প্রিয় শিক্ষার্থী,
তোমরা নিশ্চয়ই সবাই জানো যে, মহাগ্রন্থ আল কুরআন হলো আল্লাহ তা'আলার চিরন্তন বাণী। জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ আমাদের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি ও রাসুল হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর উপর নাযিল করেছেন। আল কুরআন পৃথিবীর সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ। সারা বিশ্বের মুসলমানগন এ গ্রন্থ তিলাওয়াত করে থাকে। আমরা সালাতে কুরআন তিলাওয়াত করে থাকি। ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির মতো তোমরা এই অধ্যায়ে পবিত্র কুরআনের কিছু সুরা ও কয়েকটি হাদিসের বাণী জানবে। তোমাদের উচিত নিয়মিত কুরআন বুঝে পাঠ করা, হাদিসের বাণীগুলো জানা এবং সে অনুযায়ী আমল করা। তাহলে চলো আমরা আলোচনা শুরু করি।
কুরআন ও হাদিস ইসলামি শরিয়তের প্রধান দুটি উৎস। পবিত্র কুরআন মানব জাতির হেদায়াতের জন্য ঐশী গ্রন্থ। হাদিস শরিফ হচ্ছে কুরআন মাজিদের ব্যাখ্যা গ্রন্থ। ইসলামি শরিয়তের সকল বিধি বিধান এ উৎসন্বয় থেকেই গৃহীত। কুরআন মাজিদ ও হাদিস শরিফে মানবজীবনের সকল বিষয়ের মৌলিক নীতিমালা বর্ণনা করা হয়েছে। এসব নীতিমালার আলোকেই ইসলামের সকল বিধি-বিধান প্রণীত হয়েছে। তাই ইসলাম সম্পর্কে জানতে হলে কুরআন মাজিদ ও হাদিস শরিফ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
কুরআন আরবি শব্দ। এর অর্থ পড়া, তিলাওয়াত করা, আবৃত্তি করা। সারা বিশ্বের মুসলমানগণ এ গ্রন্থ তিলাওয়াত করে থাকে। আমরা সালাতে কুরআন তিলাওয়াত করে থাকি। অধিক পরিমাণে তিলাওয়াত হয় বিধায় কুরআনকে কুরআন বলা হয়।
পরিভাষায় আল কুরআন হলো আল্লাহ তা'আলার শ্বাশ্বত বাণী। এটি জিবরাইল (আ.)- এর মাধ্যমে সর্বশেষ নবি ও রাসুল হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ওপর অবর্তীর্ণ হয়। এটি গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ, লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত। আল্লাহ তা'আলা কুরআন নাযিল করেছেন মানবজাতির হেদায়াতের জন্য আলোকবর্তিকাস্বরূপ। এটি জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎস এবং পুণ্যার্জনের অন্যতম উপায়। এটি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর নবুওয়াত ও রিসালাতের সত্যায়নকারী ও সুস্পষ্ট দলিল। আসমান ও জমিনে এর চেয়ে শুদ্ধতম আর কোনো গ্রন্থ নেই। কোনো ধরনের অনুপ্রবেশ এ গ্রন্থে কখনও হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। স্বয়ং আল্লাহ তা'আলা এর সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। ফলে কিয়ামত পর্যন্ত এটি অবিকৃত থাকবে। যুগে যুগে আল কুরআনের এ মু'জিয়া বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। আল্লাহ তা'আলার বাণী:
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَفِظُونَ
অর্থ: 'আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং অবশ্য আমিই এর সংরক্ষক।' (সুরা আল হিজর, আয়াত: ০৯) আল কুরআন মর্যাদাপূর্ণ, সম্মানিত ও বিজ্ঞানময় গ্রন্থ। এটি হক বাতিলের পার্থক্যকারী। এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। এটি মুত্তাকিদের জন্য হেদায়াতগ্রন্থ।
আমাদেরকে কুরআন পড়তে হবে, বুঝতে হবে, মানতে হবে। কারণ কুরআন হচ্ছে আমাদের জীবনবিধান। এটি আমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর পথের সন্ধান দেয়। মিথ্যা থেকে সত্যকে, অন্যায় থেকে ন্যায়কে পার্থক্য করতে শিখায়। মহান আল্লাহ আমাদের জন্য আল কুরআনকে সহজ করে দিয়েছেন। সকল ভাষাভাষী লোক কুরআন মাজিদ পড়তে ও মুখস্থ করতে পারে। ফলে প্রতি বছর অসংখ্য হাফিজে কুরআন তৈরি হচ্ছে।
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন নাম
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের আলোকে এর একাধিক নাম রয়েছে। এগুলো আল কুরআনের উচ্চ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব বহন করে। আল-কুরআনের কয়েকটি প্রসিভ নাম হলো:
১। আল ফুরকান (পার্থক্যকারী): আল কুরআন সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী। পবিত্র কুরআনে মিথ্যা থেকে সত্যকে চেনার মানদণ্ড বিবৃত হয়েছে। তাই একে আল ফুরকান বলা হয়।
২। জাল কিতাব (লিখিত): আল কিতাব নামে নামকরণের কারণ হলো, এটা একটি লিখিত গ্রন্থ এবং
এটাকে বিশুদ্ধভাবে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
৩। আয যিকর (উপদেশ, আলোচনা): কুরআন মাজিদকে যিকর নামে নামকরণ করার কারণ এতে আল্লাহ তা'আলা বান্দার জীবন যাপনের বিভিন্ন আদেশ-উপদেশ ও নিষেধসমূহ আলোচনা করেছেন এবং বান্দার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
৪। আত তানযিল (নাফিলকৃত): এই কুরআন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত তাই এর নাম তানযিল রাখা হয়েছে।
৫। আল বুরহান: বুরহান শব্দের অর্থ সুস্পষ্ট। এ গ্রন্থ কাফিরদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট দলিল।
৬। আন নূর: আন নূর অর্থ জ্যোতি, আলো। পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতকারীর জন্য আলো হবে।
৭। আশ শিকা: কুরআন মাজিদ অসুস্থ রোগীদের জন্য শিফা বা আরোগ্য স্বরূপ।
৮। আল হুদা: আল হুদা অর্থ পথপ্রদর্শন। কুরআন মাজিদ মুত্তাকিদের জন্য পথপ্রদর্শক।
৯। আল মাওয়েজা: যারা উপদেশ গ্রহণ করতে চায়, তাদের জন্য এটি এটি উপদেশগ্রন্থ।
১০। আর রহমাহ: আর রহমাহ অর্থ দয়া, করুণা। কুরআন বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরুপ।
১১। আল আজিজ: আল আজিজ অর্থ পরাক্রমশালী। মহাগ্রন্থ আল কুরআন পরাক্রমশালীগ্রন্থ।
১২। আল মুবিন: মুবিন অর্থ সুস্পষ্ট। কুরআন মাজিদে মানবজীবনের সকল দিক সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
১৩। আল বাশির: বাশির অর্থ সুসংবাদ প্রদানকারী। কুরআন মাজিদ মুমিনদের জন্য সুসংবাদ প্রদানকারী।
