঙ্ঘকে দান দিতে ও সদ্ধর্ম শোনার সুযোগ দেন, তাহলে আমি থাকতে পারি। মিগার শ্রেষ্ঠী তাতে সম্মত হলেন।
বিশাখা পরদিনের জন্য বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসঙ্ঘকে তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করলেন। বুদ্ধসহ ভিক্ষুসঙ্ঘ পরদিন মিগার শ্রেষ্ঠীর বাড়িতে এসে নির্দিষ্ট আসনে উপবেশন করলেন। খাদ্য ভোজ্যসহ দানীয় সামগ্রী সাজানো হলো। পরিবেশন করার জন্য মিগার শ্রেষ্ঠীকে আহ্বান করা হলো। কিন্তু তিনি সন্ন্যাসীদের বাধার কারণে এলেন না। এরপর বিশাখা পরিপাটিরূপে বুদ্ধ ও ভিক্ষুসঙ্ঘকে আহার পরিবেশন করার পর শ্বশুরকে ধর্মবাণী শোনার জন্য আহ্বান করলেন। সন্ন্যাসীদের পরামর্শক্রমে বুদ্ধবাণী শোনার জন্য তিনি পর্দার আড়ালে বসলেন। বুদ্ধ বললেন, শ্রেষ্ঠী, তুমি পৃথিবীর যেখানেই থাকো না কেন, আমার উপদেশ শুনতে পাবে। এই বলে বুদ্ধ ধর্মদেশনা শুরু করলেন। বুদ্ধের ধর্ম শুনে শ্রেষ্ঠী শ্রোতাপত্তি ফল লাভ করলেন, তাঁর মিথ্যাদৃষ্টি দূর হলো। তারপর তিনি বুদ্ধের সামনেই পুত্রবধূ বিশাখাকে বললেন, মা, আজ থেকে আমি তোমাকে মাতৃস্থানে স্থাপন করলাম। তুমি আমাকে জ্ঞানচক্ষু দান করেছ। আজ থেকে তুমি আমার মায়ের মতো। সেই থেকে বিশাখা 'মিগার মাতা' নামে পরিচিত হলেন। মিগার শ্রেষ্ঠী বুদ্ধশাসনের উন্নতির জন্য ৪০ কোটি স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করেছিলেন। বিশাখা প্রতিদিন তিনবার ভোজ্যদ্রব্য ও পূজার উপকরণ নিয়ে বিহারে যেতেন। বুদ্ধের কাছে তিনি আটটি বর নিয়েছিলেন। সেগুলো হলো-
১. বুদ্ধের কাছে কোনো আগন্তুক ভিক্ষু এলে বিশাখাকে জানাবেন, বিশাখা তাঁর থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করবেন।
২. বিশাখা আজীবন প্রতিদিন পাঁচশ ভিক্ষুর আহার দান করবেন।
৩. বিশাখা অসুস্থ ভিক্ষুর যাবতীয় চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করবেন।
৪. বিশাখা অসুস্থ ভিক্ষুর সেবক-সেবিকারও ভরণ-পোষণ করবেন।
৫. বিশাখা যে পাঁচশ ভিক্ষুর খাদ্যভোজ্য দান করবেন বুদ্ধও তা গ্রহণ করবেন।
৬. প্রতি বর্ষাবাসের সময় বিশাখা বুদ্ধ এবং পাঁচশ ভিক্ষুকে বর্ষাসাটিকাসহ অষ্টপরিষ্কার দান করবেন।
৭. বিহারের আবাসিক ভিক্ষুদের যত ওষুধ প্রয়োজন সব ওষুধ বিশাখা সরবরাহ করবেন।
৮. বিশাখা প্রতিবছর সকল ভিক্ষুকে 'কুণ্ডু প্রতিচ্ছাদন' নামক পরিধেয় বস্ত্র দান করবেন।
বিশাখা কোনো সময় বিহারে বুদ্ধদর্শনে গিয়ে ভুলবশত তাঁর মহালতা প্রসাধন হারটি বিহারে রেখে এসেছিলেন। পরে সেটি ফেরৎ পেলে বিশাখা এ হারের সমমূল্য পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে বিহার নির্মাণ করে দান দেওয়ার সংকল্পবদ্ধ হলেন। নয় কোটি স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করে বিশাখা বিহারের পূর্ব পাশে হাজার প্রকোষ্ঠযুক্ত পূর্বারাম বিহার ও গন্ধকুটি নির্মাণ করে বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসঙ্ঘকে দান করেন। বিশাখা প্রতিদিন ভিক্ষুদের জন্য খাদ্যভোজ্য নিয়ে সকালে একবার এবং ওষুধপথ্য ও অষ্টবিধ পানীয় নিয়ে বিকেলে একবার বিহারে গিয়ে ধর্ম শ্রবণ করতেন। বিশাখা • ছিলেন পৃথিবীর নারী সমাজের আদর্শ। একটি সুন্দর ও আদর্শ পরিবার গঠনে বিশাখার মতো সতীসাধ্বী নারীর - জীবন-ইতিহাস পাঠ অপরিহার্য।
আরও দেখুন...