বংশ বিস্তারের ধারণা কোন একটি উদ্ভিদ প্রজাতির টিকে থাকা ও সংখ্যা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে সংক্ষেপে ঐ উদ্ভিদের বংশবিস্তার বলা যায় । ফল গাছ তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য বংশ বিস্তার করে থাকে । কোন কোন ফল গাছ শুধু বীজের মাধ্যমে আবার কোন কোন ফল গাছ বীজ ও অঙ্গজ উভয় পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার করে থাকে । কিছু কিছু ফল গাছে অজ চারা উৎপাদন প্রায় অসম্ভব কিংবা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল । যেমন- নারিকেল, তাল, এসব ক্ষেত্রে চারা উৎপাদনের জন্য বীজ ব্যবহার করাই শ্রেয় । বীজ থেকে গজানো চারা বড় ও শক্ত হয় এবং ফল বেশি দেয় । যে সব ক্ষেত্রে উভয় পদ্ধতিই সমান ভাবে প্রযোজ্য সেখানে অঙ্গজ বংশ বিস্তারের মাধ্যমে চারা উৎপাদন করাই শ্রেয়।
বীজের মাধ্যমে কোন কোন ফল বংশবিস্তার করে
কোন একটি উদ্ভিদ প্রজাতির প্রকৃতিতে টিকে থাকাও তার সংখ্যাবৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে সংক্ষেপে ঐ উদ্ভিদের বংশ বিস্তার বলা যায় । বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বংশ রক্ষার্থে নির্দিষ্ট কোন একটি গাছ যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যৌনকোষের সাহায্যে বা অঙ্গজ উপায়ে তার সমতুল্য নতুন একটি গাছের জন্ম দিয়ে থাকে সে প্রক্রিয়াকে উদ্ভিদের বংশ বিস্তার বলে ।
উদ্ভিদসমূহ প্ৰধানত দুটো পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার করে থাকে । যথা- যৌন পদ্ধতি ও অযৌন পদ্ধতি বা অঙ্গজ পদ্ধতি বীজের মাধ্যমে বংশ বিস্তার পদ্ধতি বা যৌন পদ্ধতি (Sexual propagation) এ পদ্ধতিতে বীজের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করা হয় । উদাহরণ- আম, কাঁঠাল, জাম, নারিকেল, তাল ইত্যাদির বীজ দ্বারা গাছ তৈরি করা যায় ।
অঙ্গজ বা অযৌন বংশবিস্তার (Asexual vegetative propagation )
এ পদ্ধতিতে যৌনকোষ বা বীজ ছাড়া মাতৃগাছের অন্যান্য কোষ দ্বারা মাতৃগাছের অনুরূপ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নতুন গাছ তৈরি হয় । গাছের প্রতি কোষই মাতৃগাছ বা নতুন গাছ সৃষ্টির কৌলতাত্ত্বিক উপাদানসমূহ ধারন করে । এ জন্য প্রতিটি কোষ হতে একটি নতুন গাছ জন্ম হতে পারে। অযৌন বা অঙ্গজ বংশবিস্তারের পদ্ধতিগুলোর তালিকা নিম্নে দেওয়া হলো ।
ফল চাষের বংশ বিস্তার পদ্ধতি
১। অ্যাপোমিকটিক পদ্ধতি (Apomictic): উদাহরণ- সাইট্রাস, আম ইত্যাদি ।
২। পৃথকীকরণ পদ্ধতি (Separation): উদাহরণ- পেঁয়াজ, টিউলিপ ইত্যাদি ।
৩। কন্দর মাধ্যমে বংশবিস্তার (Bulb): উদাহরণ- পেঁয়াজ, টিউলিপ ইত্যাদি ।
৪ । গুড়ি কন্দের মাধ্যমে বংশবিস্তার (Com): উদাহরণ- ওল, মুখীকচু, গরাডিওলাস ইত্যাদি ।
৫। বিভাজন পদ্ধতি (Division): উদাহরণ- আলু ।
৬। স্থূল কন্দের মাধ্যমে বংশবিস্তার (Tuber): উদাহরণ- আলু ।
৭। মুলের মাধ্যমে বংশবিস্তার (Tuberous root): উদাহরণ- মিষ্টি আলু, ডালিয়া ।
