নিত্যকর্ম মানে প্রতিদিনের কর্ম। প্রতিদিন আমরা অনেক কর্ম করি। ঘুম থেকে উঠে রাতে শোয়ার পূর্ব পর্যন্ত চলতে থাকে কর্ম। তবে এই কর্মগুলো নিয়ম মেনে করতে হয়। এগুলো নিত্যকর্ম। নিত্যকর্ম চর্চায় নিয়মানুবর্তিতা শেখা যায়। ঈশ্বরের সাহিত্যও লাভ করা যায়।
'নিতা' অর্থ প্রত্যহ বা প্রতিদিন। কর্ম মানে কাজ। সুতরাং শাব্দিক অর্থে নিত্যকর্ম বলতে বোঝায় প্রতিদিনের কাজ। ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঈশ্বর ও গুরুর নাম স্মরণ করা। পিতামাতাকে প্রণাম করা। শুচি হয়ে পূজা ও উপাসনা করা। লেখাপড়া, খেলাধুলা, ব্যায়াম করা ইত্যাদি নিত্যকর্মের অংশ। শাস্ত্রে নিত্যকর্মসমূহকে ছয় ভাগে বর্ণনা করা হয়েছে। যথা: প্রাতঃকৃত্য, পূর্বাহ্ণকৃতা, মধ্যাহ্নকৃতা, অপরাহ্ণকৃতা, সায়াহ্নকৃতা, রাত্রিকৃতা।
প্রাতঃকৃত্য: সূর্য ওঠার কিছু পূর্বে বা আগে ঘুম থেকে উঠে বিছানার উপরে পূর্ব বা উত্তর দিকে মুখ করে বসতে হয়। এরপর ঈশ্বর বা দেব-দেবীদের স্মরণ করে মন্ত্র পাঠ করতে হয়।
পূর্বায়কৃত্য প্রাতঃকৃত্যের পরে এবং দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত যে সব কাজ করা হয় তাই পূর্বাহ্ণকৃত্য। এই সময়ে প্রার্থনা, উপাসনা ও পূজা করতে হয়।
মধ্যাহ্নকৃত্য : পূর্বাহ্ণের পরে অর্থাৎ দুপুরে খাওয়া-দাওয়া এবং বিশ্রাম করা হলো মধ্যাহ্নকৃত্য।
অপরাধকৃত্য: দুপুরের পর এবং সায়াহের পূর্ব পর্যন্ত যে কাজ করা হয়, তাকেই অপরাহকৃত্য বলা হয়। এ সময় বেড়াতে যাওয়া, খেলাধুলা বা ব্যায়াম অবশ্যই করা উচিত।
শুচিতা
শুচিতা মানে নির্মলতা, পবিত্রতা। এই পবিত্রতার শুরু হয় মন থেকে। মনে শুচিতা থাকলে আমরা খারাপ চিন্তা থেকে বিরত থাকি, কারও ক্ষতি করতে চাইনা, কারও অশুভও কামনা করি না। মনে শুচিতা থাকলে আমরা আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।
শুচিতা মানে যেমন মনের পবিত্রতা, তেমন শরীরের পবিত্রতাও। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক, পরিবেশ, প্রকৃতি দেখলে অন্যের মনেও পবিত্রতার অনুভূতি আসে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকাটা ঈশ্বর পছন্দ করেন। শুচিতা ধর্মের অঙ্গ। শুচিতার মাধ্যমে শরীর ও মনের পবিত্রতা আনা যায়। শরীর ও মনকে সাধনার উপযোগী করার জন্য শুচিতা প্রয়োজন। শুচিতা প্রধানত দুই প্রকার, যথা: অভ্যন্তরীণ শুচিতা ও বাহ্যিক শুচিতা।
অভ্যন্তরীণ শুচিতা : অভ্যন্তরীণ শুচিতা বলতে মনের বা অন্তরের শুচিতাকে বোঝায়। বিদ্যার্জন, সদাচরণ প্রভৃতির মাধ্যমে মনের বা অন্তরের শুচিতা অর্জন করা যায়। পৃথিবীর সকল প্রাণীর মঙ্গল কামনা করা, সবার জন্য সুচিন্তা করা, মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে কথা না বলা এগুলো সবই ভালো মনের পরিচয় বা অভ্যন্তরিণ - শুচিতার প্রতিফলন।
বাহ্যিক সুচিতা বাহ্যিক শুচিতা বলতে শারীরিক শুচিতা বোঝায়। জল দিয়ে বাহ্যিকভাবে শুচি হওয়া যায়। আমরা প্রতিদিন হাত-মুখ ধুই, স্নান করি। এভাবে বাহ্যিক শুচিতা অর্জন করি। এছাড়া পোশাক-পরিচ্ছদ পরিষ্কার করার মাধ্যমেও বাহ্যিক শুচিতা অর্জন করা যায়।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: শুচিতার ন্যায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাও ধর্মের অঙ্গ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বলতে সুন্দর ও পরিপাটি অবস্থাকে বোঝায়। উপাসনা, প্রার্থনা, পূজা-পার্বনের সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতে হয়। কারণ ধর্মীয় কাজের ক্ষেত্রে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রয়োজন সবার আগে। অপরিষ্কার অবস্থায় ধর্মীয় কাজে মন বসে না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মধ্যে পড়ে এমন আরও অনেক কিছু আছে। যেমন, নিজের কাপড়-চোপড় গুছিয়ে রাখা, বাড়ির বিভিন্ন জিনিসপত্র পরিপাটি করে রাখা, আশপাশের পরিবেশ সুন্দর রাখা। বিদ্যালয়ের পরিবেশ সুন্দর রাখা ইত্যাদি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ব্যক্তিগত হতে পারে আবার সর্বজনীনও হতে পারে।
নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে হয়। নিজের শরীরের যত্ন নিতে হয়। এগুলো ব্যক্তিগত পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতা। বিদ্যালয়, মন্দির, ধর্মক্ষেত্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। বাড়ির আধিনা, রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ, আশপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। সবার অংশগ্রহণে এই পরিচ্ছন্নতা অর্জিত হয়। এটাই সর্বজনীন পরিচ্ছন্নতা।
শুচিতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব :
শুচিতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ধর্মচর্চার পূর্বশর্ত। শুচিতা প্রার্থনার অপরিহার্য অংশ। শুচিতা ও পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতায় শরীর ও মন সুস্থ থাকে। আর শরীর ও মন সুস্থ থাকলে ধর্ম-কর্ম ভালো হয়। পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়া যায়। সর্বজনীন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় সর্বক্ষেত্রে সুন্দর পরিবেশ তৈরি হয়। মূলত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় সবার মঙ্গল হয়।
উপাসনা
আমরা যাকে কাছে পেতে চাই তার থেকে দূরে বসলে কি আমাদের ভালো লাগে? নিশ্চয়ই না। যাকে ভালো লাগে তার কাছে বসতে চাই। ঈশ্বরকে ভালোবেসে তাঁর কাছে আমরা বসতে চাই। ঈশ্বরের কাছে বসাই উপাসনা। ধর্মগ্রন্থে উপাসনা নিয়ে অনেক কথা আছে। সে কথাই এখন আমরা জানব।
'উপ' অর্থ নিকটে এবং 'আসন' অর্থ বসা। ঈশ্বরের উপাসনা অর্থ ঈশ্বরের নিকটে বসা। অর্থাৎ, যে কর্মের মধ্য দিয়ে আমরা ঈশ্বরকে কাছে পেতে পারি, তার নাম উপাসনা। একাগ্রচিত্তে ভক্তিভরে ঈশ্বরের আরাধনা করাই উপাসনা। উপাসনা ধর্মপালনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ বা পদ্ধতি। পূজা-অৰ্চনা, স্তব-স্তুতি, ধ্যান, জপ, কীর্তন, প্রার্থনা প্রভৃতি পদ্ধতিতে উপাসনা করা হয়। উপাসনার ফলে আমাদের দেহ-মন পবিত্র হয়। উপাসনার মাধ্যমে আমরা সকলের কল্যাণ কামনা করি। ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রার্থনা করি।
সাকার ও নিরাকার দুভাবেই ঈশ্বরের উপাসনা করা যায়।
সাকার উপাসনা হলো নিরাকার ঈশ্বরের আকার বা মূর্ত রূপের মাধ্যমে আরাধনা করা। "সাকার' অর্থ যার আকার বা মূর্তরূপ আছে। আমরা ঈশ্বরকে নেব-দেবীর প্রতিমারূপে উপাসনা করি। বিভিন্ন দেব-দেবী, যেমন- কার্তিক, গণেশ, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রভৃতি ঈশ্বরের সাকার রূপ। পূজারী ভক্ত ঈশ্বরকে সাকাররূপে পূজা করে। তাঁর আশীর্বাদ প্রার্থনা করে।
নিরাকার মানে যার কোনো আকার বা রূপ নেই। ব্রহ্মের কোনো রূপ নেই। ব্রহ্মই ঈশ্বর। ঈশ্বরের কোনোপ্রকার প্রতীক বা মূর্তরূপ ছাড়া ধ্যানস্থ হয়ে উপাসনা করাই নিরাকার উপাসনা। ঈশ্বর নিরাকার। জগতের কল্যাণে নিরাকার ঈশ্বর সাকার রূপ ধারণ করেন। যিনি নিরাকার, তিনিই আবার সাকার। নিরাকাররূপে ঈশ্বরের উপাসনা হচ্ছে ধ্যান। সাকাররূপে ঈশ্বরের উপাসনা হচ্ছে পূজা। উপাসনা প্রতিদিন করতে হয়। তাই এটি একটি নিত্যকর্ম। উপাসনার আগে পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন হওয়া আবশ্যক। একা বসে উপাসনা করা যায় আবার কয়েকজন মিলে একসাথে বসেও উপাসনা করা যায়। কয়েকজন একত্র হয়ে উপাসনা করাকে সমবেত উপাসনা বলা হয়।
ঈশ্বরের উপাসনায় দেহ-মন পবিত্র হয়। উপাসনা আমাদেরকে সৎপথে বা ধর্মপথে পরিচালিত করে। সকলের কল্যাণ কামনায় আমরা নিয়মিত উপাসনা করব।
প্রার্থনা
আমরা কেউ পরিপূর্ণ নই। প্রত্যেকেরই কিছু চাওয়া পাওয়া আছে। বড়দের কাছেও চাই আবার ছোটদের কাছেও চাই। তবে কেবল অভাবের জন্যই আমরা চাই না। ভালো থাকার জন্যও চাই। নিজের এবং সকলের মঙ্গলের জন্যও চাই। এই চাওয়ার একটা অর্থ প্রার্থনা। এখন আমরা প্রার্থনা সম্পর্কে জানব।
ঈশ্বর সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনি দয়াময়। করুণাময়। তাঁর ইচ্ছার উপরেই আমাদের সবকিছু নির্ভর করে। আমরা তাঁর কাছেই সবকিছু চাই। ঈশ্বরের কাছে ভক্তিমনে কিছু চাওয়াই হচ্ছে প্রার্থনা। উপাসনার একটি অঙ্গ হলো প্রার্থনা। প্রার্থনা করার আগে নিজেকে শুচি করতে হয়। পবিত্র হতে হয়। মনে বিনয়ীভাব থাকতে হয়। একা বা সমবেতভাবেও প্রার্থনা করা যায়। আমরা নিজের ও সকলের কল্যাণ কামনা করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে থাকি।
স্তব-স্তুতি ও
প্রার্থনামূলক কবিতা
