জমিতে বা বাগানে চারা রোপণের পর হতে ফল সংগ্রহের পূর্ব পর্যন্ত গাছের যথাযথ বৃদ্ধি ও ফল ধারনের জন্য যে সমত পরিচর্যা এবং সেই সাথে স্থায়ী গাছের জন্য একবার ফল ধরা পর্যন্ত যে সমস্ত পরিচর্যা করা হয় সেগুলোকে অন্তবর্তীকালীন বা আন্তপরিচর্যা বলে ।
ফলচাষে অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যার ধাপ ফল বাগানে বিভিন্ন অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যার মধ্যে রয়েছে আন্তর্ষণ, আগাছা দমন, শূন্যস্থান পূরণ, মালচিং, পানিসেচ ও নিষ্কাশন, সার প্রয়োগ, মাচা দেয়া, অঙ্গা ছাঁটাই, সাথী ফসলের চাষ, ভূমিক্ষয় রোধ, পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন ইত্যাদি । নিম্নে বিভিন্ন ধরনের পরিচর্যার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো-
১) আকর্ষণ বা ইন্টার টিলেজ (Inter-tillage)
আগাছা দমন ও জমিতে রস সংরক্ষণের জন্য বর্ষার আগে এবং বর্ষার শেষে আচঁড়া বা কোদাল ইত্যাদির সাহায্যে ফল গাছের চারদিকে কুপিয়ে এ কাজ সম্পন্ন করা হয় । এতে করে মাটির অভ্যন্তরে অনায়াসে পানি ও বায়ু চলাচল করতে পারে। আকর্ষণের ফলে মাটিতে বসবাসকারী উপকারী জীব ও জীবাণুসমূহের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় ও গাছের খাদ্যোপাদান আহরণে সুবিধা হয় । যথারীতি/নিয়মিত আন্তকর্ষণ সম্পন্ন করলে মাটির স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় ও পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং ক্ষতিকর আগাছা থেকে জমি মুক্ত থাকে ।
২) শূন্যস্থান পূরণ
জমিতে চারা রোপণের পর অনেক সময় বিভিন্ন কারণে ফলগাছের চারা মারা যায় এবং শূন্য স্থানের সৃষ্টি করে । এতে একদিকে যেমন বাগানের সৌন্দর্য হানি হয় অন্যদিকে জমির অপচয় হয় এবং গাছের সংখ্যা কমে গিয়ে বাগানের ফলন কমে যায় । তাই যথাসম্ভব শূন্যস্থানে একই জাতের ও সমবয়সের চারা রোপণ করা উচিত ।
৩) মালচিং
মালচিং-এর বাংলা অর্থ আচ্ছাদন দেয়া। মাটির রস সংরক্ষণ এবং আগাছা দমনের জন্য মালচিং খুবই উপকারী । কচুরীপানা, করাতের গুড়া, চিটাধান, গাছের শুকনা পাতা, খড় ইত্যাদি মালচিং-এর জন্য ব্যবহৃত হয় ।
৪) পানি সেচ ও নিষ্কাশন
গাছের বৃদ্ধি ও ফল ধারনের জন্য পানি অত্যাবশ্যক। অগভীরমূলী ফলের বাগানে শুষ্ক মৌসুমে পানি সেচের ব্যবস্থা করা খুবই জরুরি। অনেক ফল গাছ আবার জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না । বর্ষাকালে আমাদের দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বিধায়, গাছের গোড়ায় যাতে পানি না জমে থাকে সেজন্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা খুবই জরুরি। ফল গাছের জন্য প্রয়োজনে সেচের ব্যবস্থা করা এবং জমে থাকা পানি সরানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন ।
৫) সার প্রয়োগ
