ফলের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। শুধু খাদ্য হিসেবে নয়। মানব দেহের পুষ্টি সাধনে, জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে, সামাজিক কর্মকাণ্ডে, চিকিৎসা শাস্ত্রে ইত্যাদিতে ফল বিভিন্নভাবে অবদান রাখছে । ফল চাষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নানান ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ।
বাংলাদেশের আবহাওয়া ও মাটিতে বর্তমানে প্রায় ৭০ ধরনের ফল উৎপাদন হয়ে থাকে । একটু যত্ন নিলে ও কিছু কিছু বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এগুলোর ফলন বাড়ানো সম্ভব । এছাড়া গবেষণার মাধ্যমে জাত নির্বাচন করে আরও কিছু নতুন নতুন ফল প্রবর্তন বা চালু করা যেতে পারে। যেমন- ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান চেরী, গেছো টমেটো, স্টার আপেল, নাশপাতি, পার্সিমন ইত্যাদি ।
মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও অন্যান্য দেশে বর্তমানে টাটকা ও প্রক্রিয়াজাত করা ফলের ভালো বাজার আছে। সুপরিকল্পিতভাবে এলাকা নির্ধারণ করে উৎপাদন কর্মসূচি গ্রহণ, আমদানি কারক দেশের সাথে অগ্রিম চুক্তি, সংরক্ষণ, উন্নত ও দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থার পদক্ষেপ নেওয়া হলে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অনায়াসে অর্জন করা সম্ভব । প্রতিবছর বিদেশ থেকে আপেল, আঙ্গুর, খেজুর, কমলালেবু ইত্যাদি ফল প্রচুর পরিমাণে আমদানি করা হয় । দেশে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা হলে আমদানির পরিমাণ কমে যাবে এবং এতে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা বেঁচে যাবে ।
জাতীয় অর্থনীতিতে ফলের অবদান
জাতীয় অর্থনীতিতে দানাজাতীয় শস্য তথা খাদ্য শস্যের অবদানের চেয়ে ফলজাতীয় শস্যের অবদান তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। ২০০৬-২০০৭ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ফলের আওতায় রয়েছে মোট চাষভুক্ত জমির শতকরা ০.৭৫ ভাগ। কিন্তু জাতীয় অর্থনীতিতে মোট ফসলভিত্তিক আয়ের আনুমানিক প্রায় শতকরা ১০ ভাগ আসে ফল হতে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও অন্যান্য ফসলের তুলনায় ফলজাতীয় ফসলের আয় তুলনামূলকভাবে বেশি। ফলের বাজারমূল্য সব সময় বেশি থাকে বিধায়, ফলের গড় আয় অন্যান্য ফসলের তুলনায় অনেক বেশি । আমাদের জিডিপিতে কৃষি সেক্টরের অবদান যেখানে শতকরা ৩৩ ভাগ সেখানে ফল ও ফলজাত দ্রব্যের অবদান প্রায় শতকরা ২.৩ ভাগ । পৃথিবীর অনেক দেশেই উপযুক্ত জলবায়ুর অভাবে ফল চাষ সম্ভব হয় না। সে সব দেশে ফল রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব । তাছাড়া বাংলাদেশে চাষাবাদ সম্ভব এমন ফল যেমন আঙ্গর, অ্যাভাক্যোডো, রামবুটান, কাজুবাদাম ইত্যাদি চাষ করে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচানো সম্ভব ।
কোন কোন ফল চাষে লাভ বেশি
