প্রত্যেকটি মানব শিশু একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে এবং পরিবারেই বড় হয়। মানুষের জন্ম, সমগ্র কর্মময় জীবন এবং শেষ পরিণতি পারিবারিক বন্ধনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। পৃথিবীতে এমন কোনো মানব সমাজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে পরিবার নেই। পরিবার হলো একটি ক্ষুদ্রতম সামাজিক সংগঠন, যেখানে পিতা-মাতা ও তাদের সন্তান-সন্ততি একত্রে বসবাস করে। পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যের স্নেহ- ভালোবাসা, শাসন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দিয়ে পরিবারেই শিশুর সকল সামাজিক গুণের বিকাশ ঘটে।
পরিবারের ধারণা
পরিবার হলো সমাজকাঠামোর মৌল সংগঠন। গোষ্ঠী জীবনের প্রথম ধাপ হচ্ছে পরিবার। পরিবার হচ্ছে মোটামুটিভাবে স্বামী-স্ত্রীর একটি স্থায়ী সংঘ বা প্রতিষ্ঠান, যেখানে সন্তান-সন্ততি থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। বিবাহ পরিবার গঠনের অন্যতম পূর্বশর্ত। একজন পুরুষ সমাজস্বীকৃত উপায়ে একজন নারীকে বিয়ে করে একটি পরিবার গঠন করে। আদিম সমাজেও পরিবারের অস্তিত্ব ছিল। সে সমাজে বিবাহ ব্যতিরেকেই পরিবার গঠিত হতো। কিন্তু আমাদের সমাজে এটা সম্ভব নয়। সুতরাং বলা যায় যে, বিবাহের মাধ্যমেই পরিবার গঠন করা যায় । পরিবার হচ্ছে মানুষের দলবদ্ধ জীবনযাপনের বিশ্বজনীন প্রতিষ্ঠান। সব সমাজে এবং সমাজ বিকাশের প্রত্যেক স্তরেই পরিবারের অস্তিত্ব রয়েছে। এটি আমাদের দলবদ্ধ জীবনের আবেগময় ভিত্তি। সন্তান জন্মদান, প্রতিপালন এবং স্নেহ-মায়ামমতার বন্ধন, মূল্যবোধ গঠন, অধিকার সচেতনতা সৃষ্টি প্রভৃতি পরিবারের মধ্যেই ঘটে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবারের রয়েছে বিশেষ নিয়ম-নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধ এবং কার্যগত সাংগঠনিক ভিত্তি, যার সামগ্রিকরূপই পরিবার কাঠামো।
আদিম সমাজ হতে শুরু করে আজ পর্যন্ত পরিবারের গঠন, কার্যাবলি ও কাঠামোতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এই পরিবর্তন সত্ত্বেও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় মানব সমাজে পরিবারের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, মানুষের জীবনের শুরু হতে শেষ অবধি আশ্রয়স্থল হচ্ছে পরিবার। পরিবারের সাথে মানুষের সম্পর্ক গভীর ও শৃঙ্খলিত, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। পরিবারের মাধ্যমেই সামাজিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
পরিবারের প্রকারভেদ
সমাজভেদে বা দেশভেদে বিভিন্ন প্রকারের পরিবার রয়েছে। বিভিন্ন মাপকাঠির ভিত্তিতে পরিবারকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। স্বামী-স্ত্রীর সংখ্যা, কর্তৃত্ব, পরিবারের আকার, বংশমর্যাদা, বসবাস এবং পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের মাপকাঠির ভিত্তিতে পরিবার বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে।
১. স্বামী-স্ত্রীর সংখ্যার ভিত্তিতে পরিবার : এ ভিত্তিতে পরিবার তিন ধরনের হয়ে থাকে, যেমন: একপত্নী, বহুপত্নী ও বহুপতি পরিবার। একজন পুরুষের সঙ্গে একজন নারীর বিবাহের মাধ্যমে একপত্নী পরিবার গড়ে ওঠে। বিশ্বে এ ধরনের পরিবার অধিক দেখা যায়। আদর্শ পরিবার বলতে মূলত এ পরিবারকেই বোঝায়। এ ধরনের পরিবার কাঠামোতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। আবার একজন পুরুষের সঙ্গে একাধিক নারীর বিবাহের ভিত্তিতে যে পরিবার গঠিত হয়, তাকে বহুপত্নী পরিবার বলে। এ ধরনের পরিবারে