বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পদের বিবরণ

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - অর্থনীতি - অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ধারণাসমূহ | NCTB BOOK

বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম । জনবহুল আমাদের দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় অত্যন্ত কম । উন্নয়নের সাথে দেশের অর্থনৈতিক সম্পদের বিশেষ সম্পর্ক থাকে । এ দেশের অর্থনৈতিক সম্পদের বিবরণ নিচে দেওয়া হলো-


ক. কৃষি সম্পদ
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে রয়েছে পলিসমৃদ্ধ উর্বর কৃষিজমি। আমাদের জমির উর্বরতা, অনুকূল আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত, নদ-নদী প্রভৃতি কৃষি উৎপাদনের সহায়ক। এ দেশে প্রায় ৯০,৯৯০ বর্গ কি.মি. চাষযোগ্য কৃষিজমি রয়েছে । আমাদের কৃষিক্ষেত্রে ধান, গম, ডাল, আলু, তৈলবীজ, ফলমূল প্রভৃতি খাদ্যশস্য এবং পাট, ইক্ষু, চা, তামাক, রেশম প্রভৃতি অর্থকরী ফসল উৎপন্ন হয় । দেশের প্রায় ৬৩% লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল । জাতীয় আয়ের প্রায় ১৬% ভাগ কৃষি থেকে আসে।


খ. খনিজ সম্পদ
বাংলাদেশ খনিজ সম্পদে তেমন সমৃদ্ধ নয় । এখানে এ পর্যন্ত যেসব খনিজ সম্পদ আবিষ্কৃত হয়েছে, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে দেওয়া হলো :

১. প্রাকৃতিক গ্যাস : প্রাকৃতিক গ্যাস বাংলাদেশের প্রধান খনিজ সম্পদ । ২০১৬ সালে পর্যন্ত দেশে ২৬টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। সেখানে গ্যাসের মোট মজুদ প্রায় ৩৮.০২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে কেবল ২০টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলিত হচ্ছে । উৎপাদনরত গ্যাসক্ষেত্রগুলো হলো বাখরাবাদ, হবিগঞ্জ, কৈলাসটিলা, রশীদপুর, সিলেট, তিতাস, বেলাবো (নরসিংদী), মেঘনা, সাঙ্গু, সালদা নদী, জালালাবাদ, বিয়ানিবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ফেনী, বিবিয়ানা ও বাঙ্গুরা ইত্যাদি। এ গ্যাস রাসায়নিক সার তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে, কলকারখানা ও গৃহে এ গ্যাস জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় ।

২. চুনাপাথর : সিমেন্ট, কাচ, কাগজ, সাবান, ব্লিচিং পাউডার প্রভৃতি উৎপাদনে চুনাপাথর ব্যবহৃত হয় । বাংলাদেশের সিলেটের ভাঙ্গারহাট ও বাগলীবাজার, সুনামগঞ্জের টেকেরহাট, জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ এবং কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিন দ্বীপে চুনাপাথরের মজুদ রয়েছে ।
৩. চীনামাটি : ময়মনসিংহের বিজয়পুর ও নওগাঁ জেলার পত্নীতলায় চীনামাটির মজুদ রয়েেেছ । এটি বাসনপত্র, সেনিটারি দ্রব্য তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয় ।
৪. কয়লা : বাংলাদেশের সিলেট, রাজশাহী, জয়পুরহাট, ফরিদপুর ও দিনাজপুরের বড় পুকুরিয়ায় কয়লার সন্ধান পাওয়া গেছে । সম্প্রতি দিনাজপুরের বড় পুকুরিয়ায় কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে ।
৫. কঠিন শিলা : দিনাজপুর জেলার মধ্যপাড়া এবং রংপুর জেলার রাণীপুকুরে কঠিন শিলার মজুদ
রয়েছে । রাস্তা, রেলপথ, বাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি কাজে এ শিলা দরকার হয় ।
৬. সিলিকা বালু : সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও জামালপুরে সিলিকা বালুর মজুদ রয়েছে । এটি কাচ, রং, রাসায়নিক দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ।
৭. গন্ধক : বারুদ তৈরি, দিয়াশলাই কারখানা, তেল পরিশোধন প্রভৃতি ক্ষেত্রে গন্ধক লাগে । চট্টগ্রামের
কুতুবদিয়া দ্বীপে গন্ধক পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ।
৮. খনিজ তেল : সিলেটের হরিপুরে খনিজ তেলের সন্ধান পাওয়া গেছে । দেশের উপকূলীয় এলাকা, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটে তেল অনুসন্ধানের কাজ চালানো হচ্ছে ।
৯. তামা : রংপুর জেলার রাণীপুকুর ও পীরগঞ্জ এবং দিনাজপুরের মধ্যপাড়ায় কঠিন শিলার স্তরে সামান্য তামার সন্ধান পাওয়া গেছে । বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও তার, মুদ্রা প্রভৃতি তৈরির জন্য তামা ব্যবহার করা হয়।


