তোমরা ইতোমধ্যে জেনেছ যে জীবদেহের গাঠনিক একক হচ্ছে কোষ। সরল এককোষী উদ্ভিদদেহ একটি কোষ দিয়েই গঠিত হয়, এই শ্রেণির উদ্ভিদে সব ধরনের শারীরবৃত্তীয় কাজ এই একটিমাত্র কোষেই সম্পন্ন হয়। কিন্তু জটিল বহুকোষী উদ্ভিদের গঠন ও শারীরবৃত্তীয় কাজ অনেক জটিল, সেগুলো উদ্ভিদকে তার বিভিন্ন অঙ্গের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হয়। বিভিন্ন অঙ্গের কাজও আলাদা, যেমন কোনো অঙ্গ পানি ও খনিজ উপাদান পরিবহণ করে, কোনোটি উদ্ভিদে দৃঢ়তা প্রদান করে আবার কোনোটি উদ্ভিদের বৃদ্ধি ঘটিয়ে থাকে। ভিন্ন ভিন্ন কাজের জন্য কোষের আকারও ভিন্ন হয়। যেহেতু একটি কোষের পক্ষে এককভাবে সকল কাজ করা সম্ভব নয়, তাই অনেকগুলো কোষ একত্রিত হয়ে প্রয়োজনীয় শারীরতাত্ত্বিক কাজগুলো করে থাকে। যখন উদ্ভিদের কোনো কোষগুচ্ছ সম্মিলিতভাবে প্রয়োজনীয় শারীরতাত্ত্বিক কাজ সম্পাদন করে তখন তাদেরকেই টিস্যু বলে।
5.1 টিস্যু ও প্রকারভেদ
তোমরা হয়তো খেয়াল করেছ বীজ থেকে অঙ্কুরিত উদ্ভিদ ধীরে ধীরে বড়ো হয়। এ সময় পাতার সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কাণ্ডও বড়ো এবং দৃঢ় হয়, মূল তৈরি হয়। কোন ধরনের টিস্যু এই ধরনের কাজগুলো করে থাকে, তারা কি একই রকম নাকি আলাদা-আমরা এখন এই বিষয়গুলো একটু আলোচনা করব।
কোষ বিভাজনের ফলেই উদ্ভিদের বৃদ্ধি ঘটে তাই টিস্যু গঠনকারী কোষের বিভাজন অনুযায়ী সবধরনের টিস্যুকে ভাজক টিস্যু ও স্থায়ী টিস্যু এই দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। এই দুই ধরনের টিস্যুগুলোতে কিছু পার্থক্য রয়েছে, সেগুলো এরকম :
5.1.1 ভাজক টিস্যু
জীবদেহের কিছু কিছু কোষগুচ্ছে কোষের অবিরাম বিভাজনের ফলে জীবদেহের বৃদ্ধি ঘটে থাকে। যে কোষগুলো কোষগুলো বিভাজিত হতে পারে সেগুলো হলো ভাজক কোষ, আর ভাজক কোষ দিয়ে গঠিত টিস্যুই হলো ভাজক টিস্যু।
টিস্যুর প্রকারভেদ
বৈশিষ্ট্য:
নিচে ভাজক টিস্যুর উল্লেখযোগ্য কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো :
1। ভাজক টিস্যুর কোষগুলো জীবিত ও অপেক্ষাকৃত ছোটো।
2। কোষের নিউক্লিয়াস তুলনামূলক ভাবে বড়ো এবং সাইটোপ্লাজম ঘন হয়ে থাকে।
3। টিস্যুর কোষগুলোতে সেলুলোজ দিয়ে তৈরি পাতলা কোষপ্রাচীর থাকে।
4। ভাজক টিস্যুর কোষে সাধারণত কোষগহ্বর থাকে না।
5। এই কোষগুলো সাধারণত আয়তাকার, ডিম্বাকার, পঞ্চভুজ বা ষড়ভুজাকার হয়।
6। কোষগুলো ঘন সন্নিবিষ্ট হওয়ায় এদের মধ্যে আন্তঃকোষীয় ফাঁক থাকে না।
7। কোষে কোনো প্রকার সঞ্চিত খাদ্য, ক্ষরিত বস্তু বা বর্জ্য পদার্থ থাকে না।
কাজ:
1। ভাজক টিস্যুর বিভাজনের মাধ্যমে উদ্ভিদ দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে বৃদ্ধি পায়।
2। ভাজক টিস্যু থেকে স্থায়ী টিস্যু তৈরি হয়।
3। ভাজক টিস্যু বিভাজনের মাধ্যমে ক্ষতস্থান পূরণ করে।
5.1.2 স্থায়ী টিস্যু
