কোষ হলো জীবদেহের গঠনগত একক। জীবদেহ ব্যাকটেরিয়া, অ্যামিবা, প্লাজমিডিয়াম এগুলোর মতো এককোষী হতে পারে আবার মানুষ, বটগাছ, তিমি এগুলোর মতো বহুকোষী হতে পারে। এককোষী জীব ছাড়া অন্য সকল জীবদেহ অসংখ্য কোষ দিয়ে তৈরি হয়। প্রতিটি জীব কোষ বিভাজনের মাধ্যমে তাদের বংশবৃদ্ধি ও কোষের সংখ্যাবৃদ্ধি করে থাকে। যে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় একটি থেকে একাধিক কোষ তৈরি হয় তাকে কোষ বিভাজন বলে। কোষ বিভাজন একটি স্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। কোষ বিভাজনের মাধ্যমে একটি কোষ বিভাজিত হয়ে অসংখ্য কোষ তৈরির মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবে পরিণত হয়। আদি এককোষী জীব সাধারণত যে প্রক্রিয়ায় বিভাজিত হয় তাকে আম্যাইটোসিস বলা হয়। বহুকোষী জীব যে দুটি প্রক্রিয়ায় বিভাজিত হয় সেগুলো হচ্ছে মাইটোসিস এবং মিয়োসিস।
কোষ বিভাজনের গুরুত্ব
জীবদেহের দৈহিকবৃদ্ধি, জনন ও পরিস্ফুটনের জন্য কোষ বিভাজন প্রয়োজন। সকল প্রকার কোষ তার পূর্ববর্তী কোষ থেকে বিভাজনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। জীবদেহ আঘাতপ্রাপ্ত হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা সারিয়ে নিতেও কোষ বিভাজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আবার জননকোষে কোষ বিভাজন জীবদেহের বংশবৃদ্ধির জন্য অন্যতম মাধ্যম। এর মাধ্যমে নতুন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অপত্য (নতুন) কোষ তৈরি হয়, যা জীবের অভিযোজন, অভিব্যক্তি ও বংশপরম্পরা অব্যাহত রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
কোষের গঠন
তোমরা সপ্তম শ্রেণিতে উদ্ভিদ ও প্রাণী কোষের গঠন সম্পর্কে পড়েছ। তোমরা তখন দেখেছ যে কোষ ঝিল্লি দিয়ে আবৃত কোষের মূল দুটি উপাদান হচ্ছে সাইটোপ্লাজম ও নিউক্লিয়াস। কোষের কেন্দ্রে ঘন অস্বচ্ছ অঙ্গাণুটি হচ্ছে নিউক্লিয়াস এবং নিউক্লিয়াসের বাইরে অবস্থিত এবং কোষ ঝিল্লি দিয়ে আবৃত বাকি অংশটি সাইটোপ্লাজম। নিউক্লিয়াসটি নিউক্লিয়ার ঝিল্লি দিয়ে আবৃত থাকে এবং তার ভেতরে রয়েছে জীবের বংশগতি পদার্থ ডিএনএ দিয়ে তৈরি ক্রোমোজোম। সাধারণ অবস্থায় দীর্ঘ ক্রোমোজোম হিস্টোন নামে প্রোটিন কণার উপর পেঁচিয়ে ক্রোমাটিন হিসেবে উন্মুক্ত জালিকার মতো থাকে বলে এটি আলাদাভাবে বোঝা যায় না। শুধু কোষ বিভাজনের সময় এটি কুণ্ডলী পাকিয়ে সংকুচিত হয় বলে তখন এটি দৃশ্যমান হয়।
4.1 এককোষী জীবদেহের কোষ বিভাজন: অ্যাম্যাইটোসিস (amitosis)
আম্যাইটোসিস কোষ বিভাজন