১৪। আন নাজির: নাজির অর্থ ভয় প্রদর্শনকারী।
কুরআন মাজিদের বিভিন্ন নামে নামকরণ দ্বারা এর চিরস্থায়ী মু'জিযা প্রকাশিত হয়েছে। আমরা পবিত্র কুরআনের নামসমূহ জানবো ও কুরআন মাজিদ পড়তে শিখবো।
মাক্কি সূরা ও মাদানি সুরা
আমরা আল কুরআনুল কারিমে দুই ধরনের সূরার নাম দেখতে পাই। যথা: মাক্কি ও মাদানি সুরা। অবতরণের সময়কাল বিবেচনায় সুরাসমূহকে এ দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এখন আমরা মাক্কি ও মাদানি সুরার পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য জানবো।
মাক্কি সূরার পরিচয়: রাসুলুল্লাহ (সা.) এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পূর্বে যেসকল সূরা অবতীর্ণ হয়েছে, তাকে মাজি সুরা বলে। মাক্কি সূরার সংখ্যা ৮৬ টি।
মাদানি সূরার পরিচয়: রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের পর যে সকল সূরা অবতীর্ণ হয়েছে, সেসকল সূরাকে মাদানি সুরা বলে। মাদানি সুরার সংখ্যা ২৮টি।
মাক্কি সূরার বৈশিষ্ট্য:
১. মাক্কি সুরাসমূহে তাওহিদ ও রিসালাতের আলোচনা প্রধান্য পেয়েছে।
২. এ সূরাগুলোতে কিয়ামত, জান্নাত ও জাহান্নাম তথা আখিরাতের বর্ণনা প্রাধান্য পেয়েছে।
৩. মাক্কি সুরাসমূহে শিরক ও কুফরের পরিচয় বর্ণনা করে এগুলোর অসারতা প্রমাণ করা হয়েছে ।
৪. এ সূরাগুলোতে মুশরিক ও কাফিরদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে।
৫. মাঝি সুরাসমূহে পূর্ববর্তী মুশরিক ও কাফিরদের হত্যাযজ্ঞের কাহিনী, ইয়াতিমদের সম্পদ হরণ করা, কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়া ইত্যাদি কুপ্রথার বিবরণ রয়েছে।
৬. এর শব্দমালা শক্তিশালী, ভাবগম্ভীর ও অন্তরে প্রকম্পন সৃষ্টিকারী।
৭. এতে শরিয়তের সাধারণ নীতিমালা উল্লেখ রয়েছে।
৮. এতে প্রসিদ্ধ বিষয়সমূহ শপথের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে।
৯. মাক্কি সুরাসমূহ সাধারণত আকারে ছোট এবং আয়াতগুলো তুলনামূলকভাবে ছোট।
১০. এ সূরাগুলোতে পূর্ববর্তী নবি-রাসুলগণের সফলতা ও তাদের অবাধ্যদের শোচনীয় পরিণতির বর্ণনা করা হয়েছে।
১১. মাক্কি সূরাসমূহে تأيُّها الناس )অর্থ- ‘হে মানবজাতি’কথাটি উল্লেখ আছে।
মাদানি সুরার বৈশিষ্ট্য:
১. মাদানি সূরাসমূহে শরিয়তের বিধি-বিধান, ফরয, ওয়াজিব ইত্যাদির সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে।
২.
এতে আহলে-কিতাবের পথভ্রষ্টতা ও তাদের কিতাব বিকৃত হওয়ার কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
৩ মাদানি সূরাসমূহে নিফাকের পরিচয় ও মুনাফিকদের যড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ রয়েছে।
৪. এ সুরাগুলোতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও সাংস্কৃতিক নীতিমালা বর্ণিত হয়েছে।
৫. এতে পারস্পরিক লেনদেন, উত্তরাধিকার আইন, ব্যবসা বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয়সহ যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বিধান বর্ণিত হয়েছে।
৬. মাদানি সূরাসমূহের আয়াতসমূহ তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ।
৭. এ সুরাগুলোতে ইবাদতের রীতিনীতি, সালাত, সাওম, হজ, যাকাত ইত্যাদি বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।
৮. মাদানি সুরাসমূহে ইহুদি ও খ্রীস্টানদেরকে ইসলামের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে।
৯. মাদানি সূরাসমূহে বিচারব্যবস্থা, দন্ডবিধি, জিহাদ, পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
১০. মাদানি সূরাসমূহে يَأيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا 'হে ঈমানদারগণ') কথাটি উল্লেখ আছে।
১১. হালাল ও হারাম সংক্রান্ত বর্ণনা প্রধান্য পেয়েছে।
দলগত কাজ শিক্ষার্থীরা মাজি ও মাদানি সুরার বৈশিষ্ট্যসমূহ পোস্টার পেপারে উপস্থাপন করবে। |
আল কুরআনের বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম্য
কুরআন মাজিদ বিশ্বমানবতার জন্য হেদায়াতের বাণী নিয়ে অবর্তীর্ণ হয়েছে। তাই এই কুরআনের রয়েছে কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য, যার কারণে এটি সর্বশ্রেষ্ঠ। আমরা এখন আল কুরআনের সেই বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্যসমূহ জানবো, যার মাধ্যমে এর মাহাত্ম্যও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
পূর্বযুগের বিভিন্ন উম্মত তাদের প্রতি প্রেরিত আসমানি কিতাব এবং তাদের নবির শিক্ষা নিজেদের সুবিধামতো পরিবর্তন করে নানারকম বিকৃতি ঘটিয়েছে। আল কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ, যা যাবতীয় বিকৃতি ও ভুলত্রুটি থেকে মুক্ত। এটিকে পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থারূপে অবতীর্ণ করা হয়েছে। মানব জাতির বর্তমান ও অনাগত কালের যে সব সমস্যা ও প্রয়োজন দেখা দেবে, তার সবকিছুরই মূলনীতি কুরআনে বলে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَبَ تِبْيَانًا لِّكُلِّ شَيْءٍ
অর্থ: আর আমি আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি প্রত্যেক বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ। (সুরা আন-নাহল, আয়াত: ৮৯)
কুরআন নাযিল হওয়ার সময় থেকে অদ্যাবধি অনেকেই একে মানুষের রচনা, কবিতা, যাদু ইত্যাদি বলে অপবাদ দিয়েছে। এতে আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে এবং অনাগত কাল পর্যন্ত যাদের মনে এমন ধারণা জন্ম নেবে, তাদের সবাইকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন 'আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকলে তোমরা এটার অনুরূপ কোনো সুরা নিয়ে আস এবং তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তবে আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সকল সাহায্যকারীকে আহ্বান কর'। (সুরা আল বাকারা, আয়াত: ৪৩) কুরআনের এটা একটি বড় মু'জিযা, আজ পর্যন্ত কোনো মানুষই কুরআনের অনুরূপ কিছুই রচনা করতে পারেনি। সর্বাত্মক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে বলতে বাধ্য হয়েছে- ‘না, এটা কোনো মানুষের বাণী নয়।’