বাংলাদেশে অনেক রকমের ফলের চাষ করা হয়। তবে যে সব ফল ব্যাপকভাবে বা ব্যবসায়িক ভিত্তিতে চাষ করা হয় সেগুলো হলো আম, লিচু, কাঁঠাল, কলা, আনারস, পেঁপে, পেয়ারা, নারিকেল, কুল, লেবুজাতীয় ফল, আমড়া ইত্যাদি । এদের মধ্যে কলা, পেঁপে, আনারস ইত্যাদি স্বল্প মেয়াদী অবৃক্ষজাতীয় ফল । কারণ খুব অল্প সময়েই অর্থাৎ গাছ লাগানার এক বা দুই বছরের মধ্যেই এগুলো ফল দিয়ে থাকে এবং এগুলো খুব দীর্ঘস্থায়ী বা দীর্ঘজীবী নয় । এদেশে মোট উৎপাদিত ফলের অর্ধেকের বেশি ফল স্বল্পমেয়াদি অবৃক্ষজাতীয় গাছ হতে উৎপন্ন হয় ।
আম, লিচু, কাঁঠাল, পেয়ারা, নারিকেল, কুল, লেবু, আমড়া, জাম, সফেদা ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি বৃক্ষজাতীয় ফল । এসব গাছ থেকে ফল পেতে ৪-৭ বছর সময় লেগে যায় ।
কলা, পেঁপে, আনারস উচ্চফলনশীল ফল হিসেবে সুপরিচিত । অন্যান্য অনেক ফল মাঠ ফসলের চেয়ে স্বল্প সময়ে, স্বল্প পরিসরে প্রতি হেক্টরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনেক বেশি পরিমাণ ফলন ও পুষ্টি উপাদান পাওয়া সম্ভব । এদের হেক্টর প্রতি ফলন ও বিক্রি মূল্য এবং নীট আয়ও অন্যান্য বৃক্ষজাতীয় ফলের তুলনায় বেশি ।
কলা, পেঁপে, আনারস
কলা, পেঁপে ও আনারস দ্রুতবর্ধনশীল ফল । কলা ও পেঁপে উৎপাদনে প্রায় এক বৎসর এবং আনারসের বেলায় প্রায় দুই বৎসর সময় লাগে । এখানে যে হিসাবটি উপস্থাপন করা হল, তাতে স্পষ্ট প্রতিয়মান হবে যে, এই সব ফলের উৎপাদন প্রকৃতই অন্যান্য বৃক্ষজাতীয় ফল ফসলের তুলনায় লাভজনক ।
সারণি- ১ কলা, পেঁপে ও আনারসের আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (শত টাকা, হেক্টরপ্রতি)সারণি- ১ কলা, পেঁপে ও আনারসের আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (শত টাকা, হেক্টরপ্রতি)সারণি- ১ কলা, পেঁপে ও আনারসের আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (শত টাকা, হেক্টরপ্রতি)সারণি- ১ কলা, পেঁপে ও আনারসের আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (শত টাকা, হেক্টরপ্রতি)সারণি- ১ কলা, পেঁপে ও আনারসের আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (শত টাকা, হেক্টরপ্রতি)সারণি- ১ কলা, পেঁপে ও আনারসের আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (শত টাকা, হেক্টরপ্রতি)সারণি- ১ কলা, পেঁপে ও আনারসের আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (শত টাকা, হেক্টরপ্রতি)সারণি- ১ কলা, পেঁপে ও আনারসের আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (শত টাকা, হেক্টরপ্রতি)সারণি- ১ কলা, পেঁপে ও আনারসের আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (শত টাকা, হেক্টরপ্রতি)
কলা উৎপাদনের ক্ষেত্রে সর্বাধিক ব্যয়, শ্রম, সার ও খুটি বাবদ। পেঁপের প্রধান ব্যয় শ্রম ও সারজনিত । আনারসের ক্ষেত্রে শ্রম, বীজ, চারা জমিজনিত ব্যয় সর্বাধিক ।
আম ও অন্যান্য বৃক্ষজাতীয় ফল
বাংলাদেশের প্রধান বৃক্ষ জাতীয় ফল আম ও অন্যান্যের আয়-ব্যয়ের হিসাব করতে এক বা দুই বৎসরের পরিবর্তে অন্তত ৮-১০ বৎসরের হিসাব ধরা আবশ্যক । আম গাছে বিক্রয় উপযোগী ফল ধরতে রোপণের পঞ্চম বর্ষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। অন্যান্য বহু ফলের বেলাও প্রথম কয়েক বৎসর যাবৎ কেবল বায়ের পালা । কিন্তু একবার ভালোভাবে ফল ধরা শুরু হলে ব্যয় অনুপাতে অনেক বেশী আয় হতে থাকে । এখানে তালিকায় আম উৎপাদনের একটি আনুপাতিক হিসাব দেয়া হলো। এটা হতে অন্যান্য বৃক্ষ জাতীয় ফলের আয়-ব্যয় হিসাব সম্বন্ধে বেশ কিছুটা ধারণা লাভ করা সম্ভব হবে ।
একদিকে ক্রম- বর্ধিষ্ণু ব্যয় ধরে অপরদিকে ক্রমবর্ধিত আয় ধরা হয়েছে । তাতে আমের বেলায় লাভ আসতে প্রায় নয় বৎসর লেগে যায় । এখানে প্রথমে গাছের পারস্পরিক দূরত্বের অর্ধেক তথা ২০ ফুট দূরত্বে ১২৫ টি গাছের সংকুলান দেখানো যাচ্ছে । পনেরো বিশ বছর পরে যখন গাছসমূহ একে অন্যের গায়ে চড়াও হয়ে যাবে, তখন একান্তর গাছসমূহ কেটে ফেলতে হবে । দশম বৎসরে মাত্র পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা ব্যয় করে প্রায় একলাখ দশ হাজার টাকা মুনাফা হবে । এরপর বৎসরের পর বৎসর ধরে এ আয় চলতে থাকবে । কেবল তাই নয়, এমন কি এ আয় বাড়বে, এরূপ আশা করা যেতে পারে । আমের এই উদাহরণটি মোটামুটি ভাবে লিচু, কাঁঠাল, লেবু, সফেদা, পেয়ারা ইত্যাদির বেলায়ও অনেকটা প্রযোজ্য ।
সারণি- ২ আম উৎপাদনের প্রথম ১০ বৎসরের আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (শতটাকা, হেক্টর)
বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষের কৌশল
বাংলাদেশের জলবায়ু, পৃথিবীর প্রায় সমস্ত গ্রীষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে উৎপাদিত ফল জন্মানোর উপযোগী । বর্তমানে অধিকাংশ ফলই সমভূমি এলাকায় জন্মে । বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে বিস্তীর্ণ এলাকায় সমতল ভূমি আছে। যেখানে বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষ করা অত্যন্ত সহজ। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর ও বৃহত্তর দিনাজপুর এলাকায় উঁচু টিলা ও পাহাড়ি জমিতেও বানিজ্যিক ভাবে বিভিন্ন প্রকার ফল চাষ করা যেতে পারে। এমনকি এ সমস্ত এলাকাতে আনারস, নারিকেল, পেয়ারা, , আক্তার, কাঁঠাল, লিচু, কামরাংগা ইত্যাদি ফল চাষের জোন হিসেবে গড়ে তালো সম্ভব । বর্তমানে দেখা যায় যে, এ সমস্ত এলাকার পাহাড়ি ও টিলা ভূমিগুলো প্রায়ই অনাবাদি ও পতিত থাকে ।
রাজশাহীর বিস্তীর্ণ পদ্মার চরাঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উন্নত জাতের কুল, স্ট্রবেরী ও আমের চাষ সম্প্রসারণ করা যায়। দক্ষিণ অঞ্চলের ভালো, পটুয়াখালী ও বরগুনার চরাঞ্চলে উন্নত জাতের তরমুজ ও কলার বাণিজ্যিকভাবে বাগান তৈরি করে ফল চাষ সম্প্রসারণ করা যায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে মাথা পিছু জমির পরিমাণ দিন দিন যার ফলে সব ধরনের আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। তাই শুধু ফল চাষের জন্য মাঠ আকারে বড় বড় বাগান তৈরি করে জমির পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয় । তবে অন্য ভাবে ফলের আওতায় জমির পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে। যেমন-অফিস-আদালত, রাস্তার পাশে, রেল লাইনের পাশে, জমির আইলে, বাড়ির আনাচে কানাচে পরিকল্পিতভাবে উন্নত জাতের ফল গাছ লাগিয়ে ফলের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব ।
এদেশে কিছু কিছু ফল আছে যা স্বল্প সময়ে এবং স্বল্প পরিসরে জন্মানো যায়। যেমন পেঁপে, তরমুজ, ফুটি বা বাংগি, কলা, আনারস ইত্যাদি । বীজ হতে চারা বা গাছ উৎপাদন করে ফল ধরার উপযোগী হতে অনেক সময় লাগে । তাই অনেক ফল আছে যেগুলো কলমের মাধ্যমে তৈরি করে স্বাভাবিক সময়ের চাইতে কম সময়ে ফল উৎপাদন করা সম্ভব । যেমন- কুল, লেবু, পেয়ারা, লিচু, আম, জামরুল ইত্যাদি ।
কোন কোন ফল রোপণের সময় হতে উৎপাদনে আসতে সময় বেশি লাগে। তবে এ সময়কালের মধ্যে জমির সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করা যায় । যেমন- দীর্ঘমেয়াদি ফলের সাথে স্বল্পমেয়াদি ফল চাষ করা । এভাবে ফল চাষে মূলধন বেশি লাগে । কিনতু ফলের হেক্টর প্রতি ফলন ও বিক্রয় মূল্য বেশি পাওয়া যায় । ফল সহজে বাজার জাত করা যায় এবং সহজে খাওয়া যায় বলে এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি । আবার অনেক ফলের ভেষজ (ঔষধ) ব্যবহার আছে যেমন লেবু, আমলকি, হরিতকি, ডাব, পেঁপে, আনারস ইত্যাদি ।
এদেশে আগে লাকেজন সখের বসে যেমন ফল গাছের চারা রোপণ করেছেন তেমনি অনেকে গড়ে তুলেছেন বাণিজ্যিক ফল বাগান । এই সকল বাগানে দীর্ঘ মেয়াদি ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে বাগানের মধ্যে স্বল্প মেয়াদি ফল, শাকসবজি ও মসলাজাতীয় ফসল চাষ করা হয়। এর মাধ্যমে অনেকেই ফল চাষকে বাণিজ্যিক উৎপাদন কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড় থেকে দিঘিনালা পর্যন্ত অসংখ্য এক একর বা দুই একর বাগান যেমন হয়েছে, তেমনি সেখানে ২৫ একরের বেশি জায়গা নিয়েও বাণিজ্যিকভাবে ফলের বাগান গড়ে উঠেছে। অসংখ্য ফল বাগান আছে যা বানিজ্যিক ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এসব বাগানে লাগানো হয়েছে আম্রপালি জাতের আম, লিচু, জলপাই ইত্যাদি । অনেকে এর সাথে লেবুও লাগিয়েছেন। বছরে এসব বাগান থেকে ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকার আম বিক্রি হচ্ছে আবার অনেকে বাগানের মধ্যে হলুদের চাষ করেছেন। এসবের ফলে উক্ত এলাকার প্রান্তিক জনগাষ্ঠির জীবন । যাত্রার মানও উন্নত হয়েছে।
রাজশাহী বিভাগে প্রায় সবগুলো জেলায় ফলের বাগান গড়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ এলাকায় সাম্প্রসারিত হয়েছে কুলের বাগান । বাউ কুল, থাইকুল, আপেলকুল, তাইওয়ানসহ অসংখ্য ধরনের কুল চাষ হচ্ছে এ এলাকায় । উক্ত বিভাগে কেবল ২০০৮-২০০৯ সালেই ১২ থেকে ১৫ লাখ কুলের চারা লাগানো হয়েছে ।