মূলত একজন পুরুষের একই সময়ে একাধিক স্ত্রী বর্তমান থাকে। সাধারণত কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ মুসলিম সমাজে এ ধরনের বহুপত্নীক পরিবার দেখা যায়। এস্কিমো উপজাতি এবং আফ্রিকার নিগ্রোদের সমাজেও এ ধরনের পরিবার প্রথা রয়েছে। একজন নারীর সাথে একাধিক পুরুষের বিবাহের মাধ্যমে যে পরিবার গড়ে ওঠে তাকে বহুপতি পরিবার বলে। এ ধরনের পরিবার আধুনিক সভ্য সমাজে দেখা যায় না। তবে একসময়ে তিব্বতে বহু স্বামী গ্রহণ পদ্ধতির প্রচলন ছিল। তাছাড়া, দক্ষিণ ভারতের মালাগড় অঞ্চলে টোডাদের মধ্যে এ ধরনের পরিবার দেখা যেত।
২. কর্তৃত্বের ভিত্তিতে পরিবার : কর্তৃত্বের ভিত্তিতে পরিবার দুই ধরনের হয়ে থাকে, যেমন—পিতৃপ্রধান বা পিতৃতান্ত্রিক এবং মাতৃপ্রধান বা মাতৃতান্ত্রিক পরিবার। পরিবারের সামগ্রিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব পুরুষ সদস্য অর্থাৎ পিতা, স্বামী কিংবা বয়স্ক পুরুষের হাতে থাকলে এ ধরনের পরিবারকে পিতৃপ্রধান পরিবার বলে। এ ধরনের পরিবারের বংশ পরিচয় প্রধানত পুরুষ সূত্র দ্বারা নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশের সমাজে এ ধরনের পরিবার রয়েছে। আবার যে পরিবারের সামগ্রিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব মায়ের হাতে থাকে সে পরিবারকে মাতৃপ্রধান পরিবার বলে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা খাসিয়া এবং গারোদের পরিবার মাতৃতান্ত্রিক বা মাতৃপ্রধান।
৩. আকারের ভিত্তিতে পরিবার : আকারের ভিত্তিতে পরিবার তিন ধরনের হয়ে থাকে, যেমন-একক বা অণু পরিবার, যৌথ পরিবার ও বর্ধিত পরিবার। স্বামী-স্ত্রী ও তাদের অবিবাহিত সন্তান-সন্ততি নিয়ে গঠিত পরিবারকে একক পরিবার বলে। এ পরিবার দুই পুরুষে আবদ্ধ। দুই পুরুষ হলো পিতা এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান-সন্ততি। আমাদের দেশের শহরাঞ্চলের অধিকাংশ পরিবারই একক পরিবার। গ্রামাঞ্চলেও এ ধরনের পরিবার গড়ে ওঠার প্রবণতা লক্ষণীয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এ ধরনের পরিবার প্রথা প্রচলিত। যখন দাদা-দাদি বা পিতা-মাতার কর্তৃত্বাধীনে বিবাহিত পুত্র ও তার সন্তানাদি এক সংসারে বাস করে তখন তাকে যৌথ পরিবার বলে। একক পরিবারের মতো যৌথ পরিবারের বন্ধনও মূলত রক্তের সম্পর্কের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ পরিবারই যৌথ পরিবার। এখন এ ধরনের পরিবারের সংখ্যা নানা কারণে হ্রাস পাচ্ছে । তিন পুরুষের পারিবারিক বন্ধনের পরিবার হলো বর্ধিত পরিবার। বর্ধিত পরিবারে পিতৃকুল ও মাতৃকুল উভয় দিকের সদস্য অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। আমাদের দেশের গ্রামীণ সমাজে এ ধরনের পরিবার এখনও দেখা যায়। চীনেও এ ধরনের পরিবার প্রথা রয়েছে।
কাজ- দলগতঃ বাংলাদেশের পরিবার কাঠামোতে যে ধরনগুলো দেখা যায় তার একটি তালিকা তৈরি কর। একক ঃ তোমার এলাকায় বসবাসকারী বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী পরিবারের ধরন চিহ্নিত করে একটি ছক তৈরি কর। |
৪. বংশমর্যাদা এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে পরিবার : এ ভিত্তিতে পরিবার দুই ধরনের হয়ে থাকে, যেমন- পিতৃসূত্রীয় ও মাতৃসূত্রীয় পরিবার। পিতৃসূত্রীয় পরিবারের সন্তান-সন্ততি পিতার বংশমর্যাদার অধিকারী ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে থাকে। এ ধরনের পরিবার আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় রয়েছে। মাতৃসূত্রীয় পরিবার মায়ের দিক থেকে বংশমর্যাদা ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার অর্জন করে। খাসিয়া ও গারোদের মধ্যে মাতৃসূত্রীয় পরিবার ব্যবস্থা এখনও প্রচলিত।