আল কুরআন কিয়ামত পর্যন্ত সকল সমস্যার সমাধান সম্বলিত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব। এরপর আর কোনো গ্রন্থ অবতীর্ণ হবে না এবং প্রয়োজনও হবে না। এর আগে মানবজাতির হেদায়াতের জন্য তাওরাত, যাবুর, ইনজিল এ তিনটি বড় আসমানি কিতাব এবং ১০০ খানা সহিফা বিভিন্ন নবি-রাসুলের উপর নাযিল হয়েছিল। এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, তার কোনোটিই এখন আর অবিকৃত অবস্থায় বলবৎ নেই। তবে কুরআন মাজিদ সেসকল কিতাব নাযিল হওয়াকে সত্যায়ন করছে এবং উক্ত কিতাবসমূহের মৌলিক প্রয়োজনীয় শিক্ষাকে ধারণ করছে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল উৎস হলো আল-কুরআন। এ মহাগ্রন্থে ব্যাকরণ, আইন, গণিত, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, দর্শন, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, সাহিত্য, তর্কশাস্ত্র, অলংকারশাস্ত্র, ফারাইজ (সম্পদ বণ্টনশাস্ত্র), বর্ষপঞ্জীসহ জীবনঘনিষ্ঠ সব প্রয়োজনীয় জ্ঞানের মূলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে। মহাকাশবিজ্ঞান সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'আর তারা (গ্রহ-নক্ষত্র) প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষপথে মহাশূন্যে পরিভ্রমণ করছে।' (সুরা ইয়াসিন, আয়াত: ৪০)।
আল-কুরআনের তিলাওয়াত ব্যক্তির হৃদয় প্রশান্ত ও তৃপ্ত করে। যতবার তিলাওয়াত করা হয় প্রতিবারই এর তিলাওয়াত ব্যক্তিকে নতুন চেতনায় ও কল্যাণচিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) ইসলামের শত্রু ছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর বোন ফাতিমার কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত শুনে এতটাই বিগলিত হন যে, সাথে সাথে মুহাম্মাদ(সা.)-এর কাছে ছুটে যান এবং ইসলাম গ্রহণ করেন।
আল কুরআন মানবজীবনের সকল সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ সকল সমস্যার সমাধান পবিত্র কুরআনে স্পষ্টভাবে দেওয়া আছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَبِ مِنْ شَيْءٍ
অর্থ: 'আমি এ কিতাবে কোনো কিছুই বাদ দেইনি।' (সুরা আল-আনআম, আয়াত: ৩৮)
কুরআনের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য যত বিস্তৃতভাবে এবং যত গভীরভাবে জানা যায় তত ঈমান বাড়ে, কুরআনের প্রতি ভালোবাসা বাড়ে এবং আমল করার আগ্রহ তৈরি হয়। প্রিয় শিক্ষার্থীরা। চল, আমরা বেশি বেশি কুরআন অধ্যয়ন করি এবং তার আলোকে জীবন গড়ি। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।
দলগত কাজ শিক্ষার্থীরা পবিত্র কুরআনের বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম্য নিয়ে দলে আলোচনা করে পোস্টার পেপারে উপস্থাপন করবে |
প্রতিফলন ডায়েরি লিখন (বাড়ির কাজ) 'কুরআন-হাদিসের নির্দেশনা আমি/আমরা কীভাবে অনুশীলন করতে পারি' (উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক তোমরা দলে/প্যানেলে বিভক্ত হয়ে আলোচনা করে উপস্থাপন করো।) |
তাজবিদ শব্দের অর্থ হচ্ছে 'সুন্দর করা'। কুরআনের হরফগুলো সুন্দর করে পাঠ করা। ইসলামি পরিভাষায় তাজবিদ হচ্ছে কুরআন মাজিদের প্রতিটি হরফকে তার মূল মাখরাজ ও সিফাত থেকে আদায় করা। গুন্নাহ, পোর-বারিক, মাদ্দসহ অন্যান্য নিয়ম কানুন যথাযথভাবে পালন করে কুরআন তিলাওয়াত করাকে তাজবিদ বলে।
তাজবিদসহকারে কুরআন পাঠ করা ওয়াজিব। কারণ কুরআন মাজিদ যদি শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করা না হয়, তাহলে এর অর্থ ভিন্ন হয়ে যায়। মহান আল্লাহ তাজবিদসহ তিলাওয়াত সম্পর্কে বলেন-
وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا
অর্থ: 'কুরআন তিলাওয়াত করো ধীরে ধীরে ও সুস্পষ্টভাবে।' (সুরা আল-মুযযাম্মিল, আয়াত: ০৪)
এক হরফের জায়গায় অন্য হরফ পাঠ করা, যেকোনো হরফকে বাড়িয়ে পড়া, যেকোনো হরফকে কমিয়ে পড়া এবং যের, যবর, পেশকে পরিবর্তন করে পাঠ করা মারাত্মক ভুল। এ ধরনের ভুলের জন্য সালাত ভঙ্গ হয়।
তাজবিদ অনুযায়ী কুরআন না পড়লে পাঠকারী গুনাহগার হবে এবং নামায শুদ্ধ হবে না। অন্যদিকে সহিহ শুদ্ধভাবে কুরআন পড়লে বান্দা প্রভূত সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হবে এবং কিয়ামতের দিন এটি বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। হাদিসে এসেছে-
اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لِأَصْحَابِهِ
অর্থ: 'তোমরা কুরআন পাঠ কর। কেননা নিশ্চয়ই তা স্বীয় পাঠকের জন্য কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে।' (মুসলিম)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, 'যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার কিতাব থেকে একটি হরফ পড়বে, সে একটি নেকি পাবে এবং একটি নেকিকে দশগুণ দেওয়া হবে। আমি বলি না নে একটি হরফ বরং। একটি হরফ, একটি হরফ এবং একটি হরফ।' (তিরমিযি)
কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত করা ও অর্থ বুঝা আমাদের একান্ত কর্তব্য। এটি সর্বশ্রেষ্ঠ নফল ইবাদাত। কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত ও শিক্ষাদান করাকে রাসুল (সা.) মর্যাদাপূর্ণ আমল হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে-
خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ القُرْآنَ وَعَلَّمَهُ
অর্থ: 'তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি উত্তম যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে এবং অপরকে তা শিক্ষা দেয়। (বুখারি) ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে আমরা তাজবিদের বেশকিছু নিয়ম সম্পর্কে জেনেছি। এ শ্রেণিতে আমরা নুন সাকিন ও তানবীনের কায়েদা ও মিম সাকিনের কায়েদা সম্পর্কে জানব।