উদ্ভিদের ভাজক টিস্যু যখন পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত হয়ে উদ্ভিদের নির্দিষ্ট স্থানে স্থায়ীভাবে অবস্থান নেয় এবং আর বিভাজিত হয় না তখন তাকে স্থায়ী টিস্যু বলে। এ টিস্যুর কোষগুলো পূর্ণভাবে বিকশিত এবং সঠিক আকার-আকৃতিবিশিষ্ট।
বৈশিষ্ট্য:
স্থায়ী টিস্যুর কিছু বৈশিষ্ট্য নিচে উল্লেখ করা হলো:
1। স্থায়ী টিস্যুর কোষগুলোর প্রাচীর অপেক্ষাকৃত স্থূল ও বেশ পুরু।
2। কোষ গহ্বর অপেক্ষাকৃত বড়ো।
3। এই কোষের নিউক্লিয়াস স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট এবং সেটি কোষের একপাশে অবস্থান করে।
4। স্থায়ী টিস্যুর কোষপ্রাচীরে নানা নকশা দেখা যায়।
কাজ:
স্থায়ী টিস্যুকে আবার সরল ও জটিল এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
পরিবহণ ও পরিচলনে অংশগ্রহণ করাই স্থায়ী টিস্যুর প্রধান কাজ।
সরন টিস্যু
কিছু স্থায়ী টিস্যুর প্রতিটি কোষের আকার, গঠন এবং আকৃতি একরকম, এগুলো সরল টিস্যু নামে পরিচিত। তিন ধরনের সরল টিস্যু রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে:
(ক) প্যারেনকাইমা টিস্যু:
উদ্ভিদদেহের সব অংশে এই কোষগুলো পাওয়া যায়। এই টিস্যুর কোষগুলো জীবিত, পাতলা প্রাচীরযুক্ত এবং প্রোটোপ্লাজম দিয়ে পূর্ণ। এই টিস্যুতে আন্তঃকোষীয় ফাঁক থাকে। কোষপ্রাচীর পাতলা এবং সেলুলোজ দিয়ে তৈরি। প্যারেনকাইমা টিস্যুর প্রধান কাজ দেহ গঠন, খাদ্য প্রস্তুত, খাদ্য সঞ্চয় এবং পরিবহণ করা।
(খ) কোলেনকাইমা টিস্যু:
এগুলো বিশেষ ধরনের প্যারেনকাইমা কোষ দিয়ে তৈরি। এ টিস্যুর কোষগুলোও সজীব, প্রোটোপ্লাজমপূর্ণ এবং লম্বাটে হয়। কোষপ্রাচীরে সেলুলোজ এবং পেকটিন নামক শর্করা থাকার কারণে কোলেনকাইমা টিস্যুর কোষপ্রাচীরগুলো পুরু হয়। এই টিস্যু উদ্ভিদদেহকে দৃঢ়তা এবং স্থিতিস্থাপকতা প্রদান করা এদের প্রধান করে যে কারণে উদ্ভিদের কাণ্ড না ভেঙ্গে বাঁকা হতে পারে।
তিন ধরনের সরল টিস্যু
(গ) স্ক্লেরেনকাইমা টিস্যু:
এ টিস্যুর কোষগুলো শক্ত, অনেক লম্বা এবং পুরু প্রাচীরবিশিষ্ট হয়। স্ক্লেরেনকাইমা টিস্যু প্রোটোপ্লাজমবিহীন। প্রাথমিক অবস্থায় কোষগুলোতে প্রোটোপ্লাজম উপস্থিত থাকলেও খুব তাড়াতাড়ি সেগুলো নষ্ট হয়ে মৃত কোষে পরিণত হয়। এই টিস্যু লিগনিন নামক এক ধরনের জৈব পলিমারযুক্ত এবং যান্ত্রিক কাজের জন্য গঠিত। এই কোষ উদ্ভিদদেহে দৃঢ়তা প্রদান করে থাকে।
জটিল টিস্যু
কিছু কিছু স্থায়ী টিস্যু একাধিক প্রকার কোষ দিয়ে গঠিত হয় এবং সম্মিলিতভাবে একই রকম কাজ করে থাকে। এদেরকে জটিল টিস্যু বলা হয়। এরা উদ্ভিদে পরিবহণের কাজ করে বলে এদের পরিবহণ টিস্যুও বলা হয়। এ টিস্যু দুই ধরনের (ক) জাইলেম এবং (খ) ফ্লোয়েম। জাইলেম এবং ফ্লোয়েম একত্রে উদ্ভিদের পরিবহন টিস্যুগুচ্ছ (vascular bundle) গঠন করে।
(ক) জাইনেম টিস্যু (xylem):
উদ্ভিদের দৃঢ়তা প্রদানকারী টিস্যুর মধ্যে অন্যতম হলো জাইলেম টিস্যু। জাইলেম টিস্যু মূল থেকে উদ্ভিদের কাণ্ড দিয়ে উপরে পাতায় পানি অন্যান্য খনিজ লবণ সরবরাহ করে থাকে।