৫. বিবাহোত্তর স্বামী-স্ত্রীর বসবাসের স্থানের ওপর ভিত্তি করে পরিবার : এ ভিত্তিতে পরিবার তিন ধরনের হয়, যেমন-পিতৃবাস, মাতৃবাস এবং নয়াবাস পরিবার। যে পরিবারে বিবাহের পর নবদম্পতি স্বামীর পিতৃগৃহে বসবাস করে তাকে পিতৃবাস পরিবার বলে। আমাদের সমাজে এ ধরনের পরিবার দেখা যায়। বিবাহের পর নবদম্পতি স্ত্রীর পিতৃগৃহে বসবাস করলে তাকে মাতৃবাস পরিবার বলে। গারোদের মধ্যে এ ধরনের পরিবার দেখা যায়। বিবাহিত দম্পতি স্বামী বা সূত্রী কারও পিতার বাড়িতে বাস না করে পৃথক বাড়িতে বাস করলে নয়াবাস পরিবার বলা হয়। শহরে চাকরিজীবীদের মধ্যে এধরনের পরিবার দেখা যায়।
৬. পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের ভিত্তিতে পরিবার : মুসলমান সমাজে গোত্রভিত্তিক বিবাহের প্রচলন না থাকলেও হিন্দু সমাজে তা লক্ষ করা যায়। হিন্দু সমাজে দু'ধরনের গোত্রভিত্তিক পরিবার, যথা- বহির্গোত্র বিবাহভিত্তিক পরিবার এবং অন্তর্গোত্র বিবাহভিত্তিক পরিবার বিদ্যমান রয়েছে। কোনো ব্যক্তি যখন নিজের গোত্রের বাইরে বিবাহ করে তখন তাকে বহির্গোত্র বিবাহভিত্তিক পরিবার বলে। এ ধরনের পরিবার আবার দু'ধরনের হয়। উচু বর্ণের পাত্রের সাথে নিচু বর্ণের পাত্রীর বিবাহের মাধ্যমে গঠিত পরিবারকে অনুলোম বিবাহভিত্তিক পরিবার বলে। আর নিচু বর্ণের পাত্রের সাথে উঁচু বর্ণের পাত্রীর বিবাহের মাধ্যমে গঠিত পরিবারকে বলে প্রতিলোম বিবাহভিত্তিক পরিবার। এ ধরনের বিবাহের মূল কারণ সামাজিক অজাচার রোধ করা। আবার যখন কোনো ব্যক্তি নিজ গোত্রের মধ্যে যখন বিবাহ করে তখন তাকে অন্তর্গোত্র বিবাহ ভিত্তিক পরিবার বলে। অন্তর্গোত্রভিত্তিক বিবাহ হিন্দু সমাজেই অধিক প্রচলিত। এ ধরনের বিবাহের পিছনে যুক্তি ছিল নিজ গোত্রের মধ্যে তথাকথিত রক্তের বন্ধন ও বিশুদ্ধতা রক্ষা করা। বর্তমানে এ ধরনের পরিবার গঠনে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। অধিকাংশ হিন্দু পরিবার এ বর্ণপ্রথাকে কুসংস্কার মনে করে।
পরিবারের সাধারণ কার্যাবলি
মানব সমাজে পরিবারের ভূমিকার পরিধি ব্যাপক এবং এর কার্যাবলি বহুমাত্রিক। সন্তান প্রজনন থেকে শুরু করে লালন- পালন এবং তার সুষ্ঠু বিকাশে পরিবারের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পৃথিবীর সকল দেশের পরিবার কাঠামোতেই এ ধরনের ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। সামাজিক পরিবর্তনের সাথে পরিবারের ভূমিকারও পরিবর্তন ঘটছে। তবে পরিবারের কতকগুলো মূল কাজ রয়েছে, যা বিশ্বের সব সমাজের পরিবার পালন করে থাকে। নিচে পরিবারের সাধারণ কতকগুলো কাজ আলোচনা করা হলো।
জৈবিক চাহিদা পূরণ
সমাজ স্বীকৃতভাবে জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য মানুষ পরিবার গঠন করে। বিবাহের মাধ্যমে পরিবার নর-নারীর জৈবিক চাহিদা পূরণ করে। পরিবার গঠনের মূল উদ্দেশ্য সন্তান প্রজনন এবং লালন-পালন করা। সন্তানের সুষ্ঠু লালন-পালন সন্তান প্রজননের আনুষঙ্গিক কাজ। সন্তান যতদিন না স্বাবলম্বী হয়, ততদিন পরিবারের এই দায়িত্ব থাকে। এক্ষেত্রে পরিবারের আয়ের ওপর সন্তানের সুষ্ঠু লালন-পালন নির্ভর করে।
সন্তানের ভরণ-পোষণ