নুন সাকিন ও তানবীনের বর্ণনা
আমরা মিম সাকিন এর নিয়মগুলো জানবো, শিখবো এবং নিয়ম মেনে কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত করব।
বাড়ির কাজ তোমরা পাঠ্যপুস্তকে নির্ধারিত সুরাসমূহ বাড়িতে শুদ্ধভাবে অনুশীলন/চর্চা করবে। (এক্ষেত্রে তুমি তাজবিদের নিয়মগুলো তোমার পরিবারের সদস্যদের অবহিত করতে পারো।) |
সূরা আল কাওসার আল কুরআনের ১০৮তম সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ। এর আয়াত সংখ্যা ৩টি। এ সূরার প্রথম আয়াতের শেষ শব্দ আল কাওসার থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে সুরা আল কাওসার।
শানে নুরুল
রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর পুত্র কাসেম অথবা ইবরাহিম যখন শৈশবেই মারা গেলেন, তখন মক্কার কাফিররা তাঁকে )الأب( বা নির্বংশ বলে উপহাস করতে লাগল। তাদের মধ্যে আস ইবনে ওয়ায়েল-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার সামনে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আলোচনা হলে সে বলত, আরে তার কথা বাদ দাও, সে তো কোনো চিন্তারই বিষয় নয়। কারণ সে নির্বংশ। তার মৃত্যুর পর তার নাম উচ্চারণ করার মতো কেউ থাকবে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে সুরা আল কাওসার অবর্তীর্ণ হয়। (ইবনে কাসির, মাযহারী)
শব্দার্থ
ব্যাখ্যা
সূরা কাওসারের শুরুতে মহান আল্লাহ রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে কাওসার তথা ইহকাল ও পরকালের যাবতীয় কল্যাণ দেওয়ার সুসংবাদ দিয়েছেন। কাওসার অর্থ হাউজে কাওসার। হাউজে কাওসার হলো জান্নাতের একটি ঝরনা, যার কিনারা স্বর্ণের, তলদেশ মণি-মুক্তার, যার মাটি মিশক থেকেও সুগন্ধি, যার পানি মধুর চেয়েও মিষ্টি। এই মহান পুরস্কারের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁকে দু'টি বিষয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সে দু'টি হলো সালাত ও কুরবানি। পুত্রসন্তান না থাকার কারণে কাফিররা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে আবভার বা নির্বংশ বলে গালি দিত। এর জবাবে বলা হয়েছে যে, শুধু পুত্রসন্তান না থাকার কারণে যারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে নির্বংশ বলে, তারা তাঁর প্রকৃত মর্যাদা সম্পর্কে বেখবর। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বংশগত সন্তান-সন্ততিও কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, যদিও তা কন্যা সন্তানের দিক থেকে হয়। একদিকে শত্রুদের উক্তি নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে, অপরদিকে আরও বলা হয়েছে যারা আপনাকে নির্বংশ বলে প্রকৃতপক্ষে তারাই নির্বংশ।
শিক্ষা ১. রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহ তা'আলার কাছে সর্বাধিক প্রিয় ও সম্মানিত। ২. কিয়ামতের দিন রাসুল (সা.) হাউজে কাওসারের মালিক হবেন। তিনি তাঁর প্রিয় উম্মতকে এখান থেকে পানি পান করাবেন। ৩. যারা রাসুলের অনুকরণ অনুসরণ করবে না, তারা কাওসারের পানি পান করার সৌভাগ্য লাভ করবে না। ৪. সালাত যেমন শারীরিক ইবাদাতের মধ্যে অন্যতম, তেমনি কুরবানি আর্থিক ইবাদাতের মধ্যে অন্যতম। ৫. প্রিয়নবি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিরোধিতা করার পরিণাম খুবই মারাত্মক। |
দলগত কাজ শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের সাথে সুরা আল কাওসার তিলাওয়াত করবে। এরপর সুরাটির অর্থ খাতায় লিখে শিক্ষককে দেখাবে। |
সুরা আল মা'উন আল কুরআনের ১০৭তম সুরা। এর আয়াত সংখ্যা ৭টি। এর প্রথম তিন আয়াত মক্কায়, বাকি অংশ মদিনায় অবতীর্ণ। এ সূরার শেষ শব্দ আল মা'উন )الْمَاغون( রয়েছে বিধায় এর নামকরণ করা হয়েছে সুরা আল মা'উন।
শানে নুযুল
আবু জাহলের অভিভাবকত্বে একটি ইয়াতিম ছেলে ছিল। যার সাথে সে খারাপ ব্যবহার করত। সুরার প্রথম তিন আয়াত সে সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়। সুরার চার থেকে ছয় নম্বর আয়াতে যাদের দিকে ইশারা করা হয়েছে, তারা ঐ শ্রেণির মুনাফিক, যাদের অন্তিত মক্কায় ছিল না। মদিনায় আগমনের পর এ ধরনের লোক দেখানো সালাত আদায়কারীদের সন্ধান মিলে। শেষের চার আয়াতে মদিনার মুনাফিকদের লোক দেখানো সালাত আদায় সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়।
ব্যাখ্যা
এ সূরার শুরুতে প্রশ্নবোধক শব্দ প্রয়োগ করে পরবর্তী অংশের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা রাসুলুল্লাহ (সা)-কে সম্বোধন করে বলেছেন, 'আপনি কি দেখেছেন তাকে যে দ্বীন তথা প্রতিদান দিবসকে অস্বীকার করছে?' এ সূরায় নিকৃষ্ট দু'টি শ্রেণি তথা কাফির ও মুনাফিকদের কতিপয় মন্দ স্বভাব উল্লেখ করে তার পরিণতিস্বরূপ জাহান্নামের শাস্তির বর্ণনা করা হয়েছে।
কাফিররা প্রতিদান দিবসকে অস্বীকার করে। বিশেষত এখানে আস ইবনে ওয়ায়েলকে বুঝানো হয়েছে। মুমিন ব্যক্তি বিচার দিবসকে অস্বীকার করে না। এ কারণেই প্রথমে এমন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যে বিচার দিবস তথা কিয়ামত অস্বীকার করে। কাফিরেরা ইয়াতিমের সাথে দুর্ব্যবহার করতো। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও মিসকিনকে খাদ্য দিতো না এবং অপরকে খাদ্য দিতে উৎসাহ দিতো না।
দ্বিতীয় শ্রেণি হচ্ছে কপটচারী মুনাফিক সম্প্রদায় বিশেষত আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল। এ সূরার দ্বিতীয় অংশে তাদের মন্দ বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে। তারা লোক দেখানোর জন্য সালাত আদায় করতো যাকাত দিত না, নিত্য ব্যবহার্য ছোটখাট জিনিসপত্র দিয়ে কাউকে সাহায্য করতো না। এসব কাজ স্বভাবতই নিন্দনীয় এবং ভয়াবহ গুনাহের। যদি কেউ কুফরবশত এসব কাজ করে, তবে তার শাস্তি চিরস্থায়ী জাহান্নাম।