এককোষী আদিকোষী জীবগুলো সরাসরি বিভাজনের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে থাকে, এই প্রক্রিয়াটি আম্যাইটোসিস বা বাইনারি ফিশান নামে পরিচিত। অ্যামিবা, ব্যাকটেরিয়া কিংবা নীলাভ সবুজ শৈবাল জাতীয় আদিকোষী জীবে এ ধরনের কোষ বিভাজন দেখা যায়। এককোষী জীবের সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য এ প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত কার্যকর, বিভাজনের জন্য কোষের বিশেষ কোনো প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না এবং এই পদ্ধতিতে দ্রুত কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আম্যাইটোসিস ধরনের কোষ বিভাজনে কোষটি পরিপক্ক হলে প্রথমে নিউক্লিয়াসের ভেতর ক্রোমোজমের ডিএনএ'র প্রতিলিপন হয়। কোষের নিউক্লিয়াসটির আকৃতি পরিবর্তন হয়ে ডাম্বেলের আকৃতি ধারণ করে এবং প্রায় মাঝ বরাবর সংকুচিত হতে শুরু করে। সংকোচন শেষে মাতৃকোষের মূল দীর্ঘাকৃতির নিউক্লিয়াসটি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুটি অপত্য নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়ায় বিভাজিত দুইটি নিউক্লিয়াসে ডিএনএ সুনির্দিষ্ট এবং সমানভাবে বিভক্ত হওয়া পুরোপুরি নিশ্চিত নয়, কাজেই দুটি ভিন্ন হতে পারে। নিউক্লিয়াসের সঙ্গে সঙ্গে সাইটোপ্লাজমও মাঝ বরাবর সংকুচিত হতে হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুটি কোষে পরিণত হয়। এ ধরনের বিভাজনে মাতৃকোষের নিউক্লিয়াস ও সাইটোপ্লাজম সরাসরি বিভক্ত হয়ে দুটি অপত্য কোষ তৈরি করে, তাই একে প্রত্যক্ষ কোষ বিভাজন বলে।
4.2 বহুকোষী জীবদেহের কোষ বিভাজন
আমরা বহুকোষী প্রাণী। আমাদের শরীরে রয়েছে প্রায় এক ট্রিলিয়ন কোষ। আমাদের শরীরের বিভিন্ন ধরনের কোষ রয়েছে, যেমন- রক্তের কোষ, পেশি কোষ, ত্বকের কোষ, পাকস্থলীর কোষ ইত্যাদি। প্রতিটি ভিন্ন ধরনের কোষের নিজস্ব গঠন এবং কাজ রয়েছে। এইসব কোষ এসেছে স্টেম সেল বা স্টেম কোষ নামক এক বিশেষ ধরনের কোষ থেকে। সকল প্রাণীর ও উদ্ভিদের স্টেম কোষ প্রয়োজন। সম্পূর্ণরূপে বিকশিত না হওয়া প্রাণীকে ভ্রূণ বলে, ভ্রূণে স্টেম কোষগুলো বিভিন্ন ধরনের কোষে বিকশিত হতে পারে।
সমস্ত স্টেম কোষের কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে: স্টেম কোষ বিভক্ত হয়ে আরও স্টেম কোষ তৈরি করে। স্টেম কোষের বিভিন্ন ধরনের কোষে বিকশিত হওয়ার ক্ষমতাও রয়েছে। একটি স্টেম কোষ দুটি অপত্য কোষে বিভক্ত হয়, প্রতিটি অপত্য কোষ হুবহু মূল কোষের মতো। পরিপক্ক হলে, এই কোষগুলোও বিভাজিত হয়। এভাবেই ভ্রূণে স্টেম কোষের সরবরাহ নিশ্চিত হয়। একটি ক্রমবর্ধমান ভ্রূণ এবং তার অঙ্গগুলোর বিকাশের জন্য প্রচুর স্টেম সেল প্রয়োজন। গবেষণাগারে, কয়েকটি স্টেম সেল দিয়ে শুরু করে, কয়েক মাসের মধ্যে বিজ্ঞানীরা লক্ষ লক্ষ কোষ তৈরি করতে সক্ষম করেছেন। কীভাবে স্টেম কোষ অন্য ধরনের কোষে পরিবর্তিত হয় বিজ্ঞানীরা এই সমস্যা নিয়ে গবেষণা করছেন।