(খ) ফ্লোয়েম টিস্যু (phloem):
উদ্ভিদ কাণ্ডে এরা জাইলেমের সাথে একত্রে পরিবহণ টিস্যুগুচ্ছ তৈরি করে। জাইলেম যেমন খাদ্য প্রস্তুতের কাঁচামাল ও পানি সরবরাহ করে, তেমনি ফ্লোয়েম পাতায় প্রস্তুত খাদ্য উদ্ভিদ দেহের বিভিন্ন স্থানে পরিবহণ করে।
জাইলেম এবং ফ্লোয়েমের মধ্যবর্তী টিস্যুকে ক্যাম্বিয়াম (Cambium) বলে, এই টিস্যু ভাজক টিস্যু হিসেবে নতুন জাইলেম এবং ফ্লোয়েম টিস্যু তৈরি করে উদ্ভিদের কাণ্ড বৃদ্ধির কাজে সহায়তা করে থাকে।
5.2 উদ্ভিদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও তাদের কাজের গুরুত্ব
উদ্ভিদের প্রধান গাঠনিক অঙ্গ হচ্ছে মূল, কাণ্ড ও পাতা যা বিভিন্ন টিস্যুর সমন্বয়ে তৈরি। উদ্ভিদের মূল ও কাণ্ড কেন প্রয়োজন? উঁচু দালানে এক ধরনের নলের মাঝ দিয়ে পানি যেরকম দালানের বিভিন্ন তলার নানা অংশে পরিবাহিত হয়, ঠিক সেভাবে উদ্ভিদের জৈবিক কাজ সম্পাদনের জন্য এর বিভিন্ন উপাদান উদ্ভিদের মাঝে পরিবহণের প্রয়োজন হয়। যে সকল উদ্ভিদে ঠিক এরকম পরিবহণ করার টিস্যু আছে তাদেরকে সংবাহী (vascular) উদ্ভিদ বলে। এসব গাছ মূলের সাহায্যে মাটি থেকে পানি এবং খনিজ লবণ শোষণ করে। সেই পানি কাণ্ডের মধ্য দিয়ে উঁচু শাখা-প্রশাখা ও অন্যান্য অঙ্গে যায়। সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে পানি ও কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে উদ্ভিদ তার সবুজ পাতায় শর্করা জাতীয় উপাদান ও অক্সিজেন তৈরি করে। উদ্ভিদ তার উৎপাদিত খাদ্য ফল, মূল পাতা কিংবা বীজে সংরক্ষণ করে যেটি অন্য জীব তাদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। উদ্ভিদের দেহে তৈরিকৃত শর্করা শ্বসনের জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন হয়, উদ্ভিদ সেই অক্সিজেন ব্যবহার করে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অক্সিজেন পরিবেশে বিমুক্ত করে দেয়, যা এই পৃথিবীকে মানুষসহ অন্য সব প্রাণীর জন্য বাসযোগ্য করে রেখেছে।'
5.2.1 কাণ্ড
আমাদের চারপাশে ছোটো-বড়ো নানান রকমের গাছ আমরা দেখতে পাই। গাছের মাটির উপরের যে অংশটি আমরা দেখতে পাই, মূলত এটিই গাছের কাণ্ড। গাছের বাকল সাধারণত বাদামি বা ধূসর এবং কচি ডালপালা সবুজ বর্ণের হয়। গাছের কাণ্ড একটা গাছকে তার কাঠামো প্রদান করে এবং পাতা, ফুল ও ফল ধারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। বিভিন্ন গাছের জন্য কিংবা গাছের বিভিন্ন অঙ্গের জন্য এই কাণ্ড আবার বিভিন্ন রকম হতে পারে। ফুলের বোঁটা হিসেবে আমরা যা দেখি সেটিও মূলত এক ধরনের নরম কাণ্ড। প্রাথমিকভাবে কাণ্ড নরম হয়ে থাকে, ডালপালা দুর্বল হয় এবং ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে পরবর্তী সময়ে অনেক গাছের কাণ্ড খুব শক্ত হয় যা কাঠ হিসেবে ব্যবহার উপযোগী। এদের বাইরে পুরু বাকল থাকে। কান্ড