সন্তানের ভরণ-পোষণের সাথে তার সামাজিকীকরণের প্রাথমিক দায়িত্ব পিতা-মাতা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যের। এ সময় থেকেই শিশু অপরের দৃষ্টিতে নিজেকে দেখতে শেখে। পারিবারিক মূল্যবোধ শেখে। পছন্দ-অপছন্দ বলতে পারে। পরিবারের বাইরের লোকের সাথে পরিচয় হয় এবং খাপ খাওয়ানোর দক্ষতা অর্জন করে। শিশুকাল থেকে শিশু সমাজের রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার, নিয়ম-কানুন, অভ্যাস প্রভৃতি পরিবার থেকে শিক্ষালাভ করে। পারিবারিক সুন্দর পরিবেশেই শিশুর মধ্যে প্রত্যাশিত আচরণ তৈরি হয়। পরিবার শিশুর দৈহিক প্রয়োজনের প্রতিই যে শুধু দৃষ্টি রাখে তা নয় বরং তার মানসিক নিরাপত্তা এবং স্নেহ-ভালোবাসার দাবিও পূরণ করে। মানসিক নিরাপত্তাবোধ ব্যতিরেকে শিশুর মনে হতাশা, হীনমন্যতা ও আশংকা সৃষ্টি হতে পারে। এ সম্পর্কে আমরা পরবর্তী পরিচ্ছেদে বিস্তারিত অবগত হব।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড
পরিবার ছিল একসময়ের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের মূল কেন্দ্রস্থল। তখন পরিবারের যাবতীয় প্রয়োজনীয় বস্তুগুলো গৃহেই উৎপাদন হতো। একসময়ে গ্রামীণ যৌথ পরিবারের মধ্যেই এসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পাদিত হতো। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবারের অর্থনৈতিক কাজগুলো মিল, কারখানা, দোকান, বাজার, ব্যাংক এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পাদিত হচ্ছে। এখন পরিবারের সদস্যরা অর্থ উপার্জনের জন্য ঘরের বাইরে কাজ করে। এজন্য পরিবারকে আয়ের একক বলা হয়। তাছাড়া আমাদের দেশে গ্রামীণ কৃষি পরিবার কৃষি-অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। শুধু তা-ই নয়,পরিবারকে কেন্দ্র করে এদেশের কুটির শিল্প গড়ে উঠেছে, যা আমাদের দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ।
শিক্ষাদান
পরিবার শিশুর অন্যতম উল্লেখযোগ্য শিক্ষাকেন্দ্র। জন্মের পর শিশু গৃহেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। মাতাই শিশুর জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। যদিও বর্তমানে শিক্ষা দেওয়ার যাবতীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তবুও আচার- ব্যবহার, নিয়মানুবর্তিতা, নৈতিকতা, ধর্মীয় বিধি-বিধান, আচার-আচরণ সম্পর্কিত বিষয়গুলোর শিক্ষা শিশু পরিবার থেকেই গ্রহণ করে।
স্বাস্থ্যসেবা প্রদান
স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সব দায়-দায়িত্ব পালনে পরিবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। একসময়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও নিয়ন্ত্রণ পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আধুনিককালে এ দায়িত্ব হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিক প্রদান করে থাকে।
বিনোদনের ব্যবস্থা
অতীতে পরিবারের সদস্যদের অবসর, বিনোদন ব্যবস্থা পরিবারের মধ্যেই সম্পন্ন হতো। বর্তমানে যদিও বিনোদন ব্যবস্থায় নানা প্রযুক্তি, যান্ত্রিকতা এসেছে তথাপি মানসিক আনন্দের জন্য আজও পরিবারকেই সবচেয়ে বড় বিনোদন কেন্দ্র ধরা হয়ে থাকে। পারিবারিক আড্ডা একটি অকৃত্রিম বিনোদন ব্যবস্থা, যা পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে ঐক্য বজায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কাজ-দলগত : ব্যক্তির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক জীবন গঠনে পরিবারের ভূমিকার একটি তালিকা তৈরি কর। |
