ছক ৩.১: অপরের জন্য আমি
|
প্রত্যেক প্রাণী যে-রূপে জন্মগ্রহণ করে সেরূপেই বেড়ে ওঠে, সেভাবেই জীবন পার করে। হাঁসের বাচ্চা হয় হাঁস আর ঘাসের বীজ থেকে জন্মায় ঘাস। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্যরকম। 'মানুষ' হিসেবে পরিচয় পাওয়ার জন্য তাকে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। এই মনুষ্যত্ব হলো কতকগুলো সদগুণের সমষ্টি। সেগুলোর মধ্যে একটি হলো মূল্যবোধ। আর যে মূল্যবোধের মাধ্যমে মানুষ ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিতের বিচার করে তার আলোকে আচরণ করতে পারে তাকে নৈতিক মূল্যবোধ বলে। আমরা ছবিতে এরকম কিছু নৈতিক মূল্যবোধের উদাহরণ দেখেছি। সত্যকামের গল্পে 'সত্যবাদিতা', রাম-লক্ষ্মণের গল্পে 'ভ্রাতৃপ্রেম', কর্ণের গল্পে 'গুরুজনে ভক্তি' ইত্যাদি নৈতিক মূল্যবোধগুলোর কথা জেনেছি। মানুষের ভেতরে এ রকম আরও অনেক নৈতিক মূল্যবোধ থাকে, যেমন: উদারতা, ক্ষমাশীলতা, দায়িত্ববোধ, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি।
ছক ৩.২: আমার নৈতিক মূল্যবোধ
১.
|
২.
|
৩.
|
ছক ৩.৩: আমাদের মূল্যবোধ
|
|
হিন্দুধর্মেও এ রকম অনেক নৈতিক মূল্যবোধের গল্প রয়েছে। এখানে আমরা আত্মশ্রদ্ধা, ধর্মনিষ্ঠা, অধ্যবসায় এবং পিতামাতার প্রতি কর্তব্য সম্পর্কে জানব।
একজন ছাত্রের গণিতে ভীষণ ভয় ছিল। তাই সে পরীক্ষায় ভালো করত না। একদিন শিক্ষক তাকে ডেকে নিয়ে ছোট ছোট গাণিতিক সমস্যা দিলেন। অনেকগুলো সমস্যার সমাধান সে করে ফেলল। শিক্ষক তাতে খুশি হয়ে বললেন, তুমি তো ভালোই গণিত পারো! চাইলেই কিন্তু গণিতে আরও ভালো করতে পারো। শিক্ষকের উৎসাহে সে গণিতের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠল। শিক্ষকও তাকে মাঝে মাঝে গণিত দেখিয়ে দিতেন। অল্প দিনের মধ্যে ছাত্রের ভয় কেটে গেলা। সে দেখল, এইতো আমি পারছি! এতে নিজের প্রতি তার ভালো লাগা তৈরি হলো। এটাই হলো আত্মশ্রদ্ধাবোধ। ছাত্রটি ভাবল, তাহলে আর একটু চেষ্টা করি। এভাবে ছাত্রটি গণিতে পারদর্শী হয়ে উঠল। তার এই যে পারদর্শিতা, তা আত্মশ্রদ্ধারই ফলাফল। আসলে গণিতে ভালো করার দক্ষতা তার ভেতরেই ছিল। কিন্তু 'আমি পারি' নিজের প্রতি এই শ্রদ্ধাটুকু জাগিয়ে তুলতে শিক্ষকমহাশয় তাকে সাহায্য করেছেন। তবে আত্মশ্রদ্ধা জাগাতে যে সবসময়ে কারোর সাহায্য লাগবে, ব্যাপারটা এমনও নয়। আত্মশ্রদ্ধা জাগাতে হলে নিজের প্রকৃত পরিচয় জেনে নিজের শক্তিকে পুরোপুরি কাজে লাগানো প্রয়োজন।
'আত্মশ্রদ্ধা' কথাটির মানে নিজেকে শ্রদ্ধা করা। এর জন্য প্রয়োজন নিজের প্রতি ভালো ধারণা রাখা। প্রত্যেক মানুষেরই কিছু না কিছু সহজাত বিশেষ ক্ষমতা, কর্মকুশলতা ও বৈশিষ্ট্য থাকে। আত্মশ্রদ্ধা জাগাতে হলে নিজের এই সামর্থ্যগুলো স্পষ্ট করে জানতে হয়। সেইসঙ্গে নিজের সীমাবদ্ধতাগুলোও বুঝতে হয়। আত্মশ্রদ্ধাবান মানুষ সাময়িক ব্যর্থতা দিয়ে নিজের মহিমাকে খাটো করে দেখে না। অন্যের মতো নয় বলে নিজেকে কখনও সামান্য বলে মনে করে না। এমন মানুষ নিজেকে ভালোবাসে। গীতায় বলা হয়েছে-
উদ্ধরেৎ আত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ
আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ।
(গীতা- ৬/৫)
সরলার্থ: নিজেই নিজেকে উদ্ধার করবে। নিজেকে কখনো অবসন্ন ভাববে না। তাহলে নিজেই নিজের বন্ধু হবে। বিপরীতে নিজে শত্রুতে পরিণত হবে।
অর্থাৎ, আত্মশ্রদ্ধার বলে নিজেকে উদ্ধার করতে হয়। কখনো নিজের প্রতি শ্রদ্ধা হারাতে নেই। আত্মশ্রদ্ধাই মানুষের বন্ধু। আত্মশ্রদ্ধাহীনতাই মানুষের শত্রু। আত্ম-অবমাননা কখনও করতে নেই। আমি পাপী, আমি অধম, আমি পতিত, আমি অসহায়- এ রকম বলতে নেই বা মনে করতে নেই। আত্মশ্রদ্ধাবান আত্মশ্রদ্ধাকেই পরম অবলম্বন বলে মনে করেন। কুসঙ্গ, কুকথা ইত্যাদি থেকে নিজেকে সযত্নে দূরে রাখেন।
কেবল ব্যক্তি জীবনে নয়, জাতীয় জীবনেও আত্মশ্রদ্ধার প্রয়োজন আছে। নইলে একটি জাতি যথার্থ স্বাধীনতা পায় না। নিজ জাতির ইতিহাস জানতে হবে। নিজেদের সমষ্টিগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। জাতীয় জীবনদর্শন সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এরই ওপরে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। এভাবেই একটি আত্মশ্রদ্ধাবান জাতি সামনে এগিয়ে যায়।
আত্মশ্রদ্ধার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে রামায়ণে আমরা সীতাকে পাই। আমরা এখন সীতার কাহিনি জানব।
রাজা দশরথ বড় ছেলে রামকে রাজা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বাধ সাধেন কৈকেয়ী। তার কূটকৌশলে রামকে চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাসে যেতে হয়। সঙ্গে গেলেন স্ত্রী সীতা আর ভাই লক্ষ্মণ। তের বছর বনবাসে থাকার পর একদিন ছদ্মবেশে লঙ্কার রাজা রাবণ সীতার কাছে এলেন। সীতা তখন বনের কুটিরে একা ছিলেন। সীতা অতিথি সৎকারের আয়োজন করেন। রাবণ তখন নিজের পরিচয় দিয়ে সীতাকে বনবাস জীবন ছেড়ে তার সঙ্গে লঙ্কায় যাওয়ার প্রস্তাব দেন। সীতা ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। রাবণ তখন সীতাকে জোর করে মায়ারথে তুলে নিয়ে নিজ রাজ্য লঙ্কায় চলে যায়।
রাবণ সীতাকে বশে আনার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে। কিন্তু কোনোভাবেই না পেরে তাঁকে অশোকবনে রা- ক্ষসীদের মাঝে বন্দি করে রাখেন। এদিকে সীতাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন রাম। একদিন হনুমান লঙ্কা থেকে সীতার খবর আর একটা আংটি নিয়ে রামের কাছে আসেন। তারপর রাম আর লক্ষ্মণ লঙ্কায় উপস্থিত হন। রাম-রাবণের ভীষণ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পরাজিত রাবণ সবংশে নিহত হয়। হনুমান অশোকবন থেকে সীতাকে নিয়ে রামচন্দ্রের কাছে আসেন। কিন্তু রাম সীতাকে গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। অপমানিত সীতা আগুনের চিতায় প্রবেশ করলেন। বললেন, যদি আমি সতী হই এবং রামের প্রতি একনিষ্ঠ থাকি, তবে স্বয়ং অগ্নিদেব আমাকে রক্ষা করবেন। অগ্নিদেব স্বয়ং সীতাকে রক্ষা করেন। রামের কাছে সীতাকে গ্রহণ করার অনুরোধ করেন। রাম সীতাকে গ্রহণ করেন। তারপর রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ অযোধ্যায় ফিরে আসেন।
রামচন্দ্র রাজ্যভার গ্রহণ করলেন। আনন্দেই কাটছিল দিন। এরই মধ্যে সীতা অন্তঃসত্ত্বা হন। রাম নিঃসন্দেহ হলেও তিনি জানতে পারেন যে, প্রজাদের মনে সীতার চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ আছে। তাই প্রজাদের সন্তুষ্টির জন্য রাম সীতাকে বনবাসে পাঠান। সীতা বাল্মীকি মুনির আশ্রমে আশ্রয় পান। সেখানে সীতার লব ও কুশ নামে যমজ ছেলের জন্ম হয়। বাল্মীকি তাদের নিজের রচিত রামায়ণ কণ্ঠস্থ করান। এদিকে রাজা রামচন্দ্র অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেন। নিমন্ত্রিত বাল্মীকি মুনির সঙ্গে কুশ ও লব এই যজ্ঞে এসে রামায়ণ গান করেন। তাঁদের গান শুনে
রাম বাল্মীকি মুনির কাছে তাঁদের পরিচয় জানতে চাইলেন। বাল্মীকি মুনি বলেন, এঁরা তোমারই পুত্র।
বাল্মীকি মুনি লব ও কুশকে নিয়ে আশ্রমে ফিরে যান। সীতাকে পুনরায় গ্রহণ করার জন্য রাম বাল্মীকির কাছে সংবাদ পাঠান- সীতা যদি নিষ্পাপ হয়, সে যেন বাল্মীকির আদেশ নিয়ে আত্মশুদ্ধি করে এবং সকলের সামনে শপথ করে। বাল্মীকি এই প্রস্তাবে সম্মত হন। বাল্মীকি মুনির আদেশে সীতা লব ও কুশকে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরে আসেন। পরদিন সকলের সামনে সীতার শুদ্ধতার পরীক্ষা। কিন্তু তিনি নিজেকে আর অপমানিত হতে দিতে রাজি নন। আত্মশ্রদ্ধাশীল সীতা সর্বসমক্ষে বললেন, আমি যদি সচ্চরিত্রের অধিকারী এবং রাম ভিন্ন অন্য কাউকে মনে মনে চিন্তা না করে থাকি, তবে ধরিত্রী যেন বিদীর্ণ হয়ে আমাকে আশ্রয় দেন। তখন মাটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। মাটির নিচ থেকে নাগবাহিত এক আশ্চর্য রথে দেবী বসুমতী উঠে আসেন। তিনি সীতাকে দুহাতে ধরে সিংহাসনে বসান। তারপর সীতাকে নিয়ে তিনি পাতালে প্রবেশ করেন। সীতা পাতালে প্রবেশ করলে রাজা রামচন্দ্রসহ প্রজারা শোকে হাহাকার করতে থাকেন।
এই কাহিনিতে আমরা দেখতে পাই, সীতা রামের প্রতি একনিষ্ঠ থাকার পরও বারবার তাঁকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে, পরীক্ষা দিতে হয়েছে, এমনকি শাস্তিও পেতে হয়েছে। সেখানে আমরা তাঁর সহনশীলতা আর ধৈর্যশী- লতার পরিচয় পেয়েছি। শেষ পর্যন্ত যখন তিনি আর অপমান সহ্য করতে পারলেন না, তখন তিনি আত্মশ্রদ্ধার পরিচয় দিলেন। নিজের প্রতি সম্মানবোধ থেকে তিনি অসম্মানজনক পরিস্থিতি থেকে সরে গেলেন।
যা আমাদের কল্যাণের পথে ধরে রাখে তাই ধর্ম। আর 'ধর্মনিষ্ঠা' কথাটির মানে ধর্মের প্রতি আন্তরিক অনুরাগ, গভীর আস্থা, অটল বিশ্বাস। ধর্মনিষ্ঠ মানুষ সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের চেতনা এবং বিশ্বাসকে হৃদয়ে ধারণ করে সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও পবিত্র জীবন-যাপন করে। আমরা কেন ধর্ম পালন করি, সে সম্পর্কে হিন্দুধর্মে বলা হয়েছে: 'আত্মমোক্ষায় জগদ্ধিতায় চ।'- নিজের চিরমুক্তি, আর জগতের কল্যাণসাধনের জন্য। ধর্মনিষ্ঠা সবরকমের নৈতিক মূল্যবোধের সমষ্টি। যা নৈতিক তাই ধর্ম, যা অনৈতিক তা অধর্ম। ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তিকে ধার্মিক বলা হয়।
ধার্মিক ব্যক্তি জগতে সাময়িকভাবে দুঃখভোগ করলেও পরিণামে শান্তি পান। এখানে একজন ধর্মনিষ্ঠ রাজার উপাখ্যান জানব।
অতি প্রাচীনকালে কোশল নামে একটি জনপদ ছিল। সেখানে হরিশ্চন্দ্র নামে একজন রাজা ছিলেন। তিনি প্রজাদের খুব ভালোবা- সতেন। ধর্মনিষ্ঠা, সত্য- বাদিত্য, দান, ধ্যান ও ন্যায়বিচারের জন্য তিনি ছিলেন বিখ্যাত। তাঁর কাছে যে যা চাইত তাই পেত। এই কারণে তিনি দানবীর হিসেবে খ্যাত হন। তাঁর সুনাম স্বর্গ ও মর্ত্যে ছড়িয়ে পড়ে। একদিন ইন্দ্রের সভায়, বশিষ্ট মুনির মুখে ঋষি বিশ্বামিত্র হরিশ্চন্দ্রের দানের সুখ্যাতি শুনলেন। ঋষির ইচ্ছা হলো, হরি- শ্চন্দ্র কেমন দানবীর, তা পরীক্ষা করে দেখবেন।
এদিকে দেবরাজ ইন্দ্রের সভায় পাঁচজন অব্ন্স- রার নাচের তালভঙ্গ হয়। দেবরাজ ইন্দ্র রেগে গিয়ে তাদের অভিশাপ দেন, তোমরা বিশ্বামিত্রের তপোবনে বন্দিনী হয়ে থাকবে। তখন অব্দরাগণ হাতজোড় করে দেবরাজের কাছে তাদের মুক্তির উপায় জানতে চান। দেবরাজ ইন্দ্র বললেন, রাজা হরিশ্চন্দ্রের হাতে তোমাদের মুক্তি হবে। তারা মানুষরূপে বিশ্বামিত্রের তপোবনে বাস করতে থাকে। মানুষরূপী এই অপ্সরা প্রতিদিন তপোবনে ফুল তুলতে গিয়ে গাছের ডালপালা ভেঙে ফেলত। ঋষি বিশ্বা- মিত্র এই ঘটনায় ভীষণ রেগে পাঁচ কন্যাকে গাছের ডালে বেঁধে রাখেন। একদিন রাজা হরিশ্চন্দ্র শিকারের জন্য তপোবনে আসেন। তাঁকে দেখে বন্দী অপ্সরারা আর্তনাদ করতে লাগল। রাজা হরিশ্চন্দ্র তাদের বন্ধনমুক্ত করে দিলেন। তারা মুক্ত হয়ে স্বর্গে চলে গেল।
এভাবে কিছুদিন কাটল। একদিন ফুল তোলার সময়ে একটি কালসাপ রোহিতাশ্বকে দংশন করল। সেখানেই রোহিতাশ্বের মৃত্যু হয়। মৃত পুত্রকে দেখে শৈব্যার জীবনে অন্ধকার নেমে এল। যার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি সমস্ত দুঃখকষ্ট ভুলে ছিলেন, সেই স্নেহের পুত্রও আজ চলে গেল। তিনি পুত্রশোকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন। বলতে লাগলেন, কোথায়, কোথায় রাজা হরিশ্চন্দ্র। একবার এসে দেখে যাও তোমার সন্তানের মৃতদেহ। মরা ছেলেকে কোলে নিয়ে শৈব্যা গেলেন শ্মশানঘাটে।
সেদিন ছিল ভয়ানক দুর্যোগ। ঘোর অন্ধকার রাত। আকাশ মেঘে ঢাকা। ঘাটের কড়ি আদায় করার জন্য হরিশ্চন্দ্র শ্মশানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শৈব্যা মৃত পুত্রকে নিয়ে শ্মশানে উপস্থিত হলেন। হরিশ্চন্দ্র তাঁকে বললেন, ঘাটের কড়ি পঞ্চাশ কাহন না পেলে আমি মড়া পোড়াতে পারবো না। তুমি অন্য ঘাটে চলে যাও। শৈব্যা অপরের কেনা দাসী, তিনি পয়সা কোথায় পাবেন! মনের দুঃখে তিনি হরিশ্চন্দ্রের নাম ধরে কাঁদতে লাগলেন। এই সময়ে একবার বিদ্যুৎ চমকাল। সেই আলোতে হরিশ্চন্দ্র শৈব্যা ও মৃত পুত্র রোহিতাশ্বকে চিনতে পেরে কেঁদে উঠলেন। শৈব্যাও ডোমের পোশাক পরা রাজাকে চিনে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। মৃত পুত্র রোহিতাশ্বকে নিয়ে দুজনেই অঝর নয়নে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে তাঁরা দুজনেই বললেন, হে প্রভু আমরা সর্বস্ব দান করেছি। বিনিময়ে আজ আমাদের এই দিন দেখালে। তাই এই জীবন আমরা আর রাখব না। এই পুত্রের চিতায় আমরা দুজন প্রাণত্যাগ করব। তাই চন্দনকাঠের চিতা সাজিয়ে তাতে মৃত পুত্র রোহিতাশ্বকে রাখেন। দুই পাশে পিতা-মাতা শুয়ে পড়লেন। এবার চিতাতে আগুন দিতে যাবেন, এমন সময় স্বয়ং ধর্মরাজ সেখানে উপস্থিত হয়ে বললেন, 'হে রাজন! ধর্ম ও সত্যের প্রতি তোমার অনুরাগে দেবতারাও তুষ্ট হয়েছেন। তুমি প্রকৃতই ধার্মিক ও সত্যবাদী। ধর্মরাজ রোহিতাশ্বের গায়ে হাত বোলাতে সে বেঁচে উঠল'। বিশ্বামিত্রও তখন সেখানে এসে বললেন, 'হরিশ্চন্দ্র, তোমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তুমি সত্যই দানবীর। ধন্য তোমার জীবন। তোমার এই দান ও ত্যাগের মহিমা স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে। তোমার রাজ্য তুমি ফিরিয়ে নাও। রাজ্যে ফিরে গিয়ে স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে রাজ্যসুখ ভোগ করো এবং প্রজাদের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করো'।
ছক ৩.৫: ধর্মনিষ্ঠার বৈশিষ্ট্য
১.