শিক্ষা ১. প্রতিদান দিবস বা বিচার দিবসকে অস্বীকার করা জঘন্য অপরাধ, এটা মুমিনের কাজ হতে পারে না বরং এটা কাফির ও মুনাফিকদের কাজ। ২. ইয়াতিম ও অসহায় দুঃস্থদের তাড়িয়ে না দিয়ে তাদের যথাসম্ভব সাহায্য-সহযোগিতা করা। ৩. ইয়াতিম ও অসহায় দুঃস্থদের সাহায্য সহযোগিতার জন্য পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু- বান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশী সকলকে উৎসাহ উদ্দীপনা প্রদান করা। ৪. সালাতে অলসতা করা যাবে না। ২. লোক দেখানো সালাত আদায় করা যাবে না। ৬. সালাতে উদাসীন ব্যক্তিদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ পরিণতি। ৭. নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ধার দেওয়াতে কৃপণতা করা যাবে না। |
দলগত কাজ শিক্ষার্থীরা সুরা আল মাউন এর আলোকে ব্যক্তিগত জীবনে করণীয় লিখে একটি রঙ্গিন পোস্টার তৈরি করবে। |
সূরা কুরাইশ আল কুরআনের ১০৬তম সুরা। এটি মক্কায় অবর্তীর্ণ। এর আয়াত সংখ্যা ৪টি। এ সুরার প্রথম আয়াতের শেষ শব্দ কুরাইশ থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে সূরা কুরাইশ।
শানে নুযুল
মক্কা নগরীতে পবিত্র কা'বা ঘর অবস্থিত। কুরাইশরা এ গৃহের দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করত। তারা ছিল ব্যবসায়ী। তাদের ব্যবসায়ী কাফেলা গ্রীষ্মকালে সিরিয়া ও শীতকালে ইয়েমেনে গমন করত। আর পবিত্র কা'বা গৃহের পরিচর্যার দায়িত্ব পালনের কারণেই তারা ইয়েমেন ও সিরিয়ায় নিরাপদে ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারত। আবরাহার আক্রমণ থেকেও তারা রক্ষা পেয়েছিল। এ সমস্ত নিয়ামত তারা পেয়েছিল শুধুমাত্র কা'বা গৃহের সাথে থাকতো বলেই। তাই তাদের এই নিয়ামতের উল্লেখপূর্বক এই ঘরের প্রভু তথা আল্লাহ তা'আলার ইবাদাত করার আহবান করে এই সুরা অবতীর্ণ হয়।
ব্যাখ্যা
মক্কা ছিল একটি অনুর্বর মরুঅঞ্চল। সেখানে চাষাবাদ হতো না। এমন বাগবাগিচাও ছিলো না, যা থেকে ফল ফলাদি পাওয়া যেতে পারে। সেখানে খাদ্য-সামগ্রী বাইরে থেকে আনা হতো। তাই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কুরাইশরা বিদেশ সফর করত। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ সংগ্রহ করতো। এর ওপরই মক্কাবাসীদের জীবিকা নির্ভরশীল ছিল। কুরাইশরা কাবার তত্ত্বাবধায়ক ছিল। ফলে সকলের শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র ছিল। তাদের আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে কেউই বাঁধা দিত না। দস্যু ও শত্রুদের আক্রমণের ভীতি হতে তারা নিরাপদ ছিল। আল্লাহ তা'আলা মক্কাবাসীদের প্রতি এসব অনুগ্রহ উল্লেখপূর্বক তাদের কৃতজ্ঞতা আদায় করার নির্দেশ প্রদান করেন।
কুরাইশদের মর্যাদা
আল্লাহ তা'আলা কুরাইশদের সাতটি বিষয়ে মর্যাদা দান করেছেন;
(১) সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল (সা.) তাদের মধ্য হতে এসেছেন;
(২) নবুওয়াত তাদের মধ্য হতে এসেছে;
(৩) কাবাগৃহের তত্ত্বাবধান;
(৪) হাজীদের পানি পান করানোর দায়িত্ব পালন;
(৫) আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে হস্তীবাহিনীর বিরুদ্ধে সাহায্য করেছেন;
(৬) উক্ত ঘটনার পর কুরাইশরা দশবছর যাবত আল্লাহ তা'আলা ব্যতীত কারো ইবাদাত করেনি;
(৭) আল্লাহ তা'আলা তাদের বিষয়ে কুরআনে পৃথক একটি সূরা নাযিল করেছেন যাতে তারা ছাড়া আর কারো আলোচনা করা হয়নি।
শিক্ষা ১. আল্লাহ তা'আলা ব্যবসায়িক সফরে কুরাইশদের নিরাপত্তা দিয়ে তাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। নিরাপত্তা প্রদানের মালিক অল্লাহ। ২. আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করলে নিরাপত্তা লাভ করা যায়। ৩. আল্লাহ তা'আলা কুরাইশদের অসংখ্য অগণিত নিয়ামত দান করেছেন। ৪. প্রাপ্ত নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা। ৫. মহান আল্লাহর ইবাদাত করা। |
দলগত কাজ শিক্ষার্থীরা সূরা কুরাইশ শুদ্ধরূপে তিলাওয়াত করবে। এরপর পরস্পরের মধ্যে এ সুরাটির শিক্ষা আলোচনা করবে |
সুরা আল কারি' আহ কুরআনের ১০১তম সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ। এর আয়াত সংখ্যা ১১টি। এ সুরার প্রথম শব্দ আল কারি'আহ থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে সুরা আল কারি' আছ। চুন শব্দটির অর্থ সজোরে আঘাত করা যাতে ভীষণ শব্দ হয় এবং যে সজোরে আঘাত করে তাকে ভূত বলা হয়। এখানে এই শব্দটির অর্থ কিয়ামত বা মহাপ্রলয়।
শানে নুযুল
কাফিরদের স্বভাব ছিল পরকালকে অস্বীকার করা। মক্কার কাফির মুশরিকদের কিয়ামত দিবস ও পরকালীন জবাবদিহিতা অস্বীকারের পরিপ্রেক্ষিতে এই সুরা অবতীর্ণ হয়।
ব্যাখ্যা
এ সুরায় কিয়ামত দিবসের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে। কিয়ামত দিবসে আসমানসমূহ চূর্ণবিচূর্ণ হবে। পৃথিবী প্রকম্পিত হবে। পাহাড়সমূহ তুলার মতো উড়তে থাকবে। তারকাসমূহ খসে পড়বে। চন্দ্র ও সূর্য তাদের আলো হারিয়ে ফেলবে। ইসরাফিলের শিঙ্গার ফুৎকারে সকল মানুষ তাদের স্ব স্ব কবর থেকে বিচার দিবসের ময়দানে একত্রিত হবে। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে সবাই স্রোতের ন্যায় জড়ো হতে থাকবে। সেদিন পাহাড়সমূহ সমূলে উৎপাটিত হবে। টুকরো টুকরো হয়ে মহাশূন্যে উড়তে থাকবে। আল্লাহ তা'আলা আমল পরিমাপের জন্য মিজানের পাল্লা প্রস্তুত করবেন। মুমিনদের মধ্যে সৎকর্ম ও অসৎকর্মের পার্থক্য বিধানের জন্য আমল পরিমাপ করা হবে। যার নেক আমলের ওজন বদ আমল থেকে ভারি হবে, সে আনন্দময় জীবন লাভ করবে। আর যার হালকা হবে তার আবাসস্থল হবে হাবিয়া নামক জাহান্নাম। যার আগুনের তীব্রতা হবে কঠিন ও ভয়াবহ।
