ফটোইলেক্ট্রিক ক্রিয়া বা আলোক তড়িৎ ক্রিয়া

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - পদার্থবিদ্যা - পদার্থবিজ্ঞান – ২য় পত্র | | NCTB BOOK
146
146

     আলোক রশ্মি যখন কোনো ধাতবপৃষ্ঠে আপতিত হয় তখন ধাতবপৃষ্ঠের ইলেকট্রন আলোক রশ্মি থেকে শক্তি গ্রহণ করে। যখনই ইলেকট্রন দ্বারা গৃহীত শক্তি ধাতবপৃষ্ঠে তার বন্ধন শক্তির চেয়ে বেশি হয়, তখনই ইলেকট্রন ধাতবপৃষ্ঠ থেকে মুক্ত হয় বা বেরিয়ে আসে। এ ঘটনাকে ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়া বা আলোক তড়িৎ ক্রিয়া বলা হয়। ইলেকট্রন নিঃসরণের জন্য ধাতবপৃষ্ঠে যথোপযুক্ত কম্পাঙ্কের আলো ফেলতে হয় তা না হলে ইলেকট্রন নিঃসরণ হয় না । যথোপযুক্ত উচ্চ কম্পাঙ্কবিশিষ্ট আলোক রশ্মি কোনো ধাতবপৃষ্ঠে আপতিত হলে তা থেকে ইলেকট্রন নিঃসৃত হয়, এ ঘটনাই ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়া বা আলোক তড়িৎ ক্রিয়া নামে পরিচিত। ধাতবপৃষ্ঠ থেকে নিঃসৃত ইলেকট্রনকে ফটোইলেকট্রন বলা হয় ।

কর্মকাণ্ড : ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়া প্রদর্শনের একটি পরীক্ষা বর্ণনা কর । পরীক্ষা : ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক পর্যালোচনার জন্য যে পরীক্ষা করা হয় তা নিচে বর্ণনা করা হলো। [চিত্র ৮.৯]। চিত্রে কোয়ার্টজ নির্মিত বায়ুশূন্য নলে দুটি ধাতবপাত A ও C আছে। পাত দুটিকে বাইরের একটি | বর্তনীর সাহায্যে একটি ব্যাটারি B, রোধ R ও মিলিঅ্যামিটার mA-এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। পাত দুটির বিভব | পার্থক্য মাপার জন্য বর্তনীতে একটি ভোল্টমিটার V সংযুক্ত আছে। A পাতটি ব্যাটারির ঋণাত্মক প্রান্তের সাথে সংযুক্ত। এখন আলোক রশ্মি A-এর উপর আপতিত হলে A ও C এর মধ্যে তড়িৎ প্রবাহের সূচনা হবে মিলিঅ্যামিটার | দিয়ে যা পরিমাপ করা যাবে। 

চিত্র ৮.৯ : ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়া।

এখন পাত দুটির মধ্যে বিভব পার্থক্য ক্রমশ বাড়াতে থাকলে তড়িৎ প্রবাহও বাড়তে থাকবে। কিন্তু বিভব পার্থক্যের একটা নির্দিষ্ট মানের জন্য এই প্রবাহ আর বাড়বে না। একটা নির্দিষ্ট সর্বোচ্চ মানে এসে স্থির হয়ে যাবে। কোনো নির্দিষ্ট বিভব পার্থক্যের জন্য তড়িৎ প্রবাহের এই নির্দিষ্ট সর্বোচ্চ মানকে 'সম্পৃক্তি প্রবাহ' (saturation current) | বলে। কিন্তু যদি পাত A-কে সামান্য ধনাত্মক বিভবে এবং C-কে ঋণাত্মক বিভবে রেখে A পাতের উপর একটা নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের আলো আপতিত হতে দেওয়া হয় তাহলে নির্গত ইলেকট্রনের মধ্যে ধীর গতিসম্পন্নগুলো C-তে না পৌঁছে পুনরায় A-তে ফিরে আসে। A ও C এর মধ্যে বিভব পার্থক্য ক্রমশ বৃদ্ধি করতে থাকলে আলোক তড়িৎপ্রবাহ ক্রমশ কমতে থাকবে এবং এক | সময় A-এর কোনো নির্দিষ্ট ধনাত্মক বিভবের জন্য তড়িৎ প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে। কোনো একটা নির্দিষ্ট ধাতব পদার্থের জন্য A-এর এই ধনাত্মক বিভবকে প্রতিরোধক বিভব বা নিবৃত্তি বিভব (stopping potential) বলে। এই নিবৃত্তি বিভবে সবচেয়ে শক্তিশালী | ইলেকট্রনগুলোও A-তে ফিরে আসে। এই সময় আলোর তীব্রতা বৃদ্ধি করলেও কোনো ইলেকট্রন C-তে পৌঁছতে পারে না। এই বিভব পার্থক্যকে ইলেকট্রনের আধান দ্বারা গুণ করলে ইলেকট্রনের সর্বাধিক গতিশক্তি পাওয়া যায়। অর্থাৎ