হিন্দুধর্মের অনেক ধর্মগ্রন্থ রয়েছে। এর মধ্যে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, শ্ৰীমদ্ভগবদ্গীতা শ্রীশ্রীচণ্ডী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব ধর্মগ্রন্থে ঈশ্বরের স্তব ও প্রার্থনামূলক অনেক মন্ত্র ও শ্লোক রয়েছে। সেখানে ঈশ্বর ও দেব-দেবীর রূপ, গুণ, মাহাত্ম্য প্রভৃতি বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সহ মহান ব্যক্তিদের রচিত বাংলা ভাষায় অনেক প্রার্থনামূলক কবিতা রয়েছে। এসব মন্ত্র, শ্লোক, প্রার্থনামূলক কবিতা চৰ্চা করলে মন পবিত্র হয়। মনে ঈশ্বরের উপলব্ধি অনুভূত হয়।
আমরা এখন ধর্মগ্রন্থাবলি থেকে সরলার্থসহ কিছু মন্ত্র ও শ্লোক এবং প্রার্থনামূলক বাংলা কবিতা শিখব।
অসতো মা সাময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়।
মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়।
(বৃহদারণ্যক উপনিষদ)
শব্দার্থ : অসতো (অসতঃ) অসৎ থেকে সদাময় (সংগময়)- সত্যে নিয়ে যাও; তমসো (তমসঃ)- অন্ধকার থেকে: জ্যোতির্গময় (জ্যোতিঃ + গময়) - জ্যোতিতে অর্থাৎ আলোতে নিয়ে যাও; মৃত্যোর্মা (মৃত্যোঃ+মা); মৃত্যোঃ- মৃত্যু থেকে; মা, আমাকে অমৃতং-অমৃতে, গময়-নিয়ে যাও।
সরলার্থ : আমাকে অসত্য থেকে সত্যে নিয়ে যাও, অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যাও, মৃত্যু থেকে অমৃতে নিয়ে যাও।
নহি আনেন সদৃশং পৰিত্ৰমিহ বিদ্যতে
তৎ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি বিদতি ।।
(শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা-৪/৩৮)
শব্দার্থ :- ন নাই; হি - অবশ্যই; আনেন জ্ঞানের; সদৃশম্ সমান/তুল্য: পবিত্রম্ পবিত্ৰ ইহু এই জগতে; বিদ্যুতে বিদ্যমান তৎ তা স্বরম্ নিজে যোগসংসিক যোগ সিদ্ধগণ; কালেন - কালক্রমে/যথাসময়ে আত্মনি আত্মাতে; বিন্দতি - অনুভব করেন।
সরলার্থ এই জগতে জ্ঞানের তুলা পবিত্র আর কিছুই নেই। যোগসিগণ যথাসময়ে সে জ্ঞানকে নিজ আত্মাতে অনুভব করেন।
সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে
শরণ্যে ত্রাম্বকে গৌরি নারায়নি নমোহস্তু তে। (১১/১)
শব্দার্থ: সর্বমঙ্গলমঙ্গলো সকল মঙ্গলের মঙ্গল স্বরূপা; শিবে কল্যাণদায়িনী; সর্বার্থসাধিকে (সর্ব+ অর্থসাধিকে) সকল প্রকার সিন্ধি সুফল) প্রদায়িনী; শরণ্যে আশ্রয়স্বরূপা; গ্রাসকে - গ্রিনয়না: গৌরি - গৌরবর্ণা: নমোহস্তু তেঅনমোঃ+অন্তু তে) - তোমাকে নমস্কার।
দ্রষ্টব্য: স্ত্রীলিঙ্গে অর্থা)-কারান্ত শব্দের সম্বোধনের একবচনে এ(0-কার এবং নী)-কারান্ত শব্দের সম্বোধনের একবচনে ই-কার হয়।
সরলার্থ: হে নারায়ণী, গৌরী, তুমি সকল মঙ্গলের মঙ্গল স্বরূপা, কল্যাণদায়িনী, সকল প্রকার সুফল প্রদায়িনী, আশ্রয় স্বরূপা, ত্রিনয়না তোমাকে নমস্কার।
অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে-
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে।
জাগ্রত করো, উদ্যত করো, নির্ভয় করো হে।
মঙ্গল করো, নিরলস নিঃসংশয় করো হে।
যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ ।
সঞ্চার করো সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ।
চরণপদ্মে মম চিত নিস্পন্দিত করো হে।
নন্দিত করো, নন্দিত করো, নন্দিত করো হে।
(গীতাঞ্জলি)
দেব-দেবী
আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি, নিরাকার ঈশ্বরের সাকার রূপ হলো দেব-দেবী। ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণ বা শক্তি যখনই আকার পায়, তখন তাঁদের দেব-দেবী বলে। এসব দেব-দেবী ঈশ্বরের বিশেষ গুণ ও ক্ষমতার অধিকারী। তাই আমরা এই শক্তি বা গুন লাভ করার জন্য দেব-দেবীর পূজা করে থাকি। পূজার মধ্য দিয়ে আমরা তাঁদের শ্রদ্ধা জানাই। প্রার্থনা করি তাঁরা যেন আমাদের মঙ্গল করেন।
হিন্দুধর্মে ঈশ্বরকে নানাভাবে ভাবা হয়। নানাভাবে দেখা হয়। ঈশ্বর নিরাকার আবার তিনি সাকারও। ঈশ্বরকে নিরাকার ও সাকার দুভাবেই উপাসনা করা হয়। পূজা ঈশ্বরের সাকার উপাসনার একটি পদ্ধতি। পুজা শব্দের অর্থ প্রশংসা করা বা শ্রদ্ধা করা। ঈশ্বরের প্রতীকরূপে আছেন বিভিন্ন দেব-দেবী। বিভিন্ন দেব-দেবীকে আমরা স্তব-স্তুতি করি। ফুল-ফল ও নানা উপকরণ দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করি। এই স্তব-স্তুতি, শ্রদ্ধা নিবেদন করার প্রক্রিয়া হলো পূজা। পূজার সময়ে মন্ত্র পাঠ করে পুষ্পাঞ্জলি দেয়া হয়। দেবতার আরতি এবং ধ্বান করা হয়। সকল জীবের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করা হয়।
