কার্বোহাইড্রেট (Carbohydrate) হল এক ধরনের জৈব রাসায়নিক পদার্থ যা কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন মিলে গঠিত হয়। এর সাধারণ সংকেত C m(H2O)n। কার্বোহাইড্রেট প্রধানত তিন প্রকার। যথা-
মনোস্যাকারাইডঃ যে সব কার্বোহাইড্রেটকে আর্দ্র বিশ্লেষণ করলে আর কোন সরল কার্বোহাইড্রেট একক পাওয়া যায় না তাদের মনোস্যাকারাইড বলে। এর সাধারণ সংকেত CnH2nOn। সাধারণত এরা বর্ণহীন, পানিতে দ্রবণীয়। কিছু মনোস্যকারাইড মিষ্টি স্বাদযুক্ত। যেমন : গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ এবং গ্যলাকটোজ।
ক. গ্লুকোজঃ এই শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ “গ্লুকাস” থেকে। গ্রিক শব্দ গ্লুকাস অর্থ হলো মিষ্টি বা সুইট। গ্লুকোজ একটি মিষ্টি স্বাদ যুক্ত কঠিন কেলাসিত পদার্থ। গ্লুকোজ একটি কার্বোহাইড্রেট শ্রেণীর অ্যালিফেটিক জৈব যৌগ। গ্লুকোজের একটি অণুতে একটি কার্বনিল মূলক এবং পাঁচটি হাইড্রোক্সিল মূলক থাকে। ফুলের মধু, মিষ্টি ফলের রস বা মৌমাছির মৌচাকের মধুতে গ্লুকোজ থাকে। পাকা আঙুরের রসে প্রায় কুড়ি থেকে ত্রিশ শতাংশ গ্লুকোজ থাকে।
গ্লুকোজের উৎস নিম্নরূপ
১. পাকা ফলের রসে, মধুতে এবং পাকা আঙুরের রসে গ্লুকোজ থাকে। আঙুরের রসে প্রচুর পরিমাণে গ্লুকোজ পাওয়া যায় বলে একে দ্রাক্ষা শর্করা বলে। আঙুরের রসে প্রাইস 25 থেকে 30 পার্সেন্ট গ্লুকোজ থাকে।
২. ইক্ষু শর্করা বা সুক্রোজের আর্দ্র বিশ্লেষণ গ্লুকোজ পাওয়া যায়।
C12H22O11+H2O→C6H12O6(গ্লুকোজ)+C6H12O6(ফ্রুক্টোজ)
৩. আলু, ভুট্টা চাল, গম প্রভৃতি শ্বেতসার বা স্টার্চ জাতীয় পদার্থকে লঘু সালফিউরিক এসিড দ্বারা সম্পূর্ণরূপে আর্দ্র বিশ্লেষণ করে গ্লুকোজকে তৈরি করা হয়।
গ্লুকোজের ধর্ম
প্রকৃতিতে পাওয়া সমস্ত যৌগের মত গ্লুকোজের কিছু বিশেষ ধর্ম আছে। নিচে সেই সব গ্লুকোজের ধর্ম আলোচনা করা হলো
১. গ্লুকোজ একটি বর্ণহীন, মিষ্টি গন্ধযুক্ত এবং কেলাসাকার কঠিন পদার্থ।
২. এটি একটি কার্বোহাইড্রেট শ্রেণীর অ্যালিফেটিক যৌগ।
৩. গ্লুকোজ জলে দ্রাব্য।
৪. গ্লুকোজের গলনাঙ্ক 146°C।
৫. এটি স্বাদে মিষ্টি।
খ. ফ্রুক্টোজঃ এতে ছয়টি কার্বন থাকায়, মোনোস্যাকারাইডের হেক্সোজ শ্রেণিতে ফেলা হয়। আবার এতে একটি কিটো গ্রুপ থাকায় একে কিটো হেক্সোজ বলা হয়।
উৎসঃ অধিকাংশ ফ্রুক্টোজ ফল ও মধুতে মুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। এই কারণে অনেক সময় একে ফলের চিনি (fruit sugar) বলা হয়। ফল ও মধু ছাড়াও আখের সুক্রোজ ও বীটের সুক্রোজের সাথে ফ্রুক্টোজ পাওয়া যায়।,
ফ্রুক্টোজের বৈশিষ্ঠ্যঃ
ফ্রুক্টোজ সাদা দানাদার কঠিন পদার্থ।
এটি পানিতে দ্রবণীয়।