|
২.
|
৩.
|
জীবনে চলার পথে আছে বাধা, আছে বিঘ্ন। এসব বাধা-বিঘ্নকে অতিক্রম করে কোনো কাজে সাফল্য লাভের জন্য বারবার চেষ্টা করার নামই অধ্যবসায়। চেষ্টা, উদ্যোগ, আন্তরিকতা, পরিশ্রম, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, একাগ্রতা ইত্যাদি গুণের সমন্বয়ে অধ্যবসায় নামক নৈতিক গুণটি গড়ে ওঠে। পৃথিবীতে যা কিছু মহৎ, যা কিছু সুন্দর, যা কিছু কল্যাণকর সবই অধ্যবসায়ের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। তাই মানব সভ্যতার অগ্রগতির চাবিকাঠি হলো অধ্যবসায়। অধ্যবসায়ের গুণেই মানুষ বড় হয়। অসাধ্য সাধন করতে পারে। কবি কালীপ্রসন্ন ঘোষ বলেছেন।
পাঁচজনে পারে যাহা,
তুমিও পারিবে তাহা
পার কিনা পার কর যতন আবার
একবার না পারিলে দেখ শতবার।
অধ্যবসায়ের গুণে মানুষ কেমন করে অসাধ্যকে সাধন করে তা এখানে আমরা বোপদেব গোস্বামীর অধ্যবসায়ের গল্পের মাধ্যমে জানব।
প্রায় হাজার বছর আগেকার কথা। তখনকার দিনে প্রাচীনভারতে বিদ্যালয়কে টোল বলা হতো। মহারাষ্ট্রের অধিবাসী বোপদেব গোস্বামী টোলে পড়ালেখা করতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন ক্লাসের সবচেয়ে অমনোযোগী ছাত্র। পণ্ডিত মহাশয় ক্লাসে ব্যাকরণের যেসব সূত্র শেখাতেন, বোপদেব সেসব কিছুই বুঝতে পারতেন না। মনেও রাখতে পারতেন না। এ কারণে তিনি প্রতিনিয়ত টোলে অপমানিত হতেন। পণ্ডিত মহাশয় তাঁর মূর্খতায় খুবই বিরক্ত ছিলেন। তিনি রেগে গিয়ে বোপদেবকে বলতেন, এমন আপদ টোলে আসার চেয়ে টোল বন্ধ হয়ে যাওয়া বরং ভালো। একদিন পণ্ডিত মহাশয় বোপদেবকে টোল থেকে বের করে দেন। বলে দেন, সে যেন আর টোলে না আসে। মনে একরাশ দুঃখ নিয়ে মাথা নিচু করে টোল থেকে বেরিয়ে যান বোপদেব। টোল থেকে বিতাড়িত হওয়ার কারণে হতাশা ঘিরে ধরে তাঁকে। তিনি ভাবতে থাকেন, আমি সত্যিই খুব খারাপ ছাত্র। আমার বি- দ্যাবুদ্ধি কিছুই নেই। আমাকে দিয়ে আর লেখাপড়া হবে না। কিন্তু আমিতো ব্যাকরণের সব সূত্র মনে রাখতে চাই। ক্লাসের পড়া বুঝতে চাই। অথচ কিছুতেই মনে থাকে না! কিছুই বুঝি না। মনের দুঃখে বোপদেব বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। একদিন তাঁর খুব পিপাসা পেয়েছিল। তিনি একটি সানবাঁধানো পুকুরঘাটে যান। জলপান শেষে তিনি পুকুরের ঘাটে বসে থাকেন। হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল ঘাটের পাথরের উপর একটি গোল গর্ত। পুকুরের সানবাঁধানো ঘাটের পাথরগুলো সব ঠিকঠাকই আছে। শুধু একটি নির্দিষ্ট জায়গাতেই গোল চাকতির মতো ঐ গর্ত। তাঁর মনে প্রশ্ন জাগল, শক্ত পাথরের গায়ে কেমন করে এ রকম গর্ত হলো? মনে মনে তিনি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লাগলেন। এমন সময়ে একজন মহিলা ঐ পুকুর-ঘাটে এল। তার কাঁখে একটি মাটির কলসি। কলসিতে জল ভরে তিনি নামিয়ে রাখেন গর্ত হওয়া পাথরের উপর। তারপর জলভরা কলসি নিয়ে মাহিলাটি বাড়ি চলে যান।
বোপদেব তখন বুঝলেন, দিনের পর দিন সানবাঁধা- নো ঘাটে জলভরা মাটির কলসি নির্দিষ্ট স্থানে বারবার রাখার ফলে কলসির ঘষায় ঘষায় কঠিন পাথরের উপর কলসির মাপে গর্ত হয়েছে। এই দৃশ্য দেখে তিনি চিন্তা করলেন, কী আশ্চর্য! মাটির কলসির অবিরাম ঘর্ষণে পাথরও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। নিরেট পাথরের বুকে দিনের পর দিন মাটির কলসির রাখার ফলে যদি গর্ত হতে পারে তাহলে বারবার পাঠ করলে আমিইবা পড়া মনে রাখতে পারব না কেন! কেনইবা বারবার চেষ্টা করেও বুঝতে পারব না! নিজেকে প্রশ্ন করলেন, আমি কি পাথরের চেয়েও নিরেট? তিনি বুঝলেন, বারবার চেষ্টা করলে আমি নিশ্চয়ই ব্যাকরণশাস্ত্রের জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হব। তিনি হতাশা ত্যাগ করে ছুটে গেলেন পণ্ডিত মহাশয়ের কাছে। গিয়ে বললেন নিজের উপলব্ধির কথা।
পণ্ডিত মহাশয় অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন বোপদেবের দিকে। এইতো, এইতো তাঁর চোখ খুলেছে। মনের বিস্তার ঘটেছে। মন ভাবতে শিখেছে! এতদিন তিনি তো বারবার বোপদেবকে ভাবাতেই চেয়েছিলেন। সেই চিন্তনের পাঠ বোপদেব পেয়েছেন প্রকৃতির কাছ থেকে। যে পুত্রসম ছাত্রকে তিনি টোল থেকে বের করে দিয়েছিলেন, তাঁকেই পরমস্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরেন।
এরপর বোপদেব ব্যাকরণশাস্ত্রে জ্ঞান অর্জনের জন্য কঠোর সাধনা করতে লাগলেন। পণ্ডিত মহাশয়ের সহা- য়তায় তিনি দুর্বোধ্য ব্যাকরণ আয়ত্ত করতে সক্ষম হলেন। একসময়ে বোপদেব নিজেই সংস্কৃত ব্যাকরণকে সূত্রায়িত করেন। যে ব্যাকরণশাস্ত্র ছিল একসময়ে একেবারেই দুর্বোধ্য, সেই শাস্ত্রের সূত্রগুলো নিয়েই বোপদেব রচনা করেন একটি আধুনিক ব্যাকরণগ্রন্থ। বোপদেবের এই বিখ্যাত ব্যাকরণ গ্রন্থের নাম 'মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ'। এমন সহজবোধ্য ব্যাকরণ সেকালে আর দ্বিতীয়টি ছিল না। ব্যাকরণশাস্ত্রকে সরলতম করাই ছিল তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। তাঁর লেখা এই ব্যাকরণ বই ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। বোপদেব কবিকল্পদ্রুম ও তার কামধেনু টাকা, মুক্তাফল ও হরিলীলা বর্ণনা, শতশ্লোকী ও ধর্মশাস্ত্র ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করেন।
অপমান থেকে আত্মজিজ্ঞাসা, ক্ষণিকের দেখা থেকে দর্শন বোপদেবের চোখ খুলে দিয়েছিল। কঠোর সংকল্প ও অধ্যবসায়ের এক অনবদ্য নজির স্থাপন করেন ক্লাসের সবচেয়ে নির্বোধ পড়া-না-পারা ছাত্রটি। কঠোর অধ্যবসা- য়ের বলে মানুষ কী করে সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারে, বোপদেব গোস্বামীর গল্পটি তার অনবদ্য উদাহরণ।
ছক ৩.৬: সাফল্য-সূত্র ছক
|
মাতা ও পিতা আমাদের পরম গুরু। হিন্দুধর্ম মতে, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। অর্থাৎ জননী ও জন্ম- ভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।
পিতা সম্পর্কে হিন্দুধর্মে বলা হয়েছে-
পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্মঃ পিতাহি পরমন্তপঃ।
পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্বদেবতাঃ।।
অর্থাৎ পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাই পরম তপস্যা। পিতা প্রীত হলে সকল দেবতা তুষ্ট হন।
যা কিছু করা হয় তাই কর্ম। আর যেসব কর্ম অনুশীলন করা আবশ্যক তাই কর্তব্য। কর্তব্যের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধকে বলে কর্তব্যবোধ। পৌরাণিক কাহিনিতে আমরা মাতাপিতার প্রতি কর্তব্যবোধের অনেক উদাহরণ দেখেছি। রাম পিতৃসত্য পালনের জন্য চৌদ্দ বছর বনবাস করেছিলেন, ভীম মায়ের আজ্ঞায় রাক্ষসের মুখে যেতেও কুণ্ঠিত হননি। শাস্ত্র অনুযায়ী, মাতাপিতার প্রতি ভক্তিমান নয় এমন সন্তান কাম্য নয়। মাতা-পিতার সঙ্গে সবসময়ে নম্রতা ও বিনয়ের সঙ্গে কথা বলা প্রত্যেকটি সন্তানের একান্ত কর্তব্য। তাদের জীবনে যখন বা- র্ধক্য আসে, কর্মজীবন থেকে অবসর নিতে হয়, তখন অনেকেই অন্যের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। শৈশবে সন্তান যেমন মাতাপিতার প্রতি একান্তভাবে নির্ভর করত, ঠিক তেমনিভাবে বৃদ্ধাবস্থায় তাদের দায়িত্ব নেওয়া প্রত্যেকটি সন্তানের জন্য আবশ্যক। যে সন্তান পরিণত বয়স পর্যন্ত মাতাপিতার সেবা করার সুযোগ পান তিনি ভাগ্যবান। নিজের কর্ম এবং চরিত্র দ্বারা মাতাপিতাকে তুষ্ট করা প্রত্যেকটি সন্তানের অবশ্য কর্তব্য।
ছক ৩.৭: আমার কর্তব্যবোধ
১.
|
২.
|
৩.
|
এখানে আমরা মাতাপিতার প্রতি কর্তব্যপরায়ণ এক পুত্রের কাহিনি জানব। রামায়ণে এই গল্প আছে।
সিন্ধুমুনি ছিলেন অত্যন্ত মাতৃপিতৃভক্ত। তাঁর পিতা ও মাতা দুজনেই ছিলেন অন্ধ। মুনি অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে মা- তাপিতার সেবা করতেন। তাঁর পিতা অন্ধকমুনি নামে পরিচিত ছিলেন। সিন্ধুমুনি তাঁর অন্ধ পিতামাতাকে একটা ভারে করে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যেতেন। একবার তাঁর মাতা-পিতার তীর্থযাত্রার ইচ্ছে হলো। পুত্র সিন্ধুমুনি তাঁদের ভারে তুলে কাঁধে করে রওনা হলেন। পথে মাতা-পিতা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়েন।
সিন্ধুমুনি তাঁদের জন্য জল আনতে কলসি নিয়ে সরযূ নদীতে যান। এসময়ে অযোধ্যার রাজা দশরথ সেই বনে শিকার করতে আসেন। শিকার খুঁজে খুঁজে তিনি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। দশরথ তখন সেই জলাশয়ের তীরে একটি গাছের নিচে বসে বিশ্রাম করতে লাগলেন। সিন্ধুমুনি যখন কলসিতে জল ভরছিলেন, রাজা দশরথের কানে সে শব্দ পৌঁছায়। তিনি চোখে না দেখে কেবল শব্দ শুনেই তীর ছুঁড়ে শিকার করতে পারতেন। একে বলে শব্দভেদী বাণ। রাজা দশরথ কলসিতে জল ভরার শব্দকে হরিণের জল খাওয়ার শব্দ বলে ভাবলেন। তিনি শব্দের দিকে লক্ষ করে বাণ ছুঁড়ে মারেন। সেই বাণ সিন্ধুমুনিকে বিদ্ধ করে। বাণবি- দ্ধ মুনি সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়েন। হরিণ শিকার করেছেন ভেবে রাজা দশরথ সেটি আনতে যান। কিন্তু এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে দশরথ ভীষণ অনুতপ্ত হন। তিনি শুশ্রুষা করে সিন্ধুমুনির জ্ঞান ফিরিয়ে আনেন। দশরথের অনুতাপ দেখে মুমূর্ষু সিন্ধুমুনি তাঁকে আর কোনো অভিশাপ দেননি। মৃত্যুকালে তিনি নিজের জীবনের জন্য কোনো দুঃখও করেননি। কেবল অন্ধ মাতাপিতার আসন্ন কষ্টের কথা ভেবে তাঁর হৃদয় ব্যথায় ভরে উঠল। মুনি গভীর দুঃখে বললেন, আমার বৃদ্ধ মাতাপিতার শুশ্রুষা আর ভরণ-পোষণের সমস্ত দায়িত্ব ছিল আমার ওপরে। আমাকে ছাড়া তাঁরা কী করে বাঁচবেন! তাঁরা কী করে পুত্রশোক সহ্য করবেন! মৃত্যুর আগে সিন্ধুমুনি দশরথের কাছে বললেন, আমাকে মাতাপিতার কাছে নিয়ে চলো। এদিকে সিন্ধুমুনির মাতাপিতা ছেলের দেরি দেখে দুশ্চিন্তা করছিলেন। পাতার মচমচ শব্দ শুনে তারা ভাবলেন, এই বুঝি ছেলে এল! কিন্তু দশরথের কোলে সন্তানের মৃতদেহ রয়েছে বুঝতে পেরে তাঁরা হাহাকার করে উঠলেন। অন্ধকমুনি রাজা দশরথকে পুত্রহারা হওয়ার অভিশাপ দিলেন।
সিন্ধুমুনি মৃত্যুকালে রাজা দশরথকে নিজের মাতাপিতার দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেছিলেন। অন্ধকমুনির অভিশাপ সত্ত্বেও দশরথ তাঁদের দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
প্রত্যেক মানুষেরই সবটুকু সাধ্য দিয়ে মাতাপিতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করা উচিত। সিন্ধুমুনির জীবন তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই কর্তব্যবোধের কারণে তিনি আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর এই দৃষ্টান্ত সকলের জন্য অনুকরণীয়।
নিজের মা/ বাবা/ অভিভাবক- যে-কোনো একজনের সারাদিনের কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করে তালিকাটি তৈরি করি।
তাঁর কাজের ফলে আমার যেসব মঙ্গল/ভালো হয় সেগুলোর তালিকা করি।
ছক ৩.৯: আমাদের মঙ্গলের তালিকা
|
বাবার/ মায়ের/ অভিভাবকের প্রয়োজন বুঝে তাঁর জন্য নিজের হাতে একটি উপহার তৈরি করে শ্রেণিকক্ষে এনে সবাইকে দেখাই।
উপহারটি পেয়ে মা/ বাবা/ অভিভাবকের অনুভূতি মন্তব্য হিসেবে লিখে আনি।
যে উপহারটি দিয়েছি
|
যে কারণে এটি দিয়েছি
|
মা/ বাবা/ অভিভাবকের মন্তব্য
|
|
|
|
ছক ৩.১০: ইথিক্স ক্লাব কার্যক্রম তালিকা
১. নিজেদের করা ভালো কাজগুলো এবং নিজেদের অনুভূতি সদস্যদের সামনে নিয়মিতভাবে উপস্থাপন করব। ২. নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হওয়ার জন্য আমাদের করণীয় সম্পর্কে আলাপ করব। ৩. ব্যক্তিগত এবং দলীয়ভাবে ভালো কাজ করার পরিকল্পনা করব এবং তা বাস্তবায়ন করব। 8. ৫. ৬.
|
ইথিক্স ক্লাব-কার্যক্রমের শুরুতে আমরা প্রত্যেকে প্রথমে নিচের কাজদুটো করি।
ছক ৩.১১: চেতনার পরিচয়
নৈতিক মূল্যবোধের নাম | তারিখ | কাজের বর্ণনা | আমার অনুভূতি |
|
|
|
|
ইন্দ্রাণী বাবা-মায়ের সঙ্গে দাদুর বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছে। কতদিন ধরে তার জন্য তোড়জোড়! ছুটি নেওয়া, কেনাকাটা, গোছগাছ, বাসের টিকিট কাটা- কত প্রস্তুতি! শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট দিনে তারা রওনা দিল। বাসে ওঠার সময়ে বাবা বললেন, তাড়াহুড়ো করো না। আগে লোকজনকে নামতে দাও, তারপরে ওঠো। বাসে উঠে ইন্দ্রাণীর জানালার পাশের সিটটায় বসার ইচ্ছে হয়েছিল, কিন্তু সেখানে এক ভদ্রমহিলা বসে ছিলেন।
তিনি বললেন, তুমি চাইলে এখানটায় বসতে পার। ও খুব খুশি হয়ে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে জানালার পাশে গিয়ে বসল। একটু পরেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি নামল। সকাল থেকে আজ ভ্যাপসা গরম। এই বৃষ্টিটা ওর কি যে ভালো লাগল! ইন্দ্রাণী জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির জল গায়ে মাখতে চাইল। কিন্তু পাশের সিট থেকে ভদ্রমহিলা ওকে বললেন, হাতটা ভেতরে ঢোকাও। চলন্ত গাড়িতে এ রকম করা খুব বিপজ্জনক। ইন্দ্রাণী একটু বিব্রত হলো, সত্যিই তো! একটু পরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল। বৃষ্টির ছাঁট ওর শরীরেও লাগছিল। আহ্, কী আরাম! কিন্তু মা বললেন, জানালাটা বন্ধ করো। অন্যদের অসুবিধা হচ্ছে। বাসটা যখন ওর দাদুর বাড়ির স্টপেজে থেমেছে, বৃষ্টিটা তখন আর নেই। ইন্দ্রাণীরা বাস থেকে নামছে। ওর ইচ্ছে ছিল বাসের দরজা থেকে এক লাফে নামবে। ঠিক তখনই বাবা পেছন থেকে বলল, বাম পা আগে দেবে, তারপরে ডান পা। 'উফ্, কত যে নিয়ম-কানুন!' ইন্দ্রাণীর কণ্ঠে বিরক্তি। মা বললেন, 'সব জায়গার মতন পথে বের হবারও কিছু নিয়ম-কানুন থাকে। নিয়ম মেনে চলাটা একটু অসুবিধের বলে মনে হয়, কিন্তু কোনো নিয়ম না থাকলে পদে পদে অসুবিধে হতে থাকে'। ইন্দ্রাণী নিজের আচরণের জন্য লজ্জিত হয়ে বাবা-মায়ের কাছে দুঃখ প্রকাশ করল। মা হাসলেন। বাবা ওর হাত ধরে বললেন, ঠিক আছে। চলো এবার।
ইন্দ্রাণীর মতন আমাদেরও হয়তো মাঝে মাঝে নিয়ম-কানুন মানতে অসুবিধা বোধ হয়। কিন্তু কোনো নিয়ম না থাকলে বেড়াতে যাওয়াই হোক, কী বিদ্যালয়ের ক্লাস করাই হোক, কত যে অসুবিধা হয়, তা তো আমরা সবাই বুঝি। আজকে আমরা ক্লাসের বাইরে ক্লাস করব। অর্থাৎ ফিল্ড ট্রিপে যাব। আমাদের গন্তব্য হবে কোনো মন্দির সেবাশ্রাম কিংবা হিন্দুধর্মীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। বেড়াতে যাওয়ার মত ফিল্ড ট্রিপে যাওয়ারও কিছু নিয়ম-কানুন আছে।
ছক ৩.১২: ফিল্ড ট্রিপে পালনীয় নিয়মাবলি
১. ২. ৩. ৪. ৫.