পূজার প্রক্রিয়াগত দিক হলো পূজা করার রীতিনীতি। পূজার আয়োজনের বিভিন্ন দিক আছে। দেবতার প্রতিমা তৈরি আছে, পূজার উপচার আছে, তাঁর কাছে প্রার্থনা আছে। এ সকল পুজার প্রক্রিয়াগত দিকের সঙ্গে যুক্ত দেশ ও অঞ্চলভেদে পূজাপদ্ধতির বিভিন্নতা আছে। তবে পূজা করার মৌলিক দিকগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আবাহন, অর্ধা প্রদান, ধ্যান, পূজা, পুষ্পাঞ্জলি, প্রার্থনামন্ত্র, প্রণামমন্ত্র ইত্যাদি পূজার বিভিন্ন অঙ্গ। আমরা প্রতিদিন পূজা করি। আবার প্রতি তিনি ভেদে, মাস ও বছরের বিশেষ সময় অনুসারে বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজার আয়োজন করা হয়। দেব-দেবী অনুসারে পূজা পদ্ধতি ও মন্ত্র পৃথক হয়ে থাকে। তবে যে-কোনো দেব-দেবীর পূজা করার ক্ষেত্রে কতগুলো সাধারণ নিয়ম থাকে। তা অবশ্যই অনুসরণ করতে হয়। সাধারণভাবে এই নিয়ম- নীতিগুলোকে পূজাবিধি বলে।
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবন্ধভাবে বাস করাই মানুষের প্রকৃতি। ধর্ম সমাজকে সুগঠিত করে গড়ে তোলে। আধ্যাত্মিক ও আর্থসামাজিক দিক থেকে পূজা-পার্বণ যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। পূজা-পার্বণের মাধ্যমে সামাজিক মিলনের সৃষ্টি হয়। সকলে মিলে যখন পূজা করা হয় তখন পূজা হয়ে ওঠে পার্বণ বা উৎসবমুখর।
প্রতিমা আনয়ন, পূজার উপকরণ সংগ্রহ, মন্দিরে পূজার সাজসজ্জা, ধূপের গন্ধ, আরতি, প্রসাদ বিতরণ, নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান প্রভৃতি আমাদের মনে সুন্দর ও পবিত্র ভাবের সৃষ্টি করে। এর ফলে আমাদের ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দের ভাব জাগ্রত হয়।
পূজার মাধ্যনে মনের সৌন্দর্যের সঙ্গে একাগ্রতাও সৃষ্টি হয়। পূজায় অভীঃ দেবতার প্রতি একাগ্রতা ও ভক্তি জাগ্রত করে। পূজা উপলক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যেমন: ধর্মীয় আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা ইত্যাদি। অনেকে স্মরণিকাও প্রকাশ করে থাকেন। পূজা-পার্বণ উপলক্ষ্যে এসব আয়োজন আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশ ঘটায়।
পূজা-পার্বণে পারিবারিক, সামাজিক পর্যায়েও উন্নত খাবারদাবারের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন পূজায় ঋতুভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের ফল যাওয়া হয়। কারণ প্রত্যেক পূজায় কিছু সুনির্দিষ্ট ফলের প্রয়োজন হয়। পূজায় বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদেরও প্রয়োজন হয়, যা পূজার উপকরণ হিসেবে বিবেচিত।
গণেশ আমাদের একজন অতি পরিচিত দেবতা। গণেশকে বিঘ্ননাশকারী, সিদ্ধিদাতা বা সফলতার দেবতারূপে পূজা করা হয়। বিভিন্ন শুভকার্য, উৎসব ও অনুষ্ঠানের শুরুতে গণেশ পূজা করতে হয়। গণেশদের- গণপতি, বিনায়ক, গজানন, একদন্ত, হেরম্ব প্রভৃতি নামেও পরিচিত। পণেশ দেবের শরীর মানুষের মতো। কিন্তু উপর অংশে আছে গজ বা হাতির মাথা। এজন্য গণেশকে গজানন বলা হয়। তাঁর চার হাত এবং তিনটি চোখ। তাঁর শরীর মোটা ও উপর লম্বা। মানব কল্যাণের জন্য এক হাতে তিনি ধারণ করেছেন বরণমুদ্রা। তাঁর বাহন হলো মুষিক (ইঁদুর। গণেশ দেবতা মানুষের সকল বাধাবিপত্তি দূর করেন। সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্য দান করেন। এ কারণে যেকোনো কাজ আরম্ভ করার পূর্বে গণেশ দেবতার পূজা করা হয়। হিন্দুধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে গণেশ দেবতার ছবি বা প্রতিমা সংরক্ষণ করেন। তাঁরা বাংলা নববর্ষে হালখাতার উদ্বোধন করেন। সিদ্ধদাতা গণেশ দেবতার পূজার মাধ্যমে। ধর্মগ্রন্থে গণেশ দেবতার জ্ঞান ও বীরত্বের অনেক কাহিনি আছে।
ভাই ও মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের চতুর্থী তিথিতে গণেশ দেবের পূজা করা হয়। এছাড়া যে-কোনো পূজা করার আগে গণেশ দেবের পূজা করার রীতি রয়েছে। পূজা যথাযথভাবে সমাপ্ত করার জন্য পূজার উপকরণ সংগ্রহ করতে হয়। যেমন: দুর্বা, লাল ফুল, পান পাতা, সুপারি, গ্রুপ, নারকেল, লাল চন্দন, মোদক (মিষ্টি), আরতি থালা, ফলমূল ইত্যাদি। এরপর শুদ্ধ আসনে বসে গণেশের বন্দনা করতে হয়। "ওম গণপতয়ে নমঃ” উচ্চারণের মাধ্যমে গণেশ বন্দনা করতে হয়। ধূপ, দীপ জ্বালিয়ে নানা উপচার দিয়ে পূজা আরম্ভ করতে হয়। এরপর গণেশ দেবের ধ্যান, পুষ্পাঞ্জলি প্রদান ও প্রণাম মন্ত্র পাঠ করতে হয়।