গাছকে একটি নির্দিষ্ট আকৃতি ও কাঠামো দেয়, সুরক্ষা প্রদান করে। শুধু তাই না, গাছের ডালপালা বংশবিস্তারেও সাহায্য করে। এখানে মনে রাখতে হবে যে প্রতিটি ঋতুতে একটি গাছ শিকড়, ডগায় এবং পাশে বৃদ্ধি পায়। পাশের বৃদ্ধির কারণেই ডাঁটা, শাখা এবং কাণ্ড ঘন হয়ে যায় এবং এর মধ্যে দিয়ে আমরা গাছের কাণ্ডের প্রস্থচ্ছেদে যে রিংগুলো দেখি সেগুলো তৈরী হয়, একটি রিং যা ঋতুর একটি চক্র বা এক বছরকে চিহ্নিত করে।
কিছু ভূগর্ভস্থ রূপান্তরিত কাণ্ড যেমন- আলু ও আদা খাদ্য সঞ্চয় করে ভিন্ন আকার ও আকৃতি ধারণ করে। সুমিষ্ট পানীয় আখের রস আমরা পাই আখের রসালো কাণ্ডে সঞ্চিত খাদ্য থেকে। আবার, কাঁটাযুক্ত ক্যাকটাস তাদের কাণ্ড পানি সঞ্চয়ের কাজে ব্যবহার করে।
5.2.2 মূন
গাছের যে অংশ মাটির সাথে যুক্ত থাকে, খাদ্য জমা রাখে, মাটি থেকে পানি ও খনিজ পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করে সেটি মূল বা শিকড় (Root) নামে পরিচিত। মূলের গায়ে ছোট ছোট চুলের মতো অংশ থাকে যাকে মূলরোম (Root hair) বলা হয়। মূলরোম এমনভাবে গঠিত হয় যেন খুব সহজেই সেগুলো মাটি থেকে বেশি পরিমাণে পানি ও দ্রবীভূত খনিজ লবণ শোষণ করে নিতে পারে। প্রত্যেক মূলের আগায় থাকে মূলটুপি (Root cap), যেটি মূলত কোষের শক্ত আবরণ যা মূলকে আঘাত থেকে রক্ষা করে। উদ্ভিদের মূল সাধারণত দু ধরনের হয়। মূলের যে অংশ মাটির গভীরে প্রবেশ করে সেটি হচ্ছে প্রধান মূল এবং ভূপৃষ্ঠতলের কাছাকাছি শাখামূল বিস্তৃত থাকে। এরা মাটি থেকে পানি ও খনিজ উপাদান শোষণের জন্য কাজ করে। মাটি থেকে পানি ও খনিজ উপাদান মূলরোম, প্রশাখামূল, শাখামূল হয়ে প্রধান মূলে প্রবেশ করার পর মূলের কোষে তরলের চাপ সৃষ্টি হয়। প্রস্বেদন টানের ফলে পানি ও খনিজ উপাদান মূল হতে কাণ্ডের সাহায্যে উদ্ভিদের উঁচু শাখা-প্রশাখা ও পাতায় প্রবেশ করে।
5.2.3 পাতা
একটি উদ্ভিদের দিকে তাকালে যেটি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে সেটি হচ্ছে তার পাতা এবং এটি উদ্ভিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। পাতায় উদ্ভিদের জীবন ধারণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ক্লোরোফিল থাকে। উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য পাতায় তৈরি হয়। উদ্ভিদে বিভিন্ন রঙের এবং বিভিন্ন আকার- আকৃতির পাতা রয়েছে। পাতার গঠন তাদের কাজের সাথে সম্পর্কিত। অনেক পাতা চ্যাপ্টা এবং চওড়া হয় যাতে করে তারা সর্বাধিক পরিমাণ সূর্যালোক শোষণ করতে পারে। আম, কাঁঠাল, জাম, বট প্রভৃতি গাছে একক বা সরল পাতা দেখা যায়। গোলাপ, নিম, সজনে প্রভৃতি গাছের পাতায় একাধিক ছোট ছোট পত্রফলক (Lamina) থাকে বলে এদের যৌগিক পাতা বলে। কিছু গাছের পাতা সুচের মতো চিকন হয় আবার কোনো কোনো গাছের পাতা কাঁটাযুক্ত থাকে। চিরহরিৎ জাতীয় গাছ, যেমন-পাইন গাছে সারা বছর সবুজ পাতা থাকে। এই পাতার বাইরের আবরণ হলো কিউটিকল (Cuticle) নামক মোম-জাতীয় আবরণ, এটি খুব ঠান্ডা বা শুষ্ক আবহাওয়ায় পাতা থেকে অতিরিক্ত পানি বের হওয়া রোধ করে। এর পরের স্তর হচ্ছে ত্বকীয় বহিস্তর, বহিঃত্বক বা এপিডার্মিস (Epidermis)। খাদ্য তৈরি, প্রস্বেদন ছাড়াও পাতা বংশবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। তোমরা যারা পাথরকুচির পাতা দেখেছ, তারা সবাই নিশ্চয়ই দেখেছ সেখানে পাতা থেকেই নতুন গাছ তৈরি হয়।
উদ্ভিদের কাণ্ড, মূল এবং পাতা-এই তিনটি প্রধান অঙ্গ ছাড়া আরো যে দুটি অঙ্গ দেখা যায় তা নিচে বর্ণিত হলো:
5.2.4 ফুল
তোমরা সবাই নিশ্চয়ই স্বীকার করবে, উদ্ভিদের সবচেয়ে আকর্ষণীয়, সুগন্ধযুক্ত ও রঙিন অঙ্গ হচ্ছে ফুল। উদ্ভিদের প্রজননের জন্য রূপান্তরিত বিশেষ ধরনের কাণ্ড বা কাণ্ডের অংশই হলো ফুল। পরাগায়নকারীদের আকৃষ্ট করতেই ফুল রং ও সুগন্ধি তৈরি করে থাকে। বিভিন্ন ফুলের বিভিন্ন সুবাস থাকলে কখনোই কোনো দুটি ফুল এক সুবাস নির্গত করে না। উচ্চতর উদ্ভিদের একটি আদর্শ ফুলে মূলত পুষ্পাক্ষ, বৃতি, দলমণ্ডল, পুংস্তবক ও স্ত্রীস্তবক এই পাঁচটি অংশ দেখা যায়। এই পাঁচটি অংশের মধ্যে পুংস্তবক ও স্ত্রীস্তবক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এরা প্রজননে সরাসরি অংশ নেয়। যে ফুলে এই পাঁচটি অংশই উপস্থিত থাকে তাকে সম্পূর্ণ ফুল বলে। এর যেকোনো একটি অংশ না থাকলে তাকে অসম্পূর্ণ ফুল বলে। যখন কোনো ফুলে একই সঙ্গে পুংস্তবক ও স্ত্রীস্তবক দুটোই উপস্থিত থাকে, তাকে উভলিঙ্গ ফুল বলে, যেমন- জবা বা ধুতুরা। অন্যদিকে, পুংস্তবক বা স্ত্রীস্তবক যে কোনো একটি অনুপস্থিত থাকলে তাকে একলিঙ্গ ফুল বলে, যেমন- লাউ কিংবা কুমড়া। দুটোই অনুপস্থিত থাকলে তাকে ক্লীবলিঙ্গ ফুল বলে।
5.2.5 ফল
সপুষ্পক উদ্ভিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ফল। ফল বলতে আমরা সাধারণত আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কলা, আঙ্গুর, আপেল ইত্যাদি সুমিষ্ট ফলগুলোকে বুঝি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে লাউ, কুমড়া, ঝিঙ্গা, পটল ইত্যাদি যা কিছু আমরা সবজি হিসেবে খাই, সেগুলো সবই ফল। ফুলে নিষিক্তকরণ শেষ হলেই ফল গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। নিষিক্তকরণের পর গর্ভাশয় এককভাবে অথবা ফুলের অন্যান্য অংশসহ পরিপুষ্ট হয়ে যে অঙ্গ গঠন করে, তাকে ফল বলে। শুধু গর্ভাশয় ফলে পরিণত হলে তাকে প্রকৃত ফল বলে, যেমন- আম কিংবা জাম। অপরপক্ষে, যখন গর্ভাশয়সহ ফুলের অন্যান্য অংশ পুষ্ট হয়ে ফলে পরিণত হয়, তখন তাকে অপ্রকৃত ফল বলে, যেমন- আপেল, চালতা ইত্যাদি। বীজ নিষিক্ত হওয়ার পরে প্রতিটি ডিম্বাণু একটি বীজ হিসেবে বিকশিত হয়। প্রতিটি বীজে একটি ক্ষুদ্র এবং অবিকশিত উদ্ভিদ থাকে যাকে ভ্রূণ বলা হয়। ডিম্বাণুগুলোকে ঘিরে থাকা ডিম্বাশয় এমন একটি ফল হিসেবে বিকশিত হয় যেখানে এক বা একাধিক বীজ থাকে। উপরের চিত্রে টম্যাটোর মধ্যে যেমনটি দেখা যাচ্ছে।
