কৃষ্ণবিবর বা কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কিত ধারণাটি সাম্প্রতিক। ১৯৬৯ সালে একজন আমেরিকান বিজ্ঞানী জন হুইলার কৃষ্ণবিবর শব্দটি সৃষ্টি করলেও চিন্তাধারাটির বয়স বস্তুত দু'শ বছর । ঐ সময় আলো সম্পর্কে দুটি তত্ত্ব প্রচলিত ছিল— একটি হলো তরঙ্গতত্ত্ব, অপরটি কণিকাতত্ত্ব। তরঙ্গতত্ত্ব অনুসারে আলোক তরঙ্গ দিয়ে গঠিত, আর কণিকা তত্ত্ব অনুসারে আলোক কণিকা দিয়ে গঠিত। দুটি তত্ত্বই সঠিক, আসলে আলো তরঙ্গ ও কণিকা দুইই ।
আলো যদি তরঙ্গ হয় তাহলে এর ওপর মহাকর্ষের কী প্রভাব হবে, তরঙ্গরূপী আলো মহাকর্ষ বল দ্বারা আকৃষ্ট হবে কিনা তা স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু আলো যদি কণিকা দিয়ে গড়া হয় তাহলে এই কণিকারূপী আলোর ওপর মহাকর্ষের আকর্ষণ বল কাজ করবে না কেন? অবশ্যই আলো মহাকর্ষ দ্বারা প্রভাবিত হবে।
প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল আলোর দ্রুতি অসীম বলে মহাকর্ষ এর দ্রুতিকে কমিয়ে আলোর গতি মন্থর করতে পারবে না। কিন্তু পরবর্তীতে আলোর দ্রুতি অসীম নয়, এর সীমা আছে এটি আবিষ্কৃত হলো। সুতরাং আলোর ওপর মহাকর্ষের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকাটাই স্বাভাবিক।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক জন মিচেল তাঁর এক প্রবন্ধে বলেন যে, একটি তারকায় যদি যথেষ্ট ভর ও ঘনত্ব থাকে, তাহলে তার মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এত শক্তিশালী হবে যে, আলোক সেখান থেকে নির্গত হতে পারবে না। সেই তারকার পৃষ্ঠ থেকে নির্গত আলোক বেশি দূর যাওয়ার আগেই তারকাটির মহাকর্ষীয় আকর্ষণ তাকে পিছনে টেনে নিয়ে আসবে। এরকম বহুসংখ্যক তারকা রয়েছে বলে মিচেল ধারণা করেছিলেন। ঐ সব তারকা থেকে আলো আসতে পারে না বলে আমরা এদের দেখতে পাই না। তবে এদের মহাকর্ষ আকর্ষণ আমাদের বোধগম্য হবে, এই সমস্ত বস্তুপিণ্ডকে আমরা কৃষ্ণবিবর বা কৃষ্ণগহ্বর বলি।
কৃষ্ণবিবরের ধারণাটি আধুনিক মহাকর্ষ তত্ত্বের একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও চমকপ্রদ ফসল। একে মৌলিক নিউটনীয় নীতি থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। আমরা আমাদের অতি পরিচিত সূর্যকে নিয়ে শুরু করতে পারি। সূর্যের ভর M = 1.99 × 1030 kg এবং এর ব্যাসার্ধ = 6.96 x 108m। সূর্য অন্যান্য নক্ষত্রের তুলনায় অনেক বড় কিন্তু অন্যান্য নক্ষত্রের মতো সূর্য অতটা ভরযুক্ত নয়। সূর্যের গড় ঘনত্ব হলো—
<math xmlns="http://www.w3.org/1998/Math/MathML"><mi>ρ</mi><mo>=</mo><mfrac><mi>M</mi><mi>V</mi></mfrac><mo>=</mo><mfrac><mi>M</mi><mrow><mfrac><mn>4</mn><mn>3</mn></mfrac><mi>π</mi><msup><mi>R</mi><mn>3</mn></msup></mrow></mfrac><mo>=</mo><mfrac><mrow><mn>1.99</mn><mo>×</mo><msup><mn>10</mn><mn>30</mn></msup><mi>k</mi><mi>g</mi></mrow><mrow><mfrac><mn>4</mn><mn>3</mn></mfrac><mo>×</mo><mn>3.14</mn><mo>×</mo><mo>(</mo><mn>6.96</mn><mo>×</mo><msup><mn>10</mn><mn>8</mn></msup><mo> </mo><mi>m</mi><msup><mo>)</mo><mn>3</mn></msup></mrow></mfrac><mspace linebreak="newline"/><mo>=</mo><mn>1410</mn><mo> </mo><mi>k</mi><mi>g</mi><mo> </mo><msup><mi>m</mi><mrow><mo>−</mo><mn>3</mn></mrow></msup><mo> </mo><mspace linebreak="newline"/></math>