একদন্তং মহাকায়ং লম্বোদরং গজাননম্
বিঘ্ননাশকরং দেবং হেরম্বং প্রণমাম্যহম্ ।।
শব্দার্থ : একদন্তং- এক দাঁত মহাকায়ং- বিশাল শরীর: লম্বোদরং (লু+উদরং) - বড় পেট গজাননম্ (গজ+ আননম্) - গল্প- হাতি; আনন- মুখ: বিঘ্ননাশকরং- বিঘ্ন নাশকারী; দেবং- দেবতা; হেরম্বং- হেরম্ব; প্রণামামাহ ( প্রণমামি + অহম্) প্রণমামি প্রণাম করি; অহম্ আমি।
•• সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসারে এখানে অনুস্বারযুক্ত সব শব্দ একবচনে দ্বিতীয়া বিভক্তি হয়েছে।
সরলার্থ: যিনি এক দাঁত বিশিষ্ট, যাঁর শরীর বিশাল, লম্বা উদর, যিনি গজানন এবং বিঘ্ননাশকারী, সেই হেরম্বদেব গণেশকে প্রণাম জানাই।
গণেশ মূলত বিঘ্ননাশকারী দেবতা। তাই গণেশ দেবের পূজা করলে সকল প্রকার বাধা দূর হয় এবং যেকোনো কাজে সফলতা আসে। গণেশ পূজা করলে সংসারে সুখ-সমৃদ্ধি আসে। তাই হিন্দুধর্মে যে কোনো পূজার আগে গণেশ পূজা করতে হয়। সকল কাজের আগে গণেশ দেবতাকে স্মরণ বা পূজা শুভকর ও মঙ্গলজনক। তাই যে-কোনো কাজ আরম্ভ করার সময় আমরা পণেশ দেবকে স্মরণ করব। পূজার বিধান অনুসারে ভক্তি সহকারে তাঁর পূজা করব।
জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিদ্যা ও সুরের দেবী হলেন সরস্বতী। তিনি বিদ্যাদাত্রী ও জ্ঞানদাত্রী। জ্ঞান হচ্ছে আলো যা অন্ধকার দূর করে। জ্ঞানের আলোয় অজ্ঞানতার অন্ধকার, বিদ্যার আলোয় অবিদ্যার অন্ধকার যিনি দূর করে দেন, তিনিই হলেন দেবী সরস্বতী। সরস্বতী দেবী বাগ্দেবী, বীণাপাণি, সারনা, শতরূপা, বিরজা, মহাশ্বেতা, ব্রাহ্মী প্রভৃতি নামেও পরিচিত।
সরস্বতী দেবীর বসন শুভ্র বা সাদা। তাঁর গায়ের রং চন্দ্রের কিরণের মতো শুভ্র। তাঁর হাতে থাকে বীণা ও পুস্তক। রাজহংস তাঁর বাহন। তাঁর গলায় থাকে অক্ষমালা বা মুক্তার মালা। সাদা পদ্মফুল বেষ্টিত তাঁর আসন। শুভ্রবর্ণ
হচ্ছে সত্ত্বগুণের প্রতীক। সত্ত্বগুণ হচ্ছে পবিত্রতা, স্বচ্ছতা ও নির্মলতার প্রতীক। তাই সরস্বতী দেবীর শুভ্রবর্ণ প্রকৃত জ্ঞানের ও বিশুদ্ধতা নির্দেশ করে।
মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী দেবীর পূজা করা হয়। পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে সরস্বতী পূজা করা যায়। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাড়ম্বরে সরস্বতী দেবীর
পূজা করা হয়। প্রতিমার মাধ্যমে দেবীর সাকার রূপ গড়ে নিয়ে সাধারণত পূজা করা হয়। পূজার পদ্ধতি হিসেবে মণ্ডপ সাজানো, পূজার উপকরণ (পলাশ ফুল, গাদা ফুল, বেলপাতা, ধান, যব, দূর্বা, আম্রপল্লব, কুলসহ নানা প্রকার ফল, দোয়াত-কলম প্রভৃতি) সংগ্রহ করতে হয়। এরপর শুদ্ধ আসনে পূর্ব বা উত্তর মুখে বসে আচমন করে সংকল্প করতে হয়। এরপর দেবীর ঘট স্থাপন করে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে হয়। অর্থাৎ দেবীকে আমন্ত্রণ জানাতে হয়। মন্ত্র পাঠ করে দেবীর পূজা করতে হয়। এ সময় শঙ্খ, ঘণ্টা ও উলুধ্বনি দিতে হয়। পূজার রীতি হিসেবে সরস্বতী দেবীর ধ্যান, পুষ্পাঞ্জলি প্রদান ও প্রনাম মন্ত্র পাঠ করতে হয়।
ওঁ সরস্বত্যৈ নমো নিত্যং ভদ্রকাল্যৈ নমো নমঃ।
বেদ-বেদান্ত-বেদাঙ্গ-বিদ্যাস্থানেভ্য এব চ।।
এর সচন্দন-বিল্বপত্র-পুষ্পাঞ্জলিঃ ঐং সরস্বত্যৈ নমঃ
শব্দার্থ: সরস্বত্যৈ- সরস্বতীকে নমো নমঃ নমস্কার; নিত্যং সর্বদা; ভদ্রকাল্যৈ ভদ্রকালীকে বিদ্যাস্থানেভ্যঃ- বিদ্যাস্থানীয় বিদ্যাসমূহকে সচন্দন- চন্দনযুক্ত; বিল্বপত্র-বেলপাতা। সরলার্থ দেবী সরস্বতী, ভদ্রকালীকে সর্বদা প্রনাম করি। বেদ, বেদান্ত, বেদাঙ্গ ইত্যাদি বিদ্যাস্থানকেও প্রণাম করি। চন্দনযুক্ত বিলপত্র ও পুষ্পের অঞ্জলি দিয়ে সরস্বতী দেবীকে প্রণাম জানাই।
ওঁ সরস্বতি মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।
বিশ্বরূপে বিশালাঙ্কি বিদ্যাং দেহি নমোহস্তুতে।।
শব্দার্থ সরস্বতি হে সরস্বতী মহাভাগে- মহাভাগ; বিদ্যে বিদ্যা; কমললোচনে- পদ্মের মতো চোখ; বিশ্বরূপে- বিশ্বরূপ বিশালাঙ্কি- বিশালাক্ষী। বড়ো চোখ যার); বিদ্যাৎ- বিদ্যা: দেহি দাও: নমোহস্তু (নমঃ + অণু)- নমস্কার; তে তোমাকে।
•• এখানে সবগুলি শব্দ সম্বোধনে আছে। স্ত্রীলিঙ্গ আগে) কারও শব্দের সম্বোধনের একবচনে এর কার এবং গী-কারন্ত শব্দের সম্বোধনের ই-কার হয়।