5.3 উদ্ভিদের শারীরতত্ত্ব
প্রতিটি উদ্ভিদ কোষে প্রতিনিয়ত পানি শোষণ, অভিস্রবণ, ব্যাপন, প্রস্বেদন, পরিবহণ, সালোক সংশ্লেষণ ইত্যাদি অনেক ধরনের জৈবনিক কাজ সম্পাদন হয়। এইসব জৈবনিক কাজ করতে শক্তির প্রয়োজন হয়, উদ্ভিদ খাদ্য থেকে এই শক্তি সংগ্রহ করে। উদ্ভিদ নিজের খাদ্য নিজে প্রস্তুত করে আবার প্রস্তুতকৃত খাদ্য বিভিন্ন অঙ্গাণুতে পৌঁছে দেয়, যে কারণে উদ্ভিদের দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে। এই কাজগুলো অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত ও সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়, এই অধ্যায়ে আমরা সেরকম কিছু জৈবনিক কাজ সম্পর্কে জেনে নিই।
5.3.1 ব্যাপন (Diffusion)
তোমরা হয়তো লক্ষ করেছ যে, পানির অভাবে টবে লাগানো গাছের পাতা নুইয়ে পড়লে টবে পানি দিলে কিছুক্ষণের মধ্যে গাছের পাতাগুলো আবার আগের মতোই সতেজ হয়ে ওঠে। এটি ব্যাপন নামের প্রক্রিয়ায় ঘটে থাকে। একই তাপমাত্রা ও বায়ুমণ্ডলীয় চাপে কোনো পদার্থ অধিক ঘন স্থান থেকে কম ঘন স্থানে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়াকে ব্যাপন বলে এবং বেশি ঘনত্ববিশিষ্ট দ্রবণ থেকে কম ঘনত্বের দ্রবণের দিকে দ্রাবকের ব্যাপিত হওয়ার ক্ষমতাকে ব্যাপন চাপ বলে। পাতার মেসোফিল টিস্যুতে এই ব্যাপন চাপ ঘাটতির ফলে পানির ঘাটতি আছে এমন কোষ পাশের কোষ থেকে পানি টেনে নেয়। এভাবে উদ্ভিদে পরিবহণ ব্যবস্থা কার্যকর থাকে।
গুরুত্ব: উদ্ভিদ মাটি থেকে মূল ও কাণ্ডের মাধ্যমে তার প্রয়োজনীয় পানি ও খনিজ লবণ শোষণ করে। উদ্ভিদের পানি শোষণে ব্যাপনের গুরুত্ব অপরিসীম। শোষণ ছাড়াও অন্য সব রকম শারীরবৃত্তীয় কাজ এই ব্যাপন প্রক্রিয়ায় ঘটে। উদ্ভিদ সালোক সংশ্লেষণের সময় বাতাসের কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে। এই কাজটি ব্যাপন প্রক্রিয়া দিয়ে সম্পন্ন হয়। উদ্ভিদ দেহে শোষিত পানি ব্যাপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বাষ্পাকারে প্রস্বেদনের মাধ্যমে দেহ থেকে বের করে দেয়।
5.3.2 প্রস্বেদন (Transpiration)
উদ্ভিদ প্রধানত মূল দিয়ে তার প্রয়োজনীয় পানি শোষণ করে এবং এই শোষিত পানির অতি সামান্য অংশ উদ্ভিদের বিভিন্ন জৈবিক কার্যাবলির জন্য ব্যয় হয় এবং প্রায় 99% পানি উদ্ভিদের মূলত পত্ররন্ধ্র (stoma, বহুবচন stomata) দিয়ে বাষ্পাকারে বাইরে বের হয়ে যায়। যে শারীরতত্ত্বীয় প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ থেকে অতিরিক্ত পানি বাষ্পাকারে বের হয়ে যায়, তাকে প্রস্বেদন বলে।