চাপাইনবাবগঞ্জে আম বাগানের মধ্যে কুল বাগান করা হয়েছে । যেহেতু আম বাগানের মধ্যে অনেক জায়গা খালি থাকে সেখানে কুল চাষ করা সম্ভব । আবার কুল বাগানের মাঝে নানা রকম শাক-সবজি ও মসলার চাষ করা হয়েছে। এতে যেখানে কেবল আম ছাড়া কিছু হতোনা, সে জমিতে এখন একই সাথে আম, কুল এবং শাক-সবজি ও মসলার চাষ হচ্ছে। জমির এই বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করে প্রগতিশীল কৃষকরা ও বাগান মালিকরা লাভবান হচ্ছে ।
অন্যান্য শস্যের সাথে ফল চাষের লাভজনক অবস্থা
বাংলাদেশে কৃষি কার্যক্রম প্রধানত ধানভিত্তিক। ফল চাষের জন্য আমাদের জমির পরিমাণ অত্যন্ত কম । দানাজাতীয় ফসল যেমন- ধান, গম, সরিষা, ভুট্টা ইত্যাদির গড় ফলন হেক্টরে ৪ থেকে ৬ টন। অথচ অধিকাংশ ফল যেমন--কলা, পেঁপে, আনারস, তরমুজের গড় ফলন হেক্টর প্রতি ১৫ থেকে ৫০ বা ১০০ টন পর্যন্ত হতে পারে । ধান, গম, সরিষা, ভুট্টা অপেক্ষা ফলের মূল্য বেশি। বাজারের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকে বিধায় সব সময়ই ফলের দাম বেশি থাকে। তাই ফল চাষ করে কৃষকরা অন্যান্য ফসলের তুলনায় বেশি লাভবান হতে পারে । অনেক ফল আছে যেমন নারিকেল, সুপারি, পেঁপে, পেয়ারা ইত্যাদি বহুদিন ধরে আয় দিতে পারে । পরিকল্পিত ভাবে ফল চাষ করে ফলচাষী প্রতি মাসেই নগদ টাকা ঘরে আনতে পারেন এবং এ আয়ের পরিমাণ যেমন উল্লেখযোগ্য তেমনি তা কৃষকের দৈনন্দিন জীবন যাপনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে । বাড়ির আশে পাশে পতিত জায়গা বা প্রান্তিক জমিতে যেখানে মাঠ ফসল চাষ করা সম্ভব নয়; সেখানে পরিকল্পিতভাবে ফল চাষ করে অনেক টাকা আয় করা সম্ভব । রেল লাইন ও সড়কের ধারে, পুকুর, ডাবো ও খালের পাড়ে, ধর্মীয় উপাসনালয়ের আশে পাশে, অফিস আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশে পাশে, পাহাড়ের ঢালে, বিভিন্ন ধরনের বাধে, জমির আইলে অর্থাৎ বিভিন্ন পতিত স্থানে নারিকেল, সুপারি, খেজুর, তাল ইত্যাদি ফুল গাছ লাগিয়ে প্রচুর অর্থ আয় করা যায় । দানাজাতীয় ফসল যেমন- ধান, গম ইত্যাদি চাষ করে হেক্টর প্রতি ২৫০০/- থেকে ৩০,০০০/- আয় করা যায় । অন্যদিকে ফল চাষ করে হেক্টর প্রতি ২-২.৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করা যায় । এছাড়াও যফল বাগানের মধ্যে অন্যান্য ফসল যেমন আদা, হলুদ, মিষ্টি আলুর লতা ইত্যাদি চাষ করে আয়ের পরিমাণ আরো বাড়ানো সম্ভব । অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শস্য জাতীয় ফসল আবাদের চেয়ে ফল চাষ বেশি লাভজনক । যেমন- এক হেক্টর জমিতে কলা চাষ করে বছরে পঞ্চাশ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব । উন্নত জাতের কুলের একটি মাত্র গাছ হতে (৬ মিটার ঢ ৬ মিটার জমিতে বছরে ১০০০ টাকা পর্যন্ত কুল বিক্রি করা যায়। এক হেক্টর জমিতে পেঁপে চাষ করে বছরে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা উপার্জন করা সম্ভব । অনুরূপভাবে তরমুজ, পেয়ারা ইত্যাদি ফল চাষ করে অধিক আয় করা যেতে পারে। অথচ দানাজাতীয় শস্য চাষ করে এত বেশি লাভ করা সম্ভব নয় । (সারণি-৩)