গ. বনজ সম্পদ


বনভূমি ও বনজ সম্পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ । প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত অবস্থা ভালো রাখা জন্য যেকোনো দেশের কমপক্ষে শতকরা ২৫ ভাগ বনাঞ্চল থাকা দরকার । কিন্তু বাংলাদেশের মোট বনভূমি মোট ভূখণ্ডের প্রায় শতকরা ১১.১ ভাগ যা অন্যান্য দেশের তুলনায় কম । যেমন, আমেরিকায় শতকরা ৩৩.৮৪ ভাগ, জাপানে শতকরা ৬৭ ভাগ, বার্মায় শতকরা ৬৩ ভাগ এবং ভারতে শতকরা ২৩.৭০ ভাগ বনাঞ্চল রয়েছে । বাংলাদেশের সমগ্র বনভূমিকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায় ।
 

১. সুন্দরবন : খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও বরগুনা জেলার সমুদ্র উপকূলে এ বন অবস্থিত । এর আয়তন প্রায় ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার । এ বনাঞ্চলে সুন্দরী, গরান, গেওয়া, কেওড়া, বাইন প্রভৃতি মূল্যবান গাছ জন্মায় । সুন্দরবনে পৃথিবী বিখ্যাত বাঘ ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার' এবং বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান পশু-পাখি বাস করে ।
২. চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনভূমি : এ ৪টি জেলার প্রায় ১৩,২৯৫ বর্গকিলোমিটার পাহাড়ি এলাকা জুড়ে এ বন বিস্তৃত । এ বনে সেগুন, গর্জন, গামারি, জারুল, শিমুল, চম্পা, বাঁশ, বেত প্রভৃতি গাছ প্রচুর পরিমাণে জন্মায় ।
৩. মধুপুর ও ভাওয়াল বনভূমি : ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর গড় এবং গাজীপুর জেলার ভাওয়ালের গড় মিলে এ বনভূমির আয়তন প্রায় ১০৬৪ বর্গকিলোমিটার। এখানে শাল, গজারি, বনজাম, কড়ই প্রভৃতি গাছ জন্মায় ।
৪. সিলেটের বনভূমি : এ বনভূমি সিলেট জেলায় অবস্থিত । এর আয়তন প্রায় ১,০৪০ বর্গকিলোমিটার । এখানে শিমুল, বনজাম, বাঁশ, বেত প্রভৃতি বহু রকমের গাছ জন্মায় ।
৫. দিনাজপুর ও রংপুরের বনভূমি : এ বন দেশের উত্তর-পশ্চিমে দিনাজপুর ও রংপুর জেলার বরেন্দ্র ভূমিতে অবস্থিত । এর আয়তন প্রায় ৩৯ বর্গকিলোমিটার । এখানে শাল, গজারি প্রভৃতি গাছ জন্মায় ।

ঘ. প্রাণিজ সম্পদ


বাংলাদেশের সর্বত্র বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখি দেখা যায় । গৃহপালিত পশু-পাখির মধ্যে গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, হাঁস, মুরগি প্রভৃতি প্রধান । এ ছাড়া সুন্দরবন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে রয়েছে বাঘ, হাতি, হরিণ প্রভৃতি মূল্যবান জীবজন্তু ও অসংখ্য প্রজাতির পাখি । আমাদের নদ-নদী, বিল, হাওর, পুকুর ইত্যাদি জলাশয় এবং বঙ্গোপসাগরে বিভিন্ন রকম মাছ পাওয়া যায়। এ ধরনের সম্পদ আমাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে । কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। চামড়াশিল্পের কাঁচামালের যোগান দেয় । এ সম্পদ রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক ।