আমরা জানি, পৃথিবীর জন্য কোনো বস্তুর মুক্তি বেগ 11.2 kms-1। সূর্যের জন্য এই মুক্তি বেগ v হলো:
<math xmlns="http://www.w3.org/1998/Math/MathML"><mi>v</mi><mo>=</mo><msqrt><mfrac><mrow><mn>2</mn><mi>G</mi><mi>M</mi></mrow><mi>R</mi></mfrac></msqrt><mo>=</mo><msqrt><mrow><mfrac><mrow><mn>2</mn><mi>G</mi></mrow><mi>R</mi></mfrac><mo>.</mo><mfrac><mn>4</mn><mn>3</mn></mfrac><mi>π</mi><msup><mi>R</mi><mn>3</mn></msup><mi>ρ</mi></mrow></msqrt><mspace linebreak="newline"/><mi>v</mi><mo>=</mo><msqrt><mfrac><mrow><mn>8</mn><mi>G</mi><mi>π</mi><mi>ρ</mi></mrow><mn>3</mn></mfrac></msqrt><mo>.</mo><mi>R</mi><mo> </mo><mspace linebreak="newline"/></math>
বা, v = 6.18 x 105ms-1.. (11.2)
বা, v = 6.18 x 102 kms-1
এই মুক্তি বেগ ঘণ্টায় 2.2 মিলিয়ন কিলোমিটার বা 22 লক্ষ কিলোমিটারের সমান। এই বেগ আলোর বেগের 1 প্রায় 500 ভাগের এক ভাগ । সমীকরণ (11.2) থেকে দেখা যায় যে, মুক্তি বেগ v R l
মুক্তি বেগ সূর্যের গড় ঘনত্ব ও ব্যাসার্ধের ওপর নির্ভর করে। কোনো বস্তুর ঘনত্ব যদি সূর্যের সমান এবং ব্যাসার্ধ যদি সূর্যের 500 গুণ হয়, তাহলে ঐ বস্তুর পৃষ্ঠ থেকে মুক্তি বেগ হবে আলোর দ্রুতি এর চেয়েও বেশি। সুতরাং আলোকে সে নিজের দিকে টেনে রাখবে, ঐ বস্তু থেকে নির্গত আলো বস্তুতেই ফিরে যাবে, বস্তু থেকে বেরুতে পারবে না। এরকম বস্তুর ধারণা প্রথম দেন মিচেল। এ ধরনের বস্তুকে বর্তমানে বলা হয় কৃষ্ণবিবর বা কৃষ্ণগহ্বর।
M ভরের কোনো বস্তু তখনই কৃষ্ণবিবর হিসেবে কাজ করবে যখন এর ব্যাসার্ধ, একটি নির্দিষ্ট সংকট ব্যাসার্ধের সমান বা কম হবে। মুক্তি বেগ v এর সমীকরণে v এর পরিবর্তে c বসালে আমরা এই সংকট ব্যাসার্ধ পেতে পারি। এই সংকট ব্যাসার্ধ বের করার জন্য কার্ল সোয়ার্ডস্কাইল্ড আইনস্টাইনের সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব ব্যবহার করেন। ফলে সমীকরণটি দাঁড়ায়,
<math xmlns="http://www.w3.org/1998/Math/MathML"><mi>c</mi><mo>=</mo><msqrt><mfrac><mrow><mn>2</mn><mi>G</mi><mi>M</mi></mrow><mrow><msub><mi>R</mi><mi>s</mi></msub></mrow></mfrac></msqrt></math>
এখানে c আলোর দ্রুতি, Rs সংকট ব্যাসার্ধ সংকট ব্যাসার্ধ R, কে সোয়াস্কাইন্ড ব্যাসার্ধও বলা হয়। Rs এর জন্য সমাধান করে আমরা পাই,
<math xmlns="http://www.w3.org/1998/Math/MathML"><msub><mi>R</mi><mi>s</mi></msub><mo>=</mo><mfrac><mrow><mn>2</mn><mi>G</mi><mi>M</mi></mrow><mrow><msup><mi>c</mi><mn>2</mn></msup></mrow></mfrac></math>... (11.3)