বাগান হতে ভালো ফলন পেতে হলে ফল গাছে নিয়মিত সার প্রয়োগ দরকার । কিন্তু আমাদের দেশের কৃষকরা ফল বাগানে সার প্রয়োগে অনীহা প্রকাশ করে থাকেন । এ জন্য বাগানে ফলনও অনেক কম হয়ে থাকে । গাছের বয়স, আকার, মাটির উর্বরতা, উৎপাদন মৌসুম, গাছের প্রজাতি ইত্যাদির উপর সার প্রয়োগের পরিমাণ নির্ভর করে । ফল গাছে নির্ধারিত মাত্রায় দু'বার সার প্রয়োগ করতে হয় । গ্রীষ্মের শুরুতে এবং বর্ষার শেষে ফল গাছে সার প্রয়োগ করা আবশ্যক।
৬) বাউনি বা মাচা দেয়া
লতানো প্রকৃতির ফল যেমন - আঙ্গুর ও প্যাশন ফ্রুট গাছ ভালোভাবে বেড়ে উঠার জন্য বাঁশ, কঞ্চি, পাটকাঠি বা সম্ভব হলে তার দিয়ে মাচা করে দিতে হয়। সময়মত বাউনি না দিলে এসব গাছের বৃদ্ধি ঠিকমত হয় না বিধায় ফলনও কমে যায় ।
ফল বাগানে আগাছা দমনের উপকারিতা
কৃষি খামার স্থাপনের উদ্দেশ্য হলো অধিকতর উৎপাদান । কিছু রোগ ও কীটপতঙ্গের ন্যায় আগাছা ও উদ্যান মাঠ ফসলের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে উৎপাদন ব্যাহত করে। প্রাথমিকভাবে আগাছাজনিত কারণে ফসলের যে ক্ষতি হয় তা বোঝা না গেলেও সামগ্রিকভাবে কীটপতঙ্গ ও রোগজনিত কারণের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি এদের দ্বারা হয় । আসলে আগাছা ফসল উৎপাদনকারীদের জন্য অবাঞ্চিত বা অনাকাংক্ষিত গাছ। বাংলাদেশে আগাছার জন্য মাঠ ও উদ্যান ফসলের উৎপাদন ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কম হয় বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। অতএব, মাঠ ও উদ্যান ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে ক্ষতিকর আগাছা শনাক্ত করে তা সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস করতে হবে । আগাছা ফসলের মারাত্মক শত্রু । আগাছা জায়গা দখলসহ খাদ্য উপাদান, পানি, সূর্যরশ্মি এবং বাতাসের জন্য ফল গাছের সাথে প্রতিযোগিতা করে এবং রোগবালাই ও পোকা মাকড়ের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে । সুতরাং প্রথম হতে এদের শনাক্ত করে ধ্বংসের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। স্বল্প মেয়াদী ফলগাছের জন্য আগাছা দমন একটি অন্যতম করণীয় কাজ । দীর্ঘমেয়াদি ফলের ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় আগাছা দমনের প্রয়োজন হলেও পরবর্তীতে তা খুব দরকার হয় । কারণ আগাছা পরবর্তীতে দীর্ঘ মেয়াদী ফল গাছের সাথে পালা দিয়ে টিকে থাকতে পারে না ।
তবে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী ফল বাগানে প্রাথমিক অবস্থায় আগাছা দমন অতীব গুরুত্বপূর্ণ । কেননা গাছের বাড়ন্ত সময়ে আগাছা ফল গাছের জন্য প্রদত্ত সার ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান, সূর্য রশ্মি ও বাতাসের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় । এই সময় আগাছা দমনের ব্যবস্থা নিয়ে আন্ত চাষের মাধ্যমে আগাছাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে এগুলো পরবর্তীতে পঁচে জৈব পদার্থ হিসেবে মাটির সাথে মিশে মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি করে। আগাছা শুধুমাত্র ফসলের উৎপাদন বা ফলনহ কমায় না বরং ফসলের গুণাগুণও মারাত্মকভাবে হ্রাস করে ।