শিক্ষা ১. পৃথিবী ও পৃথিবীর জীবন খুবই ক্ষণস্থায়ী। ২. আল্লাহ তা'আলা এই পৃথিবীর সকল কিছুর নিয়ন্ত্রণ করেন এবং মহাপ্রলয়ের মাধমে তিনিই সবকিছু ধ্বংস করবেন। ৩. ইখলাসের সাথে করা আমল মিজানের পাল্লায় ভারি হবে, অপরদিকে ইখলাসবিহীন আমল হালকা হবে। ৪. কিয়ামতের মাঠে মানুষের আমলের হিসাব নেওয়া হবে। ৫. বদ আমল জাহান্নামে যাওয়ার কারণ। |
দলগত কাজ শিক্ষার্থীরা সুরা আল কারি' আহ শুদ্ধরূপে তিলাওয়াত করবে। এরপর পরস্পরের মধ্যে এ সুরাটির শিক্ষা আলোচনা করবে। |
সুরা আল যিলযাল আল কুরআনের ৯৯তম সুরা। এটি মদিনায় অবতীর্ণ। এর আয়াত সংখ্যা ৮টি। এ সুরার প্রথম আয়াতের শেষ শব্দ যিলযাল থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে সূরা আল যিলযাল। রাসুলুল্লাহ (সা.) সুরা যিলযালকে কুরআনের অর্ধেক বলে ঘোষনা দিয়েছেন।
শানে নুযুল
কাফিরদের অভ্যাস ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে পরকাল ও কিয়ামত দিবসের সময় সম্পর্কে বারবার জিজ্ঞাসা করা। পবিত্র কুরআন মাজিদের বিভিন্ন সূরায় একথা এসেছে। তাদের জিজ্ঞাসার জবাবে আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের আলামতের বর্ণনা দিয়ে এই সুরা অবতীর্ণ করেন। সেসময় দুই ব্যক্তি ছিল। তাদের একজন সামান্য পরিমাণ দান করাকে তুচ্ছ মনে করে বিরত থাকতো। অপরজন মিথ্যা বলা, গীবত করা ও কুদৃষ্টি ইত্যাদি গুনাহসমূহকে হালকা মনে করতো। সে ভাবত কবিরাগুনাহের জন্য কেবল জাহান্নামের শাস্তি হবে। তাদের এই ভ্রান্ত ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে শেষের দুই আয়াত নাযিল হয়।
ব্যাখ্যা
এ সুরায় চমৎকারভাবে কিয়ামত দিবসের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। পৃথিবী যখন স্বীয় কম্পনে প্রকম্পিত হবে। তখন পৃথিবী তার ভিতরের সবকিছু স্বর্ণ খন্ডের আকারে বের করে দেবে। তখন যে ব্যক্তি ধন-সম্পদের জন্য কাউকে হত্যা করেছিল, সে তা দেখে বলবে, এর জন্যেই কি আমি এত বড় অপরাধ করেছিলাম? যে ব্যক্তি অর্থের কারণে আত্মীয়দের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিল, সে বলবে, এর জন্যই কি আমি এ কান্ড করেছিলাম?
চুরির কারণে যার হাত কাটা হয়েছিল, সে বলবে, এর জন্যই কি আমার নিজের হাত হারিয়েছিলাম? তখন কেউ এসব স্বর্ণখণ্ডের প্রতি ভূক্ষেপও করবে না।
জমিন তার ভিতরে যত খনিজ সম্পদ রয়েছে, তা সব বাইরে বের করে দিবে। মানুষ বিস্মিত হয়ে ভয়ে বলতে থাকবে এই জমিনের কী হলো? এত কাঁপছে কেন? ভিতর থেকে সব বের করে দিচ্ছে কেন? সেদিন জমিন আল্লাহর হুকুমে তার ওপর মানুষ যেসব আমল করেছে তার সাক্ষ্য দিবে। কেউ ঈমানের সাথে অনু পরিমাণ সৎকর্ম করলে সে তা দেখবে। তাকে তার প্রতিদান দেওয়া হবে। কুফর অবস্থায় কৃত সৎকর্ম পরকালে ধর্তব্য হবে না। আর কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে সে তা দেখবে এবং তাকে তার শাস্তি পেতে হবে।
শিক্ষা ১. কিয়ামতের দিন সার্বিক পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ হবে। ২. কিয়ামতের দিন জমিন সাক্ষ্য দিবে তার উপর মানুষ কী কী করেছে। ৩. কিয়ামতের দিন মানুষ বিভিন্ন দলে তাদের আমলের হিসাব দেওয়ার জন্য বের হবে। ৪. কিয়ামতের দিন মানুষ তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আমলসমূহ দেখতে পাবে এবং এর প্রতিদান পাবে। ৫. নেক আমল অণু পরিমাণ হলেও তা পরিহার করা যাবে না। অপরদিকে বদ আমল যত ক্ষুদ্র হোক না কেন তা অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে। |
দলগত কাজ শিক্ষার্থীরা সূরা যিলযাল শুদ্ধরূপে তিলাওয়াত করবে। এরপর পরস্পরের মধ্যে এ সুরাটির শিক্ষা আলোচনা করবে। |
আয়াতুল কুরসি কুরআন মাজিদের সর্ববৃহৎ সুরা আল-বাকারার ২৫৫ নং আয়াত। এটি আল-কুরআনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আয়াত। কুরসি শব্দের অর্থ আসন, সিংহাসন, সাম্রাজ্য, মহিমা, জ্ঞান ইত্যাদি। এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলার পরিচয়, পূর্ণ ক্ষমতা, মহিমা ও শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা করা হয়েছে। এ জন্য এ আয়াতকে আয়াতুল কুরসি বলা হয়।
রাসুল (সা.) আয়াতুল কুরসিকে সবচেয়ে উত্তম আয়াত বলে অভিহিত করেছেন। মহানবি (সা.) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরয সালাতের পর আয়াতুল কুরসি নিয়মিত পাঠ করে, তার জন্য বেহেশতে প্রবেশের পথে একমাত্র মৃত্যু ব্যতীত আর কোনো বাধা থাকে না।' অর্থাৎ মৃত্যুর সাথে সাথেই সে বেহেশতে প্রবেশ করবে এবং আরাম আয়েশ উপভোগ করতে শুরু করবে।
অন্য হাদিসে মহানবি (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি সকালে ও শয়নকালে আয়াতুল কুরসি পাঠ করবে, আল্লাহ তা'আলা তাকে সর্বপ্রকার বিপদাপদ থেকে রক্ষা করবেন। (তিরমিযি)
অন্য এক হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) উবাই ইবনে কাবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আল কুরআনের মধ্যে কোন আয়াতটি সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ? উবাই ইবনে কা'ব জবাব দিলেন, তা হচ্ছে আয়াতুল কুরসি। রাসুল (সা.) তা সমর্থন করে বললেন, হে আবুল মুনজির! [উবাই ইবনে কা'ব এর ডাকনাম] তোমাকে এ উত্তম জ্ঞানের জন্য ধন্যবাদ। সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার জীবন। এর একটি জিহ্বা ও দু'টি ঠোঁট রয়েছে, যা দিয়ে আরশের অধিকারীর পবিত্রতা বর্ণনা করে। (আহমদ)
ব্যাখ্যা
আয়াতুল কুরসিতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তা'আলা এক ও অদ্বিতীয়। সকল ইবাদাত ও প্রশংসা একমাত্র তাঁরই। এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা সর্বজ্ঞানী, চিরঞ্জীব, শ্রবণকারী, দর্শক ও বাকশক্তিসম্পন্ন হওয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে। তিনি সমগ্র বিশ্বের একচ্ছত্র অধিপতি। তিনি শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বের অধিকারী। তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ কথা বলতে পারবে না। পরিপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী, যিনি সমগ্র বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। আসমান জমিনের বিশালতা তাঁর কাছে কিছুই না। সবাই তাঁর সৃষ্টি ও তাঁর অধীন। তিনি ক্লান্তি, নিদ্রা, তন্দ্রা ইত্যাদির উর্ধ্বে। এককথায় তিনি সর্বশক্তিমান, সকল শক্তির আধার, মহান, সর্বশ্রেষ্ঠ।
