তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - পদার্থবিদ্যা - পদার্থবিজ্ঞান – ২য় পত্র | | NCTB BOOK
81
81

নানা রকম শক্তির মধ্যে তাপশক্তির একটা বিশেষত্ব এই যে, অন্য সব রকম শক্তি বেশ সহজেই এবং অনেক সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তাপে পরিণত হয়। যেমন পাহাড় থেকে পানি যখন প্রচণ্ড বেগে নিচে নামে তখন এর গতিশক্তি আপনা থেকেই তাপে রূপান্তরিত হয় কিন্তু তাপ সহজে অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হতে চায় না। তাপশক্তিকে অন্যান্য শক্তিতে রূপান্তরের জন্য যন্ত্রের প্রয়োজন। এই যন্ত্রই তাপ ইঞ্জিন। কার্নো তাপ ইঞ্জিনের ওপর ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে সিদ্ধান্তে আসেন—ইঞ্জিন ছাড়া তাপের রূপাত্তর সম্ভব নয় এবং তাপকে সম্পূর্ণভাবে কাজে রূপান্তরিত করাও অসম্ভব। 

প্লাঙ্ক, ব্লসিয়াস, কেলভিন প্রমুখ বিজ্ঞানী নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাহায্যে কার্নোর পরীক্ষালব্ধ অভিজ্ঞতাকে বিভিন্নভাবে সূত্রাকারে প্রকাশ করেছেন যা তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র নামে পরিচিত।

কার্নোর বিবৃতি : 

  কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ তাপশক্তিকে সম্পূর্ণরূপে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরে সক্ষম এমন যন্ত্র নির্মাণ সম্ভব নয়।

প্ল্যাঙ্কের বিবৃতি : 

  এমন কোনো ইঞ্জিন তৈরি করা সম্ভব নয়, যেটা কোনো বস্তু থেকে তাপ গ্রহণ করে অবিরামভাবে কাজে পরিণত করবে অথচ পরিবেশের কোনো পরিবর্তন হবে না।

ক্লসিয়াসের বিবৃতি :

  বাইরের শক্তির সাহায্য ছাড়া কোনো স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের পক্ষে নিম্ন উষ্ণতার বন্ধু হতে উচ্চতর উষ্ণতার বস্তুতে তাপের স্থানান্তর করা সম্ভব নয় । কেলভিনের বিবৃতি : কোনো বস্তুকে এর পরিপার্শ্বের শীতলতম অংশ হতে অধিকতর শীতল করে শক্তির অবিরাম সরবরাহ পাওয়া সম্ভব নয়।

দ্বিতীয় সূত্রের গুণগত ধারণা : 

তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র থেকে আমরা জেনেছি যে, বিভিন্ন রকমের শক্তির মধ্যে রূপান্তর সম্ভব এবং কোনো শক্তির বিলোপ ঘটলে সমপরিমাণে অপর শক্তির আবির্ভাব ঘটবেই— অর্থাৎ শক্তির বিনাশ নেই । তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র প্রকৃতপক্ষে শক্তির নিত্যতা সূত্রেরই একটা বিশেষ রূপ। কিন্তু কোন্ বস্তু থেকে শক্তির রূপান্তর কোন্ দিকে হবে বা আদৌ শক্তির রূপান্তর হবে কিনা এই সূত্র থেকে তা আমরা জানতে পারি না। যেমন এক কিলোগ্রাম ভরের এক টুকরো বরফ বাইরে রেখে দিলে পরিবেশ থেকে 3.36 x 105 J তাপশক্তি বরফে এসে বরফকে পানিতে পরিণত করবে। এখানে বরফ যে পরিমাণ তাপশক্তি পাবে পরিবেশ ঠিক সেই পরিমাণ তাপশক্তি হারাবে। কিন্তু এক কিলোগ্রাম পানি যদি আমরা বাইরে রেখে দেই তাহলে ঐ পানি আপনাআপনি 3.36 x 105 J তাপশক্তি পরিবেশকে প্রদান করে বরফে পরিণত হবে না, যদিও তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র এমন পরিবর্তনকে বাধা দেয় না, কারণ শক্তির নিত্যতা সূত্র এক্ষেত্রে ব্যাহত হচ্ছে না ।

তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র থেকে আমরা জানি একটা বস্তু বা সিস্টেম যতটা তাপ হারাবে অপর সিস্টেম ঠিক সেই পরিমাণ তাপ গ্রহণ করবে। কিন্তু সেই তাপ কোন্ সিস্টেম পাবে বা হারাবে তা প্রথম সূত্র থেকে জানা যায় না। তাপের প্রবাহের দিক জানতে হলে সিস্টেম দুটির তাপমাত্রা জানা একান্ত প্রয়োজন। তাপ সর্বদা উচ্চতর তাপমাত্রার বস্তু থেকে নিম্নতর তাপমাত্রার বস্তুর দিকে স্বাভাবিকভাবেই প্রবাহিত হবে। এর বিপরীত কখনো স্বতঃস্ফূর্তভাবে হবে না। ঠাণ্ডা কোনো সিস্টেম থেকে তাপ আপনাআপনি বেরিয়ে গিয়ে অপর একটি উষ্ণ সিস্টেমে প্রবেশ করবে না। উষ্ণ সিস্টেমের চেয়ে শীতল সিস্টেমের তাপশক্তির পরিমাণ বেশি থাকলেও এমনটি হবে না। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কোনো নিম্নতর তাপমাত্রার সিস্টেম থেকে তাপ বের করে আনতে হলে তার জন্য আমাদের যান্ত্রিক শক্তি ব্যয় করতে হয়।

দুটি সিস্টেমের মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্য থাকলেই কেবলমাত্র উষ্ণতর সিস্টেম থেকে শীতল সিস্টেমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাপশক্তি প্রবাহিত হবে। এই তাপশক্তির স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ ততক্ষণই চলবে যতক্ষণ এদের মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্য বজায় থাকবে।

সিস্টেম দুটির তাপমাত্রা এক হয়ে গেলে তাপের আদান প্রদানও বন্ধ হয়ে যাবে। দুটি সিস্টেমের মধ্যে তাপের আদান প্রদান বন্ধ হয়ে গেলে আমরা বলি সিস্টেম দুটি তাপীয় সমতা বা সাম্যাবস্থা প্রাপ্ত হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তনগুলো সব একমুখী এবং সাম্যাবস্থায় না আসা পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। প্রকৃতিতে শক্তির রূপান্তরের দিক নিয়ে যে অভিজ্ঞতা তা থেকেই তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের উদ্ভব। কোন শক্তি কোন দিকে বা কতখানি রূপান্তরিত হবে বা কী অবস্থায় সেটি হচ্ছে তাই দ্বিতীয় সূত্রের প্রতিপাদ্য বিষয়।

Content added By
Promotion