প্রিয় শিক্ষার্থী, তুমি কি মনে করো একটি পিঁপড়ার পক্ষে এ পৃথিবীর বাস্তব রূপ ও এর বিশালতা দেখা সম্ভব? হয়তো তুমি বলবে, 'নিশ্চয়ই না'। একটি সামান্য পিঁপড়ার পক্ষে এটি যেমন অসম্ভব, তেমনি এ বিশ্ব জাহানের
মালিক ও প্রতিপালক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলার প্রকৃত পরিচয় ও গুনাবলি সম্পর্কে সম্যক জানা মানুষের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য সকল কিছুর স্রষ্টা। তিনি তাঁর সৃষ্টিরাজির কোনো কিছুকেই অনর্থক সৃষ্টি করেননি। বরং তাঁর এ সৃষ্টিরাজির মাধ্যমে তিনি তাঁর পরিচয়, নিদর্শন ও মহিমা নানাভাবে প্রকাশ করেছেন। যেমন আমাদের বসবাসের এই জমিন, মাথার উপরের আকাশ, পাহাড়, সমুদ্র, আকাশে চলমান মেঘমালা, বায়ুপ্রবাহ, রাত এবং দিনের পরিবর্তন; এসব নিয়ে আমরা যদি গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করি তাহলে এসবের মাঝে আমরা মহান আল্লাহর অজস্র মহিমা ও নিদর্শন খুঁজে পাই। আবার পবিত্র কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত 'আল-আসমাউল হুসনা'র মাঝেও মহান আল্লাহর পরিচয় ও গুণাবলির উল্লেখ রয়েছে। তোমার অবশ্যই মনে আছে, মহান আল্লাহর ওপর ইমান প্রসঙ্গে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে তুমি আল্লাহর গুণের পরিচয় জানতে আল আসমাউল হুসনা থেকে কয়েকটির বিবরণ জেনেছ্যে। এ শ্রেণিতে আমরা আরো কয়েকটি আল্লাহর গুণবাচক নাম সম্পর্কে আলোচনা করবো। তাহলে আলোচনা শুরু করা যাক।
আল্লাহ তাওয়াবুন
তাওয়াবুন অর্থ ভাওবা কবুলকারী, ক্ষমাকারী। এটি মহান আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম। আল্লাহ নিজেই তাঁর নাম রেখেছেন ‘আত-তাওয়াব’। তাওয়াব হলো যিনি সর্বদা তাওবাকারীর তাওবা কবুল করেন। অতএব যারা আল্লাহর কাছে খাঁটি ভাওবা করে, তিনি তাদের তাওবা কবুল করেন এবং ক্ষমা করে দেন। আল্লাহই তাঁর বান্দাকে তাওবা করার তৌফিক দান করেন। ফলে বান্দা গুনাহের কাজ থেকে ফিরে আসে। সে তার কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করে এবং উক্ত গুনাহের কাজে ফিরে না যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প করে। আর এভাবে বান্দা যখন খাঁটি তাওবা করে তখন আল্লাহ তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেন। মহান আল্লাহ বলেন-
وَأَنَّ اللَّهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ
অর্থ: 'নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।' (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ১০৪)
মহান আল্লাহ তাওবাকারীকে ভালোবাসেন। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ
অর্থ: 'নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারীদেরকে ভালোবাসেন।' (সুরা আল বাকারা, আয়াত: ২২২)
প্রতি রাতে আল্লাহ তা'আলা তাঁর ক্ষমার হাত প্রসারিত করেন যেন দিনের পাপী ব্যক্তিরা রাতে তাওবা করে নিতে পারে। আবার তিনি দিনে ক্ষমার হাত প্রসারিত করেন যাতে রাতের পাপী ব্যাক্তিরা দিনে তাওবা করে নিতে পারে। যখন কেউ অনুতপ্ত হয়ে তাওবা করে এবং সৎ কাজ করে, তখন আল্লাহ তা'আলা তার মন্দ কাজকে ভালো দিয়ে পরিবর্তন করে দেন।
জোড়ায় কাজ
'আল্লাহ তাওয়াবুন' মহান আল্লাহর এই নামের শিক্ষা তোমার/তোমাদের কর্মে বাস্তবায়নে করতে পারো তার একটি তালিকা তৈরি করো।
আল্লাহ কাদিরুন
কাদিরুন قَدِيرٌ অর্থ সর্বশক্তিমান, মহা ক্ষমতাধর। এটি মহান আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম। আল-কাদির হলেন এমন সত্তা, যিনি পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন আর এগুলো তিনি সুনিপুণভাবে পরিচালনা করেন। তিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু দেন। কিয়ামতের দিন পুনরায় তিনি সকলকে জীবিত করবেন আর সৎকর্মশীলদের পুরস্কার দিবেন এবং পাপীদেরকে শাস্তি দিবেন। তিনি এমন এক সত্তা যিনি কোনো কিছু করতে ইচ্ছা করলে শুধু কুন বা 'হও' বলেন, সাবে সাথে তা হয়ে যায়। তিনিই অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী। আর তিনি যাকে যেভাবে চান সেভাবেই পরিবর্তন করেন। আল্লাহ তা'আলা যা ইচ্ছা তাই করেন। সবকিছুর ওপর তিনি সর্বশক্তিমান। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرُهُ
অর্থ: 'নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।' (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২০)
আল্লাহু ওয়াদুদুন
ওয়াদুদ শব্দের অর্থ পরম স্নেহপরায়ণ, প্রেমময়, প্রেমাস্পদ। 'আল্লাহু ওয়াদুদুন' অর্থ আল্লাহ পরম প্রেমময় ও স্নেহপরায়ন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَهُوَ الْغَفُورُ الْوَدُودُ
অর্থ: 'এবং তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, প্রেমময়।' (সূরা আল-বুরুজ, আয়াত: ১৪)
আল্লাহ তা'আলা বান্দাদের অত্যন্ত ভালোবাসেন। তিনি ভালোবেসেই তাদের সৃষ্টি করেছেন। তাই বান্দার দায়িত হলো তাঁর বন্দেগি করা এবং যাবতীয় আদেশ-নিষেধ পালন করা।
সৃষ্টি জগতের মধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে মহান আল্লাহ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। এজন্য মহানবির একটি উপাধি 'হাবিব'। মহান আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের সর্বোত্তম পন্থা হলো 'তাঁর প্রিয় রাসুল মুহাম্মাদ (সা.)-কে ভালোবাসা। তাঁর আদর্শ পরিপূর্ণ অনুসরণ ও অনুকরণ করা। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, 'বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস, তবে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন।' (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১)
আল্লাহ তা'আলা মানুষকে এতই ভালোবাসেন যে, তারা পাহাড়সম গুনাহ করার পর তাওবা করলে মহান আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। তিনি তাওবাকারীকে অত্যন্ত ভালোবাসেন ও পছন্দ করেন। তাই মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাওবার দরজা কখনই বন্ধ করেন না। কারণ তাঁর স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসার কোনো সীমা নেই।
আল্লাহ তা'আলার ওয়াদুদ নাম থেকে আমরা শিক্ষা লাভ করি যে, তিনিই আমাদের একমাত্র ভরসাস্থল।
আমাদের প্রতি তিনি অত্যন্ত স্নেহপরায়ণ। আমরা যতই অন্যায় ও অপরাধ করি না কেন, আল্লাহর কাছে ফিরে আসলে তিনি আনন্দিত হন, আমাদের ক্ষমা করে দেন। তিনি আমাদের কল্যাণ চান। আমাদেরকে জান্নাত দান করতে চান। তাই আমরা আল্লাহর ইবাদাত করবো। তাঁর যাবতীয় আদেশের অনুসরণ করবো। তাঁর হাবিব হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে ভালোবাসবো। আল্লাহর জন্যই সমগ্র সৃষ্টি জগতকে ভালোবাসবো।
আল্লাহ জাকাল্গুন
জাব্বার শব্দের অর্থ মহা শক্তিধর, পরাক্রমশালী, মহাপ্রতাপশালী ইত্যাদি। আল্লাহ জাঝারুন অর্থ আল্লাহ পরাক্রমশালী। মহান আল্লাহর সামনে সবাই পরাভূত ও দুর্বল। তিনিই সবচেয়ে মহিমান্বিত। অহংকার করার একচ্ছত্র অধিকার তাঁরই। একই সাথে বান্দাদের প্রতি তিনি পরম স্নেহশীল ও দয়ালু। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা তাঁর এ গুণবাচক নামটি একবার উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন-
هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ
الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلْمُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ
سُبْحْنَ اللَّهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ
অর্থ: 'তিনিই আল্লাহ, তিনি ব্যতিত কোনো ইলাহ নেই। তিনিই অধিপতি, তিনিই পবিত্র, তিনিই শান্তি, তিনিই নিরাপত্তা বিধায়ক, তিনিই রক্ষক, তিনিই পরাক্রমশালী, তিনিই প্রবল, তিনিই অতীব মহিমান্বিত। তারা যাকে শরিক স্থির করে আল্লাহ তা হতে পবিত্র, মহান।' (সুরা আল-হাশর, আয়াত: ২৩)
মহান আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর আদেশ ও ইচ্ছাই চূড়ান্ত। কেউ তাঁকে পরাভূত করতে পারে না। বরং তিনিই সবার উপর ক্ষমতাবান। তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন, সবাই তাঁরই মুখাপেক্ষী।