৮ । রাইজোমের মাধ্যমে বংশবিস্তর (Rhizome): উদাহরণ- কলা, আদা, হলুদ ।
৯ । খর্ব ধাবকের মাধ্যমে বংশবিস্তার (Offsets / off roots): উদাহরণ- আনারস, খেজুর।
১০ । মুকুটের মাধ্যমে বংশবিস্তার (runner): উদাহরণ- থানকুনি, আমরুল ।
১১ । ধাবকের সাহায্যে বংশবিস্তার (Propagation by cutting)
১২ । দাবা কলমের সাহায্যে বংশবিস্তার (Lay ering): উদাহরণ- পেয়ারা, লেবু, হাসানা হেনা, জবা ।
১৩ । জোড় কলমের সাহায্যে বংশবিস্তার (Grafting)
১৪ । কুঁড়ি সংযোজন বা চোখ কলমের সাহায্যে বংশবিস্তার (Budding) : উদাহরণ- কুল, গোলাপ
১৫ । কোষ বা কলা কালচার পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার করে (Tissue culture)
অঙ্গজ বংশবিস্তার ও বীজের মাধ্যমে ফল চাষের পার্থক্য
উদ্ভিদসমূহ প্ৰধানত দুটো পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার করে থাকে যথা- যৌন পদ্ধতি ও অযৌন বা অঙ্গজ পদ্ধতি । ফল চাষের ক্ষেত্রে এ দুই পদ্ধতির পার্থক্য নিম্নে দেখানো হলো ।
ছক- ১ বীজের মাধ্যমে বা যৌন পদ্ধতিতে বংশ বিস্তারের সুবিধা ও অঙ্গজ বা অযৌন পদ্ধতির অসুবিধা
বীজের মাধ্যমে বা যৌন পদ্ধতিতে | অঙ্গজ বা অযৌন পদ্ধতিতে |
১। যে সব ফল গাছ সাধারনত আজ উপায়ে বংশ সজীব বিস্তার করতে পারে না সেসব ফলগাছের বংশ বিস্তারের জন্য যৌন পদ্ধতি একমাত্র উপায় | ১। কতিপয় ফলগাছ যেমন-কলা, আনারস ইত্যাদি ও প্রকৃত বীজ উৎপাদন করে না। তাই এসব গাছের বংশ টিকিয়ে রাখার জন্য অযৌন পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার করা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই । |
২। বীজ থেকে উৎপন্ন গাছ সাধারনত অধিক কষ্ট সহিষ্ণু হয় ও বেশিদিন বাঁচে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- ঝড়, বৃষ্টি, খরা বা যে কোন প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম । | ২। বীজ থেকে উৎপন্ন চারায় মাতৃগাছের গুণাগুণবজায় থাকে না। তাই মাতৃগুণ সম্পন্ন গাছ পেতে হলে অযৌন পদ্ধতিই একমাত্র উপায় । |
৩। সংকরায়ণের মাধ্যমে নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতির আর কোন বিকল্প নেই। | ৩। ফল গাছের এমন কতগুলো জাত আছে যারা উত্তম গুণাগুণ সম্পন্ন ফল প্রদান করে এবং উচ্চ ফলনশীল। কিন্তু জলাবদ্ধতা, খরা, লবণাক্ততা, রোগ, পোকামাকড় ইত্যাদির প্রতি অধিক সংবেদনশীল । এসব গাছকে বীজ থেকে না জন্মিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির সংগে খাপ খায় এমন আদিজোড় এর সাথে কলম করে প্রতিকূল পরিবেশে টিকিয়ে রাখা যায়। |
৪। যৌন পদ্ধতিতে বংশ বিস্তারের জন্য তেমন কোন কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতার দরকার হয় না । | ৪ । অযৌন পদ্ধতিতে জন্মানো গাছ কম বিস্তারশীল হওয়ায় এসব গাছের ফল সগ্রহ ও পরিচর্যা সহজতর হয়। অপরদিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গায় অধিক সংখ্যক গাছ । লাগিয়ে মোট ফলন বাড়ানো যায় । |