আয়াতের শিক্ষা ১. আল্লাহ তা'আলা এক ও অদ্বিতীয়। ২. আল্লাহ তা'আলা সমস্ত সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুনাবলির অধিকারী। ৩. কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলার অনুমতি পেলে অনেকেই সুপারিশ করতে পারবে। ৪. আয়াতুল কুরসি শয়তানের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য ঢালস্বরূপ। ৫. আয়াতুল কুরসি পাঠকারী সহজে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। ৬. আসমান ও জমিনের মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআলা। |
হাদিসের মাধ্যমে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। এ কারণেই কুরআনের ন্যায় হাদিসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
মোটকথা একজন মুসলমানের জন্ম-মৃত্যু, বিবাহ, তালাক, ইবাদাত-বন্দেগি, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-ব্যবহার, লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, যুদ্ধ-সন্ধি, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক সমস্ত বিষয়ের বিস্তারিত নির্দেশনা আমরা রাসুলের হাদিসের মাধ্যমে লাভ করতে পারি। এজন্য আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'রাসুল তোমাদের যা দেন, তা তোমরা গ্রহণ কর, এবং যা তোমাদের নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।' (সুরা হাশর, আয়াত: ৭)
মহান আল্লাহর ক্ষমা ও ভালোবাসা লাভের জন্য রাসুলের কথা-কাজ ও আদর্শের আনুগত্য করা একান্ত জরুরি। কেননা রাসুলের আনুগত্য মহান আল্লাহর অনুগত্যের নামান্তর। এতে আল্লাহ খুশি হন। আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন, তাকে ক্ষমা করে দেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, 'বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, এতে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করবেন।' (সুরা আলে ইমরান: ৩১)
হাদিস মহানবি (সা.) এর জীবনাদর্শকেই সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলে। তাই মহানবি (সা.) এর জীবনাদর্শের খুঁটি-নাটি জানতে হাদিসের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আর রাসুল (সা.) এর অনুকরণ ও অনুসরণ করতে হলে হাদিসের বিকল্প নেই। অন্য দিকে রাসুলের আনুগত্য ও অনুসরণের অর্থই হলো মহান আল্লাহর আনুগত্য করা। হাদিসের অনুসরণের মাঝেই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য নিহিত। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, 'যে রাসুলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল।' (সুরা আন-নিসা, আয়াত: ৮০১
আল-কুরআন সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রধান উৎস। আর দ্বিতীয় উৎস হলো হাদিস। হাদিস কেবল রাসুল (সা.)- এর কথা ও কাজের বর্ণনা তা নয়, এটা তাঁর প্রদত্ত শিক্ষা ও জ্ঞানের সমষ্টি। তিনি ছিলেন মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। মহান আল্লাহ তাঁকেই সবচেয়ে বেশি জ্ঞান দান করেছেন। সেই জ্ঞান আমরা হাদিস শাস্ত্রেই খুঁজে পাই। পথিবীতে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুল (সা.) প্রদর্শিত হিদায়েতের উপর অটল ও অবিচল থাকতে হলে হাদিসের অনুসরণ করতে হবে। মহানবি (সা.) নিজে হাদিসের প্রয়োজনীয়তার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন,
ترَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَن تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ رَسُوْلِهِ
অর্থ: 'আমি তোমাদের মাঝে দু'টি বন্ধু রেখে যাচ্ছি, তোমরা যতদিন এগুলোকে আঁকড়ে থাকবে, ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব (কুরআন) এবং অপরটি হচ্ছে তাঁর রাসুলের সুন্নাহ।' (মুয়াত্তা) বস্তুত কুরআন ও হাদিস ইসলামি শরিয়তের প্রধান দু'টি উৎস। কুরআনের প্রতিটি আয়াত ও নির্দেশ যেমন মানুষকে সত্য ও সৎপথের সন্ধান দেয়, তেমনি হাদিসও সমস্ত মানবজাতিকে ন্যায় এবং শান্তির পথে পরিচালিত করে। তাইতো মহানবি (সা.) বিদায় হজের ভাষণে মুসলিম জাতিকে লক্ষ্য করে নির্দেশ দেন- 'যারা এখানে উপস্থিত, তাদের দায়িত্ব হলো, যারা অনুপস্থিত তাদের কাছে আমার বাণী পৌঁছে দেওয়া।' (বুখারি)
উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, মানবজীবনে মহানবি (সা.) এর হাদিসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। হাদিসকে অস্বীকার করা কিংবা অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং আমরা মহানবি (সা.)- এর হাদিস অনুযায়ী আমল করবো এবং নিজেদের জীবন হাদিসের আলোকে সাজাবো।
কাজ: শিক্ষার্থীরা হাদিসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটি অনুচ্ছেদ বাড়ির খাতায় লিখে আনবে |
চরিত্র গঠন ও মুনাজাতমূলক হাদিস
চরিত্র গঠনমূলক দু'টি হাদিস
প্রিয় শিক্ষার্থী। তোমরা জান যে, চরিত্র মানবজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। পৃথিবীর সকল নবি-রাসুলকে প্রেরণ করা হয়েছিল মানব চরিত্রের উৎকর্ষ সাধনের জন্য। এমনকি মহানবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কেও উত্তম চরিত্রের শিক্ষাদানের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। মহানবি (সা.) বলেন, আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্য প্রেরিত হয়েছি। তাই আমাদেরকে উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। অন্যদিকে মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা ও মুনাজাত করে মানব জাতি বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পেতে পারে। আল্লাহর অফুরন্ত কল্যাণ লাভেও ধন্য হতে পারে। তাছাড়া মুনাজাতের মাধ্যমে বান্দা তার গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে থাকে। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) -এর অসংখ্য হাদিস রয়েছে। তাহলে চলো আজ আমরা উন্নত চরিত্র গঠন ও মুনাজাতমূলক হাদিস শিখবো।
