1.1 দূরত্ব ও সরণ (Distance and Displacement):
কোনো বস্তুর গতি বলতে আমরা সময়ের সাথে বস্তুটির অবস্থানের পরিবর্তন বুঝিয়ে থাকি। নানাভাবে অবস্থানের পরিবর্তন হতে পারে-দ্রুত কিংবা ধীর, সরল অথবা বক্র, সম বা অসম ইত্যাদি। গতি যেরকমই হয়ে থাকুক, সেটি ব্যাখ্যা করতে হলে সময়ের সঙ্গে আমাদের বস্তুটির অবস্থান (position) সুনির্দিষ্টভাবে পরিমাপ করতে হয়। সেটি করার জন্য আমাদের প্রয়োজন একটি স্থির বিন্দুর, যার সাপেক্ষে আমরা অবস্থান পরিমাপ করব। তোমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছ প্রকৃত স্থিরবিন্দু পাওয়া সহজ নয়, পৃথিবীতে একটি বিন্দুকে আমরা স্থির ধরে নিতে পারি কিন্তু পৃথিবীটা শুধু যে নিজের অক্ষে ঘুরছে তা নয়, সেটি সূর্যকে ঘিরেও ঘুরছে। আমাদের পুরো সৌরজগৎ আবার আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র ঘিরে ঘুরছে এবং পুরো গ্যালাক্সিটিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রসারণের কারণে ছুটে চলছে। তবে আমাদের দৈনন্দিন কাজের জন্য আমরা আমাদের আশপাশের কোনো একটি বিন্দুকে স্থির ধরে নিয়ে তার সাপেক্ষে বস্তুর অবস্থান পরিমাপ করতে পারি। এই বিন্দুটিকে বলা হয় প্রসঙ্গ বিন্দু, এবং এই প্রসঙ্গ বিন্দুটি যে কাঠামোর অংশ তাকে বলা হয় প্রসঙ্গ কাঠামো। শুধু তাই নয় প্রয়োজনে আমরা চলমান একটি কাঠামোকেও প্রসঙ্গ কাঠামো হিসেবে বিবেচনা করতে পারি তোমরা নবম শ্রেণিতে আপেক্ষিক সূত্র পড়ার সময় সেটি দেখতে পাবে।
প্রসঙ্গ বিন্দু নির্দিষ্ট করা হলে আমরা তার সাপেক্ষে একটি বস্তুর অবস্থান পরিমাপ করতে পারব। ধরা যাক একটা মাঠে একটা খুঁটির সঙ্গে একটা ছাগল বেঁধে রাখা আছে, এখানে খুঁটিটি হচ্ছে প্রসঙ্গ বিন্দু। যদি বলা হয় ছাগলটি খুঁটি থেকে দুই মিটার দূরে বসে আছে তাহলে কিন্তু ছাগলটি ঠিক কোথায় আছে তুমি বলতে পারবে না। কারণ ছাগলটি খুঁটি থেকে দুই মিটার দূরে যে কোনো দিকে থাকতে পারে! যদি বলা হয় ছাগলটি খুঁটি থেকে দক্ষিণ দিকে দুই মিটার দূরে বসে আছে তাহলে প্রসঙ্গ বিন্দুর সাপেক্ষে ছাগলটি কোথায় আছে তুমি সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারবে। অর্থাৎ একটি বস্তুর অবস্থান জানতে হলে বস্তুটি প্রসঙ্গ বিন্দুর সাপেক্ষে একই সঙ্গে কোন 'দিকে' এবং কত 'দূরে' আছে দুটিই জানতে হবে।