এই পর্যায়ে আমরা বহুকোষী জীবদেহের কোষ বিভাজন সম্পর্কে জানব।
বহুকোষী জীবদেহের দেহকোষ যে প্রক্রিয়ায় বিভাজিত হয় তাকে মাইটোসিস বলে, আবার যৌন জননকারী জীবের জনন মাতৃকোষ যে প্রক্রিয়ায় বিভাজিত হয় তাকে মিয়োসিস বলে। উদ্ভিদদেহের মূল ও কাণ্ডের অগ্রভাগ, ভ্রূণমুকুল, ভ্রূণমূল ও পাতা ইত্যাদি বর্ধনশীল অঞ্চলের টিস্যুতে মাইটোসিস ঘটে, আবার সপুষ্পক উদ্ভিদের পরাগধানী ও ডিম্বকে মিয়োসিস প্রক্রিয়ায় কোষ বিভাজিত হয়।
কোষচক্র
যে কোষ থেকে কোষ বিভাজন শুরু হয় তাকে মাতৃকোষ বলে এবং যে নতুন কোষ সৃষ্টি হয় তাকে অপত্য বা কন্যা কোষ বলা হয়ে থাকে। যে চক্রের মাধ্যমে একটি মাতৃকোষ সৃষ্টি, এর বৃদ্ধি এবং পরবর্তী সময়ে বিভাজিত হয়ে দুটি অপত্য কোষের সৃষ্টি হয় তাকে কোষচক্র বলে। কোষচক্র দুটি প্রধান ধাপে বিভক্ত, বিভাজনরত অবস্থাকে বলা হয় মাইটোসিস পর্যায় (M phase) এবং বিভাজনের পূর্ববর্তী প্রস্তুতি অবস্থাকে বলা হয় ইন্টারফেজ (Interphase) পর্যায়। কোষচক্রের প্রায় 90-95% সময় ব্যয় হয় ইন্টারফেজ পর্যায়ে এবং বাকি 5-10% সময় ব্যয় হয় মাইটোসিস পর্যায়ে। ইন্টারফেজ পর্যায় আবার G1 (Gap 1), S (Synthesis) এবং G2 (Gap 2) এই তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত। একটি কোষ বিভাজনের পর পরের কোষ বিভাজনের চক্রটি শুরু করার জন্য G1 হচ্ছে প্রথম পর্যায়। এই পর্যায়ে কোষের আকার বৃদ্ধি পায় এবং কোষটি তার চারপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে আবার কোষ বিভাজন করবে কি না সেটি নির্ধারণ করে। কোষ বিভাজনের প্রয়োজন না থাকলে কোষটি বিভাজনের প্রস্তুতি না নিয়ে 'বিশ্রাম পর্যায়ে' গিয়ে সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করে। পরবর্তী S পর্যায় হচ্ছে প্রতিলিপন পর্যায়, এই পর্যায়ে ডিএনএ প্রতিলিপন হয়ে প্রতিটি ক্রোমোজমের একটি অবিকল প্রতিলিপি তৈরি হয়। এর পরের G2 পর্যায়ে ডিএনএ প্রতিলিপনে কোনো ভুল হয়ে থাকলে তা সংশোধন করা হয়। এটি মাইটোসিস প্রক্রিয়া শুরু করার আগের পর্যায়। এই পর্যায়ে প্রতিটি ক্রোমোজমের সঙ্গে তার হুবহু প্রতিলিপি সেন্ট্রোমিয়ারে সংযুক্ত থাকে এবং তাদেরকে ক্রোমাটিড বলা হয়। G2 পর্যায় শেষ হওয়ার পর মাইটোসিস নামে প্রকৃত কোষ বিভাজন শুরু হয়।