সরলার্থ : হে মহাভাগ বিদ্যাদেবী সরস্বতী, কমলনয়না, তুমি বিশ্বরূপা। বিশাল তোমার চোখ। তুমি বিদ্যাদান করো। তোমাকে প্রণাম করি।
সরস্বতী বিদ্যার দেবী। সরস্বতী পূজার মাধ্যমে মনের অন্ধকার বা অজ্ঞতা দূর হয়। জ্ঞান বিকাশের জন্য বিদ্যাদেবীর কাছে প্রার্থনা করা হয়। বিদ্যাদেবীর পূজা করে বিদ্যার্থীদের জ্ঞান আহরণের অনুরাগ বেড়ে যায়। সামাজিক দিক থেকে সরস্বতী পূজার গুরুত্ব অনেক বেশি। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দুধর্মাবলম্বী ছাত্র- ছাত্রীরা এ দিনটি অত্যন্ত ভক্তি ভরে উদযাপন করে থাকে। সরস্বতী পূজার মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিদ্যা অর্জনের একাগ্রতা বৃদ্ধি পায়। তাদের মধ্যে এমন দৃঢ় মনোবল তৈরি হয় যে, তারা ভবিষ্যৎ স্বপ্ন পুরণের জন্যও আশান্বিত হয়ে ওঠে। তাই তারা বিদ্যাদেবী সরস্বতীর কাছে বিনীতভাবে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করে।
সরস্বতী পূজার দিনে সমাজের সকল শ্রেণির পূজারীরা বিভিন্ন পূজামন্ডপে দেবীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি দেয়ার জন্য মিলিত হয়। মিলিত হয়ে ভারা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ চারিতায় মেতে ওঠে। যা জ্ঞান বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অপরদিকে পারস্পরিক কুশল বিনিময়ে সকলের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন সু হয়। সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধি পায়। পুজারী ছাড়াও অনেকে পূজার স্থানে আসে। এতে সবার সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়। এই সুসম্পর্ক সমাজকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে।
পার্বণ
পার্বণ হলো কোনো পর্বকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠান বা উৎসবের আয়োজন। উৎসব মানে আনন্দময় অনুষ্ঠান। আমরা পূজা-পার্বণ বলতে বুঝি, যে পর্বগুলো পূজা অনুষ্ঠানকে আনন্দময় করে। দেব-দেবীর প্রতি গভীর ভক্তির সৃষ্টি করে। পূজা-পার্বণের মধ্যে রয়েছে প্রতিমা নির্মাণ। মন্দির বা ঘর সাজানো। বিভিন্ন ধরনের- বাদ্যের আয়োজন করা। বিশেষ করে ঢাক, ঢোল, ঘন্টা, করতাল, কাঁসি, শঙ্খ ইত্যাদি বাল্ব বাজানো। সকলের সাথে ভাববিনিময়, নানা ধরনের খাওয়া-দাওয়া, বিভিন্ন ধরনের আনন্দমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন, উন্নত ও পরিচ্ছন্ন পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করা ইত্যাদিও পার্বনের অঙ্গ।
আবহমান বাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী সর্বজনীন উৎসব হলো নবান্ন। নবান্ন শব্দের অর্থ নতুন অ্য। অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিনটি নবান্ন উদযাপন দিন হিসেবে পরিচিত। অগ্রহাল মাসে আমন ধান কাটার পর এই পার্বন পালন করা হয়। আমন ধান কাটার পর নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি অন্ন, নানা রকম পিঠা-পায়েস প্রভৃতি দিয়ে যে মাঙ্গলিক উৎসব করা হয় তারই নাম নবান্ন। তখন চারদিকে বাতাসে উড়ে বেড়ায় নতুন ধানের গন্ধ। এটি ঋতুভিত্তিক অনুষ্ঠান। এদিন শস্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শ্রীলক্ষ্মীর পূজা করা হয়।
বাংলা মাসের শেষ দিনকে বলা হয় সংক্রান্তি। বাঙালি সংস্কৃতিতে পৌষসংক্রান্তি একটি বিশেষ পার্বণের দিন। সংক্রান্তি শব্দটি কোথাও কোথাও 'সাকরাইনা নামে পরিচিত। তবে বাঙালি সমাজে পৌষসংক্রান্তি ও চৈত্রসংক্রান্তি এ দুটি উৎসবই উল্লেখযোগ্য। পৌষ পার্বণ বা পৌষসংক্রান্তিকে মকর সংক্রান্তিও বলা হয়। বাংলা পৌষ মাসের শেষ দিনে পৌষসংক্রান্তি পালন করা হয়। এই দিন বাঙালিরা পিঠা উৎসব, ঘুড়ি ওড়ানো সহ নানারকম উৎসবের আয়োজন করে। আনন্দে মেতে ওঠে।
নিচের বাক্যগুলো থেকে শুদ্ধ/অপুষ্ঠ নির্ণয় করি।
মন্দির হলো দেবালয়। মন্দিরে দেব-দেবীর মূর্তি থাকে। প্রতিদিন মন্দিরে দেব-দেবীর পূজা-অর্চনা করা হয়। সুতরাং যেখানে দেব-দেবীর মূর্তি থাকে এবং পূজা-অর্চনা করা হয় সে স্থানকে মন্দির বলে। সাধারণত দেব- দেবীর নামানুসারে মন্দিরের নামকরণ হয়। যেমন দুর্গা মন্দির, শিব মন্দির, কালী মন্দির, কৃষ্ণ মন্দির ইত্যাদি। মন্দির পবিত্র স্থান। মন্দিরে গেলে পুশালাভ হয়। দেহ-মন পবিত্র হয়। ভক্তরা মন্দিরে গিয়ে দেব- দেবীর পূজা-অর্চনা করেন। ভগবানের উদ্দেশে ভক্তি নিবেদন করেন। মনের বাসনা পূর্ণতার জন্য, নিজের ও সকলের শান্তির জন্য প্রার্থনা করেন। মন্দিরে গিয়ে দেব-দেবীর দর্শনে অন্তরে ভক্তিভাব উদয় হয়। মনে শান্তি আসে। আমরা সবাই মন্দির বা দেবালয়ে যাব। এখান আমরা একটি মন্দিরের পরিচয় জান