একটি বস্তুর গতি সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে বস্তুর অবস্থান ছাড়াও দূরত্ব (Distance) ও সরণ (Displacement) এই দুটি রাশি বলতে কী বোঝানো হয় সেটি বুঝতে হবে। চলমান বস্তুর বেলায় একটি বস্তু যেটুকু জায়গা অতিক্রম করে তার দৈর্ঘ্যের পরিমাণ হচ্ছে দূরত্ব। সেটি সরল রেখায় হতে পারে আবার আঁকাবাঁকাও হতে পারে। দূরত্বের একটা পরিমাণ আছে কিন্তু কোনো দিক নেই। অন্যদিকে বিজ্ঞানের ভাষায় সরণ হচ্ছে একটি বস্তু আগের অবস্থান থেকে নতুন অবস্থানে মোট কতটুকু সরে গেছে তার পরিমাপ। তুমি যদি উত্তর দিকে 10 কিলোমিটার গিয়ে আবার দক্ষিণ দিকে 5 কিলোমিটার ফিরে আস তাহলে সব মিলিয়ে তুমি 15 কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করেছ কিন্তু তোমার সরণ হয়েছে উত্তর দিকে মাত্র 5 কিলোমিটার। সরণের বেলায় সব সময় দিক নির্দিষ্ট করে দিতে হয়। নিচের ছবিতে কয়েকটা দূরত্ব এবং সেই একই দূরত্বে জন্য সরণের পরিমাপের উদাহরণ দেওয়া হলো।
(১) ধাম দিকের ছবিতে একটি ছেলে তার শুরুর অবস্থান থেকে রওনা দিয়ে কিমি হেঁটে একটি গাছের কাছে গিয়ে দিক পরিবর্তন করে। কিমি হেঁটে একটি ঘরের কাছে গিয়েছে। সেখানে আবার দিক পরিবর্তন করে। কিমি হেঁটে একটি জলাশয়ের কাছে গিয়েছে। সব মিলিয়ে সে (24-3) 9 কিমি দূরত্ব অতিক্রম করেছে। তার শুরুর অবস্থান থেকে জলাশয়ের সরণ তীর চিহ্নিত দিকে ও কিমি। (b) এই ছবিটিতে একটি শহরের উত্তর-দক্ষিণ এবা পূর্ব-পশ্চিম বরাবর উভয় দিকে । কিমি দূরে দূরে অবস্থিত সমান্তরাণ রাস্তা দেখানো হয়েছে। একজন সেই রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে A থেকে B আসতে ১৫ কিমি দূরত্ব অতিক্রম করেছে, সরণ হয়েছে পূর্ব দিকে এ কিমি। (c) বাসা থেকে জলাশয়ের পথের দূরত্ব ও কিমি। সরণ তীর চিহ্নিত দিকে কিমি।
1.2 দ্রুতি ও বেগ (Speed and Velocity)
তোমার আশপাশে তাকালেই দেখবে পথে-ঘাটে গাড়ি, বাস, সাইকেল কিংবা পথচারী চলছে। সবাই কিন্তু একইভাবে চলছে না, কেউ অনেক দ্রুত, কেউ একটু ধীরে, যেটি বোঝানোর জন্য আমরা বলে থাকি কারও বেগ বেশি কিংবা কারও বেগ কম। কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায় বেগ কথাটির একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে এবং বেগ ছাড়া দ্রুতি নামেও একটি রাশি রয়েছে। প্রথমে দ্রুতি বলতে কী বোঝানো হয় সেটি বলা যাক। আমরা এইমাত্র দূরত্ব এবং সরণ এই দুটি রাশির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, একক সময়ে অতিক্রান্ত দূরত্ব হচ্ছে দ্রুতি। অর্থাৎ কোনো বস্তু যদি। সময়ে d দূরত্ব অতিক্রম করে তাহলে তার দ্রুতি হচ্ছে: v=d/t
যেহেতু দূরত্বের কোনো নির্দিষ্ট দিক নেই তাই দ্রুতিরও কোনো নির্দিষ্ট দিক নেই, শুধু পরিমাণ আছে।
|
উদাহরণ: আমাদের আগের ছবিতে দেওয়া উদাহরণে দূরত্বগুলো অতিক্রম করতে কত সময় লেগেছে সেটি বলা হয়নি। যদি ধরে নেওয়া যায় (a), (b) এবং (c) দূরত্ব অতিক্রম করতে যথাক্রমে 2 ঘণ্টা, 30 মিনিট এবং 1 ঘণ্টা সময় লেগেছে তাহলে কোনটির জন্য দ্রুতি কত হয়েছে?