|
অনুমতি পত্রের নমুনা
ফিল্ড ট্রিপে গিয়ে সবকিছু মন দিয়ে দেখব। নানান বিষয়ে প্রশ্ন করে জেনে নেব। যেমন: প্রতিষ্ঠানটি কী কী কাজ করে, প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, প্রতিষ্ঠানটি কী কী সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা বা সেবায়েত অথবা প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো মহামানবের জীবন, কর্ম ও দর্শন সম্পর্কিত তথ্য ইত্যাদি। এই তথ্যগুলো নিচের ছক আকারে সংক্ষেপে খাতায় লিখে রাখব।
ছক ৩.১৩ (ক): তথ্য সংগ্রহের নমুনা
ছক ৩.১৩ (খ): প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান চ্যালেঞ্জসমূহ/ সীমাবদ্ধতাসমূহ |
|
ছক ৩.১৩ (গ): প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা |
|
ছক ৩.১৩ (ঘ): প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতার (সেবায়েত/ সংশ্লিষ্ট মহামানব) জীবন, কর্ম ও দর্শন |
|
মানুষ যুগে যুগে জীবনের উৎস, উদ্দেশ্য আর পরিণতির কথা ভেবেছে। তার মনে তৈরি হয়েছে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে নানা প্রশ্ন। সেসব প্রশ্নের উত্তর সে কখনো খুঁজেছে ধর্মে, কখনো বিজ্ঞানে, কখনো দর্শনে, কখনোবা নিজের অন্তরে। আবার যুগে যুগে যেসব মহামানব জন্মেছেন তাঁদের জীবনদর্শনও অপরের জীবন-জিজ্ঞাসার উত্তর দিয়েছে। আমরা এখানে হিন্দুধর্মের কয়েকজন আদর্শ মানুষের কথা জানব। যাঁরা নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন ঈশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য। তাই তাঁরা কেবল নিজের ভালোর কথা না ভেবে ঈশ্বরের সমস্ত সৃষ্টির মঙ্গলের কথা ভেবেছেন। ঈশ্বর আর তাঁর সৃষ্টির সেবার জন্য তৈরি করেছেন বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। এসব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁরা ইহলোক ত্যাগ করার পরও স্রষ্টা ও সৃষ্টির সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন। এবার আমরা এরূপ কয়েকজন মহামানব এবং মহামানবদের প্রতিষ্ঠিত দুটি ধর্মীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের কথা বিশদভাবে জানবো।
গোপালগঞ্জ জেলার সাফলিডাঙ্গা গ্রামে বাস করতেন যশোমন্ত ঠাকুর ও অন্নপূর্ণা দেবী দম্পতি। তাঁরা ছিলেন পরম বৈষ্ণব। লোকশ্রুতি আছে, অন্নপূর্ণা দেবী একদিন ভাবাবেশে দেখতে পান শিশু কৃষ্ণ তাঁকে 'মা' 'মা' বলে ডাকছেন। আর তাঁর স্তন্য পান করছেন। সেদিন সাধু রমাকান্ত এলেন তাঁদের বাড়িতে। অন্নপূর্ণা দেবীর ভা- বাবেশের ঘটনা শুনে তিনি বললেন, 'মা, তোমার গর্ভে বাসুদেব জন্মগ্রহণ করবেন'। এর কিছুদিন পরে ১৮১২ সালের ১১ মার্চ, কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে তাঁদের কোলে এলো এক পুত্রসন্তান। নাম রাখা হলো হরিদাস। ছোট্ট শিশু হরিদাস কালক্রমে ভক্তদের মুখে মুখে হয়ে ওঠেন হরিচাঁদ ঠাকুর।
তখনকার সামাজিক বিধিনিষেধের কারণে হরিচাঁদ ঠাকুরের পাঠশালায় যাওয়া হয়নি। দিনের বেশি- রভাগ সময় কাটতো বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে-ঘাটে গরু চড়িয়ে। তাঁর সুন্দর চেহারা, অমায়িক ব্যবহার, মধুর স্বরের গান, ভজন, কীর্তন সবাইকে মুগ্ধ করত। প্র- থাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও প্রখর বুদ্ধিমত্তা তাঁর মনকে বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিনির্ভর করে গড়ে তুলেছিল। সেই সময়ের গ্রাম-গঞ্জে চিকিৎসার তেমন সুযোগ ছিল না। ওঝাদের ঝাঁড়ফুক, তাবিজ-কবচই ছিল মূল ভরসা। হরিচাঁদ ঠাকুর নিজস্ব প্রজ্ঞার বলে গ্রামের লোকদের রোগমুক্তির জন্য প্রাকৃতিক চিকিৎসার নানা বিধান দিতেন। সেইসঙ্গে রোগীর মনোবল বৃদ্ধির জন্য রোগীকে সঙ্গে নিয়েই হরিবোল নামের কীর্তন করতেন। এই চিকিৎসা এবং নামকীর্তনের ফলে রোগীর মানসিক শক্তি বেড়ে যেত, যার ফলে অধিকাংশ রোগেরই উপশম হতো। তিনি অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসায় বিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু হরিনামে ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। লোকে যে-কোনো সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে এলে তিনি মনপ্রাণ দিয়ে হরিনাম করতে বলতেন। তাতেই ঘটত আশ্চর্য ঘটনা- গিরিধর বালার জ্বর সেরে গেলো, গোস্বামী গোলোকের গলার ব্যথার নিরাময় হলো, মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের পিত্ত যন্ত্রণার অবসান হলো, অন্ধ রামধন ফিরে পেলো দৃষ্টিশক্তি। এমনকি কবি আনন্দ সরকারের পুত্র লাভ হলো। লোকের মুখে মুখে রটে গেলো- হরিচাঁদ অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী।
ছোটবেলা থেকেই হরিচাঁদ ঠাকুর ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এই ভাবটি বাড়তে থাকে। তাঁর মধ্যে ধর্মভাব প্রবল হতে থাকে। তিনি মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত প্রেমভক্তির বহমান ধারাকে আরও সহজভাবে এগিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলতেন, "ভক্তির সঙ্গে হরির নাম নিলেই ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে।" তাঁর মতের সরল ব্যাখ্যা এ রকম, এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের মধ্যে একটি ঐক্যের সুর আছে। এই সুরটি প্রেমের সুর। আর এই প্রেমের ঘনীভূত নির্যাস নিহিত আছে হরিনামে। হরিনাম যে করে সে প্রেমের সমুদ্র মন্থন করে। সমুদ্র মন্থনে যেমন অমৃত উঠে এসেছিল, তেমনি হরিনামের মাধ্যমে ভক্তের সামনে উঠে আসে ঈশ্বর স্বরূপ অমৃত মাধুরী। সেই অমৃত মাধুরীর মধ্যে অবগাহন করার মানে ঈশ্বরের সাথে মিশে যাওয়া। ঈশ্বরকে পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম। হরিনাম করা। তাঁর হরিনাম সংকীর্তনের এই সাধন-ভজনের পথ বা মতবাদের নাম 'মতুয়াবাদ'। আর তাঁর অনুসারীদের বলা হয় 'মতুয়া'। এর অর্থ যারা হরিপ্রেমে মত্ত থাকে। মতুয়াবাদের মূল কথা হচ্ছে মনুষ্যত্ব অর্জন, আত্মোন্নতি এবং সার্বিক কল্যাণ সাধন। সত্য, প্রেম ও পবিত্রতা-এই তিনটি স্তম্ভের ওপর মতুয়াবাদ প্রতিষ্ঠিত।
হরিচাঁদ ঠাকুর সমাজের পিছিয়ে পড়া, নিপীড়িত মানুষের জন্য আজীবন কাজ করেছেন। কৃষকদের প্রতি নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি গোপালগঞ্জ মহকুমার জোনাসুর নীলকুঠি অভিযানে নেতৃত্ব দেন। সংসার প্রতিপালনের জন্য তাঁকে গ্রামে গ্রামে জিনিসপত্র ফেরি করা থেকে শুরু করে চাষাবাদ- সবই করতে হয়েছে। তিনি গ্রামের পিছিয়ে পড়া মানুষদের আর্থিক উন্নয়নের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার এবং উন্নততর পদ্ধতিতে অনাবাদী জমি চাষের ব্যবস্থা করেন। তিনি অনগ্রসর, নিষ্পেষিত মানুষের আত্মশক্তি- কে জাগানোর ওপরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। চেয়েছেন, শত শতাব্দীর বিধিনিষেধ আর অত্যাচারের অবসান। তিনি সবাইকে কাজ করতে বলেছেন। সন্ন্যাসধর্মে তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। বরং সংসারের দায়িত্ব পালনের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি নিজেও শান্তিবালা দেবীকে বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। জাতির উন্নতির জন্য সকলের মধ্যে শিক্ষাপ্রসারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি স্বল্পকালীন জীবদ্দশায় তখ- নকার পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যে শিক্ষার প্রসারে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁর এ কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরকে নির্দেশ দিয়ে যান। হরিচাঁদ ঠাকুর সংঘবদ্ধতার ওপর জোর দেন। মতুয়াবাদীরা তাই তৈরি করেছেন মতুয়া মহাসংঘ।
সমস্ত মানুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠাই মতুয়াধর্মের মূল উদ্দেশ্য। নারীর প্রতি সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যের বি- রুদ্ধেও হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর মত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, নারীকে অবজ্ঞা করে আদর্শ গার্হস্থ্যধর্ম প্রতিষ্ঠা করা যায় না। নারী গৃহের কেন্দ্রস্থল। নারীকে সঙ্গে নিয়ে ধর্মপথে অগ্রসর হতে হয়। এজন্যই তিনি নারীশিক্ষা, নারীর মর্যাদা দান ও অধিকার রক্ষার জন্য সবাইকে নির্দেশ দেন।
ছক ৩.১৪: আজ্ঞাপালন
আজ্ঞা
|
| ২.
| ৩.
|
অর্থ
|
১৮৭৮ সালের ৬ মার্চ হরিচাঁদ ঠাকুর ইহলীলা সংবরণ করেন। ঠাকুরের জীবন ও আদর্শ নিয়ে হরিভক্ত কবিয়াল তারকচন্দ্র সরকার রচনা করেন 'শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত' গ্রন্থ। হরিচাঁদ ঠাকুরের ভক্তগণ তাঁকে বিষ্ণুর অবতার বলে মানেন। তাঁরা বলেন-
রাম হরি কৃষ্ণ হরি হরি গোরাচাঁদ।
সর্ব হরি মিলে এই পূর্ণ হরিচাঁদ।।
ঠাকুরের অন্তর্ধানের পর তাঁর ছেলে গুরুচরণ 'গুরুচাঁদ' নামে মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রধানরূপে পূজিত হন। বাংলা- দেশের বিভিন্ন এলাকায় হরিমন্দির আছে। সেসব মন্দিরে ভক্তগণ নিয়মিত নামকীর্তন করেন, হরিচাঁদ ঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে আছে প্রধান হরিমন্দির। সেখানেই মতুয়া সম্পদায়ের মূল কেন্দ্র। প্রতিবছর চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে অর্থাৎ হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথিতে ওড়াকান্দিতে মহাবারুণী স্নান অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তিনদিন পর্যন্ত বারুণী মেলা বসে। এই স্নান ও মেলায় হাজার হাজার ভক্ত ও পর্যটকের সমাবেশ ঘটে।
ছক ৩.১৫: সমাজকর্ম
সমস্যা | সমাধান |
|
|
১৮৯৬ সালের ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া (তৎকালীন ত্রিপুরা) জেলার খেওড়া গ্রামের আকাশ ছিল মেঘা- চ্ছন্ন। একসময় আকাশ জুড়ে দেখা দিল আলোকছটা। এমন একটা সময় বিপিনবিহারী ভট্টাচার্যের পত্নী মোক্ষদা সুন্দরীর কোল আলো করে জন্ম নিলেন শিশুকন্যা নির্মলা। এই নির্মলা একদিন 'মা আনন্দময়ী' নামে সারা বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষে আলো ছড়ান।
পাঁচ বছরের নির্মলা একদিন বাবার কাছে জানতে চান, হরি নাম করলে কী হয়? বাবা বিপিনবিহারী বলেন, হরির নাম করলে হরিকে দেখা যায়, মা। মেয়ে আবার প্রশ্ন করে, হরি কি খুব বড়, বাবা? বাবা বলেন, হ্যাঁ গো, হরি যে খুব বড়। ছোট্ট নির্মলা বুঝে উঠতে পারে না, এই 'খুব বড়'টা কত বড়! শেষ পর্যন্ত সামনের মাঠটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেন, এই মাঠের মতো বড়? হেসে ফেলেন বিপিনবিহারী। বলেন, এর চেয়ে অনেক অনেক বড়। তুই তাঁকে ডাকলেই জানতে পারবি তিনি কত বড়! বাবার কথা শুনে ছোট্ট মেয়েটি মনেপ্রাণে হরিকে ডাকতে থাকেন। হরিনাম কীর্তন তাঁকে আনন্দ দিল।
গ্রামের পাঠশালায় নির্মলার পড়াশোনা শুরু হলেও তা বেশিদূর এগোয়নি। চৌদ্দ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় রম- লীমোহন চক্রবর্তীর সঙ্গে। রমণীমোহনকে তিনি ডাকতেন 'ভোলানাথ' নামে। পরে তিনি ওই নামেই পরিচিত হয়েছিলেন। ভোলানাথ বাজিতপুরে চাকরি করতেন। বিয়ের প্রায় দশ বছর পর নির্মলা স্বামীর কর্মস্থলে যান। সেখানে তাঁর মধ্যে ক্রমশই দিব্যভাব প্রকাশিত হতে থাকে। কোথাও কৃষ্ণনাম শুনলে তিনি আকুল হয়ে যান। একবার ভূদেবচন্দ্র বসুর বাড়িতে কীর্তন শুনতে শুনতে নির্মলা অজ্ঞান হয়ে যান। তখন তাঁর দেহ থেকে দিব্য আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। এভাবে নির্মলার মধ্যে মহাভাবের শুরু হয়। মা আনন্দময়ীর পুরো জীবন জুড়ে রয়েছে নানারকম অলৌকিক ঘটনার জনশ্রুতি।
১৯২৪ সালে ভোলানাথ নবাবের বাগানে চাকরি নিয়ে ঢাকার শাহবাগে চলে আসেন। সঙ্গে আসেন নির্মলাও। এই শাহবাগের কালী মন্দিরে নির্মলার মধ্যে মাতৃমূর্তি প্রকটিত হয়। নির্মলা নিজের যোগ-বিভূতির ঐশ্বর্যে হয়ে উঠলেন 'মা আনন্দময়ী'। এখানেই তাঁর সাধন-ভজন চলতে থাকে। ১৯২৬ সালে সিদ্ধেশ্বরীতে তাঁর আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। মা আনন্দময়ী মায়ের আদি আশ্রম এটি।
ঢাকার নবাবের মেয়ে প্যারীবানু মাকে অত্যন্ত ভক্তি করতেন। ১৯২৭ সালে তিনি নিজের পুত্র ও কন্যার বিয়েতে মা আনন্দময়ীকে বিশেষ আমন্ত্রণ জানান। তিনি বিয়েতে আসেন। প্যারীবানুর বাড়িতে মায়ের কণ্ঠে কীর্তন শুনতে এসেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তীদেবী। আনন্দময়ী মায়ের সর্বাঙ্গে এক দিব্যভাব, মুখম- গুলে এক স্বর্গীয় সুষমা। বাসন্তীদেবী স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মা আনন্দময়ীর দিকে... আর কোনোদিকেই তাঁর লক্ষ্য নেই। পরে এর কারণ জানা গেল; চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর কয়েকদিন আগে আনন্দময়ী মাকে তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন। স্বপ্নে মা তাকে জানিয়েছিলেন, বাসন্তীদেবীর ভয়ানক বিপদ আসছে। অথচ তখন অবধি তিনি মাকে চিনতেন না!
