পরিচ্ছেদ ১.২ : বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে রাজনৈতিক আন্দোলনের ভূমিকা

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৫) - বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় - পূর্ব বাংলার আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদের উত্থান (১৯৪৭-১৯৭০) | | NCTB BOOK
16
16

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজনৈতিক চরিত্র এবং একই সঙ্গে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভুলগুলো বুঝতে পারে। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ বাঙালি হওয়ার পরও রাষ্ট্র পরিচালনা, প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগসহ সর্বক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃত্ব শুরু করে। বাঙালি তথা পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ সকল ক্ষেত্রে বঞ্চিত হতে থাকে। তখন রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের মধ্যে তিনটি ধারা লক্ষ করা যায়। এগুলো হচ্ছে: ১. পাকিস্তানের প্রতি অনুগত ইসলামি নামধারী রাজনৈতিক দল, যেমন- মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামি ও নেজামে ইসলাম; ২. পূর্ব বাংলার স্বার্থ রক্ষার জন্যে সোচ্চার রাজনৈতিক দল, যেমন – আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফ্ফর) এবং ৩. সাম্যবাদী আদর্শের বাম রাজনৈতিক ধারা।

আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কেন্দ্রীয় সরকার ও কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগে বাঙালিদের কোণঠাসা করে ফেলা হয়। ফলে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে বাঙালিদের স্বপ্নভঙ্গ হয়। এই প্রেক্ষাপটে পূর্ববাংলার প্রগতিশীল ও গণমানুষের নেতৃত্বে বাঙালিদের অধিকার আদায়ের জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়। ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক সম্মেলনের মাধ্যমে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' গঠন করা হয়। এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক এবং যুগ্ম সম্পাদক হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শুরুতেই দলটি বাঙালিদের স্বার্থে একটি বিস্তৃত কর্মসূচি গ্রহণ করে। এর মধ্যে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, জনগণের সার্বভৌমত্ব, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান, পাট ও চা শিল্প জাতীয়করণ, বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদ, কৃষকদের মধ্যে ভূমি বণ্টন, সমবায় ভিত্তিক চাষাবাদ ইত্যাদির দাবি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব দাবি উত্থাপনের কারণে দলটি দ্রুত পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসকের রোষানলে পড়েন। তাই ১৯৪৯ সালে তাঁকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু কারাগারে বসেই তিনি ভাষার দাবিসহ রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। ফলে ১৯৫২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাঁকে বন্দিজীবন কাটাতে হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনের মূল উদ্যোগ ছিল আওয়ামী লীগের। ১৯৫৫ সালে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আদর্শের অধিকতর প্রতিফলন ঘটানোর জন্য 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’এর নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ' করা হয়। ফলে ধর্ম পরিচয় নির্বিশেষে সকল বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহ জাতীয়তাবাদের ধারায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। এ সময়ে দলটি পূর্ব বাংলার জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ সকল স্বার্থরক্ষায় একদিকে আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত রাখে, অন্যদিকে সংসদ ও প্রাদেশিক সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সোচ্চার হতে থাকে ।

যুক্তফ্রন্ট গঠন, প্রাদেশিক নির্বাচন ও সরকার গঠন

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শাসক দল মুসলিম লীগ দীর্ঘদিন নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার গঠনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এছাড়া প্রাদেশিক সরকার নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের টালবাহানা পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটানোর লক্ষ্যে ১৯৫৩ সালের ১৪ই নভেম্বর আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। চারটি দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। দল চারটি হলো : আওয়ামী লীগ,কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম এবং গণতন্ত্রী দল। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতিক ছিল নৌকা। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে জনগণ যুক্তফ্রন্টের ২১ দফাকে তাদের স্বার্থরক্ষার সনদ বলে বিবেচনা করে। পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আর মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন লাভ করে। বাকি আসন অন্যরা পায়। নির্বাচনে পূর্ববাংলার জনগণ পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের কর্তৃত্ব ও প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার রায় প্রদান করে। পূর্ব বাংলায় বাঙালিদের শাসন দেখতে জনগণ যে আগ্রহী, তা স্পষ্ট হয়। যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক সরকার গঠনের রায় লাভ করে। জনগণই যে ‘সকল ক্ষমতার উৎস'-এই নির্বাচন তা প্রমাণ করে । জনগণ এ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে প্রত্যাখ্যান করে এবং পূর্ব বাংলায় এর শাসনের অবসান ঘটায়।

১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা

১. বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হবে।                                                         ২. বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ, সকল প্রকার মধ্যস্বত্ব ও সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল করা  হবে।                                                                                                                           3.পাট ব্যবসাকে জাতীয়করণ, পাটের ন্যায্যমূল্য প্রদান এবং পাট কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।                                                                        ৪. সমবায় কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং কুটির ও হস্তশিল্পের উন্নতি সাধন করা হবে।                     ৫. পূর্ব বাংলার লবণ শিল্পের সম্প্রসারণ ও লবণ কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।                                                                                                                   ৬. শিল্প ও কারিগরি শ্রেণির বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন করা হবে।                                                7. খাল খনন, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বন্যানিয়ন্ত্রণ, কৃষিকে যুগোপযোগী করে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা হবে।                                                                                                             ৮. পূর্ব বাংলাকে শিল্পায়িত ও শ্রমিকের ন্যায় সঙ্গত অধিকার রক্ষা করা হবে।                           ৯. অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করা হবে। শিক্ষকদের ন্যায় সঙ্গত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হবে।                                                                                               ১০. শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল সংস্কার করে কেবল মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হবে।           ১১. ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান, সকল প্রকার কালাকানুন বাতিল ও উচ্চশিক্ষাকে সহজলভ্য করা হবে।                                                                                ১২. প্রশাসনিক ব্যয় সংকোচন, উচ্চ ও নিম্নবেতনভুক্ত কর্মচারীদের মধ্যে বেতন বৈষম্য হ্রাস করা হবে।                                                                                                                            ১৩. সকল প্রকার দুর্নীতি নির্মূল করা হবে।                                                                         ১৪. রাজবন্দিদের মুক্তিদান, বাকস্বাধীনতা, সভা-সমিতি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হব। ১৫. শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করা হবে।                                                      ১৬. ‘বর্ধমান হাউস 'কে আপাতত ছাত্রাবাস ও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণাগার করা হবে।    ১৭. বাংলা ভাষার শহিদদের স্মরণে শহিদ মিনার নির্মাণ করা হবে।                                         ১৮. একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হবে।                           ১৯. ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হবে।             ২০. নিয়মিত ও অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে।                                                            ২১. পরপর তিনটি উপনির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট পরাজিত হলে মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবে।

যুক্তফ্রন্ট সরকার

১৯৫৪ সালের ৩রা এপ্রিল যুক্তফ্রন্টভুক্ত কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা এ.কে. ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। যুক্তফ্রন্ট সরকার মাত্র ৫৬ দিন ক্ষমতায় ছিল। পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলার যুক্তফ্রন্ট সরকারকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি। তারা ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নেয়। আদমজী পাটকল ও কর্ণফুলি কাগজের কলে বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ১৯৫৪ সালের ৩০ মে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করে। উল্লেখ্য, পাকিস্তান সরকারের ইন্ধনে ঐ দাঙ্গা হয়েছিল। শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হককে গৃহবন্দি করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তিন হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এর মাধ্যমে পূর্ব বাংলার প্রতি পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর চরম বৈরী মনোভাব প্রকাশ পায়। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের অরাজক শাসন পর্ব শুরু হয়। কেন্দ্র এবং প্রদেশে ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন হতে থাকে। দেশ সামরিক শাসনের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়।

 

 

Promotion