গ. গ্যালাকটোজঃ গ্যালাকটোজ একটি ছয় কার্বন মনোস্যাকচারাইড এটি সাধারণ শর্করার গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এবং এটি উদ্ভিদ এবং প্রাণী উভয় প্রাণীর মধ্যেই উপস্থিত। উদ্ভিদের টিস্যুগুলিতে, গ্যালাকটোজ গ্লুকোজে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়, যা থেকে এটি স্থানের চতুর্থ কার্বন পরমাণুর গ্রুপগুলির অবস্থানের চেয়ে পৃথক হয়। মানবদেহে একটি ল্যাকটোজ উপাদান এবং কয়েকটি নির্দিষ্ট পলিস্যাকারাইড রয়েছে।স্বাভাবিকভাবেই, ল্যাকটোজের হাইড্রোলাইসিসের সময় মানুষের শরীরে গ্যালাকটোজ অন্ত্রে গঠিত হয়।
ওলিগোস্যাকারাইডঃ যে সমস্ত পলিস্যাকারাইডকে আর্দ্র বিশ্লেষণ করলে নির্দিষ্ট সংখ্যক (২ থেকে ৯ টি) মনোস্যাকারাইড পাওয়া যায় সেই সকল পলিস্যাকারাইডকে ওলিগোস্যাকারাইড বলে।
পলিস্যাকারাইডঃ যে সকল কার্বোহাইড্রেটকে আর্দ্র বিশ্লেষণ করে অনেকগুলি মনোস্যাকারাইড অণু পাওয়া যায় তাদেরকে পলিস্যাকারাইড বলে। এরা পানিতে অদ্রবণীয় ও স্বাদহীন। যেমনঃ স্টার্চ, সেলুলোজ ইত্যাদি।উদ্ভিদে শ্বেতসার বা স্টার্চ সঞ্চিত পদার্থ রূপে বিরাজ করে।
স্টার্চঃ
এটি একটি পলিস্যাকারাইড। এর সাধারণ সংকেত (C6H10O5)n। সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট গ্লুকোজের অধিকাংশই পরিবর্তিত হয়ে শ্বেতসারে পরিণত হয়। শ্বেতসার সাধারণত ঘনীভূত দানা হিসেবে উদ্ভিদ কোষে বিরাজ করে এবং এদের আকার-আকৃতি বিভিন্ন উদ্ভিদে বিভিন্ন রকম। বীজ, ফল, কন্দ প্রভৃতি সঞ্চয়ী অঙ্গে শ্বেতসার জমা হয়। ধান, গম, আলু শ্বেতসারের প্রধান উৎস।হাওয়ার্থ (Haworth) -এর পরীক্ষা থেকে জানা যায় যে, প্রায় ২৪ থেকে ৩০টি এককের সমন্বয়ে একটি স্টার্চ এর অণু গঠিত হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় বিভিন্ন উদ্ভিদের মূল ও বীজে সঞ্চিত খাদ্য হিসেবে স্টার্চ জমা থাকে। হাইলাম নামক একটি স্বচ্ছ চকচকে বিন্দুকে কেন্দ্র করে স্টার্চ কণাগুলো গঠিত হয়। হাইলাম বিন্দুর অবস্থানভেদে স্টার্চ কণাগুলো উৎকেন্দ্রিক বা সমকেন্দ্রিক। উদ্ভিদভেদে স্টার্চ কণিকার আয়তন ও আকৃতি বিভিন্ন রকম হতে পারে। গোল আলুর স্টার্চ কণিকা বৃহত্তম এবং চালের স্টার্চ কণিকা ক্ষুদ্রতম।
রাসায়নিক গঠনঃ
অ্যামাইলোজ ও অ্যামাইলোপেকটিন নামক দুটি পলিস্যাকারাইডের সমন্বয়ে শ্বেতসার গঠিত হয়। বিভিন্ন শ্বেতসারের আকার-আকৃতিতে বিরাট পার্থক্য দেখা যায়। আয়োডিন দ্রবণে শ্বেতসার গাঢ় নীল বর্ণ ধারণ করে। জলীয়বিভাজন (Hydrolysis) করলে শ্বেতসার গ্লুকোজে পরিণত হয়।
অ্যামাইলোজঃ
অ্যামাইলোজ হল α-D- গ্লুকোজের একটি সরল শিকল পলিমার। একটি α-D- গ্লুকোজ অণুর এক নম্বর কার্বনের (C₁) সাথে এবং অপর একটি α-D- গ্লুকোজ অণুর 4 নম্বর কার্বন (C₄) পরস্পরের সাথে α-গ্লাইকোসাইডিক বন্ধন দ্বারা যুক্ত হয়। এরা পানিতে দ্রবণীয় এবং আয়োডিনের সাথে বিক্রিয়া করে নীল বর্ণ ধারণ করে। এতে 60 থেকে 300 একক গ্লুকোজ অণু বিদ্যমান থাকে।
অ্যামাইলোপেকটিনঃ