রমনা কালী মন্দিরা : আমাদের একটি বিখ্যাত মন্দির হচ্ছে রমনা কালী মন্দির। এটি ঢাকায় অবস্থিত। মন্দিরটি বহু শতাব্দীর প্রাচীন। ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রমনা কালীবাড়ি মন্দিরটি ধ্বংস করে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ বহু মানুষ হানাদার বাহিনীর আক্রমণে নিহত হয়। মন্দিরের কাছে ছিল আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম। এই আশ্রমটিও ধ্বংস করে দেয়া হয়। বর্তমান মন্দিরটি আগের জায়গা থেকে কিছুটা দুরে অবস্থিত। নতুনভাবে নান্দনিক করে নির্মিত হয়েছে মন্দিরটি। মন্দিরের সামনে আছে একটি বড়ো
পুকুর। মন্দির অঙ্গনে রয়েছে মা আনন্দময়ীর আশ্রম। আনন্দময়ী ছিলেন একজন সন্ন্যাসিনী। তিনি আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্না এবং সাধিকা হিসেবে পুজিতা। এখানে কালী মন্দির, দুর্গা মন্দির, মা আনন্দময়ীর আশ্রম সহ আরও অনেক মন্দির আছে।
তীর্থক্ষেত্র হলো দেব-দেবী, অবতার কিংবা মহাপুরুষ মহীয়সীদের নামের সঙ্গে যুক্ত পবিত্র স্থান। তীর্থক্ষেত্রে গেলে মনে ধর্মের ভাব উদয় হয়। দেহ-মন পবিত্র হয়। পুণ্যলাভ হয়। সকল পাপ দূর হয়। কারও প্রতি হিংসা- বিদ্বেষ থাকে না।
বাংলাদেশ ও ভারতে অনেক তীর্থস্থান রয়েছে। যেমন: চন্দ্রনাথ ধাম, লাঙ্গলবন্দ, গয়া, কাশী, বৃন্দাবন, পুরী, মথুরা, নবদ্বীপ ইত্যাদি। দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য পুণ্যার্থী এসব পুণ্যভূমিতে তীর্থ করতে আসেন। আমরা এখন একটি তীর্থক্ষেত্র সম্পর্কে জানব।
চন্দ্রনাথ ধাম : বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত তীর্থক্ষেত্র হচ্ছে চন্দ্রনাথ ধাম। চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ড উপজেলায় এ তীর্থক্ষেত্রটি অবস্থিত। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উপর একটি শিব মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই তীর্থক্ষেত্র। শিবের এক নাম চন্দ্রনাথ। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের এই তীর্থস্থানকে কেন্দ্র করে এখানে আরও অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যেমন শম্ভুনাথ মন্দির, বিরূপাক্ষ মন্দির, ভোলানাথ গিরি সেবাশ্রম, দোল চত্বর, শ্রীকৃষ্ণ মন্দির ইত্যাদি
সীতাকুণ্ডের অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এ চন্দ্রনাথ ধাম। ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথির রাতে চন্দ্রনাথ ধামে ভগবান শিবের আরাধনা করা হয়। শিবের নামের সঙ্গে যুক্ত এই তিথি শিব চতুর্দশী বলে পরিচিত। শিব চতুর্দশী তিথিতে চন্দ্রনাথ ধামে বহু মানুষের সমাগম হয়। এ সময় এখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। মেলার আয়োজন করা হয়। দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য ভক্তের সমাগম ঘটে। চন্দ্রনাথ ধানে গেলে মন শান্ত ও পবিত্র হয়।
এই যে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকা, এটা এক প্রকার যোগাসন। এসো, এখন আমরা বিভিন্ন রকমের যোগাসন এবং এ যোগাসনগুলো কীভাবে করতে হয় সে সম্বন্ধে আরো জানি।
ঈশ্বর আরাধনার একটি পদ্ধতি হচ্ছে যোগ। সাধারণভাবে 'যোগ' শব্দের অর্থ হচ্ছে কোনো কিছুর সঙ্গে কিছু যুক্ত করা তবে ধর্ম অনুশীলনের ক্ষেত্রে যোগ বলতে বোঝায় ভগবানের প্রতি মনঃসংযোগ করা। আসন হচ্ছে যোগের একটি অঙ্গ। যোগ অভ্যাস করার জন্য যেভাবে শরীরকে রাখলে শরীর স্থির থাকে অথচ কোনো কষ্টের কারণ ঘটে না, তাকে যোগাসন বলে। যোগাসন অনুশীলনে কতগুলো সাধারণ নিয়ম মেনে চলতে হয়। তবেই এর সুফল পাওয়া যায়। নিয়মিত যোগাসন অনুশীলনে দেহকে বিভিন্ন রোগ থেকে দূরে রাখা যায়। ফলে শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ, সবল ও সুন্দর হয়ে ওঠে। মন হয়ে ওঠে আনন্দ ও শান্তিময়। সকল কাজে মনঃসংযোগ ঘটে।