দীর্ঘ মেয়াদী বাগানের জন্য রোপণকৃত ফল গাছের প্রাথমিক দিকে আগাছা খাদ্যে ভাগ বসায় । এ জন্য গাছ রোপণের পরবর্তী পর্যায় থেকে শুরু করে প্রতি বছর বর্ষার প্রারম্ভে এবং বর্ষার শেষে ফল বাগানের আন্ত চাষের মাধ্যমে আগাছা দমনের ব্যবস্থা নিতে হয় । গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধি, বিকাশ ও মানসম্মত ফলনের জন্য ফল বাগানে গাছের গোড়া সব সময় আগাছা মুক্ত রাখা উচিত। চারার গাড়ার চারদিকে অন্তত এক মিটার পরিধির মধ্যে যেন কোন আগাছা না জন্মে সেদিকে খেয়াল রেখে নিয়মিত নিড়ানি দিতে হয় । মাটির মধ্যে বায়ু যেন ঠিকমত চলাচল করতে পারে এ জন্য ১২-১৫ সে:মি: গভীর করে চারধারের মাটি নিড়ানী দিয়ে আলগা রাখতে হয়। বছরে ২-৩ বার বয়স্ক বা ফলন্ত গাছের গোড়ার চারিদিক কয়েক মিটার পর্যন্ত (সাধারণত দুপুর বেলা যে পরিমাণ এলাকায় ছায়া পড়ে) ১২-১৫ সে:মি: গভীর করে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটি আলগা রাখা প্রয়োজন । খেয়াল রাখতে হবে মাটি কুপানারে সময় যেন গাছের শেকড় বেশি কাটা না পড়ে ।
ফল গাছে প্রনিং-এর প্রয়োজনীয়তা
ফল গাছে প্রনিং-এর প্রয়োজনীয়তা গাছের অপ্রয়োজনীয় কোন অংশকে কেটে সরানোকে সাধারণভাবে ছাঁটাইকরণ বা প্রুনিং বলা হয় । প্ৰধানত: দুটি উদ্দেশে গাছের অঙ্গ ছাঁটাই করা হয়। যথা— গাছের কাঠামো গঠন এবং ফুল ও ফলের সংখ্যা ও গুণগত মানের উন্নতি সাধন । বোঝার সুবিধার্থে গাছের কাঠামো গঠনের উদ্দেশে ছাঁটাইকরণকে ট্রেনিং (Training) নামে অভিহিত করা হয় । অপরপক্ষে ফুল ও ফলের গুণগত মানের জন্য ছাঁটাইকরণকে প্রনিং (Pruning) বলা হয়।
প্রুনিং-এর সময় (Time of pruning)
গাছের সুপ্তাবস্থা (dormant period) অঙ্গ ছাঁটাই-এর জন্য উপযুক্ত সময় । গাছ বৃদ্ধির সময় ছাঁটাই পরিহার করা উচিত । পত্রপতনশীল গাছের বেলায় পাতা পড়ে যাওয়ার পরই ছাঁটাই করা যেতে পারে । আবার কুঁড়ি বের হওয়ার অনেক আগেই ছাটাই-এর কাজ সারা চাই। বেল, আঙ্গুর, শরীফা, কামরাঙ্গা, আমড়া প্রভৃতি ফল গাছের জন্য শীতকাল ছাঁটাইয়ের উপযুক্ত সময় । চির সবুজ (evergreen) গাছের বেলায় ফল সংগ্রহের পর পরই ছাঁটাই করার উপযুক্ত সময় । কুল, কাঁঠাল, আম, লিচু, পেয়ারা, প্রভৃতি ফল গাছের জন্য এ ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে।
কোন গাছের জন্য কিরূপ ছাঁটাই
কম বয়স্ক ও যে সমস্ত গাছে ফলোৎপাদন শুরু হয় নাই সে সমস্ত গাছের জন্য এবং কমবয়সী ফলোৎপাদনকারী গাছের বেলায় হালকা ছাঁটাই প্রয়োজন। পুরাতন গাছের ক্ষেত্রে সারা গাছ জুড়ে অধিক সংখ্যক ছাঁটাই করা প্রয়োজন । মৃত ও রোগাক্রান্ত শাখা দ্রুত ছাটাই করা উচিত । অতি পুরাতন এবং কম ফল ধরে এমন গাছে কখন কখনও ও নির্দয়ভাবে বড় রকমের ছাঁটাইয়ের প্রয়োজন দেখা দেয় । কুল গাছের সকল শাখা প্রশাখা কেটে দেয়া হয় । কাঁঠাল গাছের কিছু কিছু ছোট শাখা এবং ফলের বোঁটার নিম্নস্থ শাখা কাটা হয় । লিচু গাছের শাখা ছাঁটাই হয়ে যায় শাখাসহ ফল সংগ্রহের কারণে। আম, পেয়ারা, লিচু, কমলা, কামরাঙ্গা, বেল, শরীফা, আতা, আমড়া, জাম প্রভৃতির প্রয়োজন মত শাখা ছাঁটাই করা যেতে পারে ।