মহান আল্লাহর এ গুণবাচক নামটি আমাদেরকে তাঁর প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা ও ভরসা রাখতে শেখায়। আমরা বুঝতে পারি, যেহেতু আল্লাহর ইচ্ছাই চূড়ান্ত, তাই তাঁর ইচ্ছায় নিজেদের সমর্পিত করার মধ্যেই যাবতীয় কল্যাণ রয়েছে।
এটি আমাদের আত্মনির্ভরশীল ও সাহসী হতে শেখায়। আল্লাহ জাব্বারুন নামের বিশ্বাসী ব্যক্তি আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ ভরসা করে। যাবতীয় বাধা-বিপত্তি মোকাবেলা করে আপন লক্ষ্যে এগিয়ে যায়। নিজের ক্ষুদ্রতা উপলব্ধি করে অহংকার থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র আল্লাহকেই সবচেয়ে বড় মনে করে।
আমরা মহান আল্লাহর এ গুনটি উপলব্ধি করবো। তাঁকে সর্বশক্তিমান ও মহাপরাক্রমশালী হিসেবে জানবো। সকল কাজে তাঁর কাছে সাহায্য চাইবো। অন্যায় ও খারাপ কাজ পরিহার করবো।
আল্লাহ সামামুন
সামাদ অর্থ অমুখাপেক্ষী, চিরন্তন, অবিনশ্বর ইত্যাদি। আল্লাহ সামাদুন অর্থ হলো আল্লাহ অমুখাপেক্ষী। আল্লাহ তা'আলার কারও প্রয়োজন নেই। তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন। তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ। সৃষ্টিজগতের সবকিছু আল্লাহ তা'আলার মুখাপেক্ষী। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন,
اللهُ الصَّمَدُ
অর্থ: আল্লাহ কারও মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। (সূরা আল-ইখলাস, আয়াত: ২)
পৃথিবীর সবকিছু অস্তিত্বহীন ছিলো। মহান আল্লাহই সবকিছুকে অস্তিত্বে এনেছেন। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোনো কিছুই এক মুহূর্ত টিকে থাকতে পারে না। সকল সৃষ্টি জন্ম-মৃত্যু, বেড়ে ওঠা, পানাহার, সুস্থতা ইত্যাদির জন্য আল্লাহর মুখাপেক্ষী। বিশ্বজগৎ সৃষ্টি ও পরিচালনায় তাঁর কোনো সাহায্যকারীর প্রয়োজন হয় না। তাঁর হুকুমই চূড়ান্ত। কেউ তাঁর হুকুমের বাইরে যেতে পারে না। তিনি তাঁর গুণাবলি ও কর্মে পরিপূর্ণ, নিখুঁত। সমগ্র সৃষ্টিজগৎ ধ্বংস হওয়ার পর শুধু তিনি থাকবেন। আসমান-জমিনের সবকিছু তাঁর কাছে প্রার্থনা করে। তাঁর দিকেই মনোনিবেশ করে। তাঁর অনুগ্রহ লাভ করেই সবাই টিকে থাকে। মহান আল্লাহ বলেন, 'আসমানসমূহ ও পৃথিবীতে যারা আছে সকলেই তার নিকট প্রার্থী।' (সূরা আর-রহমান, আয়াত: ২৯)
মহান আল্লাহ এমন সত্তা, যিনি সকলের একমাত্র উদ্দেশ্য। তিনি ছাড়া দুনিয়ার কোনো কিছু মানুষের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়। মহান আল্লাহর কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। এমনকি মানুষের ইবাদাত-বন্দেগি, তাসবিহ- তাহলিলেরও তিনি মুখাপেক্ষী নন। মানুষের নিজেদের কল্যাণ ও প্রয়োজনেই তাঁর ইবাদাত-বন্দেগি করা উচিত। মানুষ আল্লাহর অবাধ্য হলে আল্লাহর বিন্দুমাত্র ক্ষতি নেই। এমনকি অনুগত বান্দা হলেও তাঁর বিশেষ কোনো লাভ নেই। তাঁর আহার-নিদ্রা, বিশ্রাম কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। এক কথায় তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ, অনুখাপেক্ষী ও দোষমুক্ত একমাত্র সত্তা।
আমরা মহান আল্লাহর এই পুণটি সুন্দরভাবে অনুধাবন করবো। একমাত্র তাঁরই মুখাপেক্ষী হবো। তাঁর উপর ভরসা করতে শিখবো।
জোড়ায় কাজ মহান আল্লাহর পরিচয় তথা আসমাউল হুসনা জানার মাধ্যমে আল্লাহ সম্পর্কে তোমার নতুন যে যে বিশ্বাস তৈরি হলো: ২. ---------------------- ৩. --------------------- ৪. --------------------- |
প্রতিফলন ডায়েরি লিখন (প্রিয় শিক্ষার্থী, তোমরা ইসলাম শিক্ষা বিষয়ের প্রতিফলন ডায়েরিতে নিম্নোক্ত শিরোনামে বাড়িতে লিখবে। এক্ষেত্রে, পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের যেমন: মাতা-পিতা/দাদা-দাদি/বড় ভাই-বোন। সহপাঠী প্রমুখের সহায়তা নিতে পারো।) ২. ------------------------------------------------------ ৩. -------------------------------------------------------- ৪. ------------------------------------------------------- |
Read more