সম্পদ-সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংরক্ষণ পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রথা প্রায় সকল সমাজ ব্যবস্থায় রয়েছে। বিষয় সম্পত্তি, জমিজমা থেকে শুরু করে সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয়। আর যেহেতু এই প্রজন্ম সৃষ্টির মূলে থাকে পরিবার, তাই সম্পত্তির সংরক্ষণ ও উত্তরাধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, পরিবারের মাধ্যমে শিশু ভবিষ্যৎ পিতা এবং মাতার যাবতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্যের গুণাবলি অর্জন করে। একই সাথে ভালোমন্দ বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা লাভ করে। পরিবারের কারণেই আমাদের এই সুন্দর সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে গ্রাম ও শহরের পরিবারের ভূমিকা
বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরে পরিবারের ধরন ও ভূমিকায় পার্থক্য রয়েছে। একসময়ে গ্রামীণ সমাজে যৌথ পরিবারের সংখ্যাই বেশি ছিল। কিন্তু বর্তমানে শিল্পায়ন, নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দরিদ্রতা, ভোগবাদী মানসিকতাসহ নানা কারণে যৌথ পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার ক্ষুদ্র ঋণদান কর্মসূচির বিভিন্ন সুবিধা গ্রহণও পরিবারের এ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে গ্রাম ও শহরে একক পরিবারের সংখ্যাই বেশি। গ্রামে বর্ধিত পরিবার দেখা গেলেও শহরে এ ধরনের পরিবার নেই বললেই চলে। পিতৃপ্রধান ও পিতৃবাস পরিবার ব্যবস্থা শহর, গ্রামে উভয় স্থানেই দেখা যায়। তবে নয়াবাস পরিবার শহরে সর্বাধিক। একসময়ে এদেশের মুসলিম সমাজে বহুপত্নী পরিবারের সংখ্যা ছিল অধিক। এখন এ ধরনের পরিবারের সংখ্যা কমে গিয়েছে। গ্রাম ও শহর উভয়েই এখন একপত্নী পরিবারের সংখ্যাই বেশি। আমাদের দেশের গ্রামীণ ও শহুরে সমাজে পরিবারের ধরনের পরিবর্তনের সাথে সাথে এর ভূমিকারও পরিবর্তন ঘটেছে, যেমন-আমাদের দেশের শহরাঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় গ্রামের সাধারণ নারী-পুরুষ কৃষি পেশা ছেড়ে শিল্প শ্রমিকে পরিণত হয়েছে। পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তি শহরে চলে যাওয়ায় পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা আর্থিক নিরাপত্তাহীনতাসহ নানা সমস্যায় পতিত হচ্ছে।
কাজ-একক: তোমার নিজ এলাকায় পরিবারের ভূমিকার পরিবর্তনের কারণ এবং এর ফলে সৃষ্ট সমস্যার একটি তালিকা তৈরি কর। দলগত:শিক্ষা, বিবাহ, চিকিৎসা ও পরিবারের সদস্যদের অধিকারের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকায় পরিবর্তনের প্রভাব চিহ্নিত কর। |
গ্রাম প্রধান আমাদের এদেশে এক সময়ে যৌথ কিংবা বর্ধিত পরিবারেই শিশু বড় হতো। তখন অল্প বয়স থেকেই পারিবারিক পেশার সাথে এসব শিশু অড়িত হতো। পরিবার এক্ষেত্রে শিশুর পেশা বেছে নেওরার ভূমিকা রাখত। পরিবারের এ ভূমিকার পরিবর্তন হয়েছে। গ্রাম বা শহর সবখানেই শিশুর সুন্দর জীবন গঠন ও ভাে অধিকার বিবরে পিতা-মাতা এখন অনেক সচেতন। শিশুশ্রম যে নিষিদ্ধ একথা অনেক অভিভাবকই জানেন।
পরিবার শিশুর আনুষ্ঠানিক এবং নৈতিক শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষালয়। শিশুর নৈতিক শিক্ষার জন্য পিতামাতাকেই অধিক সচেতন হতে হয়। নৈতিকতার বীজ পারিবারিক মূল্যবোধ থেকেই শিশুর আচরণে বিকশিত হয়। আবার পিতা-মাতার মাধ্যমেই শিশু শিক্ষা জগতে প্রবেশ করে থাকে। কিন্তু শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবারের এ ভূমিকা বর্তমানে প্রাক প্রাথমিক কিল্ডারগার্টেন কিংবা নার্সারি স্কুলগুলো গ্রহণ করছে। শহরে এ সুযোগ তুলনামূলকভাবে বেশি।
