বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত একটি গলদা চিংড়ির হ্যাচারি স্থাপনের উদ্দেশ্যে উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থায়ীভাবে ব্যয়বহুল বাণিজ্যিক হ্যাচারি স্থাপন করার পূর্বে স্থান নির্বাচনের জন্য দূরদর্শীতার সাথে বিভিন্ন বিষয়াদি বিবেচনা করা প্রয়োজন। হ্যাচারি স্থাপনের লক্ষ্যে উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা উচিত।
হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদনে প্রয়োজনীয় সময়ে গুণগত মানসম্পন্ন ও পরিপক ব্রুড প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকা অত্যাবশ্যক। বাণিজ্যিক হ্যাচারি পরিচালনায় সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত ব্রুড চিংড়ি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর সহজ প্রাপ্যতার উপরে হ্যাচারির বাণিজ্যিক সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে। প্রাকৃতিক উৎস থেকে বা চাষের জলাশয় থেকে পরিপক্ক ব্রুড চিংড়ি সংগ্রহ করা যেতে পারে অথবা ব্রুড চিংড়ি উৎপাদনের উপযোগী হ্যাচারি সংলগ্ন জলাশয় থাকলে নির্ধারিত সময়ে সেখানে রুড উৎপাদনের ব্যবস্থাও গ্রহণ করা যেতে পারে।
সমুদ্রের পার্শ্ববর্তী স্থানে গলদা চিংড়ির হ্যাচারি স্থাপন করা উচিত, কারণ পোনা উৎপাদনের জন্য ২৮-৩২ পিপিটি লবণাক্ত সমৃদ্ধ লোনা পানির প্রয়োজন হয়। ব্রুড চিংড়ি প্রতিপালন ও গলদা চিংড়ির পোনা উৎপাদনের জন্য লোনা পানির নিম্নোক্ত গুরুত্বপূর্ণ ভৌত-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার।
সারণি-১: গলদা চিংড়ি হ্যাচারির পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণ
উপাদান- উপযুক্ত পরিমাণ
তাপমাত্রা - ২৪-৩১°সে
পিএইচ - ৭.৫-৮.৫
পানির লবণাক্ততা - ২৮-৩৩ পিপিটি
দ্রবীভূত অক্সিজেন - >৫ পিপিএম
ক্ষারকত্ব - <১০০ পিপিএম
মোট ক্ষারত্ব - ৪০-১০০ পিপিএম
নাইট্রাইট-নাইট্রোজেন - <০.০২ মিগ্রা/লি.
ঘোলাত্ব - <৫০ এফটিইউ
লৌহ - <০.০১ পিপিএম
দস্তা - <০.২৫ পিপিএম
তামা - <০.১ পিপিএম
পারদ - <০.০১ পিপিএম
ক্যাডমিয়াম - ০.১৫ পিপিএম
ভারী ধাতু - <০.০১ পিপিএম
হাইড্রোজেন সালফাইড - <০.১ পিপিএম
জৈব অক্সিজেন চাহিদা (বিওডি) - <১.০ মিগ্রা/লি (৫ দিন)
আন আয়োনাইজড অ্যামোনিয়া - <০.১ পিপিএম
চিংড়ি হ্যাচারিতে ব্যবহারের জন্য মানসম্মত লোনা পানি (ব্রাইন) এবং স্বাদু পানির প্রয়োজন হয়। সমুদ্রের কাছাকাছি হ্যাচারি স্থাপন করা সম্ভব না হলে হ্যাচারি পরিচালনার উপযোগী ব্রাইন ভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে আনা হয়। ব্রাইন সংগ্রহের উৎস থেকে দূরবর্তী স্থানে হ্যাচারি স্থাপন করা হলে ব্রাইনের পরিবহনজনিত ব্যয় বৃদ্ধি পেতে পারে। কিন্তু স্বাদু পানি হ্যাচারি সংলগ্ন এলাকা থেকেই সংগ্রহ করা হয়। হ্যাচারি স্থাপনের পূর্বে তাই ব্রাইন অপেক্ষা স্বাদু পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করে উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করতে হয়। হ্যাচারি স্থাপনের জন্য এমন কোন স্থান নির্বাচন করা সমীচীন নয়, যেখানে ব্রাইন এবং স্বাদু পানি উভয়ই পরিবহন করার প্রয়োজন হয়। স্বাদু পানি ভূগর্ভস্থ বা ভূ-উপরিস্তরের হতে পারে। হ্যাচারিতে ব্যবহারের উপযোগী স্বাদু পানির রাসায়নিক গুণাগুণ নিম্নরুপ হওয়া বাঞ্ছনীয়:
প্যারামিটার ---------- মাত্রা
পিএইচ ------------- ৭.০-৮.৫
লৌহ -------------<০-২ পিপিএম
ক্ষারত্ব-------------৮০-১০০ পিপিএম
দ্রবীভূত অক্সিজেন -------------->৫ পিপিএম
নাইট্রাইট নাইট্রোজেন ------------ ০.১পিপিএম (যত কম তত ভালো)
নাইট্রেট নাইটোজেন ------------ ২০ পিপিএম (যত কম তত ভালো)
অ্যামোনিয়া ---------------- ০.১ পিপিএম (যত কম তত ভালো
ক্লোরিন -----------মুক্ত
ভারী ধাতু -------------<০.০১ পিপিএম
আর্সেনিক -------------<০.০১ পিপিএম
হাইড্রোজেন সালফাইডমুক্ত
কীটনাশক মুক্ত
গলদা হ্যাচারির পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দূষণমুক্ত না হলে হ্যাচারিতে আকস্মিক যে কোনো রাসায়নিক বা জীবাণুঘটিত দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে। তাই হ্যাচারি স্থাপনের জন্য স্থান নির্বাচনের প্রাক্কালে উক্ত এলাকা দূষণমুক্ত কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। শিল্প-কলকারখানা, ইটের ভাটা, রাইস মিল, কাঁচা বাজার, সুপার মার্কেট ইত্যাদির কাছাকাছি স্থানের পরিবেশ সর্বদা দূষণযুক্ত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। শিল্প- কলকারখানার অশোধিত বর্জ্য পদার্থ এবং কালো ধোঁয়া পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে। এরূপ বর্জ্য পদার্থের কারণে আশপাশের স্বাদু পানির গুণাগুণ দূষিত থাকে। তাই হ্যাচারি স্থাপনের জন্য এরূপ স্থান নির্বাচন থেকে যতদূর সম্ভব বিরত থাকাই সমীচীন।
অত্যধিক বৃষ্টির কারণে হ্যাচারির পানির গুনাগুণ, যেমন- পানির তাপমাত্রা, পিএইচ, দ্রবীভূত অক্সিজেন এবং বিশেষ করে লবণাক্ততার তারতম্য হতে পারে যা চিংড়ির পোনা উৎপাদনে মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করতে পারে। সেজন্য হ্যাচারি স্থাপনের ক্ষেত্রে অতি বৃষ্টিজনিত এলাকা পরিহার করতে হবে।
গলদা হ্যাচারি নির্মাণের পূর্বে এবং স্থান নির্বাচনের সময় মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করা প্রয়োজন। কারণ পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণ সরাসরি মাটির গুণাগুণের উপর নির্ভর করে। তাই যেখানে হ্যাচারি স্থাপন করা হবে সেই এলাকার ভূ-প্রকৃতি বিবেচনায় নিতে হবে। এছাড়া ভূ-প্রকৃতির উপর হ্যাচারির নির্মাণ খরচ অনেকাংশে নির্ভর করে।
চিংড়ি হ্যাচারির যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হলে উৎপাদিত পোনা বাজারজাতকরণে অপরিসীম সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে পরিবহনজনিত কারণে ব্যয় বৃদ্ধি পেলে হ্যাচারির বাণিজ্যিক উৎকর্ষ সাধনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া ব্রাইন সংগ্রহ, ব্রুড চিংড়ি সংগ্রহ, হ্যাচারির উপকরণাদি সংগ্রহ ইত্যাদি কাজের সুবিধার্থে উত্তম যোগাযোগ ব্যবস্থাযুক্ত স্থানে হ্যাচারি স্থাপন করা আবশ্যক ।