৫। অপেক্ষাকৃত সহজ ও সস্তায় এবং কম পরিশ্রমে চারা পাওয়া যায় । | ৫। অপেক্ষাকৃত কম সময়ে উচ্চ গুণসম্পন্ন চারা পাওয়া যায় । |
ছক-২ অঙ্গজ বা অযৌন পদ্ধতির সুবিধা বীজের মাধ্যমে বা যৌন পদ্ধতিতে বংশবিস্তারের অসুবিধা
অঙ্গজ বা অযৌন পদ্ধতিতে | বীজের মাধ্যমে বা যৌন পদ্ধতিতে |
১। এ পদ্ধতিতে নতুন কোন জাত সৃষ্টি করা যায় না । | ১। বীজ থেকে উৎপন্ন গাছে কখনো মাতৃগাছের গুণাগুণ অক্ষুন্ন থাকে না । |
২। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যৌন পদ্ধতির চেয়ে অযৌন পদ্ধতিতে বংশ বিস্তারের খরচ বেশি লাগে। | ২। গাছ লম্বা, উঁচু ও বড় হওয়ায় ফল সংগ্রহ কষ্টকর হয়। |
৩। এ পদ্ধতিতে বংশবিস্তার করতে গেলে যথেষ্ট কারিগরি জ্ঞান, দরাতা ও অনুশীলনের দরকার হয়। | ৩। এ প্রক্রিয়ায় জন্মানো গাছে ফুল ফল আসতে সময় বেশি লাগে। |
৪ । অঙ্গজ উপায়ে বংশ বিস্তারকারী গাছসমূহ সাধারণত অল্প দিন বাঁচে। | ৪। গাছ বড় আকারের হওয়ায় নির্দিষ্ট পরিমান জমিতে কমসংখ্যক গাছ লাগাতে হয় । |
৫। এ পদ্ধতিতে কিছু কলমের অস্থানিক মূল সৃষ্টি হওয়ায় তা মাটিতে শক্তভাবে আটকে থাকতে পারে না । ফলে ঝড় বৃষ্টিতে গাছ পড়ে যায় । | ৫। আঙ্গিক বৃদ্ধি বেশি হওয়ায় ঝড় তুফানে গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা থাকে |
৬। এ কাজে দর মালি পেতে কষ্ট হয় । | ৬। মানসম্মত বীজ পেতে অসুবিধা । |
৭ । পরিবহনে অল্প সংখ্যক চারার জন্য অনেক জায়গার প্রয়োজন হয় । | ৭। বীজতলা তৈরি ও চারা উৎপাদনের জন্য কারিগরি দক্ষতার অভাব । |
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। ফল গাছের বংশ বিস্তার কীভাবে ঘটে থাকে ?
২। বীজের মাধ্যমে কোন কোন ফলের বংশ বিস্তার হয় ?
৩। অঙ্গজ বংশ বিস্তারের সুবিধা কী ?
৪ । আমাদের দেশে স্বল্প মেয়াদী ফল কোনগুলো?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। বীজের মাধ্যমে কোন কোন ফল বংশ বিস্তার করে ?
২। অঙ্গজ বংশবিস্তারের ফলের নামের তালিকা তৈরি কর ।
৩ । অঙ্গজ বংশবিস্তার ও বীজের মাধ্যমে বংশ বিস্তারের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কী ?
৪। উদ্ভিদের বংশবিস্তার বলতে কি বাঝায় ?
৫ । ভিনিয়ার ও সংস্পর্শ জোড় কলমের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কী ?
৬ । গাছের পাঁচটি অংশের নাম লেখ যার মাধ্যমে বংশবিস্তার করা যায় ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। অঙ্গজ ও যৌন বংশ বিস্তারের সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ লিপিবদ্ধ কর
২। অঙ্গজ বংশ বিস্তার ও বীজের মাধ্যমে ফল চাষের পার্থক্য ব্যাখ্যা কর ।
৩। অযৌন বংশবিস্তার বলতে কী বাঝায় ? গাছের বংশবিস্তার কয় ভাগে করা যায় উদারহণসহ লেখ।
৪ । অযৌন বংশ বিস্তারের সুবিধা ও অসুবিধাগুলো লেখ ।
৫ । ভিনিয়ার জোড় কলম করার পদ্ধতি চিত্র অঙ্কনসহ বর্ণনা কর ।
৬। টীকা লেখ: ক) গুটি কলম খ) শাখা কলম গ) চোখ কলম ঘ) জোড় কলম ।
আরও দেখুন...