উত্তর: (a) 2 ঘণ্টা সময়ে অতিক্রান্ত দূরত্ব 9 km, কাজেই দ্রুতি:
(b) 30 মিনিট সময়ে অতিক্রান্ত দূরত্ব 12 km, কাজেই দ্রুতি:
(c) 1 ঘণ্টা সময়ে অতিক্রান্ত দূরত্ব 5 km, কাজেই দ্রুতি: 5 km/h
তোমরা দেখতেই পারছ কোনো বস্তুর দ্রুতি বের করার সময় আমরা সেটা কোনদিকে যাচ্ছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাই না।
তবে এখানে মনে রাখতে হবে এই দ্রুতিটি হচ্ছে পুরো সময়ের একটি গড় দ্রুতি, আমরা কিন্তু তাৎক্ষণিক দ্রুতি জানি না। বিশেষ অবস্থায় বস্তুটি যদি সম-দ্রুতিতে যায় শুধু তাহলে তার গড় দ্রুতির পরিমাণ আর তাৎক্ষণিক দ্রুতির মান সমান হবে।
আমরা যদি দ্রুতির ব্যাপারটা ঠিকভাবে বুঝে থাকি তাহলে এবারে খুব সহজেই বেগ বলতে কী বোঝায় সেটি বুঝে যাব। একটা চলন্ত বস্তুর দ্রুতির সাথে সঙ্গে সঙ্গে যদি তার দিকটাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় তাহলে সেটাকে বলে বেগ। অর্থাৎ 'একটি নির্দিষ্ট দিকে' একক সময়ে একটা বস্তু যেটুকু দূরত্ব অতিক্রম করে সেটা হচ্ছে তার বেগ। কাজেই কোনো কিছুর বেগ বের করতে হলে তার পরিমাণের সঙ্গে সঙ্গে দিকটাও বের করে নিতে হয়। যদি আমরা শুধু সরল রেখায় গতি নিয়ে মাথা ঘামাই তাহলে বেগ আর দ্রুতির মাঝে কোনো পার্থক্য নেই, তখন বেগের পরিমাণটাকে আমরা বলব দ্রুতি।
মনে রেখ দ্রুতির বেলায় যেরকম বলেছিলাম, আমরা যদি অতিক্রান্ত দূরত্বকে সময় দিয়ে ভাগ করে যে দ্রুতি বের করি সেটা হচ্ছে ঐ সময়ের গড় দ্রুতি, বেগের বেলাতেও সেটা সত্যি। আমরা যদি কোনো একটি নির্দিষ্ট দিকে ধাবমান একটি বস্তুর সরণকে সময় দিয়ে বেগ বের করি তাহলে আমরা কিন্তু বস্তুটির তাৎক্ষণিক বেগ বের করি না, আমরা তার ওই সময়ের গড় বেগ বের করি। শুধু বস্তুটি যদি সমবেগে যায় তাহলে তার তাৎক্ষণিক বেগ আর গড় বেগের মান সমান হবে।
মনে রেখো কোন বস্তু যখন গতিশীল অবস্থায় দিক পরিবর্তন করে তখন তার গড় নেওয়া হলে সেটির পরিমাণ আমাদের বিভ্রান্তিতে ফেলে দিতে পারে। ধরা যাক একটি বস্তু চলমান থেকে যেখান থেকে শুরু করেছিল ঠিক সেখানে ফিরে এসেছে, তাহলে বস্তুটির মোট সরণের মান শূন্য। কাজেই মোট সরণকে মোট সময় দিয়ে ভাগ করে গড় বেগ বের করা হলে তার পরিমাণ হবে শূন্য, যদিও চলমান অবস্থায় বস্তুটির বেগ কখনোই শূন্য ছিল না!
