আগের সেশনগুলোতে আমরা নেটওয়ার্ক সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি। এবার এসো জেনে নেই নেটওয়ার্কের বিভিন্ন উপাদান সম্পর্কে।
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে আসা ডাক যোগযোগ ব্যবস্থার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। যেখানে পঞ্চগড় থেকে কক্সবাজার চিঠি পাঠানোর জন্য আমাদের ডাকঘর ব্যবহারের প্রয়োজন হয়েছিল। পঞ্চগড়ে অবস্থিত আমাদের এলাকার ডাকঘর থেকে চিঠি যেতে পারে জেলা ডাকঘরে। সেখান থেকে বিভাগীয় ডাকঘর, কেন্দ্রীয় ডাকঘরসহ বেশ কিছু ডাকঘর হয়ে, শেষে গিয়ে আমাদের চিঠি পৌঁছাবে কক্সবাজারে অবস্থিত আমাদের বন্ধুর এলাকার ডাকঘরে। এখানে প্রতিটি ডাকঘর একেকটি রাউটারের ভূমিকা পালন করেছে।
কিন্তু, আমরা যদি দূরের কোনো বন্ধুর কাছে চিঠি না পাঠিয়ে আমাদের এলাকার কোনো বন্ধুর কাছে চিঠি পাঠাতে চাই, তাহলে কিন্তু ডাকঘরের মাধ্যমে পাঠানোর প্রয়োজন হয় না। একইভাবে, কম্পিউটার নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রেও একই LAN এর অন্তর্ভুক্ত ডিভাইসগুলোর নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য রাউটার না থাকলে সমস্যা নেই। এক্ষেত্রে সাধারণত সুইচ (SWITCH) বা হাব (HUB) ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সুইচ ব্যবহার করে এটির সাথে সংযুক্ত কোনো প্রেরক বার্তা পাঠালে সেটি শুধু প্রাপকের কাছে যাবে। আর হাবের মাধ্যমে প্রেরকের বার্তা হাবের সাথে সংযুক্ত সকল ডিভাইসের কাছে চলে যাবে।
অতএব, একই নেটওয়ার্কের মধ্যে বার্তা আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে সুইচ ব্যবহার হয়ে থাকে, কিন্তু, লোকাল নেটওয়ার্কের বাইরে বার্তা আদান প্রদানের জন্য রাউটার প্রয়োজন হবে। রাউটার একটি নেটওয়ার্ক থেকে আরেকটি নেটওয়ার্কের ডেটা প্যাকেট ফরোয়ার্ড করে। ক্ষেত্রবিশেষে এটিকে 'গেটওয়ে' বলা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, সুইচের সাথে যুক্ত না হয়ে, সরাসরি রাউটারের সাথে যুক্ত হয়েও বার্তা আদান প্রদান করা যায়।
এখন প্রশ্ন হলো, নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আসা ডেটা প্যাকেটগুলো কম্পিউটারের ভিতর আসে কীভাবে? ডাকপিয়ন যেমন চিঠি পৌঁছানোর জন্য আমাদের বাড়িতে চলে আসে এবং আমাদের ঘরের দরজা দিয়ে সে চিঠি ভিতরে প্রবেশ করে। সেরকম নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আসা ডেটা কম্পিউটারে প্রবেশ করে নেটওয়ার্ক ইন্টারফেস কার্ড বা এনআইসি (NIC) এর মাধ্যমে। এটি নেটওয়ার্ক অ্যাডাপ্টার বা ইন্টারফেস কন্ট্রোলার নামেও পরিচিত। কম্পিউটার বা যে কোনো ডিভাইসকে নেটওয়ার্কে সংযুক্ত করতে হলে NIC প্রয়োজন হবে। প্রতিটি NIC কার্ডে নির্মাতা কর্তৃক নির্ধারিত একটি অনন্য MAC অ্যাড্রেস (ঠিকানা) থাকে, যা নেটওয়ার্কে একটি ডিভাইসকে আলাদাভাবে সনাক্ত করতে ব্যবহার করা হয়। পরবর্তী সেশনে আমরা MAC অ্যাড্রেস সম্পর্কে আরো জানতে পারব।