   Kmax= eVo

বা, 12mvm2= eVo

এখানে, m = ইলেকট্রনের ভর

Vm = ইলেকট্রনের সর্বাধিক বেগ

e = ইলেকট্রনের আধান

এবং Vo = নিবৃত্তি বিভব

     পুনরায় যদি A-কে ঋণাত্মক ও C-কে ধনাত্মক করে আলোর কম্পাঙ্ক অপরিবর্তিত রেখে তীব্রতা ক্রমশ বাড়ানো | হয় তাহলে দেখা যাবে যে নিবৃত্তি বিভবের মান সব সময় একই থাকছে কিন্তু তড়িৎ প্রবাহের মান বৃদ্ধি পাবে।

    আবার আলোর তীব্রতা একই রেখে কম্পাঙ্ক পরিবর্তন করলে দেখা যাবে যে, কম্পাঙ্ক যতই বাড়ানো হয়, নিবৃত্তি | বিভব ততই বেড়ে যায় কিন্তু তড়িৎপ্রবাহের কোনো পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ কম্পাঙ্ক বৃদ্ধির সাথে সাথে ফটো | ইলেকট্রনের সর্বোচ্চ গতিশক্তি বৃদ্ধি পায়। আবার কম্পাঙ্ক হ্রাস করলে দেখা যায় যে, কোনো একটি নিম্নতম কম্পাঙ্কে | ঐ ধাতু থেকে কোনো ইলেকট্রন নিঃসৃত হয় না। উক্ত ন্যূনতম কম্পাঙ্ককে ঐ ধাতুর ছেদন কম্পাঙ্ক বা সূচন কম্পাঙ্ক fo বলে।

   ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য

   ১। ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়া একটি তাৎক্ষণিক ঘটনা । ধাতবপৃষ্ঠে আলো আপতিত হওয়া এবং তা থেকে ইলেকট্রন নিঃসরণের মধ্যে কোনো কাল বিলম্বন (time lag) নেই। আলোর তীব্রতা যত কমই হোক না কেন যথোপযুক্ত কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট আলোক রশ্মি ধাতবপৃষ্ঠে আপতিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃষ্ঠ থেকে ইলেকট্রন নিঃসৃত হয় এবং আলো বন্ধ হওয়া মাত্র ইলেকট্রন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়।

   ২। ফটোইলেকট্রনের গতিশক্তি আপতিত আলোর কম্পাঙ্কের ওপর নির্ভরশীল কিন্তু আলোর তীব্রতার ওপর নির্ভরশীল নয়।

   ৩। যে কোনো নির্দিষ্ট কম্পাঙ্ক এবং মন্দনক বিভব পার্থক্যের জন্য ফটোপ্রবাহ I (Photo current) আপতিত আলোর তীব্রতার সমানুপাতিক অর্থাৎ আলোর তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে ফটোপ্রবাহ বৃদ্ধি পায় এবং আলোর তীব্রতা হ্রাস পেলে ফটোপ্রবাহ হ্রাস পায়।

   ৪। প্রতি ধাতুর বেলায় একটি নিম্নতম কম্পাঙ্ক আছে, আপতিত আলোর তীব্রতা যাই হোক না কেন তার কম্পাঙ্ক এই নিম্নতম কম্পাঙ্ক থেকে বেশি না হলে ঐ ধাতু থেকে ইলেকট্রন নিঃসৃত হয় না। এটাকে ধাতুর সূচন কম্পাঙ্ক fo বলে।

ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়া ব্যাখ্যায় চিরায়ত তরঙ্গ তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা

     ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়ার পরীক্ষালব্ধ ফলগুলোকে আমরা এখানে চিরায়ত তরঙ্গ তত্ত্ব অনুসারে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করব।