ঙ. শক্তি সম্পদ


কলকারখানা, যানবাহন ও যোগাযোগ, যান্ত্রিক চাষাবাদ, গৃহকর্ম প্রভৃতি ক্ষেত্রে শক্তি সম্পদের ব্যবহার অপরিহার্য । কয়েকটি উৎস থেকে শক্তি পাওয়া যায়। এগুলো হলো কয়লা, খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, পানি, আণবিক শক্তি, সৌরশক্তি এবং বিভিন্ন প্রকার প্রচলিত জ্বালানি সামগ্রী ।

বাংলাদেশের কয়েকটি স্থানে কয়লার সন্ধান পাওয়া গেলেও তা এখনও উত্তোলন করা শুরু হয়নি । সিলেটের হরিপুরে পেট্রোলিয়ামের সন্ধান পাওয়া গেছে । প্রয়োজনীয় পরিমাণ পেট্রোলিয়াম বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় । আণবিক শক্তির সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন এখনও এ দেশে শুরু করা সম্ভব হয়নি ।
বাংলাদেশে শক্তির যোগান বহুলাংশে প্রাকৃতিক গ্যাস, বিদ্যুৎ ও প্রচলিত উপকরণ থেকে আসে । আমরা প্রাকৃতিক গ্যাস কলকারখানা, গৃহকর্ম ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করি । এ দেশে পানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় । একে পানি বিদ্যুৎ বলে । পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাই নামক স্থানে কর্ণফুলি নদীর তীরে দেশের একমাত্র পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি অবস্থিত। গ্যাস, তেল, কয়লার সাহায্যে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়, তাকে তাপ বিদ্যুৎ বলে । বাংলাদেশে নিম্নলিখিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে খনিজ তেল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় :


১. গোয়ালপাড়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, খুলনা
২. ভেড়ামারা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্ৰ, কুষ্টিয়া
৩. ঠাকুরগাঁও তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্ৰ
৪. সৈয়দপুর তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্ৰ, নীলফামারী
এ দেশের গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো হলো-
১. সিদ্ধিরগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, নারায়ণগঞ্জ
২. আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
৩. ঘোড়াশাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্ৰ, , নরসিংদী
৪. শাহজিবাজার তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সিলেট
৫. চট্টগ্রাম তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্ৰ


এ দেশে বিভিন্ন প্রকার প্রচলিত জ্বালানি যেমন, কাঠ, খড়, গোবর, পাটখড়ি, তুষ, পাতা ইত্যাদি থেকেও তাপশক্তি সৃষ্টি হয় । বর্তমান সরকার কুইক রেন্টাল সার্ভিসের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে ।
উল্লেখ করা দরকার, বর্তমানে বিভিন্ন দেশে বায়ুপ্রবাহ, সৌর তাপ ও জৈব গ্যাসকে শক্তি উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে । আধুনিক বিশ্বে আণবিক শক্তির উপরও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে । আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের এসব উৎস থেকে শক্তি উৎপাদনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হবে ।

চ. পানি সম্পদ


পানি একটি মৌলিক প্রাকৃতিক সম্পদ, যা প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য। দেশের কৃষিজ, বনজ, প্রাণিজ ও শক্তি সম্পদের অস্তিত্ব রক্ষা ও উন্নয়নের জন্য পানি সম্পদ প্রয়োজন । বাংলাদেশে পানির উৎস প্রধানত তিনটি, যথা : ১. নদ-নদী, খালবিল, পুকুর ও সমুদ্র, ২. বৃষ্টিপাত এবং ৩. ভূ-গর্ভস্থ পানি ।
এ তিনটি উৎসের পানি আমাদের কৃষির জন্য অপরিহার্য । পানির যোগান কম বা বেশি হলে কৃষিকাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয় । অভ্যন্তরীণ জলাশয় ও সমুদ্র এলাকায় রয়েছে মাছ ও অন্যান্য জলজ সম্পদ । নদীর স্রোত থেকে উৎপন্ন হয় পানি বিদ্যুৎ। আমাদের অসংখ্য নদ-নদী, খালবিল ও জলাশয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এ দেশের যাতায়াতব্যবস্থা ও ব্যবসা-বাণিজ্য । নদ-নদীর পানি ও বৃষ্টিপাত দেশের আবহাওয়া ও পরিবেশের জন্য অনুকূল প্রভাব সৃষ্টি করে । পানি সম্পদের উন্নয়ন ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি বাড়বে ।

Promotion