ফল গাছের অঙ্গ ছাঁটাই
বেশির ভাগ বৃক্ষ জাতীয় ফল গাছের চারা অবস্থায় কিছু কিছু অঙ্গ ছাঁটাই করা হলে চাহিদা মোতাবেক গাছের আকৃতি সুগঠিত ও সুন্দর করা যেতে পারে । কলমের চারার ক্ষেত্রে অঙ্গ ছাঁটাই বিশেষভাবে উপকারী । অনেক সময় বয়স্ক গাছের অঙ্গও ছাঁটাই করা প্রয়োজন পড়ে। যেমন— কুল, পেয়ারা, লিচু, কাঁঠাল গাছ-এর উপযুক্ত উদাহরণ । মুলত অঙ্গ ছাঁটাই বলতে গাছের অপ্রয়োজনীয় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে গাছ বড় হলে সমস্যা হতে পারে কেটে বাদ দেয়াকে বোঝায়। অঙ্গ ছাঁটাই করা হলে গাছের ফলন বাড়ে এবং গাছটি সুন্দর দেখায় । ছাটায়ের সময় চারার/গাছের ছোট ছোট অংশ/ ডালপালা ছেটে ছোট করে দেয়া হয়। কোন গাছের একই সাইজের দুটো ডালের মধ্যে যদি একটি অপেক্ষা আরেকটি বেশি ছাঁটাই করা যায় তাহলে বেশি ছাঁটাই করা ডালটি কম বাড়বে । গাছের আকৃতি সুন্দর ও ফল বেশি হওয়ার জন্য অনেক সময় ডালপালা ছাঁটাই করে কমিয়ে দেয়া হয় । ছাঁটাই-এর সাথে ফল উৎপাদনের পরিমাণের সরাসরি সংযোগ আছে। অনেক ফলবতী গাছ বেশি ছাঁটাই করা হলে দীর্ঘদিন ধরে ফলন কম হবে । তাই গাছ বিশেষে সতর্কতার সাথে সঠিকভাবে ছাঁটাই করতে হবে । লতানো গাছে ফলন বৃদ্ধি ও সঠিক আকার দেয়ার জন্য ছাঁটাই অপরিহার্য। আঙ্গুরের মত লতানো ফল গাছকে ছোট মাচায় দিলে বেশি ফলন দেয় । এছাড়া অনেক সময় বড় গাছের মাথা হেঁটে ছোট করে রাখলে ফল পাড়তে, যত্ন নিতে ও অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যার সুবিধা হয়। কিছু কিছু চারা গাছ লাগানোর পর প্রধান কাণ্ড বা ডগা তাড়াতাড়ি বেড়ে লম্বা হয় এবং ডালপালা কম হয় বা আদৌ হয় না। এসব ক্ষেত্রে প্রধান কাণ্ড বা ডগা কেটে দিলে ডালপালা গজায়ে ঝাকড়া হয়, যা ফলন বৃদ্ধির জন্য সহায়ক। গাছের ভারসাম্য রক্ষার জন্য চারদিকে সম দূরত্বে তিন থেকে পাঁচটি ডাল রাখলে ভালো হয় । বড় গাছের ভেতরে ছোট ছোট এবং গাছের ভিতর বাতাস ও রোদ চলাচলে অসুবিধা সৃষ্টি করে । গাছের কাণ্ড মজবুত করা এবং ফলন বাড়ানোর জন্য চারা লাগানোর দুই/তিন বছরের মধ্যে প্রধান কাণ্ডের সাথে গাছের ডালের বিন্যাস ঠিক করে হেঁটে দিতে হয় ।
যেমন— রোগাক্রান্ত ও দুর্বল ডাল সব সময় হেঁটে দিতে হয়। কেননা রোগাক্রান্ত ডাল থেকে সব সময় রোগ ছাড়ানারে সম্ভাবনা থাকে ।
মূল ছাঁটাই (Root Pruning )
ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দ্যেশে মূল ছাঁটাই একটি কার্যকর ব্যবস্থা । এর ফলাফল সচরাচর শাখা ছাঁটাইয়ের বিপরীতে হয়ে থাকে । গাছের গোড়া হতে কিছু দূরে অর্থাৎ গাছের আকার অনুযায়ী ৩ হতে ১০ ফুট দুরে নালা খনন করে সেখানকার সকল মূল কেটে দেয়া মুল ছাঁটাই-এর একটি পদ্ধতি । নালাটি গাছের চার পাশ দিয়ে সম্পূর্ণ চক্রাকারে, অর্ধচন্দ্রাকারে, এক চতুর্থাংশ চক্রাকারে প্রভৃতি বিভিন্ন পরিধি বা দৈর্ঘ্যের হতে পারে। গাছ হতে কিছু দূরে গর্ত করলে কিছুটা মূল ছাটাইয়ের কাজ সম্পন্ন হয় । আবার সারা বাগান বা মাঠ জুড়ে লাঙ্গলের সাহায্যে জমি চাষ করলেও মুল ছাঁটাই হয়ে যায়। যেসব গাছের অঙ্গ অধিক বৃদ্ধি হওয়ার কারণে ভালোভাবে ফলবতী হয় না তাদের মূল ছাঁটাই ফলের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে । মূল ছাঁটাই করলে গাছে নাইট্রোজেন সরবরাহের পরিমাণ কমে যায়, ফলে গাছের মধ্যস্থিত নাইট্রোজেনও কার্বোহাইড্রেটের অনুপাত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে এবং ফুল ও ফল উৎপাদনে সহায়তা করে ।
পাতা ছাঁটাই (Pruning of leaves)
হাপর হতে চারা স্থানান্তরিত করে রোপণের সময় চারার অনেক মূল নষ্ট হয়ে যায়, তাতে গাছে পানি সরবরাহের পরিমাণ কমে যায় । অথচ গাছের উপরিভাগের পাতার মাধ্যমে আগের মত প্রবেদন ক্রিয়া চলতে থাকে । ফলে গাছে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানির অভাব দেখা দেয় এবং পানির অভাব অতিরিক্ত হলে গাছ মরে যায়। এ জন্য হাপর হতে চারা উঠিয়ে কিংবা উঠানোর ঠিক আগেই কিছু পাতা হেঁটে দিলে গাছ বাঁচানো সহজ হয় ।
ফুল ও ফল পাতলাকরণ (Thining of flower and fruit )
গাছে অতিরিক্ত সংখ্যক ফুল এলে তাদের কিছু কিছু ভেঙে দেয়া যেতে পারে। তাতে অপর ফুল সমূহের ফলে পরিণত হতে সুবিধা হয় । অতি ছোট গাছে ফুল আসলে ফুলকে ফলে পরিণত হতে না দিয়ে ভেঙে দিলে ফলের দরুণ গাছ দুর্বল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। গাছে অনেক সময় অতিরিক্ত ফুল ধরলে ফলের আকার ও গুণগত মান কমে যায়। এরূপ ক্ষেত্রে ফল ছিড়ে পাতলা করে দিলে অবশিষ্ট ফল আকারে বড় হয় এবং তাদের গুণাগুণ ঠিকমত প্রকাশ পায়। আবার ফল বেশি পাতলা করে দিলে গাছের খাদ্যসামগ্রী তথা কার্বোহাইড্রেট পরিমাণ ব্যয় না হওয়ার দরুণ পরের বৎসর ফল ধরার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেতে থাকে ।
প্রুনিং (Pruning) সম্পর্কিত অন্যান্য তথ্য
ছাঁটাই এমনভাবে করা উচিত যাতে কাটা অংশটি ভূমির সমান্তরাল না হয়ে যথাসম্ভব ভূমির সাথে খাড়াভাবে হয় । তা হলে এ স্থানে সূর্যের কিরণ দ্বারা ফেটে যাওয়ার এবং বৃষ্টির পানি জমে রোগ ও কীটের উপদ্রবের সম্ভাবনা কমবে । কুঁড়ির ঠিক উপরের দিকে কাটলে ভাল হয়। এতে করে কুঁড়ি হতে নতুন শাখা বের হওয়ার সুবিধা হবে । এমনভাবে কাটতে হবে যাতে কাটার নিম্নাংশ কুঁড়ির দিকে এসে ওটার বিপরীত দিকে থাকে । দেড় ইঞ্চি অপেক্ষা কম ব্যাস বিশিষ্ট শাখার কাটা স্থানে কোন প্রলেপ না দিলেও চলে। দেড় ইঞ্চির অধিক ব্যাস বিশিষ্ট শাখার জন্য সাধারণ পেইন্ট, বোর্দাপেষ্ট ইত্যাদির প্রলেপ দেয়া যেতে পারে ।
ফল গাছের পোকা ও রোগ বালাই দমন