পত্ররন্ধ্র এক ধরনের রন্ধ্র বা ছিদ্র। পাতায়, কচি কাণ্ডে, ফুলের বৃতি ও পাপড়িতে পত্ররন্ধ্র দুটি রক্ষীকোষ (Guard cell) দিয়ে বেষ্টিত থাকে। সালোক সংশ্লেষণের জন্য কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করতে এবং অক্সিজেন নির্গত করতে পত্ররন্ধ্রকে খোলা রাখতে হয়, এবং তার ফলাফল হিসেবে পত্ররন্ধ্র দিয়ে বিশাল পরিমাণ পানি জলীয় বাষ্প হিসেবে বের হয়ে যায়। প্রস্বেদনের কারণে মূল থেকে পাতায় একটি অবিরাম পানির প্রবাহ চলতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় পানিকে বাষ্পীভূত করে উদ্ভিদ অতিরিক্ত তাপকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে অতিরিক্ত পানিকে বের করে দেওয়ার প্রক্রিয়াটির কারণে উদ্ভিদ পানিশূন্যতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আমরা সবাই জানি কৃষক ও চাষিদের তাদের ফসলকে রক্ষা করার জন্য সব সময়ই পানি সেচের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাটি নিশ্চিত রাখতে হয়।
গুরুত্ব:
প্রস্বেদন প্রক্রিয়া উদ্ভিদের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় ও অত্যাবশ্যকীয় একটি প্রক্রিয়া। উদ্ভিদের সকল কোষে পানি সরবরাহ ও সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি খাদ্য বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছানোতে প্রস্বেদন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। প্রস্বেদনের ফলে বাহ্যিক নালিতে যে টান পড়ে সেই টান মূলরোম কর্তৃক পানি শোষণে সাহায্য করে। এছাড়াও প্রস্বেদনের ফলে সৃষ্ট টান পানি ও খাদ্যরস উপরে উঠানো, লবণ পরিশোষণ, পাতা ও অন্যান্য অংশে খনিজ উপাদান পৌঁছানো ইত্যাদিতে সহায়তা করে।
5.3.3 উদ্ভিদের পরিবহণ ব্যবস্থা
উদ্ভিদে পরিবহণ বলতে মাটি থেকে শোষিত পানি ও খনিজ উপাদান এবং পাতায় প্রস্তুতকৃত খাদ্যের চলাচলকে বুঝায়। কোষের ভিতরকার পানি এবং পানিতে দ্রবীভূত খনিজ উপাদানকে একত্রে কোষরস (cell sap) বলে। প্রস্বেদন টান এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ার প্রভাবে এই কোষরস জাইলেম ভেসেলের মধ্য দিয়ে উদ্ভিদের পাতায় পৌঁছায়। পাতায় পানি পৌঁছানোর পর সেখানে খাদ্য তৈরি হয়। তৈরিকৃত খাদ্য উদ্ভিদের বিভিন্ন এলাকায় পরিবহণের কাজটি ফ্লোয়েম টিস্যু করে থাকে।
উদ্ভিদের মূল পানি ও খনিজ উপাদান শোষণ করে। এ কোষরস মূলত অভিস্রবণ (Osmosis), প্রক্রিয়ায় মূলরোমের ভেতর দিয়ে মূলে প্রবেশ করে। একটি অর্ধভেদ্য পর্দার ভেতর দিয়ে কম ঘনত্বের তরলের বেশি ঘনত্বের তরলে প্রবেশের প্রক্রিয়াকে অভিস্রবণ বলে। মূলরোম দিয়ে শোষিত পানি এবং খনিজ উপাদান অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় মূলরোমে এক কোষ থেকে পার্শ্ববর্তী কোষে যায়। ঐ কোষ থেকে তা পুনরায় তার পার্শ্ববর্তী কোষে যায়। এভাবে কোষ থেকে কোষে পানি এবং খনিজ পদার্থ চলতে চলতে এক সময় জাইলেম ভেসেলে পৌঁছায়। তখন প্রস্বেদন স্রোতের সঙ্গে কাণ্ডের পরিবহণ কলার মাধ্যমে পাতার মেসোফিল কলায় পৌঁছায়।
