যা স্বাভাবিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে তা প্রকৃতি। ঈশ্বর প্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন। মানুষ প্রকৃতি সৃষ্টি করতে পারে না। প্রকৃতি পৃথিবীর স্বাভাবিক রূপ।
প্রকৃতিতে মানুষসহ যাদের জীবন আছে তারা জীব। অন্যরা জড়। প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে আমরা বেঁচে থাকি। আমরা বাতাসের সাহায্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নিই। নদী থেকে জল পাই। মাটিতে ফসল হয়। সে ফসল থেকে আমাদের খাবার তৈরি হয়।
গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়। সেই অক্সিজেন আমরা গ্রহণ করি। গাছের কাঠ দিয়ে আমরা ঘরবাড়ি নির্মাণ করি। সেখানে আমরা বসবাস করি। আমরা যে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ফলমূল খাই- সবই জীবের কাছ থেকে পাওয়া।
জড় বস্তুর কাছ থেকেও আমরা উপকার পাই। পাহাড়-পর্বত থেকে পাথর পাই। পাথর নানা কাজে লাগে। পর্বতের উপর বরফ জমে। বরফ গলে জল হয়। আকাশের সূর্য থেকে আমরা আলো পাই। এই আলোতে অন্ধকার দূর হয়। সূর্যের আলোতে গাছপালা জীবন পায়। ফলে প্রকৃতিকে জীবজগৎ থেকে পৃথক করা যায় না। হিন্দুধর্মমতে প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অভিন্ন। প্রকৃতিকে রক্ষা করা আমাদের ধর্মের অঙ্গ। এ কারণে প্রকৃতিকে আমরা নানাভাবে শ্রদ্ধা করি, স্তুতি করি। আমাদের প্রতিটি পূজাতে প্রাকৃতিক নানা উপকরণের প্রয়োজন হয়।
সরস্বতীপূজার উপচারগুলো একবার দেখা যাক। পলাশসহ নানারকম ফুল, আমের পল্লব, বেলপাতা, যবের শীষ ইত্যাদি। অন্যান্য পূজাতেও বিভিন্ন ফুল-ফল-পাতা-কাণ্ড ও শস্য লাগে। এসব কোনো না কোনো বিশেষ গুণসম্পন্ন। আবার কিছু কিছু পূজায় গাছ লাগে। যেমন কলা, তুলসী, বেল, বট ইত্যাদি। অর্থাৎ পূজা-অর্চনার জন্য আমাদেরকে গাছের কাছে যেতে হয়। তাই বিভিন্ন উপকারী গাছ বাঁচিয়ে রাখতে হয়।
আমাদের সকল দেবতার নির্দিষ্ট বাহন আছে। সেসব বাহন কোনো না কোনো প্রাণী। যেমন কার্তিকের ময়ূর, গণেশের ইঁদুর, সরস্বতীর রাজহাঁস। এসব প্রাণী আমাদের কাছে অনেক শ্রদ্ধার। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ বিভিন্ন প্রাণীর ওপরেও নির্ভর করে। প্রত্যেক জীবের মধ্যে ঈশ্বর বিরাজ করেন। তাই জীবহত্যা মহাপাপ। অকারণে আমরা জীবহত্যা করব না।
ধান, গম, ডাল এসব ফসল। ফসল থেকে মানুষের খাবার তৈরি হয়।
ইঁদুর ফসল নষ্ট করে। চড়ুই পাখিও ফসল নষ্ট করে। একবার চীন দেশে এসব প্রাণীকে হত্যার অভিযান শুরু হয়। তারা ভেবেছিল এতে ফসলের উৎপাদন বাড়বে। কিন্তু পরের বছর থেকে ফসল উৎপাদন কমতে শুরু করে। পরে তারা বুঝতে পারে যেসব প্রাণীকে ক্ষতিকর মনে হয়, কিন্তু তারা ক্ষতিকর নয়। প্রকৃতিতে তাদেরও অবদান আছে। চড়ুই পাখি কীটপতঙ্গ খায়। ইঁদুর মাটির উর্বরতা বাড়ায়।
আমাদের ধর্মে সকল প্রাণীর প্রতি সম্মান দেখানো হয়েছে। দেবী মনসার সঙ্গে সাপকেও আমরা শ্রদ্ধা করি। কারণ সাপ আমাদের উপকার করে। সাপ ইঁদুর খায়।
প্রকৃতিতে প্রতিটি সৃষ্টির প্রয়োজন আছে। নইলে ঈশ্বর তা সৃষ্টি করতেন না। একটু চারদিকের জীবদের দিকে তাকিয়ে দেখো। দেখবে প্রত্যেকটি জীব আমাদের কোনো না কোনো উপকারে আসে। একটি জীব আর একটি জীবের ওপর নির্ভরশীল। কোনো একটি জীব বিলুপ্ত হলে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়।
ঘর-বাড়ি তৈরির জন্য জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে। বন কাটা হচ্ছে। কৃষি কাজের জন্যও বন উজাড় হচ্ছে। এতে পশু-পাখির বাসস্থান কমে যাচ্ছে। অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে প্রকৃতি বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে।
বন-জঙ্গল কেটে ফেললে বৃষ্টিপাত কমে যায়। ভূমিক্ষয় হয়। সবুজ প্রান্তর পরিণত হয় মরুভূমিতে। গাছের অভাবে দিন দিন পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। এজন্য বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েই চলছে। এতে আমাদের খাদ্য, বাসস্থানের সংকট দেখা দিচ্ছে। তাই প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করতে পারলে আমাদের অস্তিত্ব সুরক্ষিত হবে।