2.3 ত্বরণ ও মন্দন (Acceleration and Deceleration)
তোমরা তোমাদের চারপাশে অনেক ধরনের গতি দেখেছ, কোনটা সোজা যাচ্ছে, কোনটা বাঁকা হয়ে যাচ্ছে, কোনটা বৃত্তাকারে ঘুরছে আবার কোনটা সামনে পিছনে কিংবা উপরে নিচে দুলছে। আপাতত এদের ভেতরে সবচেয়ে সহজ যে গতি-যেখানে কিছু একটা সরল রেখায় যাচ্ছে-আমরা তার মাঝে আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব। তোমরা এর মাঝে জেনে গেছ এই সরল রেখার গতিতে দ্রুতি আর বেগের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই, এবং যেহেতু সরল রেখায় যাচ্ছে তাই দিকটিও একেবারে সুনির্দিষ্ট, সেজন্য আমরা যখন বেগের কথা বলব তখন আলাদাভাবে আর আমাদের বেগের দিকটি উল্লেখ করারও কোনো প্রয়োজন নেই।
গতিশীল বস্তুর বেগ বেড়ে যাওয়া কিংবা কমে যাওয়া একটি অত্যন্ত পরিচিত বিষয়। তোমরা নিশ্চিতভাবেই সাইকেল, গাড়ি, বাস কিংবা ট্রেনে উঠেছ যেখানে স্থির অবস্থা থেকে বেগ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে, কিংবা উল্টোটা ঘটেছে, অর্থাৎ বেগ ধীরে ধীরে কমে এসেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেগ বেড়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে বলে ত্বরণ এবং কমে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে বলে মন্দন।
অবস্থানের পরিবর্তন মাপতে আমরা 'সরণ' ব্যবহার করেছি। আবার সেই সরণ দ্রুত না ধীরে ঘটছে, সেটি মাপতে গিয়ে আমরা 'বেগ' পেয়েছি। ঠিক একইভাবে বেগের পরিবর্তন কি দ্রুত হচ্ছে না ধীরে হচ্ছে, এটি পরিমাপ করতে গিয়ে আমরা ত্বরণ এবং মন্দন পেয়েছি। অর্থাৎ একক সময়ে বেগের পরিবর্তন হচ্ছে ত্বরণ। যদি প্রথমে কোনো একটা বস্তুর বেগ থাকে। এবং। সময় পরে তার বেগ হয় । তাহলে বেগের পরিবর্তন হচ্ছে - এবং তার ত্বরণ হবে,
বেগ সম্পর্কে বলতে হলে যেরকম তার পরিমাণ এবং দিক দুটিই নির্দিষ্ট করে দিতে হয় ঠিক সেরকম ত্বরণের বেলাতেও তার পরিমাণ এবং দিক দুটিই নির্দিষ্ট করে দিতে হয়।
একক সময়ে একটি বস্তুর বেগ কতটুকু পরিবর্তিত হলো তাকে বলে "ত্বরণ'। ত্বরণ প্রকাশে আমরা ব্যবহার করি পূর্ব দিকে 2 m/s (পড়া হয় দুই-মিটার-পার-সেকেন্ড- স্কয়ার) কিংবা নিচের দিকে 9.8 m/s² ইত্যাদি। শুরুর চেয়ে শেষের বেগ বেশি হলে বেগ বৃদ্ধি পায় বা পজিটিভ পরিবর্তন ঘটে, তখন হয় পজিটিভ ত্বরণ। শুরুর চেয়ে শেষের বেগ কম হলে বেগ হ্রাস পায় বা নেগেটিভ পরিবর্তন ঘটে, তখন হয় নেগেটিভ ত্বরণ। নেগেটিভ ত্বরণকে অনেক সময় মন্দন' বলা হয়। |
1.3.1 ত্বরণ কেমন করে হয়?
