ঋণ বিশ্লেষণ-এর ধারণা

এইচএসসি (বিএমটি) ভোকেশনাল - ফিন্যান্সিয়াল কাস্টমার সার্ভিসেস-২ - ব্যাংকিং ঋণ পরিচালনা | NCTB BOOK

ব্যাংক অর্থের ব্যবসায়ী। জনসাধারণের আমানতের অর্থ ব্যাংক বিভিন্ন খাতে ঋণ দিয়ে মুনাফা অর্জন করে থাকে। ব্যাংকের মুনাফা ও অস্তিত্ব রক্ষা উভয়ই নির্ভর করে সঠিক ঋণ ব্যবস্থাপনার ওপর। ঋণ ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ঋণ বিশ্লেষণ। ঋণের বিপরীতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের লাভের একটি বড় অংশ আসলেও ঋণদান বাণিজ্যিক ব্যাংকের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। কারণ, ঋণগ্রহীতা দেউলিয়া হয়ে গেলে অথবা কোনো ঋণ খেলাপি বা দেউলিয়া হয়ে গেলে বাণিজ্যিক ব্যাংককে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। তাই ঋণের অর্থ যাতে নির্ধারিত সময়ে সুদসহ ব্যাংকে ফেরত আসে সেজন্য ঋণদানের পূর্বে ঋণের প্রকৃতি বিশ্লেষণ অর্থাৎ, ঋণগ্রহীতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, আর্থিক সামর্থ্য, লেনদেনের পূর্ব-ইতিহাস, ঋণ গ্রহণের উদ্দেশ্য প্রভৃতি বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করার প্রক্রিয়াকে ঋণ বিশ্লেষণ বলে।

ঋণের সাথে যেহেতু ঝুঁকি বিদ্যমান, সেহেতু ঋণ মঞ্জুরের সময় অত্যন্ত সতর্কভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাই বলা যায়, ঋণদানের সতর্ক পদক্ষেপই ঋণ বিশ্লেষণ। ঋণ বিশ্লেষণের কাজ নিম্নলিখিত পদক্ষেপ অনুসরণে সম্পাদন করা হয়-

১.তথ্য সংগ্ৰহ পর্যায় (Data collection stage) : ঋণ প্রত্যাশী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঋণের জন্য আবেদন করলে ঋণগ্রহীতা সম্পর্কে ব্যাংক বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে। যেমন— ঋণগ্রহীতার চরিত্র, ঋণ গ্রহণের উদ্দেশ্য, ব্যবসায় প্রকল্পের সম্ভাবনা, ঋণের ফেরতযোগ্যতা, ঋণগ্রহীতার আর্থিক সচ্ছলতা, ব্যবসায়িক লেনদেনের অভ্যাস, জামানতের প্রকৃতি ইত্যাদি।

২.তথ্য বিশ্লেষণ পর্যায় (Data analysis stage) : ব্যাংক পর্যায়ে ঋণ আবেদন বা ঋণ প্রত্যাশী সম্পর্কে ইতোমধ্যে সংগৃহীত তথ্যাদি বিচার- বিশ্লেষণ করে দেখে ঋণ মঞ্জুর করা যায় কি না। এক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো যাচাই- বাছাই করে দেখা হয়, সেগুলো হলো—

• আবেদনের যথার্থতা

• আবেদনকারীর সামর্থ্য

• ঋণ ব্যবহারের যোগ্যতা

• ঋণ ফেরতের নিশ্চয়তা

• জামানতের মূল্য ও বিক্রয়যোগ্যতা

৩. চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায় (Final decision making stage) : ঋণ আবেদনের প্রেক্ষিতে সংগৃহীত তথ্যাদি বিচার-বিশ্লেষণ শেষে ব্যাংক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় যে, আবেদনটি গ্রহণ করবে নাকি নাকচ করে দিবে। আবেদনপত্রটি গ্রহণ করা হলে ব্যাংক নিজস্ব ঋণ নীতির অধীনে ঋণ পরিশোধে প্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত শর্তসমূহ আরোপ করে। ব্যাংকের দেওয়া শর্তে ঋণগ্রহীতা রাজি থাকলে ব্যাংক তাকে ঋণ সরবরাহ করে থাকে।

অতএব, ঋণের ঝুঁকি ও আয়ের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী বিষয়াদি চিহ্নিতকরণ, সেগুলো সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, সংগৃহীত তথ্য সহজভাবে উপস্থাপন ও বিশ্লেষণ এবং সর্বোপরি ঋণ প্রদানের সম্ভাব্যতা সম্পর্কিত সুপারিশমালা প্রণয়নকেই ঋণ বিশ্লেষণ বলা হয়।

▪️জেনে রাখো

ঋণ বিশ্লেষণের পদ্ধতিসমূহ

বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণসংক্রান্ত কাজ ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ব্যাংক প্রদত্ত ঋণ ফেরত আসা নিশ্চিত করার জন্য ঋণ ও ঋণগ্রহীতা সম্পর্কিত তথ্যের বিচার বিশ্লেষণ করে।