বাংলাদেশের মাটি এবং উষ্ণ আর্দ্র জলবায়ু ফল উৎপাদনের উপযোগী । তেমনি ভাবে এখানকার জলবায়ু নানা প্রকার রোগবালাই ও পোকামাকড়ের উপদ্রবের অনুকূল । পোকা মাকড় ও রোগ বালাই ফসলের মারাত্মক শত্রু । তাদের আক্রমণে বাগানের সমপূর্ণ ফসল নষ্ট হয়ে যেতে পারে । এ জন্য সঠিক সময়ে ফল ও ফল গাছকে ক্ষতিকর পোকামাকড়, রোগ বালাই ও নানাবিধ প্রতিকূল পরিবেশগত অবস্থা থেকে রক্ষার জন্য উপযুক্ত দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পোকা মাকড় ও রোগবালাই দমনের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হয় । তবে ঢালাওভাবে পোকা মাকড় ধ্বংস করা উচিত নয় । কেননা ফল বা ফল গাছের অনিষ্টকারী পোকামাকড়ের সাথে অনেক উপকারী পোকাও থাকে । এরা ফুলের পরাগায়নে সাহায্য করে এবং অনিষ্টকারী পোকামাকড়ের ডিম ও কীড়া খেয়ে অনেক উপকার করে থাকে । ফলে বা ফল গাছে পোকা মাকড় ও রোগ বালাই আক্রমণের পূর্বে সতর্কতামুলক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত । কেননা আক্রমণের পর দমন করা অপেক্ষা আগে প্রতিরোধ ব্যবস্থা করা উচিত।
এ জন্য সময়মত জমি চাষ, আগাছা দমন, পরিমাণ মত সার ব্যবহার, পানি সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ভালো জাত নির্বাচন করে সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে রোপণ করে সুস্থ গাছ জন্মাতে হবে । গাছ দৈহিকভাবে দুর্বল হলে নানা প্রকার পোকামাকড় ও রোগ বালাই এর আক্রমণ বেশি হতে পারে । তাই মান সম্মত ফল উৎপাদনের জন্য সঠিক সময়ে পোকা মাকড় ও রোগবালাই দমনের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে । প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসাবে ফল বাগান সব সময় পরিষ্কার পরিছন্ন রাখা, ফল গাছ হতে পরজীবি উদ্ভিদ অপসারণ, মরা ডাল, পাতা ইত্যাদি অপসারণ এবং পোকা মাকড় ও রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন জাত ব্যবহার করতে হবে।
অতি সংক্ষিত প্রশ্ন
১ । ফল বাগানে অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা কখন করা যায় ।
২। আন্তঃকর্ষণের উপকারীতা কী ?
৩ । ফল বাগানে শূন্যস্থানে কী রকম চারা লাগানো উচিত ?
৪। প্রুনিং কখন করতে হয় ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১ । অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যার সংজ্ঞা লেখ ।
২ । প্রনিং এর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা কর ।
৩ । ফুল ও ফল গাছের পোকা ও রোগ বালাই দমন সম্পর্কে লেখ ।
৪ । ফল গাছে প্রনিং-এর সময় উল্লেখ কর ।
৫ । মূল ছাঁটাই-এর উপকারিতা বর্ণনা কর ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। ফল চাষে অন্তর্বর্তী পরিচর্যার ধাপগুলোর বর্ণনা কর ।
২ । প্রুনিং-এর পদ্ধতিসমূহ বর্ণনা কর ।
৩ । ফল বাগানে আগাছা দমনের উপকারিতা বর্ণনা কর ।
৪ । ফল ও ফল গাছের পোকা মাকড় ও রোগ বালাই দমন সম্পর্কে সংক্ষেপে বর্ণনা দাও ।
আরও দেখুন...