কীভাবে এই কোষচক্রটি নিয়ন্ত্রিত হয় সেটি জেনে নেয়া দরকার, কারণ যদি কোষচক্র নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই ঘটে, তবে কোষগুলো প্রস্তুত হওয়ার আগেই এক পর্যায় থেকে পরবর্তী পর্যায়ে চলে যেতে পারে। সেটি কোষের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কোষচক্রের স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ ব্যাহত হলে ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগ হতে পারে। স্বাভাবিকভাবে তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কোষচক্রটি নিয়ন্ত্রিত হয় কীভাবে, অর্থাৎ কীভাবে কোষ জানতে পারে কখন বৃদ্ধি পেতে হবে, কখন ডিএনএ'র প্রতিলিপন হতে হবে কিংবা কখন বিভক্ত হতে হবে। কোষচক্র প্রধানত কিছু নিয়ন্ত্রক প্রোটিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এইসব প্রোটিন কোষটি এগিয়ে যাওয়ার আগে পূর্ববর্তী পর্বটি সম্পূর্ণ হয়েছে কি না সেটি নিশ্চিত করে এবং চক্রের পরবর্তী পর্ব শুরু বা বিলম্বিত করার জন্য কোষকে সংকেত দিয়ে চক্রটিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
4.2.1 মাইটোসিস
বহুকোষী জীবদেহ গঠনের জন্য একটি মাতৃকোষ থেকে দুটি অপত্য কোষ তৈরির প্রক্রিয়াকে মাইটোসিস বলে। এ প্রক্রিয়ায় কোষের ভেতরের সাইটোপ্লাজম, নিউক্লিয়াস ও ক্রোমোজম উভয়ই সমানভাবে বিভক্ত হয় এবং ক্রোমোজমের সংখ্যা ও গুণাগুণ মাতৃকোষের অনুরূপ হয়, অর্থাৎ এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি বিভাজন ক্ষমতাসম্পন্ন দেহকোষ বিভাজিত হয়ে হুবহু মাতৃকোষের অনুরূপ দুটি অপত্য কোষ তৈরি করে। এই বিভাজন প্রকৃত নিউক্লিয়াসযুক্ত জীবের দেহকোষে হয়ে থাকে এবং বিভাজনের ফলে কোষের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রাণী ও উদ্ভিদ দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে বৃদ্ধি পায়।
তোমরা ইতোমধ্যে জেনেছ যে আদি-এককোষী জীবে মাইটোসিস হয় না। এছাড়াও বহুকোষী জীবের জনন মাতৃকোষ, প্রাণীর স্নায়ুকোষ, স্তন্যপায়ী প্রাণীর পরিণত লোহিত রক্তকণিকা, অণুচক্রিকা এবং উদ্ভিদের স্থায়ী টিস্যুর কোষে মাইটোসিস বিভাজন দেখা যায় না।
মাইটোসিস কোষ বিভাজনের ধাপসমূহ
মাইটোসিস কোষ বিভাজন একটি ধারাবাহিক পদ্ধতি। এই বিভাজন সাধারণত কয়েকটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে। কোষচক্র পড়ার সময় তোমরা জেনেছ মাইটোসিস প্রক্রিয়া শুরু করার আগে প্রস্তুতি হিসেবে ইন্টারফেজ পর্যায়ে কোষের প্রতিটি ক্রোমোজোমের একটি করে প্রতিলিপি তৈরি হয়। মাইটোসিস প্রক্রিয়ার ধাপগুলো হচ্ছে:
(ক) প্রোফেজ: মাইটোসিসের প্রথম ধাপ হলো প্রোফেজ, এই ধাপে কোষের নিউক্লিয়াস আকারে বড়ো হয়, এই ধাপের শুরুতে কোষের প্রতিটি ক্রোমোজোমের সঙ্গে তার প্রতিলিপি সেন্ট্রোমিয়ারে যুক্ত থাকে এবং যেগুলোকে ক্রোমাটিড বলা হয়। এই পর্যায়ে নিউক্লিয়াসের দুই মেরুতে তন্তুযুক্ত স্পিন্ডল যন্ত্র (Spindle apparatus) গঠিত হতে শুরু করে। এদিকে নিউক্লিয়াসের অভ্যন্তরে ক্রোমাটিডগুলো ক্রমাগত স্প্রিঙয়ের ন্যায় কুণ্ডলিত হয়ে খাটো ও মোটা হতে থাকে। এই পর্যায়ে নিউক্লিয়াসের অভ্যন্তরে নিউক্লিওলাস ও নিউক্লিয়ার মেমব্রেন ক্রমাগত বিলুপ্ত হতে থাকে।
(খ) মেটাফেজ: এ পর্যায়ে নিউক্লিয়াসের অভ্যন্তরে নির্মিত দুই মেরুবিশিষ্ট তন্তুযুক্ত স্পিন্ডল যন্ত্রের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় (বিষুবীয় অঞ্চলে) ক্রোমোজমগুলো বিন্যস্ত হয়। প্রতিটি ক্রোমোজমের সেন্ট্রোমিয়ার বিষুবীয় অঞ্চলে এবং ক্রোমাটিড বাহু দুটি মেরুমুখী হয়ে অবস্থান করে। এ পর্যায়েই ক্রোমোজমগুলোকে সবচেয়ে খাটো ও মোটা দেখায়। এ পর্যায়ের শেষদিকে সেন্ট্রোমিয়ারের বিভাজন ঘটে দুটি অপত্য সেন্ট্রোমিয়ার সৃষ্টি হয় এবং নিউক্লিয়ার মেমব্রেন সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
(গ) অ্যানাফেজ: কোষ বিভাজনের এ পর্যায়ে প্রতিটি ক্রোমোজমের সেন্ট্রোমিয়ার বিভক্ত হওয়ার ফলে ক্রোমাটিড দুটি আলাদা হয়ে পড়ে। ক্রোমাটিড দুইটিকে অপত্য ক্রোমোজম বলে এবং দুটিতেই একটি করে সেন্ট্রোমিয়ার সংযুক্ত থাকে। অপত্য ক্রোমোজমদুটি কোষের মধ্যবর্তী বা বিষুবীয় অঞ্চল থেকে বিপরীত মেরুর দিকে যেতে থাকে। মেরুর দিকে যাওয়ার সময় অপত্য ক্রোমোজমের সেন্ট্রোমিয়ার অগ্রগামী থাকে এবং ক্রোমাটিড বাহুগুলো তাদের পেছন দিকে থাকে। এ পর্যায়ে স্পিন্ডল তন্তু প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। অপত্য ক্রোমোজমগুলো মেরুর কাছাকাছি পৌঁছালেই এ পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।
(ঘ) টেলোফেজ : মাইটোসিস কোষ বিভাজনের শেষ পর্যায় হলো টেলোফেজ। এই পর্যায়ে অপত্য ক্রোমোজমগুলো বিপরীত মেরুতে এসে পৌঁছায়। ক্রোমোজমগুলো ধীরে ধীরে আবার সরু ও লম্বা আকার ধারণ করে। নিউক্লিওলাস এবং নিউক্লিয়ার মেমব্রেনের পুনরাবির্ভাব ঘটে, যার ফলে দুই মেরুতে দুটি অপত্য নিউক্লিয়াস গঠিত হয়। স্পিন্ডলযন্ত্রের কাঠামো ধীরে ধীরে অদৃশ্য হতে থাকে এবং সবশেষে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
(ঙ) সাইটোকাইনেসিস: যে প্রক্রিয়ায় বিভাজনরত কোষের সাইটোপ্লাজম দুভাগে বিভক্ত হয় তাকে সাইটোকাইনেসিস বলে। এই পর্যায়ে নিউক্লিয়াসের বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে কোষের মধ্যবর্তী অংশে নিউক্লিয়ার মেমব্রেনের উভয়পাশ থেকে দুটি খাঁজ সৃষ্টি হয়। এ খাঁজ ক্রমান্বয়ে গভীর হয়ে মিলিত হয়ে দু'টি কোষে বিভক্ত হয়। সাইটোপ্লাজমিক অঙ্গাণুসমূহের সমবন্টন ঘটার ফলে দুটি পরিপূর্ণ অপত্য কোষ (daughter cell) সৃষ্টি হয়।