আরাধনার ক্ষেত্রে দেহ এবং মন উভয়েরই গুরুত্ব রয়েছে। দেহকে আশ্রয় করে ধর্ম সাধনা অগ্রসর হয়। তাই দেহকে সুস্থ রাখা সাধনার পূর্বশর্ত। আর যোগাসন হচ্ছে দেহ ও মনকে সুস্থ রাখার একটি প্রক্রিয়া। সেজনা প্রাচীনকালে মুনি-ঋষিগণ শরীর ও মনকে সুস্থ রাখার উপায় হিসেবে যোগাসন অনুশীলনের বিধান দিয়ে গেছেন। যোগাসনের সংখ্যা অনেক, যেমন- পদ্মাসন, শরাসন, সিদ্ধাসন, গোমুখাসন, সর্বাঙ্গাসন ইত্যাদি।
প্রতিটি কাজেরই কিছু নিয়ম-কানুন থাকে। ঠিক তেমনি যোগাসন অনুশীলনেরও কিছু নিয়ম-কানুন রয়েছে। যেমন-সকাল ও সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট সময়ে যোগাসন অনুশীলন করতে হয়। ভরা পেটে কিংবা একেবারে খালি পেটে আসন অনুশীলন করা অনুচিত। নরম বিছানার ওপর আসন অনুশীলন করা ঠিক নয়। আসন করার সময় ঢিলেঢালা হালকা পোশাক পরা উচিত। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখতে হয়। নিয়ম অনুসারে প্রত্যেকটি আসন অনুশীলন করার পর শবাসনে বিশ্রাম নিতে হয়।
যোগাসনের গুরুত্ব
নিয়মিত যোগাসনে দেহ সুস্থ থাকে। দেহে স্থিরতা আসে। আসন হলো দেহভঙ্গি। এ দেহভঙ্গিতে দেহের প্রতিটি পেশি, স্নায়ু ও গ্রন্থির ব্যায়াম হয়। দেহ-মনের কর্মতৎপরতা ও জীবনী শক্তি বৃদ্ধি পায়। দেহের গঠন সুন্দর ও উজ্জ্বল হয়। দেহের রক্ত প্রবাহ বিশুদ্ধ হয়। দেহের মেদ কমাতে, শীর্ণতা দূর করতে যোগাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যোগাসন দেহের ক্লান্তি দূর করে। মনের চঞ্চলতা দূর করে। যোগাসন অনুশীলনে আধ্যাত্মসাধনায়। নিজেকে নিয়োজিত করা যায়।
বিভিন্ন আসনের মধ্যে আমরা এখন পদ্মাসন ও শবাসন সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।
পদ্মাসন
আমরা একটি সুন্দর আসনের কথা জানব। এ আসনটি দেখলে মনে হবে যেন একটি পদ্মফুল ফুটে আছে। অর্থাৎ আসনটি দেখতে পদ্মের মতো। তাই এ আসনের নাম পদ্মাসন।
পদ্মাসনের নিয়ম :
কোনো সমতল স্থানে দুই পা সামনে ছড়িয়ে বসতে হবে। তারপর ডান পা হাঁটুর কাছ থেকে ভেঙে বাম জানুর ওপর রাখতে হবে। আবার বাম পা ভেঙে ডান জানুর ওপর রাখতে হবে। দুই পায়ের গোড়ালি তলপেটের সঙ্গে মিশে থাকবে। দুই হাঁটুও মিশে থাকবে বসার জায়গার সঙ্গে। দেখতে হবে হাঁটু যেন উঁচু না হয়। সোজা হয়ে বসতে হবে। মাথা, ঘাড় এবং মেরুদণ্ড সোজা থাকবে। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকবে। এক মিনিট বসে থাকার পর পা ছড়িয়ে দিতে হবে। এরপর আবার পা পরিবর্তন করে বসতে হবে। অর্থাৎ বাম পা জ্ঞান জানুর ওপর রাখতে হবে। এভাবে প্রতিবারে এক মিনিট করে প্রথম দিকে তিন-চারবার অভ্যাস করতে হবে। প্রতিবার অভ্যাসের পর পনের সেকেন্ড শবাসনে বিশ্রাম নিতে হবে।
উপকারিতা :
এতে স্বাস্থ্য ভালো থাকে। দীর্ঘজীবন লাভ করা যায়। মনঃসংযোগ ও একাগ্রতা বাড়ে। শিক্ষার্থীদের জন্য পদ্মাসন খুবই উপকারী।
শবাসন
আমরা একটা মজার আসন শিক্ষক। আসনটির নাম শুনলে একটু কেমন কেমন লাগবে। কিন্তু চিন্তার কোনো কারণ নেই। আসনটির নাম শরাসন। আসনটিতে শবের মতো হয়ে শুয়ে থাকতে হয়। অর্থাৎ মরার মতো শুয়ে থাকতে হয়। তাই এর নাম শবাসন।
শবাসনের নিয়ম :
কোনো শক্ত জায়গায় চিত হয়ে শুয়ে পা দুটি লম্বা করে ছড়িয়ে দিতে হবে। পা দুটোর মাঝে এক ফুট থেকে দেড় ফুটের মতো ফাঁক থাকবে। পায়ের গোড়ালি ভিতরের দিকে থাকবে। আঙুলগুলো থাকবে বাইরের দিকে। হাত দুটো লম্বালম্বিভাবে শরীরের দু-পাশে উরু থেকে একটু দূরে রাখতে হবে। হাতের পাতা আধমুঠো অবস্থায় থাকবে। কোনো শত্রুভাব যেন না থাকে। এবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস গ্রহণ ও আগ করতে হবে। এই আসনটি একসঙ্গে ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর্যন্ত অনুশীলন করতে হয়। আধঘণ্টা হলে আরও ভালো হয়। তবে দৈনিক যোগাভ্যাসে অন্য কোনো আসনের পর এই আসন অন্ততঃ ৫ থেকে ১০ মিনিট পর্যন্ত করা উচিত।
উপকারিতা :
শবাসন অনুশীলনে শরীরের সব ক্লান্তি দূর হয়। মন শান্ত থাকে। শরীর সুস্থ ও সবল হয়। মাংসপেশি ও স্নায়ু শিথিল হয়। শরীরে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয়। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। অনেক পরিশ্রম ও পড়াশোনার পর শবাসন করলে খুব উপকার হয়।
যোগাসনের নিয়মগুলো এবং কেন করতে হবে সে কারণগুলো লেখ।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------- |