স্টার্চের এ অংশ α-D-গ্লুকোজের একটি শাখাযুক্ত পলিমার। একটি শিকলের এক নম্বর কার্বন (C₁) এবং অপর একটি শিকলের 6 নম্বর কার্বন (C₆) পরমাণু পরস্পরের সাথে α-গ্লাইকোসাইড বন্ধন দ্বারা শাখাযুক্ত শিকল গঠন করে। এরা পানিতে অদ্রবণীয় এবং আয়োডিনের সাথে লাল বর্ণ ধারণ করে। এতে 300-600 একক গ্লুকোজ অনু বিদ্যমান থাকে।
বৈশিষ্ট্য
১. এটি বর্ণহীন, গন্ধহীন ও স্বাদহীন এক ধরনের সাদা নরম অদানাদার পাউডারের মতো জৈব রাসায়নিক পদার্থ।
২. সাধারণ তাপমাত্রায় এরা পানিতে, ইথার ও অ্যালকোহলে অদ্রবণীয়।
৩. আয়োডিন দ্রবণে এরা নীল বর্ণ ধারণ করে।
৪. উচ্চ তাপমাত্রায় এরা ভেঙে ডেক্সিটিনের বড় বড় কণায় পরিণত হয়।
৫. ফেহলিং দ্রবণ স্টার্চ কর্তৃক বিজারিত হয় না।
৬. আণবিক সংকেত (C6H10O5)n।
সেলুলোজঃ
সেলুলোজ উদ্ভিদের একটি প্রধান গাঠনিক পদার্থ। উদ্ভিদের কোষ প্রাচীর সেলুলোজ দিয়ে গঠিত। অসংখ্য β-D গ্লুকোজ অণু পরস্পর β-১-৪ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সেলুলোজ তৈরি করে। উদ্ভিদের অবকাঠামো নির্মাণে সেলুলোজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদ্ভিদদেহে যেহেতু কোনো কঙ্কাল নেই,সেহেতু উদ্ভিদের ভার বহনের দায়িত্ব পালন করে সেলুলোজ। তুলায় সেলুলোজ এর পরিমাণ ৯৪%,লিনেনে ৯০% এবং কাঠে ৬০%। সেলুলোজ ঘন H2SO4 বা HCL বা NaOH দ্বারা হাইড্রোলাইসিস করে গ্লুকোজে পরিণত করা হয়। মানুষের পাকস্থলী বা অন্ত্রে সেলুলোজ এনজাইম না থাকায় সেলুলোজ পদার্থ হজম হয়না,তবে গরু-ছাগলে সেলুলোজ পুষ্টি হিসেবে কাজ করে। বন ও বস্ত্র শিল্পের প্রধান উপাদান সেলুলোজ,আর তাই মানব সভ্যতায় এর দান অপরিসীম। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বিরাজ করে সেলুলোজ। এককথায় বলতে গেলে সেলুলোজ হলো একটি কার্বোহাইড্রেড-জাতীয় মস্ত বড়ো অণু।
সেলুলোজ এর ধর্ম
১. সেলুলোজ স্বাদহীন,গন্ধহীন, সাদা ও কঠিন জৈব রাসায়নিক পদার্থ।
২. এটি পানিতে অদ্রবণীয়,অবিজারক,আণবিক ভর দুই লক্ষ থেকে কয়েক লক্ষ।
৩. এটি মিষ্টি বিবর্জিত এবং বিজারণ ক্ষমতাহীন।
৪. আয়োডিন দ্রবণ প্রয়োগে কোনো রং দেয়না।
৫. এটির ফাইবার সদৃশ ও শক্ত।
৬. এর কোনো পুষ্টিগুণ নেই।
সেলুলোজ এর কাজ
উদ্ভিদের গাঠনিক উপাদান হিসেবে কাজ করে। উদ্ভিদকে দৃঢ়তা ও সুরক্ষা প্রদান করে এবং ভার বহন করে।
সেলুলোজ এর ব্যবহার
* সেলুলোজ কাগজ ও বস্ত্রশিল্পের প্রধান উপাদান।
* এটি নাইট্রেট বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
* এটি অ্যাসিটেট ফটোগ্রাফিক ফিল্মে ব্যবহার করা হয়।
* নির্মাণ সামগ্রী ও আসবাবপত্র নির্মাণে সেলুলোজ প্রধান উপাদান হিসেবে যান্ত্রিক সাহায্য প্রদান করে।
* কাঠখেকো কীটপতঙ্গ এর পুষ্টিনালীতে বসবাসকারী এক ধরনের পরজীবী সেলুলোজ নামক উৎসেচক নিঃসৃত করে কাঠ হজমে সাহায্য করে।
আরও দেখুন...