১৯৩২ সালে মা আনন্দময়ী স্বামীসহ চলে যান উত্তর ভারতের দেরাদুনে। দিব্যভাবের পরিচয় পেয়ে সেখানকার অনেকেই তাঁর ভক্ত হয়ে ওঠেন। অনেক নগর, জনপদ, তীর্থ ভ্রমণ করে, অনেক মানুষকে কৃপা করে মা আন- ন্দময়ী আসেন হরিদ্বারে। দেরাদুনে যাওয়ার বছর পাঁচেক পরে, সেবার কুম্ভমেলায় যোগস্নানে ভক্তদের নিয়ে মা এসেছেন। উঠেছেন ভক্ত ডা, পীতাম্বর পন্থর বাড়িতে। গঙ্গাতীরে ডা. পন্থের বাড়িটাকেই মা 'আনন্দময়ী সেবাশ্রম' করে গড়ে তুলেছেন। এখানে আসার দুই একদিন পরেই মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসকেরা মায়ের ক্যা- সার হয়েছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করলেন। ফলে সকলেই উদ্বিগ্ন, দিশেহারা। সবাই ধরে নিলেন, মাকে এবার আর বাঁচানো যাবে না। একদিন মা ভক্ত অভয়কে নামকীর্তন করার নির্দেশ দিলেন। কীর্তনানন্দে সবাই ভেসে গেলেন, সেইসঙ্গে ভেসে গেল মায়ের রোগ-ব্যাধিও।
মা আনন্দময়ীর কাছে জগৎ নৃত্যময়। মাটিতে একটি বীজের যখন অঙ্কুরোদ্াম হয়, সেটা কিন্তু তখন নৃত্যের ভঙ্গিমায় বেড়ে ওঠে। গাছটি বেড়ে উঠতে উঠতে একটা সময় সেই মাটিতেই মিলিয়ে যায়। তাই তিনি বলছেন, এই তরঙ্গ- রূপ নৃত্য যা থেকে শুরু হয়, একসময়ে স্তিমিত হয়ে আবার তাতেই মিলে যায়। তাঁর এই ভাব মূলত জীবাত্মা এবং পরমা- আর সম্পর্কেরই রূপ। তাঁর মতে, ভগবানের খেলা, লীলা, সৃ- ষ্টি-স্থিতি-লয় সবই নৃত্যরূপে প্রকাশ। নৃত্যশিল্পী পণ্ডিত উদয়- শঙ্করও নৃত্য সম্পর্কে মায়ের বিশ্লেষণ শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
মা আনন্দময়ী বলতেন, "সংসারটা ভগবানের; যে যেই অবস্থায় আছে, সেই অবস্থা থেকে কর্তব্যকর্ম করে যাওয়া মানুষের কর্তব্য।" এটাই মায়ের মুখ্য বাণী।
মা আনন্দময়ীর আরও কিছু বাণী
মা আনন্দময়ী তৎকালীন ভারতবর্ষের জনগণকে ভগবমুখী করার কাজে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তিনি পুরো উপমহাদেশে অনেকবার ভ্রমণ করেছেন। তিনি অন্যান্য দেশেও গিয়েছেন। ভারতীয় সংস্কৃতির মর্মস্থল, সহস্র ঋষির তপোভূমি নৈমিষারণ্যকে তিনি জাগরিত করেন। এখন সেখানে কীর্তন, নাচ, গান, ধর্মগ্রন্থপাঠ, সৎসঙ্গ ইত্যাদি কর্মকান্ড চলছে। এভাবে তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থানের ম্লান হয়ে ওঠা এবং হারিয়ে যাওয়া ধর্মস্থানকে জাগ্রত করেছেন। সেখানে যাগ-যজ্ঞ, মন্দির, বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে সনাতন ধর্মের ভাব- ধারায় একাত্ম করেছেন। বাংলাদেশের রমনা ও খেওড়ার দুটি আশ্রমসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে তাঁর নামে প্রায় পঁচিশটি আশ্রম, বিদ্যাপীঠ, হাসপাতাল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
মা আনন্দময়ীর সান্নিধ্যে এসেছেন দেশের অতি সাধারণ গ্রামবাসী থেকে শুরু করে ভারতের অনেক জ্ঞানী-গুণী। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখ তাঁর প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন। এঁরা মায়ের সঙ্গে দেখাও করেছেন। তাঁর দেখা হয়েছে মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রোমেন রোল্যান্ডের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে। তিনি পরমহংস যোগানন্দ, রমণা মহর্ষি, স্বামী শিবানন্দ এবং মাদার তেরেসার মতো অন্যান্য আধ্যাত্মিক শিক্ষকদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন।
মা আনন্দময়ী কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন না। সব মানুষই তাঁর স্নেহের পাত্র ছিল। তিনি সর্বজনীন প্রেম ও সম্প্রীতির শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ঈশ্বর সবকিছুর মধ্যে বিরাজমান। মানুষের জীবনের লক্ষ্য হলো নিজের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করা। তিনি মানুষকে ধ্যান, প্রার্থনা, সেবা এবং আত্মানুসন্ধান করতে বলতেন। আনন্দময়ী স্বামী ভোলানাথ ছাড়া কাউকে দীক্ষা দেননি এবং নিজেও কারোর কাছে দীক্ষিত হননি। মা আনন্দময়ী সমাধিস্থ হয়ে বহু মন্ত্র বীজসমেত উচ্চারণ করতেন। সেই সমস্ত মন্ত্র লিখে রাখতেন ভোলানাথ। মা বলতেন, যখন কেউ দীক্ষা নিতে আসবে, তখন এই মন্ত্রই তাদের দেবে। তবে তিনি বলতেন, স্থূলভাবে দীক্ষার প্রয়োজন, সকলের জন্য সব না।
মা আনন্দময়ী ১৯৮২ সালের ২৭ আগস্ট দেহত্যাগ করেন। কথিত আছে, নিজের বিদায়ক্ষনটি তিনি নিজেই স্থির করেন। তার সমাধি মন্দিরের অবস্থান উত্তর ভারতের হরিদ্বারে কনখল আশ্রমে গঙ্গার তীরে। প্রতি বছর হাজার হাজার তীর্থযাত্রী সেখানে যান। মায়ের শিক্ষা এবং উত্তরাধিকার, বিশ্বজুড়ে যারা জীবনে শান্তি, আনন্দ এবং জ্ঞানের সন্ধান করে তাদের অনুপ্রাণিত করে।
মা আনন্দময়ীর বাণী | কার এবং কেন ভালো লেগেছে |
১.
|
|
২.
|
|
৩.
|
|
১৮৯৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর, কলকাতার টালিগঞ্জ এলাকায় মামার বাড়িতে জন্ম নেয় এক শিশু। মামা শিশুটির নাম রাখেন নন্দদুলাল। নন্দদুলালের বাবা গৌরমোহন দে আর মা রজনী দেবী। তাঁরা শিশুটির নাম রাখেন অভ- য়চরণ। তাঁদের বসবাস কলকাতার হ্যারিসন রোডে। অনেক পরে শিশুটির পুরো নাম হয়েছিল কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি অভয়চরণারবিন্দ শ্রীলভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ। স্বামী প্রভুপাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন 'ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস (ইস্কন)', বাংলায় যাকে বলে 'আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ'। তিনি ভক্তিযোগের শিক্ষা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
শৈশবে অভয়চরণ সম্পর্কে জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, 'শিশুটির বয়স যখন ৭০ বছর হবে, তখন তিনি সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশে যাবেন, এক বিখ্যাত ধর্মপ্রচারকরূপে স্বীকৃতি লাভ করবেন এবং ১০৮টি মন্দির প্রতি- ষ্ঠা করবেন।' এই ভবিষ্যদ্বাণীর প্রায় সবটাই তাঁর জীবনে সত্যে পরিণত হয়েছিল। কলকাতার ছেলে অভয়চরণ কেমন করে সারাবিশ্বে কৃষ্ণভাবনামৃত ছড়িয়ে দিলেন সে কাহিনি গল্পকেও হার মানায়।
গৌরমোহন দে ছিলেন একজন শুদ্ধাচারী বৈষ্ণব। তাঁর ইচ্ছে ছেলে অভয়চরণও তাঁর মতো বৈষ্ণব হোক। এজন্য তিনি ছেলেকে নিয়মিত রাধা-কৃষ্ণ মন্দিরে নিয়ে যেতেন। অভয়চরণের মা ছিলেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব পরিবারের কন্যা। তাই তাঁর মধ্যেও বৈষ্ণবভাবের প্রকাশ ঘটেছিল। অভয়চরণ শৈশব থেকেই দেখতেন, মা কেমন সারল্য- ভরে সকলের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করেন, পূজা-পার্বণ করেন- এই ভক্তি ও সারল্য বালক অভয়চরণের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।
অভয় যতই বড় হচ্ছিলেন, ততই ভগবানের বিগ্রহের প্রতি ভক্তি বাড়ছিল। পাঁচ বছরের ছোট্ট অভয়কে বাবা তিন ফুট উঁচু একটা রথ বানিয়ে দেন। এরপর অভয়ের অনুরোধে বাবা তাঁকে রাধা-গোবিন্দ বিগ্রহ কিনে দেন। তখন থেকে নিজের খাবার আগে তিনি রাধা-গোবিন্দকে নিবেদন করতেন, তারপর প্রসাদ গ্রহণ করতেন। সেই পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকেই অভয় প্রতিদিন ধূপ-দীপ জ্বালিয়ে সেই বিগ্রহের আরতি করতেন।
কলেজে পড়বার সময়ে বাইশ বছর বয়সে অভয়চরণের বিয়ে হয় রাধারাণী দত্তের সঙ্গে। তখন তিনি কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজে দর্শনশাস্ত্রের স্নাতক শ্রেণির ছাত্র। সেই সময়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্রতর হচ্ছিল। তাঁরই কলেজে এক ক্লাস উপরে পড়তেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেওয়ার জন্য ছাত্রদের উৎসাহ দিতেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব, বক্তৃতা ও সাংগঠনিক ক্ষমতা অভয়চরণকে মুগ্ধ করে।
মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের প্রতিও অভয়চরণের আকর্ষণ ছিল। গান্ধীর চিন্তাজগৎ পুরোনো ভারতীয় সংস্কৃতির মূলনীতি-প্রভাবিত ছিল। তাঁর কথায় ছিল গীতার স্পষ্ট প্রভাব। অভয়চরণ গান্ধীর বক্তৃতা-বিবৃতি শুনতে এবং পাঠ করতে ভালোবাসতেন। ১৯২০ সালে অভয়চরণ স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময় ইতঃপূর্বে সংঘটিত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রেক্ষিতে গান্ধীজী সম্পূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং ইংরেজদের সবকিছু বর্জনের জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে অভয়চরণ তাঁর স্নাতক ডিগ্রি প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর বাবা তখন ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে ওঠেন। তিনি বন্ধু কার্তিক চন্দ্র বসুর বিখ্যাত ওষুধ কোম্পানিতে ছেলের জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করেন। অভয়চরণের চাকরিজীবন শুরু হয় বোস ল্যাবরেটরির ডিপার্টমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে।
১৯২২ সালে অভয়চরণ বন্ধু নরেন্দ্রনাথ মিত্রের অনুরোধে কলকাতার বাগবাজারের গৌড়ীয় মঠে যান; এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা করতে। সন্ন্যাসীর নাম শ্রীলভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী। সেদিন সন্ন্যাসী তাঁদের বললেন, 'তোমরা শিক্ষিত যুবক। তোমরা কেন সারা পৃথিবী জুড়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী প্রচার করছ না?' অভয় তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, 'আমরা একটি পরনির্ভর দেশের অধিবাসী, প্রথমে ভারতবর্ষকে স্বাধীন হতে হবে। তা নাহলে, ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আপনি কীভাবে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসার করবেন?' সন্ন্যাসী উত্তর দিয়েছি- লেন, 'কৃষ্ণভাবনামৃত ভারতীয় রাজনীতির পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করে থাকতে পারে না।' যুবক অভয় সেই রাতেই শ্রীলভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরকে গুরুরূপে বরণ করে নিয়েছিলেন। গুরু তাঁকে বলেন, 'হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র নামকীর্তন সহজেই সকল শ্রেণির মানুষকে কাছে টানতে পারে। সংসারের সকল রকম দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে শান্তি দিতে পারে। কলিযুগে জীবোদ্ধারের এটাই একমাত্র পথ।'
শ্রীলভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর ছিলেন ভক্তিমার্গের বিদগ্ধ পন্ডিত এবং ৬৪টি গৌড়ীয় মঠের (বৈদিক সংঘের) প্রতিষ্ঠাতা। তিনি এই বুদ্ধিদীপ্ত, তেজস্বী ও শিক্ষিত যুবকটিকে বৈদিক জ্ঞান প্রচারের কাজে জীবন উৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। অভয়চরণ এগারো বছর ধরে গুরুর আনুগত্যে বৈদিক শিক্ষা গ্রহণ করেন।
১৯৩২ সালে অভয়চরণ চাকরিসূত্রে সপরিবারে এলা- হাবাদ চলে যান। সেখানে তিনি চাকরির পাশাপাশি ব্যবসাও শুরু করেন। এর পরের বছর তিনি শ্রীলভ- ক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের কাছে দীক্ষাপ্রাপ্ত হন। গুরু তাঁকে বারবার বলেছেন, 'ইংরেজির ওপরে জোর দাও। অনুবাদে মন দাও, বই ছাপাও।' ইংরেজি বই ও পত্রপত্রিকার মাধ্যমে তিনি সারা বিশ্বে কৃষ্ণভাবনামৃত বা চৈতন্যদেবের বাণী প্রচার করতে চেয়েছিলেন। ১৯৩৬ সালে গুরুর দেহত্যাগের এক মাস আগে, নিজের কর্তব্য সম্বন্ধে গুরুদেবের কাছে জানতে চেয়ে, অভয়চরণ একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠির উত্তরে গুরু অভয়চরণকে বলেছিলেন, 'আমি নিশ্চিত যে, যারা বাংলা ও হিন্দি ভাষা জানে না, সেইসব মানুষের কাছে তুমি ইংরেজিতে আমাদের চিন্তা ও যুক্তি ব্যাখ্যা করতে পারবে। আশা করছি তুমি নিজেকে একজন সুদক্ষ ইংরেজি ধর্ম প্রচারকে পরিণত করবে।' এই কথার ভিত্তিতে অভয়চরণ নতুন করে কাজে নামেন। দুই-তিন বছরের মধ্যে অভয়চরণ বই লিখলেন 'ইনট্রোডাকশন টু গীতোপনিষদ'।
১৯৪৪ সালে অভয়চরণ ইংরেজি সাময়িকী 'ব্যাক টু গডহেড' প্রকাশনা শুরু করেন। তিনি নিজেই এটা সম্পাদনা করতেন, পাণ্ডুলিপি লিখতেন, প্রুফ যাচাই করতেন। এমনকি প্রতিটা কপি নিজেই বিতরণ করতেন। পত্রিকাটি এখনও সারা পৃথিবীতে তাঁর শিষ্যবৃন্দ কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত হচ্ছে। ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির সময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বহু মানুষের মৃত্যু হয়। সেসময়ে অভয়চরণ তাঁর পত্রিকায় গান্ধী-জিন্নাহর সাক্ষা- ৎকার নিবন্ধটিতে লিখেছিলেন, যতদিন পর্যন্ত মানুষ স্বার্থপরতা এবং ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির বাসনার দ্বারা প্রভাবিত থাকবে, ততদিন সাম্প্রদায়িক লড়াই চলবেই। পরমেশ্বর ভগবানের সেবা এবং পারমার্থিক উপলব্ধির ভিত্তিতেই কেবল প্রকৃত ঐক্য স্থাপন করা সম্ভব। সেবছরই তাঁর দার্শনিক জ্ঞান ও ভক্তির উৎকর্ষের স্বীকৃতিরূপে' গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ' তাঁকে 'ভক্তিবেদান্ত' উপাধিতে ভূষিত করেন।
১৯৫০ সালে অভয়চরণ সংসারজীবন থেকে অবসর নিয়ে বানপ্রস্থ আশ্রম গ্রহণ করেন। তখন থেকে তিনি লেখা ও পড়ার কাজে আরও বেশি করে নিবেদিত হলেন। তিনি বৈদিক শাস্ত্র, বিশেষ করে শ্রীমদ্ভগবদ্দীতা এবং শ্রীমদ্ভাগবতের ভাষ্যসহ অনেক বই লিখেছেন। তিনি নিজের পত্রিকা এবং বই তৎকালীন ভারতের বিখ্যাত মনীষীদের কাছে পৌঁছে দিতেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহাত্মা গান্ধী, পন্ডিত রাধাকৃষ্ণান, লালবাহাদুর শাস্ত্রী প্রমুখ। এঁদের সঙ্গে তিনি দেখাও করেছেন। এঁরা তাঁর কাজের উচ্চ প্রশংসা করেছেন।
১৯৫৩ সালে তিনি ঝাঁসীতে নিজের প্রথম শিষ্যকে দীক্ষিত করেন। সেখানে তাঁর নিজস্ব কেন্দ্র ও ভক্তসংঘেরও শুভ উদ্বোধন হয়। কিন্তু থাকার জায়গা এবং প্রয়োজনীয় সহায়তার অভাবে তিনি ঝাঁসী ত্যাগ করেন। তবে বিশ্বব্যাপী ভক্তসংঘ গড়ে তোলার পরিকল্পনাটি ত্যাগ করেননি। ১৯৫৪ সালে অভয়চরণ পরিবার পরিত্যাগ করে গুরুমহারাজের আদেশ পালন করার উদ্দেশ্যে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন। এরপরে তাঁকে বিভিন্ন আশ্রয়ে নানারকম কষ্টভোগ করে দিন কাটাতে হয়েছে। তাঁর কাছে অর্থ ছিল না, বন্ধু-পরিবার ছিল না, তিনি ছিলেন একেবারে একা। তবুও তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল তাঁর গুরুমহারাজের স্বপ্নপূরণ। ১৯৫৬ সালে তিনি শ্রীবৃন্দাবন ধামে চলে যান এবং জীবনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের বিশদ প্রস্তুতি ও অধ্যাপনা শুরু করেন। তিনি সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষা নেন। তাঁর নাম হয় 'অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী'।
অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী ১৯৬৫ সালে প্রায় ৭০ বছর বয়সে জাহাজে চড়ে একা আমেরিকা যান। তাঁকে বিদায় দেওয়ার জন্য জাহাজঘাটে কেউ ছিল না। অচেনা নতুন দেশেও তাঁর অপেক্ষায় কেউ ছিল না। জাহাজ থেকে নেমে ডানে না বাঁয়ে যাবেন তাও জানতেন না। তাঁর সম্বল ছিল কেবল আটটি ডলার, কিছু শুকনো খাবার আর নিজের লেখা বেশকিছু বই। অথচ অনেক ঝড়-ঝাপটা পেরিয়েও প্রবল মনের জোর আর অটল বিশ্বাসে তিনি সেখানে টিকে রইলেন। প্রচার করলেন কৃষ্ণনাম। ক্রমশ তাঁর খ্যাতি আমেরিকা ছাড়িয়ে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। আমেরিকায় পৌঁছানোর এক বছর পরে তিনি নিউইয়র্কে প্রতিষ্ঠা করেন 'আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ' সংক্ষেপে 'ইস্কন' নামে পরিচিত। তিনি অল্প সময়ের মধ্যে এমন অনেক আমেরিকান যুবক-যুবতীকে আকৃষ্ট করেছিলেন যারা বস্তুবাদী সংস্কৃতিতে অসন্তুষ্ট হয়ে জীবনের আধ্যাত্মিক অর্থ খুঁজছিল। তিনি তাদের 'হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।'- এই মহা- মন্ত্র জপ করতে এবং শুদ্ধ জীবনযাপন করতে শিখিয়েছিলেন। তখন তিনি পরিচিত হন 'শ্রীলভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ' নামে। তাঁর কাছে কবি অ্যালেন গিনসবার্গও এসেছিলেন; ভক্তদের নিয়ে পথে পথে গেয়েছিলেন 'হরে কৃষ্ণ' মহানাম।
স্বামী প্রভুপাদ বিশ্বাস করতেন, সকল জাতির মধ্যে কৃষ্ণভাবনামৃত ছড়িয়ে দিতে পারলে কোনো জাতিভেদ, হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না। যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক কাজ থেমে যাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তিনি মন্দির, আশ্রম, পল্লী-আশ্রম, বিদ্যালয়, রেঁস্তোরা এবং প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে তিনি চৌদ্দবার বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ করেন। অনেক বিশিষ্ট নেতা, পন্ডিত এবং বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেন। বিটলস্ তারকা জর্জ হ্যারিসনসহ বহু স্বনামধন্য ব্যক্তি তার আদর্শের অনুসারী হন। শতাধিক মন্দির, আশ্রম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কৃষ্ণকেন্দ্রের সমন্বয়ে ইস্কনকে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। বর্তমান বিশ্বের অন্তত একশটি দেশে ইস্কনের সাতশরও বেশি মন্দির আছে। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার মায়াপুরে ইস্কনের প্রধান মন্দিরের অবস্থান। বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট প্রভৃতি জেলা শহরে ইস্কনের মন্দির আছে।