হাদিস- ১
خَيْرُ النَّاسِ أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ
অর্থ: 'সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ সেই ব্যক্তি, যে মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী।' (ইবনু হিব্বান)
ব্যাখ্যা ও শিক্ষা: পরোপকার মানব চরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উত্তম পূণ। মহান আল্লাহ পরোপকারীকে ভালোবাসেন। মহানবি (সা.) নিজে পরোপকারী ছিলেন এবং উম্মতকে অন্যের উপকার করার জন্য উৎসাহ দিতেন। আলোচ্য হাদিসে মহানবি (সা.) মানুষকে অন্য মানুষের প্রতি সদয় হতে, বিপদে-আপদে সর্বাবস্থায় উপকার করতে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। তবে এখানে কেবল পার্থিব বা বস্তুগত উপকার উদ্দেশ্য নয়; বরং দুনিয়া ও আখিরাতে যত রকমভাবে মানুষকে উপকার করা যায়, সবই এই হাদিস এর উদ্দেশ্য। দুনিয়ায় একজন মানুষকে নানাভাবে উপকার করা যায়। যেমন অভাবীকে অর্থ দিয়ে, রোগীর সেবা করে ও বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করে। অনুরূপভাবে আখিরাতের দৃষ্টিকোণ থেকেও একজন মানুষকে উপকার করা যায়। এই উপকার পার্থিব উপকারের চেয়েও মহান। যেমন পথভ্রষ্ট কাউকে সঠিক পথ দেখানো, আল্লাহর পরিচয় জানানো, সঠিক জ্ঞান দান করা, ভালো মানুষ হতে উদ্বুদ্ধ করা ইআদি।
আল্লাহ তা'আলা আমাদের কল্যাণ চান। তাই তিনি যখন দেখেন আমরা তাঁর অপর বান্দার উপকার করছি, তখন তিনি খুবই খুশি হন। পরোপকারীর যাবতীয় প্রয়োজন তিনি নিজেই তখন পূর্ণ করে দেন। পরোপকারকারীকে সর্বোত্তম মানুষদের কাতারে নিয়ে আসেন।
সুতরাং আমরা সবসময় আমাদের সাধ্যমতো অন্যের উপকার করব। কখনও কারো ক্ষতি করব না। তাহলেই আমরা মহান আল্লাহর দরবারে সর্বোত্তম মানুষ হিসেবে পরিগণিত হতে পারব।
হাদিস- ২
الْمُسْلِمُ مَن سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِن لِسَانِهِ وَيَدِهِ
অর্থ: 'প্রকৃত মুসলিম সে-ই, যার জিহ্বা ও হাত থেকে সকল মুসলিম নিরাপদ থাকে।' (বুখারি)
ব্যাখ্যা ও শিক্ষা: মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। বিপদে-আপদে একে অপরকে সাহায্য করবে। তার জান-মাল ও মান-সম্মান হেফাযত করবে। শত্রুর কবল থেকে তাকে রক্ষা করবে। কখনও বিপদের মুখে ঠেলে দিবে না। কোনো ক্ষতি করবে না ও অকল্যান কামনা করবে না।
মানুষ দুইভাবে অপরের ক্ষতি করতে পারে। কথা দিয়ে এবং সরাসরি শক্তি প্রয়োগ করে। এই হাদিসের শিক্ষা হলো, একজন প্রকৃত মুসলিম কখনও কোনোভাবে অপরের ক্ষতি করতে পারে না। কারণ অপরের ক্ষতি করা ইসলামের শিক্ষা নয়।
মুখ দিয়ে অপরকে গালিগালাজ করা যায়, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া যায়, পশ্চাতে নিন্দা করা যায়। সর্বোপরি মিথ্যা বলে কারো সম্মানহানি করা যায়। সবগুলো কাজই চরম নিন্দনীয় ও ইসলামি আদর্শের বিপরীত। অন্যদিকে হাত বা বল প্রয়োগ করে অপরকে মারধর করা থেকে শুরু করে তার জীবন পর্যন্ত বিনষ্ট করা যায়। অথচ অপরকে বিনা কারণে আঘাত করা হারাম। যে অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে, সে জাহান্নামি হবে। তাই আমরা কখনও মুখে যেমন কারও ব্যাপারে খারাপ কথা বলবো না, তেমনি কারও বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে শক্তি প্রয়োগ করবো না। আমরা একে অপরের প্রতি সহনশীল হবো। ক্ষমাশীল হবো। তাহলেই আমরা প্রকৃত মুসলিম হতে পারবো।
মুনাজাতমূলক দু'টি হাদিস
মহান আল্লাহ আমাদের সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক। তিনি মহানবি (সা.)-কে বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন। তাই তিনি সর্বদা সৃষ্টিজগতের কল্যান কামনা করতেন। মানুষের জন্য কল্যাণকর কাজ ও পথ দেখিয়ে দিতেন। তিনি দুনিয়া ও আখেরাতে মহান আল্লাহর অফুরান নিয়ামত লাভের জন্য আমাদেরকে মুনাজাতের শিক্ষা দিয়েছেন। মহানবি (সা.)-এর অসংখ্য মুনাজাতমূলক হাদিস রয়েছে। আজকের পাঠে আমরা মহানবি (সা.)- এর মুনাজাতমূলক দু'টি হাদিস শিখব।
হাদিস- ১
اللهم إني أسألُكَ الصِّحْةَ، وَالْعِفَّةَ، وَالْأَمَانَةَ
وَحُسْنَ الْخَلْقِ ، وَالرِّضَى بِالْقَدْرِ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাস-সিজ্জাতা ওয়াল 'ইজ্জাতা ওয়াল আমানাতা ওয়া হুসনাল-খুলুকি ওয়ার- রিদা বিল-কাদরি।
অর্থ: হে আল্লাহ। আমি আপনার কাছে সুস্বাস্থ্য, পবিত্রতা, আমানতদারি, উত্তম চরিত্র এবং তাকদিরের উপর সন্তুষ্ট থাকার মানসিকতা প্রার্থনা করছি। (বায়হাকী)
উপরোক্ত হাদিস দু'টি গুরুত্বপূর্ণ মুনাজাতমূলক হাদিস। প্রথম হাদিসে মুনাফিকি, রিয়া, মিথ্যা, খিয়ানাত হতে রক্ষার এবং ২য় হাদিসে সুস্বাস্থ্য, পবিত্রতা, আমানতদারি, উত্তম চরিত্র এবং তাকদিরের উপর বিশ্বাস রাখার ব্যাপারে প্রার্থনা শিখানো হয়েছে। আমরা অর্থসহ হাদিস দু'টি শিখব। এগুলোর মাধমে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করব। তাহলে আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে কল্যাণ দান করবেন।
প্রতিফলন ডায়েরি লিখন | ||
সুরা/হাদিসের নাম | সুরা/হাদিস থেকে যে শিক্ষা পাই | বাস্তবজীবনে যেভাবে চর্চা করবো |
সুরা আল মাউন | আশে-পাশের মানুষকে দেখানোর জন্য সালাত আদায় করা যাবে না | নিয়মিত যথাসময়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় সালাত আদায় করবো। |
আরও দেখুন...