বাংলাদেশের মত ঘন বসতিপূর্ণ দেশে গড় খামারের আকার অত্যন্ত ছোট । তাই একমাত্র ফুল চাষের মাধ্যমে অল্প জমি হতে অধিক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব । দানা শস্য বা অন্যান্য অনেক ফসল অপেক্ষা ফলের হেক্টর প্রতি ফলন বেশি এবং বাজার মূল্যও অনেক বেশি। সারণি: ৪ হতে দেখা যাচ্ছে যে, হেক্টর প্রতি দানা শস্য অপেক্ষা ফলের উৎপাদন অনেক বেশি ।
ফলের মধ্যে দ্রুত বর্ধনশীল ফল হলো কলা, পেঁপে, তরমুজ ও ফুটি। এদের ফলন তুলনামূলকভাবে অন্যান্য ফল অপেক্ষা আরো অনেক বেশি । দ্রুতবর্ধনশীল ফলের মধ্যে ৭০ ভাগই হচ্ছে কলা। ২০০৬-০৭ সালে মোট আবাদি জমি ১৯২৬৬ হে: এর মধ্যে প্রধান প্রধান ফল চাষের জমির পরিমাণ হচ্ছে ১৪৪২৬ হেক্টর এবং দানা শস্যের জমির পরিমাণ হচ্ছে ১১৪০৩.৫০ হেক্টর (সারণি-৫) এই তথ্য গুলো থেকে অনুমান করা যায় যে বাংলাদেশে ফল চাষের জমির পরিমাণ কম অথচ দানা শস্যের চাইতে হেক্টর প্রতি ফলন অনেক বেশি ।
তথ্য সারণি- ১ হতে দেখা যায় যে, মোট জমির মাত্র ০.৭৫ ভাগ জমিতে ফল চাষ হচ্ছে । এ থেকে আমরা দৈনিক মাথা পিছু ফল পাই মাত্র গড়ে ৩০-৬০ গ্রাম । যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম । কেননা খাদ্য বিজ্ঞানীদের মতে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের দৈনিক গড়ে অন্তত ১১৫ থেকে ১২০ গ্রাম ফল খাওয়া উচিত । যদিও উন্নত বিশ্বের লাকেজন গড়ে ২০০ গ্রামের ও বেশি ফল খায় । ফলের আওতায় জমি বৃদ্ধি এবং উন্নত জাতের আবাদ করে ইউনিট প্রতি উৎপাদন বৃদ্ধি করে ফলের চাহিদার এ ঘাটতি পূরণ করা যায় ।
সারণি- ৪ বাংলাদেশে বিভিন্ন ফলের তুলনামূলক ফলন
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও মাটিতে বর্তমানে কত ধরনের ফল উৎপাদন হয় ?
২ । বাংলাদেশের জিডিপিতে ফল ও ফলজাত দ্রব্যের অবদান কত ?
৩ । দ্রুত বর্ধনশীল ফলের মধ্যে কলার অবদান কত ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১ । কোন কোন ফল চাষে কৃষক সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারে তার একটি তালিকা তৈরি কর ।
২ । বাণিজ্যিক ভাবে ফল চাষের কৌশল বলতে কী বোঝায় ?
৩ । বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ফলের অর্থনৈতিক গুরুত্ব কেমন বর্ণনা কর ।
৪ । অর্থনৈতিক বিবেচনায় কোন কোন ফল বাংলাদেশে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ?
রচনামূলক প্রশ্ন
১ । বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষিতে কোন কোন ফল চাষ সবচেয়ে লাভজনক তার বিবরণ দাও ।
২ । বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষ বৃদ্ধির কৌশল ব্যাখ্যা কর ।
৩ । বাংলাদেশে উৎপাদিত অন্যান্য ফসলের সাথে ফল চাষের লাভজনক অবস্থা ছকের মাধ্যমে ব্যাখ্যা কর ।
আরও দেখুন...