শ্রীল প্রভুপাদের লেখা বইগুলো যেমন জ্ঞানীর পাঠ্য তেমনি সাধারণ মানুষেরও। বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেগুলো পাঠ্য। বৈদিক দর্শনের এই সমস্ত বই প্রকাশ করছে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা সংস্থা 'ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্ট'। শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের চারটি খণ্ড তাৎপর্যসহ ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। শ্রীমদ্ভাগবতের ভা- য্যসহ আঠারো হাজার শ্লোকের ইংরেজি অনুবাদও করেন, যা আঠারোটি খণ্ডে প্রকাশিত। বৈদিক সংস্কৃতি ও দর্শনের বিভিন্ন বিষয়ে সত্তরটিরও বেশি বই অনুবাদ করেছেন ও লিখেছেন। এই বইগুলো আশিটির বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। শ্রীল প্রভুপাদ ১৯৭২ সালে আমেরিকার ডালাসে গুরুকুল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বৈদিক শিক্ষা-ব্যবস্থার প্রচলন হয়। আজ পৃথিবীর ১৫টি গুরুকুল বিদ্যালয়ে ছাত্রের সংখ্যা হাজারেরও বেশি।
১৯৭৭ সালের ১৪ নভেম্বর শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীধাম বৃন্দাবনে ইহলীলা সংবরণ করেন। সেখানকার কৃষ্ণবলরাম মন্দিরে তিনি সমাধিস্থ আছেন।
ছক ৩.১৭: জীবন-সাধনা
|
|
|
|
আঠারো শতকের বাঙালি গীতিকবি রামপ্রসাদ সেন, যাঁর গান পরবর্তী সময়ে কমলাকান্ত, লালন, রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত- সকলকেই প্রভাবিত করেছে। তিনি ছিলেন মাতৃসাধক। তাই তাঁকে আমরা সাধক রামপ্রসাদ বলেই চিনি। মা কালীর প্রতি ভক্তি, ভালোবাসা, ভরসা, অভিমানে তিনি কালীকে নিজের মা, মেয়ে, বন্ধু এবং গুরু হিসেবে গণ্য করতেন। তিনি শ্যামাসংগীতের মাধ্যমে কালীর সাথে আবেগ, হাস্যরস, বিদ্রূপ এবং প্রজ্ঞায় পূর্ণ এক গভীর সম্পর্ক প্রকাশ করেছিলেন। সাধক রামপ্রসাদ মা কালীকে ব্রহ্মজ্ঞানে আরাধনা করতেন। আবার একইসঙ্গে নিজের ঘরের মেয়ে বলেও ভাবতেন। গানে গানে সাধক রামপ্রসাদ বলেছেন-
আমার অন্তরে আনন্দময়ী
সদা করিতেছেন কেলি,
আমি যেভাবে-সেভাবে থাকি
নামটি কভু নাহি ভুলি।
আনুমানিক ১৭২০ সালে পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গাতীরে হালিশহর গ্রামের সর্বেশ্বরী দেবীর কোলে আসেন রামপ্রসাদ সেন। তাঁর বাবা রামরাম সেন। তিনি ছিলেন আয়ুর্বেদিক ঔষধ ব্যবসায়ী। রামপ্রসাদের লেখা আত্মপরিচয় থেকে বোঝা যায়, রামরাম সেনেরও কাব্য-প্রতিভা ছিল। রামপ্রসাদ শৈশব থেকেই নিজের মেধার পরিচয় দিয়েছি- লেন। পাঠশালার পাঠ শেষ করে পারিবারিক ব্যবসার প্রয়োজনে তিনি সংস্কৃত ভাষা শেখেন। কিন্তু ব্যবসার প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। সাহিত্য ও সংগীত তাঁকে প্রবলভাবে টানত। তাই রামরাম সেন ছেলেকে ফারসি ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা করেন। এভাবে রামপ্রসাদ ষোলো বছর বয়সের মধ্যেই সংস্কৃত, বাংলা, ফারসি, হিন্দি ইত্যাদি ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। ফলে তাঁর সাহিত্য ও সংগীত চর্চার পথ প্রসারিত হয়। এ বয়সেই তাঁর মধ্যকার অসাধারণ কবিত্ব শক্তি প্রকাশিত হয়।
সংসারের প্রতি তাঁর একেবারেই মন ছিল না। এই দেখে বাবা-মা চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাই সমস্যার সমাধান হিসেবে তাঁকে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হলো। কনে ছিলেন শর্বাণী দেবী। কিন্তু বিয়ের পরও সংসারের প্রতি রামপ্রসাদের কোনো আগ্রহ তৈরি হলো না। বরং মাতৃসাধনায় মনোযোগ আরও বাড়ল। বয়স তখন সতেরো কী আঠারো, এমন সময়ে রামপ্রসাদের জীবনে নেমে এল ঘোরতর দুর্যোগ; বাবা রামরাম সেন মারা গেলেন। ফলে সংসারের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব তাঁর ওপরে এসে পড়ে। তাই অর্থ উপার্জনের জন্য রামপ্রসাদকে কলকা- তায় যেতে হয়।
কলকাতার ম্যানহাটের জমিদার দুর্গাচরণ মিত্র। রামপ্রসাদ তাঁর সেরেস্তায় মুহুরির পদে কাজ নেন। মুহুরির কাজ খাতায় হিসাব লিখে রাখা। কিন্তু কালীভক্ত রাম- প্রসাদ হিসাবের খাতা শ্যামাসংগীত লিখে ভরে ফেললেন। জমিদারের কানে খবর গেল। তিনি খাতাসহ রামপ্রসাদকে ডেকে পাঠালেন। রামপ্রসাদের মনে ভয়, চাকরি বুঝি আর থাকে না! কিন্তু ঘটনা ঘটল উল্টোরকম। জমিদারবাবু রামপ্রসাদের রচনা পড়ে মুগ্ধ হলেন। বললেন, হিসাব করার জন্য তোমার জন্ম হয়নি। আরো বড় কাজের জন্য তোমার জন্ম। বাড়ি ফিরে যাও, মায়ের সাধনা করো আর শ্যামাসংগীত রচনা করো। রামপ্রসাদের বেতন ছিল ত্রিশ টাকা। দুর্গাচরণ এই টাকাটা রামপ্রসাদের মাসিক বৃত্তি হিসেবে বরাদ্দ করলেন। রামপ্রসাদ ফিরে এলেন নিজ গ্রাম হালিশহরে। জমিদারের বরাদ্দের টাকায় সংসার কোনোমতে চলছিল। আর রামপ্রসাদ একমনে মায়ের ভজনা আর সংগীতের সাধনা করে চললেন।
রামপ্রসাদ গঙ্গার ঘাটে বসে আপন মনে স্বরচিত গান গাইতেন। তাঁর সুমধুর গান শুনে নৌকার মাঝিদের দাঁড় থেমে যেত। যাত্রীরা যাত্রা থামিয়ে ভক্তিভরে রামপ্রসাদী গান শুনতেন। কথিত আছে, একদিন নবাব সিরাজ- উদ-দৌলা গঙ্গার ওপর দিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় যাবার সময়ে রামপ্রসাদের গান শুনে মুগ্ধ হন এবং তাঁকে বজরায় ডেকে এনে মন ভরে গান শোনেন।
ধীরে ধীরে সাধক রামপ্রসাদের মাতৃসাধনা ও শ্যামাসংগীতের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তখন নবদ্বীপের রাজা ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র রায়। তিনি রামপ্রসাদের খ্যাতির কথা শুনে তাঁকে রাজসভায় যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু সাধক রামপ্রসাদ, যিনি গানে গানে কালী মাকে জানিয়েছেন, 'চাই না মাগো রাজা হতে-'; তিনি মহারা- জের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। তবুও রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রামপ্রসাদের সাধনা ও প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে একশত বিঘা নিষ্কর জমি দান করেন। মহারাজের অনুরোধে রামপ্রসাদ রচনা করেন 'বিদ্যাসুন্দর' কাব্য। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ছিলেন ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর। তিনি এই কাব্য পড়ে মুগ্ধ হন এবং তাঁর প্রস্তাবে মহারাজ রামপ্রসাদকে 'কবিরঞ্জন' উপাধিতে ভূষিত করেন।
ছক ৩.১৮: আমার পছন্দের রামপ্রসাদী গান
|
রামপ্রসাদের ধ্যান-জ্ঞান ছিল শ্যামা মা। সারাক্ষণ কেবল মায়ের কথাই ভাবতেন। তিনি কাজ করতে করতেও মুখে শ্যামা মায়ের নাম নিতেন। কন্যারূপে মা কালী রামপ্রসাদের কাছে ধরা দিয়েছিলেন- এরকম অলৌকিক ঘটনাও প্রচলিত আছে। ঘটনাটি হলো, একদিন রামপ্রসাদ ঘরের বেড়া বাঁধছিলেন। বেড়ার উল্টোদিক থেকে মেয়ে জগদীশ্বরী বেড়া বাঁধবার দড়িটা ফিরিয়ে দিয়ে বাবাকে সাহায্য করছিল। এক সময়ে ছোট্ট মেয়ে জগদী- শ্বরী বাবাকে কিছু না বলে খেলতে চলে যায়। তখন মা শ্যামা জগদীশ্বরীর রূপ ধরে এসে রামপ্রসাদকে কাজে সাহায্য করেন। অনেকক্ষণ পরে জগদীশ্বরী এসে দেখে বাবার বেড়া বাঁধা হয়ে গেছে। তার কথায় বাবা রামপ্রসাদ জানলেন, মেয়ে এতক্ষণ এখানে ছিল না। তখন রামপ্রসাদ বুঝতে পারলেন, শ্যামা মা-ই জগদীশ্বরী-রূপে এসে- ছিলেন। রামপ্রসাদ তখন আকুল হয়ে 'মা মা' বলে ডাকতে লাগলেন। ভক্তিভাবে তাঁর দুচোখ বেয়ে জলধারা নামল। এরপর রামপ্রসাদের সাধনা আরও গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগল। রাতদিন শুধু মা-ই ধ্যান-জ্ঞান। এই একনিষ্ঠ সাধনায় তুষ্ট হয়ে একদিন মা নিজরূপে দেখা দিলেন। চারদিক আলোকিত করে তিনি রামপ্রসা- দের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সাধক রামপ্রসাদ মায়ের চরণে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করলেন। সিদ্ধ হলো তাঁর সাধনা। এরপর তিনি প্রায়শই ভাব-সমাধিস্থ হতেন এবং মা কালীর দর্শন লাভ করতেন। রামপ্রসাদের আশীর্বাদে অলৌ- কিকভাবে বহু মানুষ রোগমুক্ত হয়েছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। মাতৃরূপে শক্তিসাধনার যে নতুন ধারা রামপ্রসাদ প্রবর্তন করেছেন তা-ই পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণ, বামাক্ষ্যাপা প্রমুখ সাধককে অনুপ্রাণিত করেছে।
রামপ্রসাদ রাগ ও বাউল সুরের মিশ্রণে এক ভিন্ন ধারার সুর সৃষ্টি করেন, যা 'রামপ্রসাদী সুর' নামে পরিচিত। বাস্তব জীবনে কর্মযোগের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সাধনার এক অপূর্ব মিলনের চিত্র আমরা রামপ্রসাদের জীবন ও সংগীতে খুঁজে পাই। অন্তরে বৈরাগ্য নিয়েও রামপ্রসাদ গৃহী ছিলেন। সংসারের দায়িত্ব-কর্তব্য মাথা পেতে নিয়ে- ছিলেন। জীবনের দুঃখ-কষ্টকে গৌরব মনে করে গানের মধ্য দিয়ে বলেছেন, 'আমি কি দুঃখেরে ডরাই'। তাঁর রচিত গানের বেশিরভাগই হারিয়ে গিয়েছে। যা খুঁজে পাওয়া যায় তার সংখ্যাও খুব কম নয়। তাঁর কিছু জনপ্রিয় গান- মন রে কৃষি কাজ জানো না, ডুব দেরে মন কালী বলে, মা আমায় ঘুরাবি কত ইত্যাদি। দুর্গাপূজার সময়ে যে আগমনী গান শোনা যায়, সেই গানের ধারাটিরও প্রবর্তক রামপ্রসাদ। এছাড়া রামপ্রসাদ কালীকীর্তন, কৃষ্ণ- কীর্তন, শিবকীর্তন, সীতাবিলাপ, নৌকাখন্ডের সংগীত নামে বিভিন্ন জনপ্রিয় পালা রচনা করেছেন। রামপ্রসাদের অনেক গান আজও ভক্ত এবং সংগীতপ্রেমীদের মুখে মুখে ফেরে। তাঁর রচনা বাংলা সাহিত্য ও সংগীতের ধ্রুপদী সম্পদ বলে বিবেচিত।
রামপ্রসাদের সময়ে ভারতীয় সমাজ নানা বিপর্যয় এবং পরিবর্তনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল- ১৭৩৯-এর মহা- প্লাবন, ১৭৪২ এবং ১৭৫২ সালের বর্গী হানা, ১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধ আর ১৭৬৯-এর মন্বন্তর। এসবের ভয়াবহ প্রভাব পড়েছিল বাংলার সাধারণ মানুষের ওপর। এসব ঘটনা প্রবাহের প্রভাব রামপ্রসাদের গানে রয়েছে। ফলে এই গানগুলোর ঐতিহাসিক এবং সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্বও অনেক। সমাজে প্রচলিত নানা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন রামপ্রসাদ। সতীদাহ প্রথা রদ হওয়ার বহু আগে রামপ্রসাদ সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে বলেছিলেন, 'নহে শাস্ত্রশাম্যতা সহমৃতা।'
আনুমানিক ১৭৮১ সালে রামপ্রসাদ ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুঘটনা সম্পর্কে লোককথা এই যে, কালীপূজা শেষে প্রতিমা বিসর্জনের সময় 'তিলেক দাঁড়াওরে শমন' গানটি গাইতে গাইতে তিনি প্রতিমার সঙ্গে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেন।
উনিশ শতকের সাধিকা সারদা দেবীর মধ্যে ভক্তরা করুণা, বিশুদ্ধতা এবং প্রজ্ঞার মূর্ত রূপ দেখেছিলেন। তারা সারদা দেবীর মাতৃসুলভ গুণটি অনুভব করতে পারতেন।
পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটী গ্রামের দম্পতি রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও শ্যামাসুন্দরী দেবী। ১৮৫৩ সালের ২২ ডিসেম্বর তাঁদের এক কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। বাবা কন্যাটির নাম রাখেন ঠাকুরমণি দেবী। আর মা রাখেন ক্ষেমাঙ্করী। পরে শিশুটির নাম হয় 'সারদামণি'। এই সারদামণিই কালক্রমে সারদা দেবী ও শ্রীমা হিসেবে সকলের কাছে পরিচিতি লাভ করেন। কথিত আছে, সারদা দেবীর জন্মের পূর্বে রামচ- ন্দ্র ও শ্যামাসুন্দরী দিব্যদর্শনে মহাশক্তিকে তাঁদের কন্যারূপে জন্ম নিতে দেখেছিলেন।
সারদা দেবীর শৈশব বেশ অনটনে কেটেছে। পিতা রামচন্দ্রের সামান্য জমির ফসল আর পৌরোহি- ত্যের আয় দিয়ে কোনোরকমে সংসার চলত। ছোট্ট সারদামণি ঘরের কাজকর্ম করতেন। ছোট ভাইদের দেখাশোনা করতেন। গবাদিপশুর যত্ন নেয়া থেকে শুরু করে ক্ষেতের ধান কুড়ানোর কাজও তাঁকে করতে হতো। সেকালের সাধারণ ঘরের মেয়েদের মতো সারদা দেবীও লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। তবে তিনি নিজের উৎসাহে ভাইদের সঙ্গে কিছুদিন গ্রামের পাঠশালায় পড়াশোনা করেছেন। এভাবে কিছুটা পড়তে শেখা হলেও লেখা শেখা হয়নি। তবে কথক ঠাকুরদের কথা, যাত্রাপালা, কীর্তন শুনে শুনে তিনি নানা বিষয়ে অনেক কিছু জেনে- ছিলেন। বেশকিছু পৌরাণিক আখ্যান ও শ্লোকও আত্মস্থ করেছিলেন। পরবর্তী জীবনে সারদা দেবী স্বামী শ্রীরামকৃষ্ণের ভাইয়ের মেয়ে লক্ষ্মীদেবীর কাছে কিছু লেখাপড়া শিখেছিলেন।
শৈশবে লক্ষ্মী ও কালীর মূর্তি গড়ে খেলার ছলে পূজা করতেন সারদা দেবী। ছোটবেলা থেকেই মহামায়ার ধ্যান করতেন। সেই সময়ে তাঁর বিবিধ দিব্যদর্শন ও অভিজ্ঞতার কথা শোনা যায়।
সেকালের রীতি অনুযায়ী শৈশবেই সারদা দেবীর বিয়ে হয় গদাধরের সঙ্গে। গদাধরের বাড়ি ছিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রামে। এই গদাধরই পরে সাধক শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলে খ্যাত হন। বিয়ের বছর দেড়েক পরে শ্রীরামকৃষ্ণ চলে আসেন কলকাতার দক্ষিণেশ্বরে। সারদা দেবী চলে যান নিজের বাবার বাড়িতে। প্রায় দুই বছর পর জয়রামবাটীতে তাঁদের আবার দেখা হয়। সেখানে কিছুদিন থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ আবার দক্ষিণেশ্বরে চলে আসেন। এরপর দীর্ঘ সাত বছর পর শ্রীরামকৃষ্ণ জন্মভূমি কামারপুকুরে যান। সারদা দেবীও সেখানে আসেন। এ সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণ সারদা দেবীকে জীবনের কর্তব্য ও ঈশ্বর সম্পর্কে অনেক উপদেশ দেন। তিনি বলেন, 'ঈশ্বর সকলেরই অতি আপনার। যে তাঁকে মনেপ্রাণে ভালোবাসে, ডাকে, সেই তাঁর দেখা পায়। তুমি যদি ডাক, তুমিও তাঁর দেখা পাবে। তাঁর দেখা পাওয়াই জীবনের উদ্দেশ্য।' তখন থেকেই সারদা দেবী শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকে ধ্যান ও আধ্যাত্মিক জীবনের উপদেশ পান। স্বামীর এই উপদেশ সারদা দেবীর হৃদয়কে স্পর্শ করে। তিনি একে মন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে সাধনার পথে যাত্রা শুরু করেন।
সাত মাস কামারপুকুরে কাটিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ আবার দক্ষিণেশ্বরে চলে আসেন। আর সারদা দেবী বাবার বাড়িতে চলে যান। তারপর দীর্ঘদিন কেটে যায়। একসময়ে সারদা দেবী শুনলেন যে তাঁর স্বামী পাগল হয়ে গেছেন। আবার শুনলেন তিনি বিরাট সাধক হয়ে উঠেছেন। স্বামীর জন্য সারদা দেবীর উদ্বেগ বাড়তে থাকে। তিনি বাবার সঙ্গে ১৮৭২ সালে দক্ষিণেশ্বরে রওনা হন। ফাল্গুনী পূর্ণিমায় কলকাতায় গঙ্গাস্নান উৎসব হবে। এই উৎসবকে সামনে রেখেই তাঁরা যাত্রা শুরু করেন। অনেক কষ্ট করে পায়ে হেঁটে তাঁরা দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছান। পথে সারদা দেবী খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। লোকশ্রুতি আছে যে, সেই সময়ে ঘোর কৃষ্ণবর্ণা এক নারীর রূপে মা কালী দিব্যদর্শন দিয়ে তাঁকে সুস্থ করে তোলার আশ্বাস দেন। দক্ষিণেশ্বরে আসার পর সারদা দেবীর সকল সন্দেহের অবসান ঘটে। তিনি উপলব্ধি করতে পারেন, শ্রীরামকৃষ্ণ প্রকৃতই এক মহান আধ্যাত্মিক গুরু। সারদা দেবী শ্রীরামকৃষ্ণের সেবায় মনপ্রাণ ঢেলে দেন। তিনি চেষ্টা করতেন যাতে স্বামীর সাধনায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। তিনি নিজেও রামকৃষ্ণের উপদেশ মতো কঠোর সাধনা শুরু করেন। ভক্তিতে বিশ্বাসে সাধন-ভজনে শ্রীরামকৃষ্ণের যোগ্য সহধর্মিণী হয়ে ওঠেন। সারদা দেবীকে সকলে খুব শ্রদ্ধা করত। এক সময়ে সকলের কাছে তাঁর নতুন পরিচয় হয় 'শ্রীমা' বলে। শ্রীরামকৃষ্ণও স্ত্রীকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। মনে করা হয়, সারদা দেবীই শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম শিষ্য। তিনি সারদা দেবীকে মন্ত্রশিক্ষা দেন। মানুষকে দীক্ষিত করে আধ্যাত্মিক পথে পরিচালিত করার শিক্ষাও প্রদান করেন।
১৮৮৬ সালের ১৫ আগস্ট শ্রীরামকৃষ্ণ পরলোক গমন করেন। শ্রীমা তখন একেবারে একা হয়ে যান। যদিও ভক্তরা সবসময় তাঁকে ঘিরে রাখত। শ্রীরামকৃষ্ণের মহাপ্রয়াণের দুই সপ্তাহ পর শিষ্যদের নিয়ে সারদা দেবী উত্তর ভারতে তীর্থ ভ্রমণে যান। অযোধ্যা, কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির ও কৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র বৃন্দাবন দর্শন করেন। এই বৃন্দাবনেই সারদা দেবী নির্বিকল্প সমাধি লাভ করেন। এখান থেকে গুরুমাতা হিসেবে তাঁর আধ্যাত্মিক জীবন শুরু হয়। সেই সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যদের তিনি মন্ত্রদীক্ষা দেন। কথিত আছে, শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোধানের পর সারদা দেবী দিব্যদর্শন লাভ করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন যে, তিনি মারা যাননি, কেবল এক ঘর থেকে অন্য ঘরে স্থানান্তরিত হয়েছেন।
তীর্থযাত্রা শেষে সারদা দেবী কিছুদিন কামারপুকুরে একাকী অনেক দুঃখ-কষ্টে কাটান। ১৮৮৮ সালে শিষ্যরা মা সারদাকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। পরবর্তী সময়ে কলকাতার বাগবাজারে তাঁর জন্য স্থায়ী বাসভবনও তৈরি করা হয়। এটি 'মায়ের বাটা' নামে পরিচিত হয়েছিল। প্রতিদিন অগণিত ভক্ত মায়ের দর্শন, উপদেশ ও দীক্ষালাভের উদ্দেশ্যে সেখানে আসতেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে মা সারদা 'রামকৃষ্ণ আন্দোলন' চালিয়ে নিয়ে যান। কথিত আছে, কয়েকজন শিষ্য মায়ের দর্শন লাভের পর আধ্যাত্মিক অনুভূতি অনুভব করেছিলেন। কেউ কেউ তাঁর সাক্ষাৎ লাভের পূর্বেই দেবী রূপে তাঁর দর্শন পেয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ স্বপ্নেও তাঁর কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছিল। এঁদের মধ্যে অন্যতম নাট্যব্যক্তিত্ব গিরিশ চন্দ্র ঘোষ।
সারদা দেবীর জীবন নিঃস্বার্থ সেবা, ত্যাগ ও সম্প্রীতির বড় উদাহরণ। তিনি সমস্ত ধর্ম ও সংস্কৃতিকে সম্মান করতেন। সকলের সঙ্গে মায়ের মতো আচরণ করতেন। তিনি ছিলেন উদারমনা। তাঁর মধ্যে কোনো ধরনের কুসংস্কার, বৈষম্যের বোধ ছিল না। জাতপাতেরও কোনো ভেদাভেদ ছিল না। একদিন বিবেকানন্দ নিবেদিতাকে পাঠিয়েছেন সারদা দেবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। একজন শিষ্য সারদা দেবীর কাছে জানতে চাইলেন, তিনি এই মেমসাহেবার সঙ্গে দেখা করবেন কিনা। উত্তরে সারদা দেবী বললেন, 'নরেন একটি শ্বেতপদ্ম পাঠিয়েছে। তা কি আমি না নিয়ে পারি?'