ঋণ বিশ্লেষণের গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিগুলো SCs, SRs, CAMPARI, PARSAR ইত্যাদি সংক্ষিপ্তরূপে প্রকাশ করা যায়। নিচের চিত্রে ঋণ বিশ্লেষণের দৃষ্টিভঙ্গিগুলো দেখানো হলো :

চিত্র : ঋণ বিশ্লেষণের উপাদানসমূহ

সাধারণত নিচের পদ্ধতিসমূহের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যাংক ঋণ বিশ্লেষণ করে—

★ ঋণ নীতি নির্দেশক (Credit Policy Guidelines বা CPG) 

★ ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নীতি (Credit Risk Management Principles বা CRM)

★ ঋণ ঝুঁকি গ্রেড (Credit Risk Grading বা CRG) 

★ পূর্ব সতর্কীকরণ সংকেত (Early Warning Signals বা EWS )

নিচে এদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো-

ঋণ নীতি নির্দেশক (Credit policy guidelines) : এ পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের নিজস্ব ঋণদান নির্দেশনা থাকে। এতে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন থাকে। যেমন : বিভিন্ন ঋণের সুবিধা বিশ্লেষণ (ঋণের সর্বোচ্চ আকার, ঋণের সহজলভ্যতা ও জামানতের পরিমাণ ইত্যাদি)। ঋণ নীতি নির্দেশনাসমূহের যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমে ঋণের প্রকৃতি ও এর গ্রহণযোগ্যতা বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়।

ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নীতি (Credit risk management Principles) : ঋণের অর্থ আদায় না হওয়ার আশঙ্কাকে ঋণ ঝুঁকি বলে। ঋণ দেওয়ার আগে ঋণ পর্যালোচনা করতে হয়। পরবর্তী সময়ে সেই পর্যালোচনার আলোকে ঝুঁকি গ্রেডিং করতে হবে। ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নীতি অনুসরণের মাধ্যমে ঝুঁকি কমানো বা ক্ষেত্রবিশেষে ঝুঁকি রোধ করা সম্ভব হয়। CRM বা ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ধাপগুলো হলো— 

১. ঝুঁকি নির্ধারণ (Risk Identification); 

২. ঝুঁকি মূল্যায়ন (Risk Evaluation) 

৩. ঝুঁকি পর্যবেক্ষণ (Risk Monitoring) | 

১. উক্ত পদ্ধতি অনুযায়ী ঋণের ঝুঁকি নির্ধারণের জন্য নিম্নোক্ত কাঠামোটি অনুসরণ করা হয়— 

২. ঋণের ঝুঁকির ভার পরিমাপের মাধ্যমে ঋণ গ্রহণকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকির মাত্রা মূল্যায়ন করা হয়। ঋণের মোট ভার সন্তোষজনক হলে উক্ত ঋণ মঞ্জুর করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আবার ঋণের মোট ভার কম হলে এর সুনির্দিষ্ট কারণও চিহ্নিত করা সম্ভব হয় ।

৩. ঋণের ঝুঁকি পুনঃবিশ্লেষণের মাধ্যমে ঝুঁকি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে ঝুঁকি পুনঃবিশ্লেষণের জন্য ঋণ প্রস্তাব রিলেশনশিপ অফিসারের (RM) কাছ থেকে পর্যায়ক্রমে Zonal Credit Officer Head of Credit (HOC) & Head of Corporate Banking (HOCB), Managing Director ও Executive Committee / Board এর কাছে পাঠানো হয়। সবার সম্মতিতে ঋণ প্রস্তাব গৃহীত হলে তা আবার প্রতিটি ধাপ হয়ে ঋণ রিলেশনশিপ অফিসারের কাছে ফিরে আসে। উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গকে ঋণ অনুমোদনের কর্তৃপক্ষ বলা হয়।

→ ঋণ ঝুঁকি গ্রেডিং (Credit risk grading) : ঝুঁকি পর্যালোচনার পরপরই ঝুঁকির গ্রেডিং করা হয়। এটি ঋণ বিশ্লেষণে কার্যকরী হাতিয়ার। CRG পদ্ধতি অনুযায়ী ঋণ ঝুঁকি বিশ্লেষণের জন্য ঋণকে সর্বমোট আটটি ঝুঁকি গ্রেডে বিভক্ত করা যায়।

→ ঋণ অনুমোদন (Loan approval) : ঋণ অনুমোদনের জন্য একটি ঋণ ক্রেডিট কমিটি (Credit Committee) থাকে। এই কমিটি যদি আবেদনকারীর ঝুঁকি গ্রেডিং-এ সন্তুষ্ট হয়, তবে ঋণ অনুমোদন দিয়ে থাকে।

→ অভ্যন্তরীণ অডিট (Internal audit) : ব্যাংকের একটি অভ্যন্তরীণ অডিট বিভাগ থাকে, যাদের কাজ হচ্ছে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত যেসব নীতিমালা হয়েছে তার যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কি না তা যাচাই করা। এভাবে ঋণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যাংক ঋণের অর্থ আদায়ের সম্ভাবনা সম্পর্কে ধারণা পায়। তাই অবশ্যই ঋণ অনুমোদনের আগে ঋণ বিশ্লেষণ করতে হয়। এক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণ বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয় কাঠামো তৈরি করে।

Content added By
Promotion