সন্তান জন্মদান এবং প্রজননের ক্ষেত্রে গ্রামের চেরে শহরের পিতা-মাতা অধিক সচেতন। শহরের পিতা-মাতা দুইয়ের অধিক সন্তান নিতে চান না। পর্ববর্তী মাকে সন্তান প্রসবে অদক্ষ দাইরের পরিবর্তে হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে প্রেরণের ওপর গুরুত্ব দেন। পরিবারের ভূমিকার এ চিত্র গ্রাম ও শহরভেদে প্রায় একই। চিকিৎসা ক্ষেত্রে একসময় গ্রামের পরিবারগুলো কবিরাজ কিংবা হোমিও চিকিৎসকের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন এসব পরিবার সরকারি হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকের চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করছে। চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে শহরের সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে আমরা প্রায় সকলেই জানি।
পরিবারই ছিল একসময়ে ধর্ম শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সম্পর্কে পিতা-মাতা, দাদা-দাদি ও অন্যান্য সদস্য বিভিন্নভাবে শিশুকে অবহিত করেন।
একসময়ে আমাদের দেশে গায়োজিত বিবাহ (settled or arranged marriage) প্রার প্রচলন ছিল। বিয়ের ক্ষেত্রে অভিভাবকের মতের প্রাধান্য দেওয়া হতো। বর্তমানে এ প্রথার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। বিবাহ অনুষ্ঠানেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। বিবাহের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকার এ পরিবর্তন গ্রাম ও শহরভেদে পার্থক্য বিদ্যমান। বাল্যবিবাহ ও যৌতুক গ্রহণকে ঘৃণ্য প্রথা হিসেবে জানা সত্ত্বেও গ্রাম ও শহরে এ প্রথার প্রচলন এখনও লক্ষ করা যায়। তবে গ্রাম ও শহরের সচেতন পরিবারগুলো এখন বাল্যবিবাহ ও যৌতুক প্রথাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতে শিখেছে। এ সঙ্ক্রান্ত আইন সম্পর্কেও সচেতন হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে গ্রামীণ ও শহর উত্তরেরই পরিবার কাঠামোতে নারী অধিকারের প্রতি পুরুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পেরেছে। নারীরাs wi fre অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনেক সচেতন। বর্তমানে গ্রাম ও শহরে নয়াবাস পরিবার বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবারের মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব পরিবারে বৃদ্ধ পিতা-মাতা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে
একসময় আমাদের দেশে গ্রাম কিংবা শহরে জন্মালেকারী বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু, যেমন- বৃদ্ধি প্রতিবন্ধী, প্রবণ প্রতিবন্ধী, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, শারীরিক প্রতিবন্ধী, বহুমুখী প্রতিকর্মী এবং অটিস্টিক শিশুদের পরিবারের বোঝা ভাবা হতো। বর্তমানে পরিবারের এ মনোভাবে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। উপরের চিত্রটির দিকে লক্ষ কর, এসব শিশুর জন্য গড়ে ওঠা বিদ্যালয়ে তারা পড়ালেখা করছে এবং বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে তারা গান, নাচ ও খেলাধুলা করছে। আবার কোনো কোনো শিশু কারিগরি বিদ্যা ও হাতের কাজে পারদর্শিতা অর্জন করছে। যার কারণে আমাদের দেশের অটিস্টিক শিশুরা আজ শিশু অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে শারীরিক ও মানসিক যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে সক্ষম হয়েছে। এসব শিশুর অধিকার বিষয়ে পরিবারের সদস্যগণ অধিক সচেতন। আমরাও বিশেষ চাহিদার ধরন ও মাত্রার ওপর নির্ভর করে বিদ্যালয়, পারিবারিক এবং সামাজিক পরিবেশ পরিবর্তন ও উপযোগী করে তুলব। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু যাতে যথাসম্ভব স্বাধীন ও নিরাপদভাবে নিজের কাজ নিজে করার সুযোগ পায় এমন পরিবেশের ব্যবস্থা করব।
আরও দেখুন...