সেখানে সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য তৈরি হয়। পাতা থেকে তৈরিকৃত খাদ্য ফ্লোয়েমের সিভ টিউবের (sieve tube) ভেতর দিয়ে উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশে পৌঁছে যায়। সিভ টিউব এক ধরনের নিউক্লিয়াসবিহীন পাতলা প্রাচীরযুক্ত নল আকৃতির সজীব কোষ। লম্বালম্বিভাবে এরা একটির সাথে অন্যটি যুক্ত হয়ে উদ্ভিদদেহে দীর্ঘ নলের মতো গঠন সৃষ্টি করে। দুটো সিভ টিউব কোষের মাঝখানের অনুপ্রস্থ প্রাচীরটি স্থানে স্থানে বিলুপ্ত হয়ে চালুনির মতো আকৃতি ধারণ করে। এর ফলে খাদ্যদ্রব্য সহজেই এক কোষ থেকে অন্য কোষে চলাচল করতে পারে। এভাবে ফ্লোয়েমের মাধ্যমে জীবন ধারণের জন্য উদ্ভিদের সর্বত্র পুষ্টি সরবরাহ করা হয়।
জাইলেম ভেসেল বা ফ্লোয়েমের সিভ টিউব কখনো কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলে উদ্ভিদের মৃত্যু অবধারিত। এজন্য বলা যায় উদ্ভিদ-জীবনে পরিবহণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম।
5.4 উদ্ভিদে টিস্যু কালচার ও তার ব্যবহার
উদ্ভিদে কোষ বিভাজনের মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবেই প্রয়োজন অনুসারে টিস্যু তৈরি হয়, যেগুলো উদ্ভিদের বিভিন্ন শারীরতাত্ত্বিক কাজে অংশগ্রহণ করে থাকে। বর্তমানে বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হওয়ার কারণে প্রকৃতির উপর নির্ভর না করে কৃত্রিম উপায়ে উদ্ভিদ টিস্যু তৈরি করা সম্ভব। উদ্ভিদের শীর্ষমুকুল, কক্ষমুকুল, কচি পাতা, পাপড়ি বা এই জাতীয় কোনো বিভাজনক্ষম অঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করা কোনো টিস্যু সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত অবস্থায় উপযুক্ত পুষ্টির মাধ্যমে বৃদ্ধি করে এবং পর্যায়ক্রমে পূর্ণাঙ্গ উদ্ভিদের চারা সৃষ্টি করাকে টিস্যু কালচার বলে। অর্থাৎ গবেষণাগারে কোনো টিস্যুকে পুষ্টি সরবরাহের মাধ্যমে আবাদ বা কালচার করাই হলো টিস্যু আবাদ বা টিস্যু কালচার।
ভালোজাতের একটি উদ্ভিদ থেকে টিস্যু নিয়ে কালচার করে অনেক সংখ্যক চারাগাছ উৎপাদন করা সম্ভব হয়। অতি ক্ষুদ্র টিস্যু থেকে বহু চারা উৎপাদনের এ পদ্ধতিকে মাইক্রোপ্রোপাগেশন বলে। এ প্রক্রিয়া রোগমুক্ত উদ্ভিদ সৃষ্টি, চারা উৎপাদন, বিলুপ্ত প্রায় উদ্ভিদ সংরক্ষণ, অল্প সময়ে অধিক চারা উৎপাদন, ভ্রূণ কালচার প্রযুক্তির মাধ্যমে উদ্ভিদের কৃত্রিম প্রজননে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করছে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে বেশ কিছু সাফল্য অর্জিত হয়েছে। দেশে বিভিন্ন ধরনের দেশি ও বিদেশি অর্কিডের চারা তৈরি হচ্ছে, তাছাড়া কলার চারা, বেলের চারা, কাঁঠালের চারা ইত্যাদিও সফলভাবে উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। বিভিন্ন ডালজাতীয় শস্য ও বাদাম উৎপন্ন হয়েছে। টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উৎপাদিত রোগমুক্ত স্ট্রবেরি, স্টেভিয়া, ও কলার বীজ ও চারাও এই তালিকায় রয়েছে।
আরও দেখুন...