ইন্টারনেট বা নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে চাইলে আমাদের আরো একটি ডিভাইসের প্রয়োজন হয়। সেটি হলো মডেম। ইন্টারনেট যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাধারণত ডিজিটাল এবং অ্যানালগ এই দুই ধরনের সংকেত ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কম্পিউটার শুধুমাত্র ডিজিটাল সিগন্যাল বুঝতে পারে। কিন্তু, যে সমস্ত মাধ্যম বা ক্যাবলের মাধ্যমে ডেটা ট্রান্সফার হয়ে থাকে সেগুলো বুঝতে পারে অ্যানালগ সিগন্যাল। মডেম কম্পিউটার থেকে পাওয়া ডিজিটাল ডেটাকে (সংকেত) অ্যানালগে রূপান্তর করে এবং নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আগত অ্যানালগ ডেটাকে ডিজিটাল ডেটায় রূপান্তর করে। মডেম (MODEM) নামটি এসেছে মূলত এর প্রধান দুটি উপাদান: মডুলেটর (MO) এবং ডিমোডুলেটর (DEM) থেকে।
এছাড়া নেটওয়ার্কের দুর্বল সিগন্যালকে সবল করার জন্য ব্যবহৃত হয় রিপিটার; লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্কের একাধিক অংশকে সংযুক্ত করতে ব্যবহার হয় ব্রিজ; তারযুক্ত (Wired) সিগন্যালকে তারবিহীন (Wireless) সিগন্যালে রূপান্তরিত করে WiFi এর মাধ্যমে অধিকসংখ্যক ব্যবহারকারীর ডিভাইসে নেটওয়ার্ক সংযোগ স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ব্যবহার হয় অ্যাক্সেস পয়েন্ট। এগুলো বাদেও আরো বিভিন্ন ধরনের নেটওয়ার্ক হার্ডওয়্যার রয়েছে।
তবে, একটি নেটওয়ার্কে শুধু হার্ডওয়্যার উপাদান থাকে না। হার্ডওয়্যার উপাদানসমূহ পরিচালনার সফট্ওয়্যার; নেটওয়ার্কে সংযুক্ত বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটিং ডিভাইস, সংশ্লিষ্ট সফটওয়্যার ও অপারেটিং সিস্টেম; সার্ভার কম্পিউটারে পরিচালিত বিভিন্ন পরিষেবা প্রদানকারী সফটওয়্যার, অনুমতি ছাড়া যেন নেটওয়ার্কে সংযুক্ত না হওয়া যায় বা ডেটা আদান-প্রদান না করা যায়, সেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবহৃত হয় ফায়ারওয়াল, ইত্যাদি উপাদানও নেটওয়ার্কের অংশ।
অপরদিকে, নেটওয়ার্কের কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য বেশকিছু নিয়মকানুনও নির্দিষ্ট করা থাকে। রাস্তায় গাড়ি চলাচলের জন্য যেমন ট্রাফিক সিগন্যাল আছে, কোন পথে কোন গাড়ি যেতে পারবে বা পারবে না সে নিয়ম আছে, রাস্তায় জ্যাম লাগলে কী করতে হবে সেটির ব্যবস্থা আছে, সেরকম নেটওয়ার্কের বিভিন্ন ডিভাইসের একটির অপরটির সাথে যোগাযোগের জন্য বা ডেটা প্যাকেট পাঠানোর জন্যও বেশ কিছু নিয়ম- কানুন আছে। সে সমস্ত নিয়ম-কানুন ও রীতিনীতিকে নেটওয়ার্ক প্রটোকল বলা হয়ে থাকে।
আমাদের বাসায় ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে কিছু ক্ষেত্রে আমরা খেয়াল করলে দেখব যে, অনেকগুলো উপাদানের পরিবর্তে সেখানে শুধুমাত্র ওয়্যারলেস রাউটার নামে একটি ডিভাইস থাকে। এক্ষেত্রে, রাউটার, সুইচ ও ওয়্যারলেস অ্যাক্সেস পয়েন্ট একটি ডিভাইসে একসাথে দেওয়া থাকে। কিছুকিছু ডিভাইসে এগুলোর সাথে মডেমও একসাথে দেওয়া থাকে। চিত্র ৫.৮ এর ডানপাশে যে চারটি পোর্ট (LAN Port) একসাথে আছে, সেটিকে মূলত চার পোর্টের একটি সুইচ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের চারটি ডিভাইস যুক্ত করা যাবে। অ্যান্টেনাগুলো অ্যাক্সেস পয়েন্টের কাজ করবে, যেগুলোর মাধ্যমে ওয়্যারলেস যোগাযোগ সম্পন্ন হবে এবং ওয়াইফাই ডিভাইসগুলো নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে। বাম পাশের একটি পোর্টে (WAN Port) ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারী (আইএসপি) থেকে আসা তার সংযুক্ত হবে।
আরও দেখুন...