M ভরবিশিষ্ট অঘূর্ণনশীল বা ঘূর্ণনবিহীন কোনো গোলকীয় বস্তুর ব্যাসার্ধ যদি Rs, হয় তাহলে কোনো কিছুই (আলোও) এই বস্তুপৃষ্ঠ থেকে মুক্ত হতে পারবে না এবং বস্তুটি কৃষ্ণবিবর হিসেবে কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে Rs, ব্যাসার্ধের মধ্যে কোনো বস্তু থাকলে কৃষ্ণবিবরের মহাকর্ষ আকর্ষণ দ্বারা আটকা পড়বে এবং বস্তুটি থেকে মুক্ত হতে পারবে না। কৃষ্ণবিবরকে ঘিরে Rs, ব্যাসার্ধের গোলকের পৃষ্ঠকে বলা হয় 'ঘটনা দিগন্ত'। কারণ, যেহেতু আলো এই গোলকের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না, সুতরাং এর ভেতরে সংঘটিত কোনো ঘটনা আমরা দেখতে পাই না। এই ঘটনা দিগন্তের বাইরের কোনো পর্যবেক্ষক শুধু জানতে পারেন এখানে একটি কৃষ্ণবিবর আছে, জানতে পারেন এর ভর (অন্য বস্তুর ওপর এর মহাকর্ষীয় প্রভাব থেকে), এর তড়িৎ আধান (অন্য আহিত বস্তুর ওপর কৃষ্ণবিবর প্রযুক্ত তড়িৎ বল দ্বারা) এবং এর কৌণিক ভরবেগ ।
কৃষ্ণবিবর কী করে তৈরি হয় সেটা বুঝতে হলে আমাদের তারকার জীবনচক্র বুঝতে হবে। যখন বৃহৎ পরিমাণ বায়ু নিজস্ব মহাকর্ষীয় আকর্ষণের চাপে নিজের উপরেই চুপসে যেতে থাকে তখন একটি তারকা সৃষ্টি হয়। তারকাটি সংকুচিত হবার সাথে বায়ুর পরমাণুগুলো ক্রমশ বেশি ঘন ঘন ও বর্ধনশীল দ্রুতিতে পারস্পরিক সংঘর্ষ হতে থাকে, ফলে বায়ু উত্তপ্ত হয়। শেষ পর্যন্ত এতটা উত্তপ্ত হয় যে প্রবল তাপে হাইড্রোজেন পরমাণু ফিউশনিত হয়ে হিলিয়াম পরমাণুতে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়া একটি নিয়ন্ত্রিত হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণের মতো, এর ফলে যে তাপ নির্গত হয় তার জন্যই তারকাটি আলোক বিকিরণ করে।
শুরুতে নক্ষত্র থাকে আন্তঃনাক্ষত্রিক ধূলিকণা ও গ্যাসের এক বিশাল মেঘ রূপে । মহাকর্ষ বলের প্রভাবে ধূলিকণা ও গ্যাসের এই বিশাল মেঘ সংকুচিত হয়। সংকোচনের সময় উচ্চ চাপ ও উচ্চ তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে যখন কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রি হয়, তখন তাপ-নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া সংঘটিত হয়, পরিণামে বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়। ফলে পদার্থের গোলকটি দীপ্তি ছড়ায়। এই অবস্থা বা ধাপকে বলা হয় নক্ষত্রের জন্ম। নক্ষত্রের বিবর্তনের এটি হলো আদি বা প্রারম্ভিক পর্ব। বামন নক্ষত্র এই ধাপে পাওয়া যায়। মোট নক্ষত্র সংখ্যার শতকরা ৯০ ভাগ হলো এই বামন নক্ষত্র। আমাদের সূর্য বর্তমানে এই ধাপে রয়েছে।
নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় মূলবস্তুতে বা অন্তর্বস্তুতে যতক্ষণ পর্যন্ত হাইড্রোজেন জ্বালানি থাকে, ততক্ষণ নক্ষত্রে তাপ নিউক্লিয় বিক্রিয়া ঘটতে থাকে। হাইড্রোজেন নিঃশেষ হয়ে গেলে নক্ষত্রের মূলবস্তু সংকুচিত হতে থাকে কিন্তু বহিস্থ অংশ তখনও প্রসারিত হতে থাকে। ফলে নক্ষত্রের ব্যাসার্ধ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং একই সাথে পৃষ্ঠ তাপমাত্রা হ্রাস পেতে থাকে। নক্ষত্রের বিবর্তনের এই ধাপকে বলা হয় দানব নক্ষত্র বা অতি দানব নক্ষত্র। এসব নক্ষত্রের ব্যাসার্ধ সূর্যের ব্যাসার্ধের 50 থেকে 220 গুণ পর্যন্ত হয়। এখন থেকে 5 বিলিয়ন (500 কোটি) বছর পরে আমাদের সূর্য এই ধাপে পৌঁছাবে।
নক্ষত্র বামন ধাপের চেয়ে অনেক কম সময় দানব ধাপে থাকে। প্রায় এক মিলিয়ন বছর পর দানব নক্ষত্র শীতল হতে থাকে ফলে নক্ষত্রটি সংকুচিত হতে থাকে। এর পরে এই নক্ষত্রের কী ঘটবে তা নির্ভর করে এর আদি বা মূল ভরের ওপর। যেসব সম্ভাব্য অবস্থা বা ধাপ ঘটতে পারে তা হলো :
এ রকম অবস্থায় নক্ষত্রটি যখন সংকুচিত হতে থাকে, তখন এর শক্তি মুক্ত হতে থাকে কিন্তু এটি এমন একটি ধাপে বা অবস্থায় পৌঁছায় যে এটি এর বহিস্থ আস্তরণকে উড়িয়ে বা ছুঁড়ে দেয়। ফলে হঠাৎ করেই প্রচুর পরিমাণ শক্তি নির্গত হয় যা নক্ষত্রের ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়ে দেয়। এ ধাপে নক্ষত্রটি এত উজ্জ্বল হয় যে, খালি চোখেও দেখা যায়। এটি এখন নোভা স্টার বা নোভা নক্ষত্র অর্থাৎ একটি নতুন নক্ষত্র ।
উপরোক্ত বিস্ফোরণে যা অবশিষ্ট থাকে তাকে বলা হয় শ্বেত বামন নক্ষত্র। নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপাদনের জন্য কোন হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম এতে থাকে না। নক্ষত্রটি থাকে অত্যন্ত ঘন বা ভারী। সময়ের সাথে এর ঔজ্জ্বল্য কমতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না এটি দীপ্তি ছড়ায়।
এ রকম নক্ষত্রের বেলায়, সংকোচনের সময় এমন একটি ধাপে পৌঁছায় যে, এটি এর বহিস্থ আস্তরণ ছুঁড়ে দিয়ে অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে যায়। একে বলা হয় সুপার নোভা। নক্ষত্রটি যখন সুপার নোভা হিসেবে বিস্ফোরিত হয়, তখন এর কোর বা মূলবস্তুর চাপ এত বেশি হয় যে, প্রোটন ও ইলেকট্রন একত্রিত হয়ে নিউট্রন গঠন করে। একে তাই বলা হয় নিউট্রন স্টার বা নিউট্রন নক্ষত্র। নিউট্রন নক্ষত্রের সাথে জড়িত থাকে অতি উচ্চ চৌম্বকক্ষেত্র। এটি তাই একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর রেডিও পাল্স নির্গমন করে, একে তাই পালসার বলা হয়। ১৯৬৭ সালে প্রথম নিউট্রন নক্ষত্র বা পালসারকে উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়েছিল।
সুপার নোভা বিস্ফোরণের পর নক্ষত্রের ভর যদি খুব বেশি হয় তখন এর অন্তর্বস্তু অনির্দিষ্টভাবে সংকুচিত হতে থাকে। এভাবে যে বস্তু তৈরি হয় তাকে কৃষ্ণবিবর বলে। কৃষ্ণবিবরের ঘনত্ব থাকে অত্যন্ত বেশি এবং এর পৃষ্ঠে অভিকর্ষজ ত্বরণ g এর মান অত্যন্ত বেশি থাকে। প্রকৃতপক্ষে ৪ এর মান এত বেশি হয় যে, এমনকি ফোটন কণাও এর পৃষ্ঠ থেকে মুক্ত হতে বা বেরিয়ে আসতে পারে না। কোনো কণিকা বা ফোটন এর কাছে যেতে থাকলে, তাৎক্ষণিকভাবে এর মধ্যেই হারিয়ে যায়। এ কারণেই এরকম বস্তুকে বলা হয় কৃষ্ণবিবর।
আরও দেখুন...