আমরা এইমাত্র দেখেছি নির্দিষ্ট সময়ে বেগের বেড়ে যাওয়া আর কমে যাওয়ার পরিমাপ করে আমরা তার নাম দিয়েছি ত্বরণ আর মন্দন। কিন্তু আমরা এখনো বলিনি ত্বরণ বিষয়টি কেন ঘটে কিংবা কেমন করে ঘটে-এক কথায় কেন বেগের পরিবর্তন হয়। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কিন্তু নিয়মিতভাবে বেগের বেড়ে যাওয়া কিংবা কমে যাওয়ার ব্যাপারটি দেখছি। তুমি স্থির অবস্থা থেকে হাঁটতে শুরু করলে, তোমার বেগের পরিবর্তন হলো। থেমে থাকা বাস কিংবা ট্রেনে বসে আছো এক সময় সেটা চলতে শুরু করলো, আবার বেগের পরিবর্তন হলো। একটা সাইকেলে উঠে প্যাডেলে চাপ দিয়ে তুমি সেটা চালাতে শুরু করলে, তুমি তোমার বেগের পরিবর্তন করলে কিংবা একজন বেপরোয়া মোটরবাইক চালক তার চলন্ত বাইক দিয়ে লাইটপোস্টে ধাক্কা দিয়ে বাইকসহ নিচে পড়ে থেমে গেল-আবার তার বেগের পরিবর্তন হলো।
একটুখানি চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে কখনো নিজের থেকে বেগের পরিবর্তন হয় না, সব সময়েই তার পিছনে কোনো একটা কারণ থাকতে হয়, সোজা ভাষায় বেগের পরিবর্তন করার জন্য কিছু একটা করতে হয়। বেগের পরিবর্তন করার জন্য যেটা করতে হয় সেটা হচ্ছে বল প্রয়োগ। বাইরে থেকে বল প্রয়োগ না করে কখনো কোনো বস্তুর বেগের পরিবর্তন করা যায় না। সাইকেল চালানোর জন্য প্যাডেলে চাপ দিয়ে বল প্রয়োগ করা হয়েছে, বাস বা ট্রেন চালানোর জন্য সেগুলোর ইঞ্জিন চালু হয়ে বল প্রয়োগ করেছে, রাস্তার লাইটপোস্ট বেপরোয়া বাইকচালকের উপর বল প্রয়োগ করে তাকে থামিয়েছে।
এবারে বল (Force) বলতে কী বোঝায় সেটা জানার চেষ্টা করি। বল প্রয়োগের সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হচ্ছে কোনো কিছুকে ধাক্কা দেওয়া কিংবা টেনে আনা। আবার কোনো বস্তুকে উপর থেকে ছেড়ে দিলে সেটি নিচের দিকে পড়তে থাকে, এটিও ঘটে আরেকটি বলের কারণে, যার নাম মহাকর্ষ। তোমরা যারা চুম্বক নিয়ে খেলেছ তারা নিশ্চয়ই সেটা দিয়ে লোহাকে আকর্ষণ করা টের পেয়েছ, সেটি এক ধরনের বল তার নাম চৌম্বকীয় বল। শীতের দিনে চুলে চিরুনি ঘষে সেটা দিয়ে তোমরা নিশ্চয়ই কাগজের টুকরাকে আকর্ষণ করে দেখেছ, সেটা এক ধরনের বল, সেটি হচ্ছে স্থির বিদ্যুতের বল, বিজ্ঞানী কুলম্বের নাম অনুসারে তাকে বলে কুলম্বের বল। তুমি যখন কিছু একটা গড়িয়ে দাও চলতে চলতে সেটা থেমে যায়, যে বলের জন্য সেটা থেমে যায় তার নাম হচ্ছে ঘর্ষণ বল। কাজেই চোখ-কান খোলা রাখলে তোমরা এরকম অনেক ধরনের বলের খোঁজ পাবে।
তবে বলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হচ্ছে, যদি কখনো কোনো কিছুর বেগের পরিবর্তন করতে হয় তাহলে অবশ্যই সেখানে বল প্রয়োগ করতে হবে। বল প্রয়োগ না করে কখনোই তোমরা বেগের পরিবর্তন করতে পারবে না, বেগ বাড়াতেও পারবে, না কমাতেও পারবে না। এর উল্টোটাও কিন্তু সত্যি, যদি কখনো দেখ কোনো কিছুর বেগের পরিবর্তন হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে বুঝে নেবে যে নিশ্চয়ই সেখানে কোনো না কোনোভাবে বল প্রয়োগ করা হয়েছে।