স্বামী বিবেকানন্দ সারদা দেবীকে জীবন্ত দুর্গা বলে অভিহিত করেছিলেন। রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা তাঁকে 'সংঘ জননী' বলে জানতেন। কুসংস্কার ও শিক্ষার অভাবে বিভ্রান্ত ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও চেতনা ফিরিয়ে আনার জন্য স্বামী বিবেকানন্দ পুরো ভারতবর্ষ পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছি- লেন। তখন সারদা দেবীই ছিলেন তাঁর একমাত্র প্রেরণা। যেভাবে ভক্তরা তাঁকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করতেন, ঠিক তেমনিভাবে সারদা দেবীও মমতাময়ী মায়ের মতো সকলের দেখাশোনা করতেন। সকলের মঙ্গল কামনা করতেন।
১৯১৯ সালের শুরুতে মা সারদা জয়রামবাটীতে থাকতে শুরু করেন। মাসকয়েক কাটানোর পর তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। এরপরও বেশ কয়েকমাস অসহনীয় রোগযন্ত্রণা ভোগ করার পর ১৯২০ সালের ২১ জুলাই কলকাতার উদ্বোধন ভবনে তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে। বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনে গঙ্গার তীরে তাঁর শেষকৃত্য হয়। এখানে গড়ে উঠেছে সারদা দেবীর সমাধি- মন্দির।
যেসব জায়গায় তিনি থাকতেন বা পরিদর্শন করেছিলেন সেসব জায়গায় তাঁর দেহাবশেষ ও ব্যক্তিগত জিনি- সপত্র সংরক্ষিত আছে। সারদা দেবীর কথা ও কাজ নিয়ে বিভিন্ন বই লেখা হয়েছে। তাঁর প্রভাব ও অনুপ্রেরণা মুক্তিকামী লক্ষ লক্ষ ভক্তকে শান্তি ও মুক্তির পথ দেখায়।
মহাসমাধির আগে সারদা দেবীর শেষ কথা সম্পর্কে স্বামী গম্ভীরানন্দজী বলেন, 'শ্রীমায়ের দেহ ত্যাগের মাত্র পাঁচ দিন পূর্বে এক ভক্ত অন্নপূর্ণা মাকে দেখিতে আসিয়াছিলেন। কিন্তু ভেতরে যাইতে নিষেধ বলিয়া ঠাকুরঘরের বাইরে দাঁড়াইয়া ছিলেন। হঠাৎ পাশ ফিরিয়া মা তাহাকে দেখিয়া ইশারা করে নিকটে ডাকিলেন। তিনি কাছে গিয়া প্রণাম করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলেছিলেন, মা, আমাদের কী হবে? করুণাবিগলিত ক্ষীণকণ্ঠে অভয় দিয়া মা আস্তে আস্তে বলিয়াছিলেন, ভয় কী? তুমি ঠাকুরকে দেখেছ, তোমার আবার ভয় কী? তবে একটি কথা বলি, যদি শান্তি চাও, কারও দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপনার করে নিতে শেখ। কেউ পর নয়, জগৎ তোমার।' ভক্তদের প্রতি এই ছিল সারদা মায়ের শেষ বাণী।
সারদা দেবীর উপদেশগুলো নিজের ভেতরে লালন করতে হয়; আচরণে পালন করতে হয়। পাঠ্যবইয়ের বাইরের উৎস থেকে প্রত্যেকে তাঁর উপদেশগুলো খুঁজে বের করি। নিজের পছন্দের দুটি উপদেশ সম্পর্কে 'অনুসরণীয়' ছকে লিখি।
আমি লালন করতে চাই:
|
আমি পালন করতে চাই:
|
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তাঁর প্রিয় শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দকে বলেন, 'তুই আমায় কাঁধে করে যেখানেই নিয়ে যাবি, আমি সেখানেই যাব এবং থাকব।' গুরুর মৃত্যুর পর স্বামীজী তাঁর দেহাবশেষের অস্থিকলসটি গঙ্গা নদীর উপকূলে বেলুড়ে প্রতিষ্ঠা করেন। সে জায়গাটি এখন রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান কেন্দ্র। বেলুড়ের এই মঠ ও মিশনকে সংক্ষেপে বেলুড় মঠও বলা হয়। বেলুড় মঠ একটি পুণ্যতীর্থক্ষেত্র। স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, 'ঠাকুরের যেমন উদার মত ছিল, এটি ঠিক সেই ভাবের কেন্দ্রস্থল হবে।'
সারদা দেবী এবং স্বামী বিবেকানন্দ তাঁদের জীবনের শেষ দিনগুলোও এখানেই কাটিয়েছেন। তাঁরা এখানেই সমাধিস্থ আছেন। এখানে আগত অতিথিদের থাকার জন্য অতিথি-ভবন আছে। সেইসাথে প্রতিদিন আগত অতি- থিদের জন্য প্রসাদ ভোজনের ব্যবস্থাও রয়েছে। কেবল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্যই নয়, সারা বিশ্বের সকল মানুষের জন্যও বেলুড় মঠের দ্বার উন্মুক্ত।
পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রামে ১৮৩৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব আবির্ভূত হন। তাঁর পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা চন্দ্রমণিদেবী।
কৈশোরের শুরুতে তিনি কলকাতায় আসেন। তিনি রাণী রাসমণির দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের সেবায়েত হন। তাঁর দিব্য সাধনলীলায় এই মন্দির হয়ে ওঠে মহাতীর্থ। ১৮৮৬ সালের ১৬ আগস্ট তাঁর দেহাবসান হয়।
তাঁর সাধনার লক্ষ্য ছিল সর্বধর্মের, সর্বমতের মিলন ও সমন্বয়। তিনি নিজে সকল ধর্মাচরণ করে মত দিয়েছি- লেন, 'যত মত তত পথ'। তিনি ঈশ্বরজ্ঞানে জীবসেবা ও ত্যাগের উপদেশ দেন। এর মাধ্যমে রামকৃষ্ণ মঠ এবং রামকৃষ্ণ মিশনের বীজ বপন করেন তিনি। তাই অঙ্কুরিত হয় স্বামী বিবেকানন্দের প্রয়াসে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ এই মঠ ও মিশনের ইষ্টদেবতা।
রামকৃষ্ণ 'সর্বজীবে দয়া' কথাটি বলেই আবার সংশোধন করে বলেছিলেন, 'না, জীবে দয়া নয়, শিবজ্ঞানে জীবসেবা।' স্বামী বিবেকানন্দ সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যদি কোনোদিন সুযোগ পান, তবে গুরুর এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করবেন। রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সেই প্রতিজ্ঞাই বাস্তবরূপ পেল। বিবেকানন্দর প্রতি তাঁর নির্দেশ ছিল, 'তোর ছায়ায় যেন হাজার হাজার লোক আশ্রয় পায়'। পরবর্তীতে তাই হয়েছিল।
ভগবান যখন নররূপে অবতীর্ণ হন তখন তাঁর শক্তি নারীরূপে তাঁর সহগামিনী হন। রামচন্দ্রের সঙ্গে সীতা, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে রাধা, শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে বিষ্ণুপ্রিয়া, তেমনি রামকৃষ্ণের সঙ্গে সারদা দেবী। ১৮৫৩ সালের ২২ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটী গ্রামের শ্রীরামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং শ্যামাসুন্দরী দেবীর কন্যারূপে শ্রীমা আবির্ভূত হন। ভাগ্যবান ভক্তরা শ্রীমায়ের মধ্যে যে যার ইষ্টদেবী দুর্গা-কালী-লক্ষ্মী-জগদ্ধাত্রী- সীতা-রাধা-মেরির দর্শন পেতেন। শ্রীমা সারদা দেবী রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের অধিষ্ঠাত্রী।
উত্তর কলকাতায় বিশ্বনাথ দত্ত এবং ভুবনেশ্বরী দেবীর কোলে ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি জন্ম নেয় এক পুত্র সন্তান। যার নাম রাখা হয় নরেন্দ্রনাথ দত্ত। তার সুন্দর চেহারা, সংগীত-নৃত্য-বাদ্যে পারদর্শিতা, সাহস, ঔদার্য, সত্যনিষ্ঠা শৈশব থেকেই সকলকে মুগ্ধ করেছে। রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে এসে তিনি সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। তারপর তাঁর নাম হয় স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁকে বলা হয় স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেবের অবতার।
তিনি গুরুদেব রামকৃষ্ণের প্রভাবে সমস্ত ভোগসুখ ত্যাগ করে মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করেন। পরিব্রাজক হয়ে পুরো ভারতবর্ষ ঘুরে ভারতের দুঃখ-দুর্দশার কারণ অনুভব করেন। এরপর ১৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগোতে বিশ্বধর্ম মহাসভায় বক্তব্য দিয়ে উপস্থিত সকলকে অভিভূত করেন। এরপর তিনি পাশ্চাত্যে হি- দুধর্মের বেদান্তবাণী এবং শ্রীঠাকুরের আদর্শ ও সমন্বয়ের বাণী প্রচার করেন। ১৯০২ সালের ৪ জুলাই তিনি পরলোকে গমন করেন।
১৮৬৮ সালের ২৭ জানুয়ারি শ্রীরামকৃষ্ণ মথুরবাবুর সঙ্গে বৈদ্যনাথধাম-দেওঘরে উপস্থিত হলেন। সেখানকার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের দুর্দশা দেখে মথুরবাবুকে এই মানুষগুলোকে সাহায্য করার অনুরোধ করলেন। মথুরবাবু জানালেন, এদের সাহায্য করতে গেলে তীর্থভ্রমণের খরচে টান পড়বে। ঠাকুর তখন বললেন, "দুর, তোর কাশী আমি যাব না। আমি এদের কাছেই থাকব, এদের কেউ নেই, এদের ছেড়ে যাব না।" তখন মথুরবাবু রামকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের সেবা করলেন। সেদিন অচল শিবদর্শনের চেয়ে সচল শিব শ্রীরাম- কৃষ্ণের কাছে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ ভাব আন্দোলনের লক্ষ্য 'মানুষের সেবা' হিসেবে সেদিনই নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
১৮৮৬ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর গুরুর ইচ্ছানুসারে সন্ন্যাসী-সংঘ গড়ে তোলার দায়িত্ব নেন স্বামী বিবেকানন্দ। ১৮৯৭ সালের ১ মে স্বামীজী ঠাকুরের সন্ন্যাসী ও গৃহী ভক্তদের একত্রিত করে 'রামকৃষ্ণ মিশন' নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। রামকৃষ্ণ মিশনের লক্ষ্য ও কার্যাবলি হলো:
এরপর ১৮৯৯ সালে 'রামকৃষ্ণ মিশন' বর্তমান বেলুড় মঠে স্থানান্তরিত হয়। ১৯০১ সালে রামকৃষ্ণ মঠের রেজি- স্ট্রেশন হয় আর ১৯০৯ সালে রামকৃষ্ণ মিশনের রেজিস্ট্রেশন হয়। উভয়ের প্রধান কার্যালয় এই বেলুর মঠ। রা- মকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন হলো রামকৃষ্ণ সংঘের দুটো দিক। মিশন শিবজ্ঞানে জীবসেবা- এই আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জনসেবামূলক কাজ পরিচালনা করে। মঠ পূজা ও দীক্ষার আয়োজন, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মতবাদের প্রচার-প্রসার এবং মহামানবদের শ্রদ্ধা জানানোর কাজ করে।
জ্ঞান-ভক্তি-কর্ম-বাক্য যোগ সাধনার এই চার পদ্ধতির সমন্বয় ঘটেছিল রামকৃষ্ণের জীবন ও বাণীতে। তাই স্বামীজী রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের এই আদর্শ- কে সিলমোহরে অঙ্কিত করে তার ব্যাখ্যা করেছিলেন এভাবে, জলের ঢেউগুলো কর্মের, পদ্মফুল ভক্তির, উদী- য়মান সূর্যটি জ্ঞানের, পুরো ছবিকে জড়িয়ে ধরা সাপটি যোগ ও কুন্ডলিনী শক্তির এবং রাজহাঁসটি পরমাত্মার প্রতীক।
রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্দেশ্য হলো, 'আত্মনো মোক্ষার্থম্ জগদ্ধিতায় চ'- নিজের মুক্তি ও জগতের হি- তসাধন।
রামকৃষ্ণ সংঘের ভারতে ১৫৭টি এবং ভারতের বাইরে ৫১টি রেজিস্ট্রিকৃত কেন্দ্র আছে। সবগুলো কেন্দ্রের প্রধান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বেলুর মঠ। এই কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে শ্রীশ্রীঠাকুরের আদর্শে এবং স্বামীজীর পথনির্দেশে নানান রকম আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ পরিচালিত হয়। ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী এই সংঘের রয়েছে ১৪টি হাসপাতাল, ১১১টি দাতব্য চিকিৎসালয়, ৫৬টি ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসালয়, ৩৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩৩টি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩৮১টি অন্যান্য বিদ্যালয়, ১২টি মহাবিদ্যালয়, ১টি বিশ্ব- বিদ্যালয়, ১৩৭টি ব্যক্তিগত শিক্ষাকেন্দ্র, ৭৮টি নৈশ (প্রাপ্তবয়স্ক) বিদ্যালয়, ২টি ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র, ১টি বৈদিক শিক্ষাকেন্দ্র, ৪টি শিল্প বিদ্যালয়, ৭টি কুটিরশিল্প ও লঘু উদ্যোগীয় শিল্প, ১১১টি ছাত্রাবাস, ৩টি অনাথালয়, ৩টি বৃদ্ধাশ্রম, ২৩৬টি গ্রন্থাগার, ২০টি প্রধান পুস্তক প্রকাশনি কেন্দ্র, ৫টি বিকলাঙ্গ কেন্দ্র, ৩টি কৃষি বিদ্যালয়, বহু গোশালা, ৪টি গ্রাম্যবিকাশ শিক্ষাকেন্দ্র। এছাড়া রামকৃষ্ণ সংঘের অনেক কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং মহামারিতে ত্রাণকার্য পরিচালনা করা হয়। এর বাইরেও নানাবিধ দানের মাধ্যমে সমাজসেবামূলক কাজ করা হয়। মানুষের আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা মেটাতে এবং তাদের উৎসাহিত করতে নানান পূজানুষ্ঠান ও সভার আয়োজন করা হয়। আবার সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সব ধর্মের আচার্যদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়।
ভগবান রামকৃষ্ণের মন্দির, পুরাতন মন্দির, স্বামী বিবেকানন্দের কক্ষ, স্বামী ব্রহ্মানন্দজী বা রাজা-মহারাজের মন্দির, জগজ্জননী সারদা দেবীর মন্দির, স্বামী বিবেকানন্দজীর মন্দির, সমাধিপীঠ, পুরোনো মঠ, রামকৃষ্ণ সংগ্রহমন্দির এবং মঠের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
সংঘগুরু পরম পূজনীয় প্রেসিডেন্ট মহারাজজীর নিবাস স্থান, মঠ অফিস, রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান কার্যালয়, মা সারদা সেবাব্রত (অন্নপ্রসাদ দেওয়ার জায়গা), পল্লীমঙ্গল (গ্রামীণ হস্তশিল্প বিক্রয়কেন্দ্র), পুস্তকালয়, বিবেকানন্দ দর্শন (প্রদর্শনী কেন্দ্র), প্রতীক্ষালয় (দুপুরে মঠ বন্ধ থাকে, সেই সময়ে দর্শনার্থীরা এখানে অপেক্ষা করতে পারেন)
কলকাতার বেলুর মঠ থেকে স্বামী বিরজানন্দ ও স্বামী প্রকাশনন্দ ১৮৯৯ সালে ঢাকায় আসেন। বাংলাদেশে ঠাকুর রামকৃষ্ণের ভাবধারা প্রচারের উদ্দেশ্যে স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর এই দুই শিষ্যকে পাঠিয়েছিলেন। তাঁদের উদ্যোগে পুরান ঢাকার টিকাটুলিতে প্রতিষ্ঠিত হয় রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন। ১৯০৪ সাল থেকে এই মঠ ও মিশন বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও প্রকাশনার কাজ শুরু করে। তারও বারো বছর পরে বেলুর মঠ একে রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের শাখা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