হ্যাচারি এলাকায় ২২০ ও ৪৪০ ভোল্টের নির্ভরযোগ্য ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। বিদ্যুৎ ব্যতীত একটি গলদা চিংড়ি হ্যাচারি বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা করা সহজসাধ্য নয়। তাই হ্যাচারি স্থাপনের পূর্বে সেখানে ১-ফেজ (২২০ ভোল্ট) এবং ৩-ফেজ (৪৪০ ভোল্ট) বৈদ্যুতিক সংযোগ রয়েছে কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। বিকল্প হিসেবে এয়ার ব্লোয়ার চালানোর জন্য ডিজেল ইঞ্জিন ও জেনারেটর থাকা আবশ্যক।
দক্ষ জনশক্তি ছাড়া লাভজনকভাবে হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন সম্ভব নয়। তাই দক্ষ জনশক্তির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করে হ্যাচারি স্থাপন করা উচিত।
হ্যাচারির উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য হ্যাচারিতে ব্যবহৃত ঔষধ, যন্ত্রপাতি, ব্রুড শ্রিম্প, পিএল এর খাদ্য আর্টেমিয়া ইত্যাদি সহজেই পাওয়া যায় এমন স্থানে হ্যাচারি স্থাপন করতে হবে। এছাড়া অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সহজেই সংগ্রহের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকতে হবে।
এমন এলাকায় চিংড়ি হ্যাচারি স্থাপন করতে হবে যেখানে কৃষি বা অন্যান্য ফসলের ফলন বা চাষ হয় না। অন্যথায় সামাজিক বিশৃঙ্খলা বা পরিবেশ গত প্রতিকূলতার সৃষ্টি হতে পারে।
সফলভাবে গলদা চিংড়ি হ্যাচারি পরিচালনার জন্য এলাকার সামাজিক পরিস্থিতি একটি উল্লেখযোগ্য নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ এবং নৈতিক সমর্থন ব্যতীত কোনো প্রকার উৎপাদন সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা সম্ভব নয়। পলদা চিংড়ি হ্যাচারি স্থাপন ও পরিচালনায় যেহেতু বড় অঙ্কের পুঁজি বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়, তাই হ্যাচারি স্থাপনের পূর্বে বিনিয়োগকৃত পুঁজির নিরাপত্তার বিষয়টি সতর্কতার সাথে বিবেচনা করা উচিত। হ্যাচারি এলাকার সামাজিক পরিস্থিতি, চুরি ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, ধর্মঘট, রাজনৈতিক ও অন্যান্য অস্থিরতা সে স্থানে গলদা চিংড়ি হ্যাচারি স্থাপন, পরিচালনা ও পোনা বিপণন কর্যক্রমকে ব্যাহত করবে। তাই এরূপ সমস্যা সংকুল স্থানে হ্যাচারি স্থাপন করা উচিত নয়।
হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনা সঠিকভাবে বিপণনের জন্য হ্যাচারির বাণিজ্যিক উপযোগিতা নিশ্চিতকরণের বিষয়টি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। তাই উৎপাদিত পোনার বাজার প্রাপ্তির বিষয়টি হ্যাচারি স্থাপনকালেই গুরুত্বের সাথে বিবেচনার দাবী রাখে। গলদা চিংড়ি চাষ এলাকার কাছাকাছি যেখানে মূল চাষ মৌসুমে গলদা চিংড়ি পোনার চাহিদা রয়েছে সেসব এলাকায় হ্যাচারি স্থাপন করা হলে হ্যাচারিতে উৎপাদিত পিএল বিপণনের সুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি পিএল-এর পরিবহনজনিত পীড়নের সম্ভবনা থাকে না ।
আরও দেখুন...