মাইটোসিস কোষ বিভাজনের গুরুত্ব
জীবদেহের বৃদ্ধি ও কোষ সংখ্যার স্থিতিশীলতার জন্য মাইটোসিস কোষ বিভাজনের গুরুত্ব অপরিসীম। নিচে মাইটোসিস কোষ বিভাজনের উল্লেখযোগ্য গুরুত্বগুলো তুলে ধরা হলো:
1। বহুকোষী জীবে জাইগোট নামক একটিমাত্র কোষ হতে মাইটোসিস বিভাজনের মাধ্যমে দৈহিক বৃদ্ধি সম্পন্ন হয়।
2। মাইটোসিস কোষ বিভাজনের মাধ্যমেই মাতৃকোষের স্বাভাবিক আকার, আকৃতি, আয়তন ও গুণাগুণ অপত্য কোষে বজায় থাকে।
3। মাইটোসিস কোষ বিভাজনের মাধ্যমে কোষের নিউক্লিয়াস এবং সাইটোপ্লাজমের মধ্যকার ভারসাম্য বজায় থাকে।
4। মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় কোষ বিভাজনের কারণে দেহের সব কোষে সমসংখ্যক ও সমগুণধারী ক্রোমোজম থাকে।
5। বহুকোষী জীবদেহে সৃষ্ট যে কোনো ক্ষতস্থান মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় কোষ বিভাজনের মাধ্যমে পূরণ হয়।
6। কিছু কিছু অতিপ্রয়োজনীয় কোষের জীবনকাল সীমিত এগুলো ক্রমাগত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। মাইটোসিস কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় এদের পুনরুৎপাদন ঘটে।
মাইটোসিস কোষ বিভাজনের নিয়ন্ত্রণ
মাইটোসিস কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় একটি থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি এভাবে কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। মাইটোসিস কোষ বিভাজন প্রক্রিয়াটি জীবের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক প্রভাবক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জীবের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় অবস্থায় বিভিন্ন প্রভাবকের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির কারণে কোষের অনিয়ন্ত্রিত বিভাজনের ফলে টিউমার সৃষ্টি হয় যা পরবর্তীকালে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হতে পারে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে বিভিন্ন রোগজীবাণু, রাসায়নিক পদার্থ কিংবা তেজস্ক্রিয়তা ইত্যাদি অনিয়ন্ত্রিত মাইটোসিস কোষ বিভাজনে বাহ্যিক প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। যকৃত, ফুসফুস, মস্তিষ্ক, স্তন, ত্বক, কোলন এরকম প্রাণিদেহের প্রায় সকল অঙ্গে ক্যান্সার হতে পারে।
4.2.2 মিয়োসিস (Meiosis)