ঢাকার জমিদার, ধর্ম ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক যোগেশ চন্দ্র দাসের দান করা সাত বিঘা জমিতে এ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর দান করা জমিতে মন্দির, সাধু নিবাস, হাসপাতাল, স্কুল, সংস্কৃতি ভবন তৈরি করা হয়।
১৯১৬ সালে স্বামী ব্রহ্মানন্দ এবং স্বামী পরমানন্দ রামকৃষ্ণ মঠ এবং রামকৃষ্ণ মিশনের ভিত্তি স্থাপন করেছি- লেন। ঐ বছরই পূর্ববঙ্গের প্রথম রাজ্যপাল লর্ড কারমাইকেল মেডিকেল সার্ভিস সেন্টারের উদ্বোধন করেন। ২০০৫ সালে নতুন মন্দিরের কাজ শেষ হয়।
বর্তমানে এই মঠটি বাংলাদেশস্থ রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান কার্যালয়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এটি অধ্যাত্মচর্চা এবং সমাজসেবায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। এরপর বাংলাদেশ রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের আরও কিছু কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়- বরিশাল (১৯০৪), নারায়ণগঞ্জ (১৯০৯), মানিকগঞ্জ (১৯১০), সিলেট (১৯১৬), ফরিদপুর (১৯২১), হবিগঞ্জ (১৯২১), ময়মনসিংহ (১৯২২), দিনাজপুর (১৯২৩) ও বাগেরহাট (১৯২৬)। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদ্যাপন ছাড়াও এই কেন্দ্রগুলো চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা, ত্রাণ, পুনর্বাসন ইত্যাদি কাজও পরিচালনা করে। ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনের চিকিৎসাকেন্দ্রটি ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর সহায়তায় কর্মকাণ্ড শুরু করে। বর্তমানে এটি মিশন পরিচালিত নানাবিধ সেবামূলক কার্যক্রমে বিশেষ অবদান রাখছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে রাম- কৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন ত্রাণ ও পুনর্বাসন সহযোগিতাসহ চিকিৎসাসেবা নিয়ে আর্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে।
ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনে একটি স্কুল ও একটি গণগ্রন্থাগার আছে। এখানে ঢাকার বাইরে থেকে আসা উচ্চমাধ্য- মিক স্তরের ছাত্রদের জন্য একটি ছাত্রাবাসও আছে। গণগ্রন্থাগারে বিভিন্ন ধর্মীয় পুস্তক আছে, তার সঙ্গে আছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার অনেক বই ও পত্রপত্রিকা। প্রতিদিন নানা বয়সের বিপুল সংখ্যক মানুষ এখানে বই পড়তে আসে।
রামকৃষ্ণ মিশনের কর্মকাণ্ড সকল ধর্মের মানুষের জন্যই উন্মুক্ত। দুর্গাপূজা, কালীপূজা ও সরস্বতীপূজাসহ ইসলাম, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মের বিশেষ বিশেষ পর্ব উপলক্ষে এখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন ধর্মীয় একত্বের অনুভূতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে বছরব্যাপী বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষা ও সংস্কৃতিমূলক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সেমিনার ও আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন ধর্মীয় এবং সামাজিক খ্যাতিমান পণ্ডিতবর্গ। রামকৃষ্ণের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতি বছর তাঁর জীবনদর্শন নিয়ে আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দেশি-বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে এখানে রচিত হয় সহাবস্থানের এক মিলনক্ষেত্র। এটিই রামকৃষ্ণের জীবনদর্শন এবং রামকৃষ্ণ মিশনেরও আদর্শ।
ছক ৩.২২: আবাহন ঘর
| |
|
|
বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে অবস্থিত একটি উল্লেখযোগ্য তীর্থস্থান শ্রীঅঙ্গন। বাংলাদেশে মহানাম সম্প্রদায়ের কেন্দ্রীয় আশ্রম এই শ্রী- অঙ্গন। মহানাম সম্প্রদায় বৈষ্ণব মতাবলম্বী। এই সম্প্রদায়ের আধ্যাত্ম দেবতা প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দর ফরিদপুরের গোয়ালচামটে শ্রীঅঙ্গন প্রতিষ্ঠা করেন। মহানাম সম্প্রদায়ের সদস্যরা জগদ্বন্ধু সুন্দরকে কৃষ্ণের অবতার বলে মনে করে। তাদের বিশ্বাস শ্রীচৈতন্যদেব ও শ্রী- নিত্যানন্দের মিলিত রূপে প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দর আবির্ভূত হয়েছেন।
শ্রীঅঙ্গনের প্রতিষ্ঠাতা প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরের আবির্ভাব ২৮ এপ্রিল ১৮৭১ সালে। তিনি মা- নবলীলা সংবরণ করেন ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯২১ সালে; নিজের প্রতিষ্ঠিত আশ্রম শ্রীঅঙ্গনে। তাঁর বাড়ি ফরিদপুর শহরের কাছের গ্রাম গোবিন্দপুরে। তবে তাঁর জন্ম হয়েছে বাবার কর্মস্থল মুর্শিদাবাদ জেলার ডাহাপাড়ায়।
তিনি শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৯৯ সালে। শ্রীঅঙ্গনের জন্য জমি দান করেন শ্রীরাম সুন্দর ও শ্রীরাম কুমার মুদি। দিনে দিনে শ্রীঅঙ্গন মহানাম প্রচারের কেন্দ্রে পরিণত হয়। জগদ্বন্ধু সুন্দরের তিরোধানের পরবর্তী মাস থেকে শ্রীঅঙ্গনে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা অখন্ড মহানাম সংকীর্তন চলছে।
ফরিদপুরের নতুন এবং পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের মাঝামাঝি জায়গায়, ঢাকা-ফরিদপুর মহাসড়কের পাশেই শ্রী-
অঙ্গনের অবস্থান। স্থানীয়দের কাছে আশ্রমটি আঙিনা নামেই বেশি পরিচিত। কোলাহলমুক্ত, খোলামেলা, ছায়াঘেরা এই অঙ্গনে এলে দর্শনার্থীর মন প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। প্রতিদিন এখানে প্রচুর পুণ্যার্থী আসেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখানে রাত্রিযাপন করেন। তাদের জন্য রয়েছে থাকার ব্যবস্থা। শ্রীঅঙ্গনেরে একাধিক ভক্তা- বাসে অসংখ্য ভক্ত থাকতে পারেন। এখানে প্রতিদিন প্রভুর উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদন করা হয়। ভক্তরাও এখানে প্রসাদ ভোজন করতে পারে। এই ভোগ ভক্তদের কাছে অমৃতসম মনে হয়। অনেকে আবার বিভিন্ন মানত করে প্রভুর আশ্রম থেকে মালসা ভোগের অর্ডার করে বিভিন্ন শুভ কাজ, যেমন অন্নপ্রাশন, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী ইত্যাদি পালন করে।
প্রতি বছর বৈশাখ মাসে শ্রী শ্রী প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরের জন্মতিথিতে আশ্রমে বিরাট উৎসবের আয়োজন হয়, মেলা বসে। নাটমন্দিরে অখণ্ড তারকব্রহ্ম নাম সংকীর্তন হয়। সে সময়ে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দেশের ভক্তরা প্রভুর পুণ্যভূমি দর্শন করতে আসেন।
শ্রীঅঙ্গনের প্রবেশপথের ডান দিকে শ্রীশ্রী জগদ্বন্ধু লাইব্রেরি আছে। সেখানে প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরের নানা গ্রন্থ, অনেক মূল্যবান ও দুষ্প্যাপ্য ধর্মীয় গ্রন্থ, গীতা, মহাভারত, রামায়ণ, বেদ, আদি পঞ্জিকা ইত্যাদি পাওয়া যায়। এছাড়াও আছে বিভিন্ন দেবদেবীর ছবি, ঘরে সাজিয়ে রাখার মতো ছোট মূর্তি, ঠাকুরের আসন, নিত্য প্রয়োজনীয় পূজার সামগ্রী ইত্যাদি।
শ্রীঅঙ্গনে ঢুকতেই চোখে পড়বে একজন বৈষ্ণ বের মূর্তি, যিনি তিলক হাতে আগতদের অভ্যর্থনা জানান।
এই অঙ্গনে প্রার্থনার জন্য রয়েছে বেশকিছু মন্দির। প্রভু জগদ্বন্ধু সম্পর্কে কিংবদন্তী প্রচলিত আছে যে, সীতা নবমী তিথিতে ব্রাহ্মমুহূর্তে দীননাথ ন্যায়রত্ন তার স্ত্রী বামাদেবীসহ ভোরে গঙ্গায় স্নান করতে যান। শিশু জগদ্বন্ধু একটি পদ্মফুলের উপর শুয়ে ভাসতে ভাসতে সামনে এলে দীননাথ শিশুটিকে তুলে বামাদেবীর কোলে দেন। বামাদেবী জগদ্বন্ধু- কে কোলে করে ঘরে গেলে জগদ্বন্ধু কেঁদে ওঠেন। তখন দীননাথ এবং বামাদেবী সকলকে জানালেন, 'আমাদের ছেলে হয়েছে'। শ্রীঅঙ্গনের একটি মন্দিরে এই কাহিনিটি প্রতিমার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আছে একটি নৌকা মন্দির। এই মন্দিরের ভেতরে একটি নৌকা রাখা আছে। এই নৌকায় চড়েই প্রভু জগদ্বন্ধু ভক্তদের নিয়ে পদ্মা নদীতে বেড়াতে যেতেন, সাধুসঙ্গ ও কীর্তন করতেন এবং রাতের শেষভাগে ফিরে আসতেন। এই নৌকা মন্দিরে সেই নৌকাটির ওপর কিছু তৈরি করা অবয়ব এমনভাবে রাখা আছে যা দেখে মনে হয় যে প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দর মাঝখানে বসে আছেন আর তাঁর চারপাশে অনুসারী ভক্তবৃন্দ বসে কীর্তন করছেন। অঙ্গনে আছে কাঠের তৈরি নান্দনিক রথ। প্রতি বছর আষাঢ় মাসে রথযাত্রার সময়ে হাজার হাজার ভক্ত এই রথটিকে প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরের আরেকটি আশ্রমে টেনে নিয়ে যান আবার ফিরিয়ে আনেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২১ এপ্রিল পাক-হানাদার বাহিনি ফরিদপুর শহরে আসে। তাদের সহযোগী ছিল একজন অবাঙালি ব্যক্তি। লোকটি হানাদার বাহিনিকে শ্রীঅঙ্গনে নিয়ে আসে। বরাবরের মতন সেখানে নামসংকীর্তন চলছিল। তারা গাইছিল 'জয় জগদ্বন্ধু।' বিহারী লোকটি মিলিটারিদের বোঝাল, আসলে এরা বলছে 'জয় বঙ্গবন্ধু'। তখনই মিলিটারিরা গুলি চালায়। নয়জন কীর্তনিয়ার মধ্যে কেবল একজন পালাতে পেরেছিল। বাকি আটজন মারা যান করেন। এই আশ্রম প্রতিষ্ঠার পর কেবল সেই সময়ে কয়েকদিনের জন্য শ্রীঅঙ্গনে কীর্তন বন্ধ হয়েছিল। আশ্রমে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। যে ক্যাপ্টেনের নির্দেশে গুলি চালানো হয়েছিল তার নাম ছিল জামশেদ। শোনা যায়, দেশ স্বাধীন হবার কিছুদিন আগে ক্যাপ্টেন জামশেদ উন্মাদ হয়ে যায়। এরপর শ্রীঅঙ্গনে এসে নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করে। সেই আটজনের সমাধি রয়েছে শ্রীঅঙ্গনের চালতা গাছ তলায়। প্রত্যেক বছরের একুশে এপ্রিল তারিখে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে অসংখ্য মানুষ শ্রীঅঙ্গনে এসে এই আটজন শহিদের সমাধিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।
এখানে আছে বিশাল রন্ধনশালা। আছে প্রসাদালয়; যেখানে প্রতিবছর উৎসবের সময়ে হাজার হাজার মানুষ প্রসাদ গ্রহণ করে। আশ্রমের নিজস্ব গরুর খামারও আছে। যে পথে খামারে যেতে হয় সেই পথটির নাম দেওয়া হয়েছে 'ধেনুপথ'। এখানে অফিস আছে, আশ্রম আছে। একটি ছাত্রাবাসও আছে। সেখানে বাঙালি ছাড়াও অন্যান্য নৃগোষ্ঠী, যেমন ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠীর ছাত্ররা রয়েছে।
শ্রীঅঙ্গনে আরও আছে তুলসী বেদী। আছে অনন্য সুন্দর নাটমন্দির। জগদ্বন্ধু সুন্দরের একটি অপরূপ বিগ্রহ আছে এখানে। এখানেই চব্বিশ ঘণ্টা নামকীর্তন করা হয়। আছে প্রভু জগদ্বন্ধুর সমাধি, গম্ভীরা সাধনগৃহ, আছে তাঁর বস্ত্র-সমাধি। এখানে আরও কিছু সমাধি মন্দির রয়েছে।
শ্রীঅঙ্গনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর নাম। তিনি মহানাম সম্প্রদায়ের একজন ধর্মীয় গুরু, লেখক, সংগঠক এবং দার্শনিক। তিনি প্রভু জগদ্বন্ধু সম্পর্কে জানার পর তাঁকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। আশি মাইল পথ পায়ে হেঁটে বরিশাল থেকে ফরিদপুর শ্রীঅঙ্গনে আসেন প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরের দর্শন পেতে, সাধু হতে। কিন্তু বাবা-মায়ের অনুমতি না নিয়ে আসা ও এন্ট্রান্স পাস না করার জন্য সে যাত্রায় তাঁকে ফেরত যেতে হয়। সাধু হওয়ার তাগিদে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করে মায়ের অনুমতি নিয়ে শ্রীঅঙ্গনে আসেন। এখানে মহানাম সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য মহেন্দ্রজীর কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৩৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্বধর্মসভায় যোগ দিতে যান। সেখানে তিনি বৈষ্ণব বেদান্তের ওপর শিক্ষাগ্রহণও করেন। আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপের নানা জায়গায় এ বিষেয়ে ভাষণ দেন। এর প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর তিনি দেশে ফেরেন। ফিরে আসেন শ্রীঅঙ্গনে। তিনি মানুষের অধ্যাত্মবোধ এবং মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করে শান্তিময় সমাজ গঠনের জন্য ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে ছুটেছেন, তত্ত্ব আলোচনা করেছেন। দেশভাগের পর শ্রীঅঙ্গনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে তিনি দুর্গতদের সহায়তা করেছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বিভিন্ন মঠ ও মন্দির সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
শ্রীঅঙ্গনে বিভিন্ন সময়ে এসেছেন মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পল্লীকবি জসীম উদ্দীন অনেক মহান ব্যক্তিত্ব। সুমহান ইতিহাস এবং বর্তমানের উপযোগিতা আশ্রম হিসেবে শ্রীঅঙ্গনকে একটি অনন্য মহিমা দিয়েছে। তাই শতবছরেরও বেশি পুরোনো এই অঙ্গন এখন কেবল মহানাম সম্প্রদায়ের সদস্যদের কাছেই নয়, বরং সারাবিশ্বের হিন্দুধর্মবলম্বীদের কাছে একটি আকর্ষণীয় তীর্থক্ষেত্র।
|
আদর্শ মানবচরিত এবং ধর্মীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জেনে আমি অনেক কিছু শিখেছি। অনেক কথা নতুন করে ভাবতে পারছি। এখান থেকে কিছু শিক্ষা আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনেও প্রয়োগ করতে পারি। যেমন:
১.