এবারে তোমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করা যাক। বেগের মান কিংবা দ্রুতির পরিবর্তন হলে অবশ্যই বেগের পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ বল প্রয়োগ না করে বেগের মান কিংবা দ্রুতির পরিবর্তন করা যাবে না। দ্রুতির কোনো সুনির্দিষ্ট দিক থাকে না কিন্তু বেগের সুনির্দিষ্ট দিক থাকে। কাজেই কোনো গতিশীল বস্তুর দ্রুতির পরিবর্তন না করে শুধু দিক পরিবর্তন হলে কী তার বেগের পরিবর্তন হয়? সেটাকে কী আমরা ত্বরণ বলতে পারি? আমরা এখন সেটি আলোচনা করব।
1.3.2 বক্ষ রেখায় ত্বরণ
আমরা একটি বস্তুকে দড়ি দিয়ে বেঁধে যদি ছবিতে দেখানো উপায়ে মাথার উপরে ঘুরাতে থাকি তাহলে সেই বস্তুটির কি কোনো ত্বরণ হয়? যদি ত্বরণ হয়ে থাকে তাহলে তার মান কত?সময়ের সাথে বেগের পরিবর্তনের হার হচ্ছে ত্বরণ। বৃত্তাকার পথে ঘুরতে থাকা একটি বস্তুর বেগের 'দিক' প্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে, যার অর্থ এর বেগটিও প্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে। কাজেই বৃত্তাকার পথে ঘুরতে থাকা একটি বস্তু হচ্ছে একটি চমকপ্রদ উদাহরণ যেখানে একটি বস্তুর দ্রুতির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না কিন্তু বেগের পরিবর্তন হচ্ছে, কাজেই এখানে অবশ্যই একটি ত্বরণ রয়েছে। আমরা জানি ত্বরণ সৃষ্টি করা সম্ভব বস্তুটির উপরে কোনো এক ধরনের বল প্রয়োগ করে। তোমরা যারা ছবিতে দেখানো উপায়ে একটি বস্তুকে দড়িতে বেঁধে মাথার উপরে ঘোরাতে চেষ্টা করেছ তারা সবাই জান তোমাকেই হাত দিয়ে টেনে ধরে রেখে বস্তুটিকে ঘোরাতে হয় বা বস্তুটির উপর কেন্দ্রমুখী একটা বল প্রয়োগ করতে হয় যেটি কেন্দ্রমুখী একটি ত্বরণের সৃষ্টি করে।
এই ঘুরন্ত বস্তুটির গতি ব্যাখ্যা করতে শুধু দুটি রাশির প্রয়োজন, দড়ির দৈর্ঘ্য (যা আসলে কেন্দ্র থেকে দূরত্ব) এবং পাথরের বেগ। কাজেই ত্বরণটিও নিশ্চয়ই এই দুটি রাশি দিয়েই গঠিত। একটুখানি ক্যালকুলাস জানলে আমরা খুব সহজেই এই ত্বরণের রূপটি বের করে ফেলা যায় কিন্তু যেহেতু সেটি তোমাদের এখনো জানার সৌভাগ্য হয়নি তাই তোমাদের সরাসরি ত্বরণটি জানিয়ে দেওয়া যাক। বেগের মান যদি আর দড়ির দৈর্ঘ্য যদি হয় তাহলে কেন্দ্রমুখী ত্বরণ হচ্ছে,
আমরা এই সহজ সম্পর্কটা যদি জেনে রাখি তাহলে দেখবে এটি ব্যবহার করে আমরা বিজ্ঞানের কত চমকপ্রদ বিষয় বের করে ফেলতে পারব। তোমরা দেখবে শুধু এই সূত্রটা ব্যবহার করে অন্য কোনো কিছু না জেনেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পৃথিবী থেকে কত উপরে ঘুরপাক খাচ্ছে সেটা তুমি বের করে ফেলতে পারবে!