    ১। চিরায়ত তরঙ্গ তত্ত্ব অনুসারে কোনো ধাতবপৃষ্ঠে আলোর পতন ও তা থেকে ইলেকট্রন নিঃসরণের জন্য সময়ের প্রয়োজন, এ সময় কয়েকদিন পর্যন্ত হতে পারে। কেননা, ধাতবপৃষ্ঠে যে আলো শক্তি আপতিত হয়, পৃষ্ঠের ইলেকট্রনগুলো সেই শক্তি শোষণ করে উত্তেজিত হয়। যখন ইলেকট্রনগুলো শক্তি শোষণ করে তাদের বন্ধশক্তি বা তার চেয়ে বেশি শক্তি অর্জন করে তখনই ধাতব পৃষ্ঠ থেকে মুক্ত হয়। আর তার জন্য যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু উপরিউক্ত সমীকরণকে ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়া সম্পর্কিত আইনস্টাইনের সমীকরণ বলা হয়। কোনো ধাতবপৃষ্ঠ থেকে নিঃসরণের জন্য ইলেকট্রনের একটি ন্যূনতম শক্তি প্রয়োজন, তা না হলে আলোর অনুপস্থিতিতে ইলেকট্রন ধাতবপৃষ্ঠ থেকে বেরিয়ে পড়ত। ন্যূনতম শক্তি hfo কে ধাতবপৃষ্ঠের কার্যাপেক্ষক (work function) বলা হয়। এটা ধাতব পৃষ্ঠের ওপর নির্ভরশীল। কার্যাপেক্ষককে সাধারণত ইলেকট্রন ভোল্ট এককে প্রকাশ করা হয়।

    সুতরাং (8:43) নং সমীকরণকে লেখা যায়, 

কোয়ান্টামশক্তি = ইলেকট্রনের সর্বাধিক শক্তি + পৃষ্ঠের কার্যাপেক্ষক

 hf= Kmaxφ…(8.44)

এখানে φ = hfo = কার্যাপেক্ষক

   এই সমীকরণের সাহায্যে নিম্নোক্তভাবে ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়া ব্যাখ্যা করা যায় :

     ১। কোয়ান্টাম তত্ত্বানুযায়ী একটি ফোটনের সাথে কেবলমাত্র একটি ইলেকট্রনেরই সংঘর্ষ হয় এবং ইলেকট্রন তার গৃহীত শক্তির ভাগ অন্যান্য ইলেকট্রনকে দেয় না। সুতরাং এই সংঘর্ষে শক্তি সংরক্ষিত থাকে এবং একে স্থিতিস্থাপক সংঘর্ষ বলে। স্থিতিস্থাপক সংঘর্ষে শক্তির তাৎক্ষণিক হস্তান্তর হয় বলে আলোক রশ্মির আপতন ও ইলেকট্রন নির্গমন এই দুইয়ের মাঝে কোনো কাল বিলম্বন (time lag) ঘটে না। সুতরাং ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়া একটি তাৎক্ষণিক ঘটনা।

    ২। কার্যাপেক্ষক φ = hfo যেহেতু একটি ধ্রুবরাশি সুতরাং hf = Kmax + p সমীকরণ থেকে দেখা যায় যে, Kmax = hf - φ । এ থেকে সহজে বোঝা যায় যে, ইলেকট্রনের গতিশক্তি আলোর কম্পাঙ্কের ওপর নির্ভরশীল । কম্পাঙ্ক f এর বৃদ্ধির সাথে গতিশক্তি বৃদ্ধি পায়।

    ৩। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী আলো যেহেতু পৃথক পৃথক কোয়ান্টামের সমষ্টি এবং f কম্পাঙ্কবিশিষ্ট আলোর জন্য প্রত্যেক ফোটনের শক্তি hf সেহেতু আলোর তীব্রতা বৃদ্ধির সাথে সাথে ফোটনের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং ফটোতড়িৎ প্রবাহ বাড়ে। কিন্তু আলোর কম্পাঙ্ক অপরিবর্তিত থাকায় ফোটনের শক্তি বৃদ্ধি পায় না এবং ইলেকট্রনের বেগ অপরিবর্তিত থাকে । সুতরাং কোয়ান্টাম তত্ত্ব পরীক্ষালব্ধ ফলের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।

   ৪। আলোর কম্পাঙ্ক f এর মান হ্রাস পেতে থাকলে ইলেকট্রনের বেগ হ্রাস পায় এবং একটি ন্যূনতম কম্পাঙ্ক fo এর জন্য বেগ শূন্য হয়ে যায়, ফলে কোনো ফটোইলেকট্রন নিঃসৃত হয় না। সুতরাং প্রত্যেক ধাতুর জন্য একটি সূচন কম্পাঙ্ক থাকে এবং তার মান, foφ / h.

Content added || updated By
Promotion