২.
|
বিচিত্রতা আছে মানুষে মানুষে। মানুষের গড়ন, রুচি, ভাষা, সংস্কৃতি, আচরণ, বিশ্বাস, ধর্ম- সবকিছুতেই আছে কত না রকমফের! তাই জয়শ্রীর যখন আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করে অনির্বাণের তখন ইচ্ছে করে তেঁতুলের শরবত খেতে। নীলাদ্রি যখন পর্বতে যাবে বলে ঠিক করে মেঘদীপা তখন সমুদ্রেই যাব বলে গোঁ ধরে। এসব ক্ষেত্রে যদি দুজনের ইচ্ছেই আলাদা করে পূরণ করবার সুযোগ থাকে তাহলে তেমন সংকটের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু যদি এমন হয় যে, একজনের ইচ্ছেই পূরণ করা যাবে, তখন কাউকে না কাউকে ছাড় দিতে হয়। নইলে সংঘাত হয়; তাতে আপাতদৃষ্টিতে একজনের লাভ হয়েছে বলে মনে হলেও, ক্ষতি কিন্তু দুজনেরই কম-বেশি হয়। আবার জয়শ্রী যদি অনির্বাণকে জোর করতে চায় যে, আইসক্রিমই খেতে হবে অথবা নীলাদ্রি মেঘদীপাকে পর্বতে যেতে বাধ্য করে তাহলে চরম অশান্তি হবে। অন্যরকমভাবেও সমস্যার সমাধান হতে পারে- আজ আইসক্রিম কাল তেঁতুলের শরবত, আজ সমুদ্র কাল পাহাড়।
আমরা পাতার মধ্যে যে বৈচিত্র্য পেয়েছি তা শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন করব। পোস্টার প্রদর্শনী, মাল্টিমিডিয়া, বক্তৃতা, পাতা প্রদর্শনী ইত্যাদি কোন পদ্ধতিতে উপস্থাপন করলে সবচেয়ে ভালো হয় তা নিয়ে সকলে মিলে দুই- রকমভাবে আলোচনা করব। প্রথমে সবাই যে যার মতন করে মতামত দেবো এবং নিজের মতে অনড় থাকব। তারপরে প্রত্যেকে অন্যের মত শুনে এবং গুরুত্ব দিয়ে সবার মত মিলিয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করব।
যদি এই পৃথিবীতে কেবল একই রকমের প্রাণী থাকত, সবকিছুর রং এক হতো, সবাই একই পেশায় কাজ করত তাহলে ব্যপারটা কেমন হতো ভেবে দেখি। প্রকৃতিতে বৈচিত্র্য না থাকলে সৃষ্টিজগৎ কি টিকে থাকতে পারত? তেমনি মানুষে মানুষে যে মতভিন্নতা সেটিও জরুরি। সবার পছন্দ, সবার মতামত যদি একরকম হতো তাহলে কেমন হতো আসলে? পৃথিবীর উপাদান, মানুষের মতামতের মতন প্রকৃতির নিয়মেও বৈচিত্র্য আছে। আবার এই সকল বৈচিত্র্যর মাঝে আছে ঐক্য। বৈচিত্র্যকে যেমন স্বীকার করতে হয়, তেমনি ঐক্যের নিয়মকেও মানতে হয়। এবারে বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে ঐক্যবদ্ধতার বিষয়ে আমাদের হিন্দুধর্ম কী বলছে জেনে নিই।
সকলে সহমত হলেই শান্তি আসে না, শান্তি তখন আসে, যখন ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রেখে আমরা পাশাপাশি চলতে পারি। শিবমহিম্নস্তোত্রে বলা হয়েছে- রুচীনাং বৈচিত্র্যাদ্ ঋজুকুটিলনানাপথজুষাম্। নৃণামেকো গম্যস্ত্রমসি পয়সামর্ণব ইব।।
অর্থাৎ বিভিন্ন নদীর উৎস বিভিন্ন স্থানে, কিন্তু তারা সকলেই একই সমুদ্রে তাদের জলরাশি ঢেলে দেয়। তেমনি নিজের রুচির বৈচিত্র্যের কারণে সোজা-বাঁকা নানা পথে যারা চলছে, হে ঈশ্বর, তুমিই তাদের সকলের একমাত্র লক্ষ্য। |
বৈচিত্র্যময়তা যেমন পৃথিবীকে সুন্দর করেছে, তেমনি সংঘাতেরও সুযোগ তৈরি করেছে। এই সংঘাত এড়াতে প্রয়োজন পরমতসহিষ্ণুতার। ব্যক্তি জীবন থেকে বৃহত্তর সমাজ জীবনে সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য পরমতসহিষ্ণু হওয়া খুবই জরুরি। তাহলে জয়শ্রী, অনির্বাণ, নীলাদ্রি, মেঘদীপা কিংবা রফিক, সুলতানা, ব্রান্ডেন, জেনোলিয়া, আনুচিং, রাহুল সকলের জীবনই আনন্দময় হতে পারে।
পরমতসহিষ্ণুতা মানে অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। কেবল নিজে মত দেওয়া নয়, অপরকেও মতামত দেওয়ার সুযোগ দেওয়া। নিজের মতের সঙ্গে না মিললেও অন্যের মতকে গুরুত্ব দেওয়া। সকলের মত প্রকাশের অধিকারকে সাদরে গ্রহণ করা। পরমতসহিষ্ণুতা শিষ্টাচারের অঙ্গ, একই সঙ্গে ধর্মেরও অঙ্গ। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্ম সত্য, সুন্দর, কল্যাণের কথা বলে। প্রতিটি ধর্মই পরমতসহিষ্ণু হওয়ার শিক্ষা দেয়। ঋগ্বেদে পরমতসহিষ্ণুতা নিয়ে নিচের কথাগুলো বলা আছে।
সং গচ্ছধ্বং সং বদধ্বং সং বো মনাংসি জানতাম্। দেবা ভাগং যথা পূর্বে সঞ্জানানা উপাসতে। সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং মনঃ সহ চিত্তমেষাম্। সমানং মন্ত্রমভিমন্ত্রয়েবঃ সমানেন বো হবিষা জুহোমি। সমানী ব আকুতিঃ সমানা হৃদয়াণি বঃ। সমানমস্তু বো মনো যথা বঃ সুসহাসতি। (ঋগ্বেদ: ১০.১৯১.২-৪)
সরলার্থ: হে মানব, তোমরা একসঙ্গে চলো, একসঙ্গে মিলে আলোচনা করো, তোমাদের মন উত্তম সং- স্কারযুক্ত হোক। তোমাদের পূর্বকালীন জ্ঞানী ব্যক্তিরা যেরকম কর্তব্য পালন করেছে, তোমরাও তেমনটাই করো। তোমাদের সকলের মিলনের মন্ত্র এক হোক, মিলন ভূমি এক হোক, মনসহ চিত্ত এক হোক। তোমাদের সকলকে আমি একই সাম্যের মন্ত্র এবং খাদ্য ও পানীয় দিয়েছি। তোমাদের সকলের হৃদয়ের আকুতি এক হোক, হৃদয় এক হোক। মন এক হোক, সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হও।
মানবজাতির মধ্যে ভিন্নমত, বৈচিত্র্য থাকলেও পরমতসহিষ্ণুতার চর্চার মাধ্যমে বেদ-এ মানুষের প্রতি ঈশ্বরের এই ঐক্যবদ্ধতার আহ্বানকে আমরা বাস্তব-রূপ দিতে পারি।
|
শিকাগো ধর্মসম্মেলনের বক্তারা শ্রোতাদের প্রথাগতভাবে 'ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ' সম্বোধন করেছিলেন। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ সবাইকে 'ভ্রাতা ও ভগিনী' বলে সম্বোধন করেন। অজানা-অচেনা লোকদের এভাবে ভাই-বোন বলে আপন করে নেয়ার মানসিকতা দেখে শ্রোতারা মুগ্ধ হন। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বক্তব্যে বলেন, 'হিন্দুধর্ম পৃথিবীর সকল ধর্মকে সমান মনে করে। সব ধর্মের লক্ষ্যই এক। নদীসমূহ যেমন এক সাগরে গিয়ে মিলিত হয়, তেমনি সকল ধর্মেরই লক্ষ্য এক-ঈশ্বরলাভ। তাই বিবাদ নয়, সহায়তা; বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাবগ্রহণ; মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি।'
সেখানে অনেকেই কেবল নিজ-নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ব্যস্ত ছিলেন, কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দুধর্ম সম্পর্কে বললেন, 'যে ধর্ম অন্যকে চিরকাল পরমতসহিষ্ণুতার ও সর্ববিধ মত স্বীকার করার শিক্ষা দিয়ে আসছে, আমি সেই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমরা শুধু সকল ধর্মকে সহ্য করি না, সকল ধর্মকেই সত্য বলে বিশ্বাস করি।'
হিন্দুধর্মের অনুসারী হিসেবে, দৈনন্দিন জীবনে পরমতসহিষ্ণুতার নীতিগুলো প্রয়োগ করা আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার প্রতিবেশী, সহপাঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস এবং চর্চা আমার চেয়ে আলাদা হলেও তাকে সম্মান করা উচিত। বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং ধর্ম সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের মনকে উন্মুক্ত রাখা প্রয়োজন। এভাবে আমরা বিশ্বে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
হিন্দুদর্শন অনুযায়ী, আমাদের শরীরটা আসল 'আমি' নয়, আসল 'আমি' হলো আমাদের চৈতন্য বা জীবাত্মা; যা পরমাত্মারই অংশ। চৈতন্য দেহটাকে আশ্রয় করে আছে কেবল। তাই একের থেকে অপরের বাইরের আবরণে, আচরণে তফাৎ হয় কিন্তু সকলের ভেতরে একই সত্তা। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী একবার ছেলে মানুষ কার্তিক অকারণে একটা বেড়ালকে বল্লমের খোঁচা দিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে দেখলেন মা ভগবতীর মুখে আঘাতের চিহ্ন। কার্তিক এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে মা জবাব দিলেন, এ তোমারই বল্লমের আঘাত। কার্তিক বললেন, আমি একটা বেড়ালকে আঘাত করেছি বটে, কিন্তু তার সঙ্গে তোমার কী সম্বন্ধ! ভগবতী জবাব দিলেন, আমি বিশ্বব্রহ্মান্ডে ছড়িয়ে রয়েছি। সমস্ত প্রাণীই আমার সন্তান। তুমি যাকে আঘাত করো, সে আঘাত আমাতেই লাগে।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর 'মানুষ জাতি' কবিতায় বলেছেন-
'কালো আর ধলো বাহিরে কেবল
ভিতরে সবারই সমান রাঙা।'
বিশ্বের সকল মানুষের গায়ের রং, পোশাক, ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি নানান কিছুতে রকমফের আছে, ভিন্নতা আছে দৃশ্যমান 'আমি'তে। কিন্তু জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে আসলে কোনো আত্মিক দূরত্ব নেই। সকলের আত্মা সেই এক পরমাত্মার অংশ। কালের নিয়মে সকলের আত্মাই এক পরমাত্মায় মিশে যাবে। আমাদের ইহজাগতিক জাতিভেদ, ধর্মভেদ, মতভেদ- সমস্তই অসহিষ্ণুতার ফল। পরমতসহিষ্ণুতাই পারে এসব ভেদচিহ্ন মুছে দিতে। যে-কোনো ধর্মপ্রাণ, মানবতাবাদী মানুষের প্রধানতম গুণ হলো পরমতসহিষ্ণুতা।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব হিন্দুধর্মীয় নানা পৌরাণিক উপাখ্যান থেকে গল্প বলার মাধ্যমে ভক্তদের উপদেশ দিতেন। পরমতসহিষ্ণুতার বিষয়ে তিনি এই গল্পটি বলতেন- ঘণ্টাকর্ণ এক লোক দিনরাত শিবের আরাধনা করত। অপরদিকে অন্যান্য দেবদেবীর প্রতি ভক্তি দেখানো তো দূরের কথা, লোকটি তাঁদের রীতিমতো ঘৃণা করত। একদিন শিব তাকে দেখা দিয়ে বললেন, 'সব দেবতাই তো এক। একজনকে ঘৃণা করলে সকলকেই ঘৃণা করা হয়। তুমি যতদিন না অন্যান্য দেবতাদের ভক্তি করবে ততদিন আমি কিছুতেই সন্তুষ্ট হব না।' কিন্তু তাতে ফল হলো উল্টো; লোকটি প্রকাশ্যে শিব বাদে বাকি সকল দেব-দেবীর নিন্দা করতে লাগল। তাদের নাম শুনলেও ক্ষেপে উঠতে লাগল। দিনে দিনে এই কথা রাষ্ট্র হয়ে গেল। তাকে ক্ষেপানোর জন্য ছেলেদের দল কানের কাছে 'শ্রীবিষ্ণু' বলে চেঁচাতে শুরু করল। লোকটি তখন অন্য কোনো দেব-দেবীর নাম কানে শুনতেও নারাজ। তাই সে দুই কানে দুইটা ঘণ্টা ঝুলিয়ে দিল। ছেলের দল যখনই শ্রীবিষ্ণুর নাম করে তখনই সে প্রবলভাবে মাথাটা নাড়াতে থাকে। তখন ঘণ্টার আওয়াজে তার কানে আর বিষ্ণুর নাম যায় না। গোঁড়ামির জন্য সে সকলের এমন ঘৃণার পাত্র হলো যে, আজও ফাল্গুন মাসের সংক্রান্তিতে লোকে ঘণ্টাকর্ণের মূর্তি গড়ে ভেঙে ফেলে।
এই গল্পটির উপদেশ হলো এই যে, ধর্মের গোঁড়ামি মহাপাপ। সকল ধর্মেই সত্য আছে- যে তা না দেখে সে কখনই ধার্মিক নয়।
|
মনুসংহিতায়ও সহিষ্ণু হতে বলা হয়েছে,
ধৃতিঃ ক্ষমা দমোহস্তেয়ং শৌচমিন্দ্রিয়নিগ্রহঃ।
ধীর্বিদ্যা সত্যমক্রোধো দশকং ধর্মলক্ষণম্ ॥ (৬/৯২)
অর্থাৎ সহিষ্ণুতা, ক্ষমাশীলতা, আত্ম-সংযম, চুরি না করা, শুচিতা, ইন্দ্রিয়সংযম, শুদ্ধবুদ্ধি, বিদ্যা, সত্য এবং ক্রোধহীনতা- ধর্মের এই দশটি লক্ষণ।
'বিবিধের মাঝে মিলন মহান'- এটাই হিন্দুধর্মের মূল চেতনা। হিন্দুধর্ম যেমন অন্য ধর্মমতের প্রতি সহিষ্ণু হওয়ার শিক্ষা দেয় তেমনি এই একই ধর্মের ভেতরে বহু মত ও পথের সহাবস্থানকে স্বীকৃতি দেয়; এখানে অদ্বৈতবাদী, দ্বৈতবাদী, একেশ্বরবাদী, শাক্ত, বৈষ্ণব প্রভৃতি বিভিন্ন ধারার বিশ্বাসের সমন্বয় ঘটেছে। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন- 'যত মত তত পথ'। বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসহ প্রতিটি ধর্মগ্রন্থেই জীবের প্রতি ভালোবাসার কথা, মানবকল্যাণের কথা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সাম্যের বাণী প্র- চারিত হয়েছে। লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলেছেন- 'ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য এসবই জগতের ব্যবহারিক সত্য, মনের সৃষ্টি। আমি যে জগতের লোক সেখানে নেই কোনো ভেদ, সেখানে সবই সমান-সবই সুন্দর।'
কূপমণ্ডুক
একটা কুয়ার মধ্যে থাকত এক ব্যাঙ। সেই কুয়াতেই সে জন্মেছে, সেখানেই বেড়ে উঠেছে। কুয়ার জলের মধ্যে জন্মানো পোকামাকড় খেয়েই জীবন কাটিয়েছে। কোনোদিন কুয়ার বাইরে যাবার কোনো প্রয়োজনই ব্যাঙটি বোধ করেনি। সেই কুয়ায়ও কেউ কোনোদিন আসেনি। তাই কুয়ার বাইরের পৃথিবীর খবর আমাদের গল্পের ব্যাঙটির একেবারেই অজানা। একদিন হঠাৎ কোথা থেকে একটা ব্যাঙ এসে সেই কুয়ায় উপস্থিত হলো-
কুয়ার ব্যান্ড: কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
নতুন ব্যান্ড: সমুদ্র থেকে আসছি।
কুয়ার ব্যান্ড: সমুদ্র? সে কত বড়?
নতুন ব্যাঙ: সমুদ্র অনেক বড়।
কুয়ার ব্যান্ড: বটে। তা সে কি আমার এই কুয়ার মতো বড়?
(এই বলে কুয়ার ব্যাঙটি কূপের এক
প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে লাফ দিল।)
নতুন ব্যান্ড: ওহে ভাই, তুমি এই ক্ষুদ্র কূপের সঙ্গে সমুদ্রের তুলনা করবে কী করে?
(এই কথা শুনে কূপমণ্ডুক আরও একবার লাফ দিল)
কুয়ার ব্যান্ড: তোমার সমুদ্র কি এত বড়?
নতুন ব্যান্ড: সমুদ্রের সঙ্গে কুয়ার তুলনা করে তুমি অত্যন্ত মূর্খতার পরিচয় দিচ্ছ!
কুয়ার ব্যাঙ: আমার কুয়ার মতো বড় পৃথিবীতে আর কিছুই হতে পারে না।
তুমি নিশ্চয়ই মিথ্যা বলছ! তোমাকে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত!
'কূপমণ্ডুক' কথার মানে কী?
|
এই গল্পটি পড়ে তুমি কী বুঝেছ?
|
কুয়ার ব্যাঙকে কি তোমার পরমতসহিষ্ণু বলে মনে হচ্ছে? কেন? বুঝিয়ে লেখো।
|
কারোর সঙ্গে আমার মত মিলছে না বলে ধরে নেবো না যে তার মতটা ভ্রান্ত। একজন মানুষ আমার পথে হাঁটছে না বলেই ধরে নেবো না যে, সে পথ হারিয়ে ফেলেছে। গীতায় ভগবান স্বয়ং বলেছেন, যারা অন্য দেবতায় ভক্তিমান হয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁদের পূজা করে, তারা ঈশ্বরেরই পূজা করে (৯/২৩)। সুতরাং সকল ধর্মের মানুষই তাদের নিজ নিজ মত ও পথ অনুসরণ করে একই ঈশ্বরের উপাসনা করে।
বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় অনেকেই নতুন নতুন ভাবনা নিয়ে এসেছেন। তবে বে- শিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা তাদের ভাবনার প্রসারে নানাবিধ বাধার মুখোমুখি হয়েছেন। বিভিন্ন ধর্ম প্রচারকগণও অনেক বাধা-বিপত্তির মুখে পড়েছেন। কিন্তু আমাদের এই অঞ্চল এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এখানে সুপ্রাচীনকাল থেকেই পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা হয়েছে। তাই এখানে ধর্মপ্রচারকদের অভিজ্ঞ- তাও ব্যতিক্রম। এই অঞ্চলে হিন্দুধর্ম যেমন বিকশিত হয়েছে। তেমনি অন্যান্য ধর্মমতের বিকাশও ঘটেছে সাবলীলভাবে। পৃথিবীর সকল প্রাণীর মঙ্গলকামনার উদার প্রার্থনা এখানকার মানুষ সাত হাজার বছর আগে থেকে করছে। সংস্কৃত ভাষায় একটি প্রচলিত শ্লোকে বলা হয়েছে-সর্বে ভবস্তু সুখিনঃ সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু মা কশ্চিদ্ দুঃখভাণ্ডবেৎ।। ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।। যার অর্থ সবাই সুখী হোক, সকলে আরোগ্য লাভ করুক, সকলে কল্যাণ লাভ করুক, যেন কেউ দুঃখ ভোগ না করে। জগতের সকল প্রাণী শান্তি লাভ করুক।
|
হিন্দুধর্ম ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ একটি ধর্ম। এই ধর্মে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানান রকমের বিশ্বাস ও অনুশীলনের সমন্বয় ঘটেছে। হিন্দুধর্ম অন্যান্য ধর্মীয় বিশ্বাস ও বৈচিত্র্যময় ধর্মীয় চর্চাকে স্বীকৃতি দেয় এবং সাদরে গ্রহণ করে। তাই একজন মানুষ হিসেবে যেমন তেমনি হিন্দুধর্মাবলম্বী হিসেবেও আমরা পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা করব।
|
আরও দেখুন...