1.4 গতির সমীকরণ (Equations of Motion)
আগের শ্রেণিতে তোমাদের 'সরল সমীকরণ' সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। এই পরিচ্ছেদে সরণ, বেগ ও ত্বরণকে ব্যবহার করে কয়েকটি গতির সমীকরণ গঠন করা হবে। এবারেও আমরা শুধু সরল রেখায় গতি নিয়ে আলোচনা করব।
1.4.1 বেগের সমীকরণ
মনে করো কোনো গতিশীল বস্তুর বেগ শুরুতে ছিল u, a ত্বরণ থাকার কারণে। সময় পার হওয়ার পর বস্তুটির বেগ বেড়ে হয়েছে, আমরা একটু আগেই দেখেছি তাহলে বস্তুর ত্বরণটির জন্য লিখতে পারি:
যত সহজ সরলই হয়ে থাকুক না কেন এটি একটি সমীকরণ। এর বামপক্ষ আর ডানপক্ষের মান যেহেতু সমান, তাই আমরা চাইলেই বামপক্ষ ডানদিকে আর ডানপক্ষ বামদিকে লিখতে পারি:
এবারে এর দুই পাশেই। দিয়ে গুণ করি :
তাহলে সমীকরণটি হয়ে যাবে :
এবার, দুই পাশেই u যোগ করি : v = u + at
এটি হচ্ছে গতির প্রথম একটি সমীকরণ। তুমি যদি কোনো বস্তুর শুরুর বেগ (u) এবং ত্বরণ (a) জানো তাহলে একটি নির্দিষ্ট সময় (1) পরে তার বেগ (ⅳ) কত হবে এই সমীকরণটির দিয়ে তুমি সেটি বের করে ফেলতে পারবে। এখন আমরা এটি ব্যবহার করে হিসাবপত্র করতে পারব।
উদাহরণ: একটি গাড়ির ইঞ্জিন 2 m/s² ত্বরণ সৃষ্টি করে, তুমি গাড়িটিকে 3 m/s বেগে গতিশীল দেখলে। 4s পরে এটির বেগের মান কত হবে?
উত্তর: এখানে প্রথমেই আমরা দেখে নেব, কী কী তথ্য জানা আছে। গাড়ির ত্বরণ 2 m/s² যা a এর মান। শুরুতে এটি 3 m/s বেগে গতিশীল, অর্থাৎ এটি হল u, 4s হল সময়ের পরিমাণ যা ৮, আর এই সময় পরে পরিবর্তিত বেগের মান অর্থাৎ জানতে চাওয়া হয়েছে।
তাহলে, আমরা শিখেছি v=u+at
v = 3+ 2 x 4 = 11 m/s
অর্থাৎ, হিসেব বলছে 4 s পরে গাড়িটি 11 m/s বেগে গতিশীল থাকবে।
1.4.2 দূরত্বের সমীকরণ
গতিশীল বস্তু সম্পর্কে কিছু জানতে হলে প্রথমেই আমাদের জানার কৌতূহল হয় একটি নির্দিষ্ট সময়ে বস্তুটি কতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করেছে। একটি বস্তু যদি সমবেগে যায় তাহলে বিষয়টা খুবই সোজা, বেগকে সময় দিয়ে গুণ দিলেই অতিক্রান্ত দূরত্ব পেয়ে যাই। অর্থাৎ বস্তুর বেগ যদি হয়, সেটি যদি । সময় ধরে গতিশীল থাকে তাহলে অতিক্রান্ত দূরত্ব বা সরণ S' হচ্ছে: S = Vt
কিন্তু বস্তুটির যদি একটা ত্বরণ থাকে তাহলে এটি সমবেগ নয়, প্রতি মুহূর্তেই বেগের পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে তখন আর এই সোজা সূত্রটা ব্যবহার করতে পারব না। কিন্তু বস্তুটি যদি সমত্বরণে গতিশীল হয় অর্থাৎ বস্তুটির ত্বরণের কোনো পরিবর্তন না হয়, তাহলে আমরা উপরের সূত্রে বেগের পরিবর্তে গড়বেগ ব্যবহার করতে পারি। প্রথমে গড়বেগ বের করে নিই:
কিন্তু আমরা একটু আগেই -এর জন্য একটা সমীকরণ লিখেছিলাম, সেটা এখানে ব্যবহার করা যাক:
কাজেই গড়বেগ হচ্ছে:
যেহেতু অতিক্রান্ত দূরত্ব S = Vt, কাজেই আমরা লিখতে পারি :
কিংবা :
আমরা গতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমীকরণ বের করে ফেলেছি। এটিকে ব্যবহার করে হিসাবপত্র করে দেখা যেতে পারে।
1.4.3 গতির তৃতীয় সমীকরণ
আগের দুইটি সমীকরণেই কিন্তু, সময় বা। রাশিটি আছে। আমরা চাইলে দুটি সমীকরণ একত্র করে তৃতীয় একটি সমীকরণ গঠন করতে পারি যেখানে সময় বা। রাশিটি থাকবে না। আমরা v=u+at থেকে শুরু করতে পারি, এর ডানপক্ষে। আছে। আবার,
এই সমীকরণের ডানপক্ষে আছে।, কাজেই v = u + at সমীকরণটিকে বর্গ করে ব্যবহার করার চেষ্টা করতে পারি।প্রথমে সমীকরণের দুপাশেই বর্গ করে দেখি: v= (u + at)²
বা,
বা,
বা,
যেহেতু Sut + 1½ at², এটি ব্যবহার করে এবারে আমরা ।-বিহীন গতির একটি সমীকরণ পেয়ে যেতে পারি:
সহজ সরল এই সমীকরণটি মনে রেখো, কারণ এর মাঝে কিছু চমকপ্রদ বিজ্ঞান বের হওয়ার অপেক্ষায় লুকিয়ে আছে!