যদি জীবকোষে প্রত্যেকটি ক্রোমোজম দুটি করে থাকে তবে তাকে ডিপ্লয়েড (Diploid) বলে। মানুষ ডিপ্লয়েড কারণ মানুষের প্রতিটি কোষে দুটি করে মোট 23 জোড়া ক্রোমোজম রয়েছে। এই 23 জোড়া ক্রোমোজমের 23টি এসেছে বাবার পুংজনন কোষ থেকে এবং অন্য 23টি এসেছে মায়ের স্ত্রীজনন কোষ থেকে। কাজেই এখান থেকে তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ মানুষের অন্যান্য কোষ থেকে এই পুংজনন কোষ এবং স্ত্রীজনন কোষগুলো ভিন্ন, কারণ এখানে 23 জোড়ার বদলে তার অর্ধেক, 23টি করে ক্রোমোজম রয়েছে, এই কোষগুলোকে হাপ্লয়েড (Haploid) বলে। আমরা মাইটোসিস নিয়ে আলোচনা করার সময় দেখেছি অপত্য কোষগুলো হুবহু মাতৃকোষের অনুরূপ হয়, কাজেই মাইটোসিস কোষ বিভাজন দিয়ে আমরা কখনোই ডিপ্লয়েড থেকে হাপ্লয়েড পেতে পারব না, এর জন্য আমাদের ভিন্ন এক ধরনের কোষ বিভাজন পদ্ধতি দরকার এবং এই কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ার নাম হচ্ছে মিয়োসিস।
একটি ডিপ্লয়েড মাতৃকোষ মিয়োসিস প্রক্রিয়ায় কোষ বিভাজনের আগে মাইটোসিসের মতোই কোষচক্রের ইন্টারফেজ পর্যায় দিয়ে যায়, এবং একইভাবে চক্রের ১ বা প্রতিলিপন পর্যায়ে এর প্রতিটি ক্রোমোজম তার আরেকটি করে প্রতিলিপি তৈরি করে।
মিয়োসিস কোষ বিভাজনের ধাপসমূহ
মিয়োসিস কোষ বিভাজন প্রক্রিয়াকে মিয়োসিস-1 এবং মিয়োসিস-2 এই দুটি প্রধান পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম মিয়োসিস-1 পর্যায়ে প্রতি জোড়া ক্রোমোজম থেকে একটি করে ক্রোমোজোম নিয়ে দুটি কোষ তৈরি হয়। দ্বিতীয় বিভাজনটি মাইটোসিস বিভাজনের অনুরূপ। অর্থাৎ, প্রথম বিভাজনে উৎপন্ন প্রতিটি কোষ পুনরায় বিভাজিত হয়ে দুটি করে সর্বমোট চারটি অপত্য কোষের সৃষ্টি করে। মিয়োসিস-1 পর্যায়কে প্রোফেজ-1, মেটাফেজ-1, আনাফেজ-1 এবং টেলোফেজ-1 এই চারটি মূল পর্যায়ে ভাগ করা যায়। একইভাবে মিয়োসিস-2 পর্যায়কে প্রোফেজ-2, মেটাফেজ-2, আনাফেজ-2 এবং টেলোফেজ-2 এই চারটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়।
পরের পৃষ্ঠায় দেওয়া ছবিতে একই ধরনের এক জোড়া ক্রোমোজম সংবলিত একটি ডিপ্লয়েড কোষের মিয়োসিস-1 এবং মিয়োসিস-2 এর বিভিন্ন পর্যায়ে রূপান্তর দেখানো হয়েছে। মানুষের বেলায় এক জোড়ার পরিবর্তে 23 জোড়া ক্রোমোজম দিয়ে শুরু হতো। মিয়োসিস প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে কোষচক্রের ইন্টারফেজ পর্যায়ে ডিপ্লয়েড কোষের একই ধরণের ক্রোমোজম দুইটি আরেকটি করে প্রতিলিপি তৈরি করে।
প্রোফেজ-1: ক্রোমোজমগুলো নিজেদের মধ্যে জোড় বাধে এবং পরস্পরের মধ্যে ডিএনএ বিনিময় করে (ক্রসিং ওভার)।
মিয়োসিস কোষ বিভাজনের গুরুত্ব
মিয়োসিস কোষ বিভাজনের গুরুত্ব অপরিসীম, নিচে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হলো:
1। ডিপ্লয়েড জীবে মিয়োসিসের ফলে গ্যামিট বা জনন কোষ তৈরি হয়। যৌন প্রক্রিয়ায় জনন কোষের মিলনের মাধ্যমেই বংশবিস্তার হয় বলে মিয়োসিস কোষ বিভাজন ব্যতিত জীবের বংশবৃদ্ধি সম্ভব নয়।
2। বংশানুক্রমে প্রজাতির স্বকীয়তা রক্ষা করার জন্য ক্রোমোজম সংখ্যা সঠিক থাকতে হয়, মিয়োসিস কোষ বিভাজনে ক্রোমোজম সংখ্যা অপরিবর্তিত থাকে।
3। মিয়োসিস কোষ বিভাজনে জননকোষের ক্রসিং ওভারের ফলে জীবজগতে বৈচিত্রের সৃষ্টি হয়েছে।
4.ও বংশগতি নির্ধারণে ক্রোমোজম ও ডিএনএ'র ভূমিকা
তোমাদের কী কী দৈহিক বৈশিষ্ট্য আছে? তোমাদের কারো কারো চুল কোঁকড়ানো, আবার কারো চুল সোজা, কেউ লম্বা আবার কেউ খাটো, কারো চুল কালো আবার কারো চোখ বাদামি। আমাদের দেহে এই যে নানা রকম বৈশিষ্ট্য, সেগুলো আমাদের শরীরের ক্রোমোজমে থাকা ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড) বহন করে থাকে। জীবের যে কোনো বৈশিষ্ট্যের জন্য প্রয়োজনীয় সকল তথ্য ডিএনএ'তে সংরক্ষিত থাকে। ডিএনএ-ই মাতা-পিতার বৈশিষ্ট্য সরাসরি তার সন্তান-সন্ততিদের মাঝে নিয়ে আসে, যেটি বংশগতি নামে পরিচিত। কাজেই তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ বংশগতির ধারা রক্ষা করার মূল ভূমিকা পালন করে ক্রোমোজমে থাকা মানব দেহের বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী ডিএনএ। অর্থাৎ বংশগতির ধারা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য ডিএনএ-ই বংশগতির ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে। ক্রোমোজমে অবস্থিত এই ডিএনএ মিয়োসিস কোষ বিভাজনের সময় সরাসরি পিতামাতা থেকে পরবর্তী বংশধরে স্থানান্তরিত হয়। সেজন্য ক্রোমোজমকে বংশগতির ভৌত ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পরবর্তী শ্রেণিতে তোমরা এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পারবে।
পুরুষ ও নারী সন্তান পুংজনন কোষ ও স্ত্রীজনন কোষের 22টি ক্রোমোজোম অভিন্ন, 23তম ক্রোমোজোমটি পুংজনন কোষ ও স্ত্রীজনন কোষের জন্য ভিন্ন হতে পারে। স্ত্রীজনন কোষের বেলায় সেটি সবসময়েই X, পুংজনন কোষের বেলায় সেটি কখনো X কখনো Y। সে কারণে পুংজনন কোষ ও স্ত্রীজনন কোষ এক সাথে মিলিত হওয়ার পর ক্রোমোজোমের 23 তম জোড়াটি XX কিংবা XY হতে পারে। যদি সেটি XX হয় তাহলে সন্তানটি হয় নারী এবং 1 পুরুষ ও নারী সন্তান 6 7 8 13 2 3 10 4 5 9 11 12 14 15 16 17 18 1 19 20 21 22 X Y XY হলে সন্তানটি হয় পুরুষ। সংযুক্ত ক্রোমোজোমের ছবিগুলো লক্ষ করলে তোমরা দেখতে পাবে X এবং Y ক্রোমোজমের আকার ভিন্ন। Y ক্রোমোজম X ক্রোমোজোমের তুলনায় অনেক ক্ষুদ্র। |
আরও দেখুন...