এবারসমীকরণটি একটি সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।
1.4.5 গতির সমীকরণের নেখচিত্র:
আমরা তিনটি সমীকরণ বের করে সেগুলোর সাহায্যে একটু সত্যিকারের হিসাবপত্র পর্যন্ত করে দেখেছি। এই বেলা আমরা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখে নিই, সেটি হচ্ছে সমীকরণকে লেখচিত্র দিয়ে প্রকাশ করা। লেখচিত্র কীভাবে আঁকতে হয় সেটি তোমাদের অনুশীলনী বইটিতে শিখিয়ে দেওয়া হবে, তখন তোমরা বিজ্ঞানের সমস্যা সমাধানের নতুন আরেকটি পদ্ধতি জেনে যাবে। এই অধ্যায়ে আমরা গতির যে তিনটি সমীকরণ বের করেছি সেগুলোর জন্য এখানে তোমাদের তিনটি লেখচিত্র দেখানো হয়েছে। তোমরা এখান থেকে অনেক তথ্য বের করে আনতে পারবে।
প্রথম লেখচিত্রটিতে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে বস্তুর বেগ সময়ের সাথে সরল রেখায় পরিবর্তিত হয়। লেখচিত্রে শুরুর বেগ (u) এবং ত্বরণের (a) মান উপরে লিখে দেওয়া হয়েছে। যদি দেওয়া না-ও থাকত আমরা এই লেখচিত্র থেকে সেগুলো বের করে ফেলতে পারতাম। যেমন আমরা লেখচিত্রে দেখতে পাচ্ছি সময়ের মান যখন শূন্য তখন বেগের মান 10 m/s অর্থাৎ এটি হচ্ছে শুরুর বেগ (u)। ঠিক সেরকম আমরা দেখতে পাচ্ছি 15 সেকেন্ডে বেগের মান 10 m/s থেকে বেড়ে 40 m/s হয়েছে। কাজেই ত্বরণ a হবে
গতির অন্য দুটো সমীকরণ পরের পৃষ্ঠায় দুটি লেখচিত্রে দেখানো হয়েছে। তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করছ অতিক্রান্ত দূরত্ব যখন সময়ের সাপেক্ষে দেখানো হয় তখন সেটি সরল রেখায় বৃদ্ধি না পেয়ে বর্গের আনুপাতিক হয়ে বৃদ্ধি পায়।
তোমরা গতির সমীকরণগুলো ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট সময়ে কিংবা নির্দিষ্ট দূরত্বের জন্য কোনো একটি রাশির মান হিসাব করে বের করেছিলে। লেখচিত্র থেকে তোমাকে শুধু একটি নির্দিষ্ট মানে সন্তুষ্ট থাকতে হবে না। তোমরা নিচের অক্ষের যে কোনো মানের জন্য একটা আনুমানিক মান বের করে ফেলতে পারবে!
জেনে রাখো, বিজ্ঞান শেখার সময় বিভিন্ন রাশির কাছাকাছি একটা মান অনুমান করতে পারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দক্ষতা।
আরও দেখুন...