বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট: রাজনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে
মানুষের ইতিহাসের সুদূর অতীতে যাযাবর বৃত্তির কথা তোমরা জেনেছ। নিরাপদ জীবন এবং খাদ্যের সংস্থানে মানুষ এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাতায়াত করত। এই প্রক্রিয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়া এবং বাংলা অঞ্চলের তৈরি হয়েছিল এক গভীর সংযোগ। বিশ্বের নানান অংশ থেকে বিভিন্ন যোদ্ধাদল, শাসক, বণিকগোষ্ঠী ভারতবর্ষ এবং ভারতবর্ষের পূর্বপ্রান্তের দিকে এসেছে, সম্পদ ও ক্ষমতা দখল করেছে, শাসন ও শোষণ করেছে, অনেকেই বসতি স্থাপন করেছে এবং ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতি নির্মাণ ও বিনির্মাণে ভূমিকা রেখেছে।
শাসকশ্রেণির নির্ধারণ করে দেওয়া রাজস্ব প্রদান করে, বিধিবিধান মেনে নিয়েই মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালিয়ে গেছেন। তবে মানুষ যে সব সময়ই বিনা বাক্য ব্যয়ে শাসকদের সকল আদেশ মেনে গৎবাঁধা জীবনযাপন করেছে তা কিছুতেই বলা যাবে না। বিভিন্ন সময়েই দেখা যায়, অত্যাচারী শাসককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবার জন্য মানুষ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে, বিপ্লব ও বিদ্রোহ করেছে। এসবের মধ্য দিয়েই মানুষ ক্রমে ক্রমে নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।
রাষ্ট্র ও রাজতন্ত্রের গোঁড়ার কথা
পৃথিবীতে প্রথম কবে রাজা ও রাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছিল? বিভিন্ন গবেষণার আলোকে ইতিহাসের পণ্ডিতগণ বলে থাকেন যে, আজ থেকে প্রায় সাত-আট হাজার বছর আগেই মানুষ যখন নগর সভ্যতা গড়ে তুলতে শুরু করে, তখনই রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজনৈতিক সংগঠন এবং রাজতন্ত্রের সূচনা হয়। এই রাষ্ট্র বা রাজ্যব্যবস্থার উদ্ভবের পেছনেও কৃষির ভূমিকা ছিল ব্যাপক। আদি যুগের শিকার ও সংগ্রহজীবী মানুষ যখন স্থায়ী বসতি স্থাপন করে কৃষিকাজ শুরু করে তখন তাদের জীবনব্যবস্থা বদলে যায়। কৃষি জমির চাহিদা বেড়ে যায়। জমির উপর ব্যক্তির মালিকানা প্রতিষ্ঠা এবং তা রক্ষা করার প্রয়োজন হয়। কৃষি থেকে প্রচুর পরিমাণে সম্পদ উৎপাদিত হতে থাকে। শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ ঘটে। মানুষ যখন বনে-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে শিকার ও সংগ্রহ করে বেড়াতো তখন একেকটি গোত্রে একেকজন গোত্রপতি থাকত। কিন্তু স্থায়ী বসতি স্থাপনের পর গোত্র প্রথার পরিবর্তে বৃহৎ সমাজ গড়ে ওঠে। নানান শ্রেণি পেশার মানুষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই মানুষদের নিরাপত্তা, বাইরের আক্রমণ থেকে নিজেদের সুরক্ষা, আইন-কানুন তৈরি ও তা বাস্তবায়নের দরকার হয়। আর এভাবেই একটি শক্ত কাঠামো গড়ে ওঠে। গোত্রপতি বা দলপতিদের মধ্য থেকেই কেউ একজন আরও বেশি শক্তি অর্জন করে নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করে রাজার আসনে আসীন হন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন ধর্মগুরুরাও। রাজা এবং ধর্মগুরুরা মিলে নগরগুলোতে একটি শক্তিশালী রাজতান্ত্রিক কাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করেন। ধীরে ধীরে তাঁরা অনেক বেশি শক্তি ও সম্পদ সঞ্চয় করেন। নিজেদের জন্য সুরক্ষিত দুর্গের ভেতর উন্নত বাসস্থান নির্মাণ করেন। সশস্ত্র প্রহরী দিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। এভাবে সমাজে অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষ থেকে রাজা ও ধর্মগুরুরা নিজেদের আলাদা করে ফেলেন। নগরের সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, বণিক ও কৃষকদের নিরাপত্তা দেবার নাম করে কর বা খাজনা আদায় করেন। বিপুল অর্থের মালিকানা লাভ করেন। শুধু তা-ই নয়, একজন শাসক বা রাজার মৃত্যুর পর তাঁর সন্তানই যেন রাজা হয়, সেই ব্যবস্থাও তাঁরা করে যান। এভাবেই রাজা ও রাজতন্ত্রের উদ্ভব হয়।
প্রাচীন মিশর, মেসোপটেমিয়া, হরপ্পা, গ্রিক-রোমান সভ্যতাগুলোর বিকাশের সঙ্গে এই রাজতন্ত্রের বিকাশের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। রাজ্য ও রাজতন্ত্রের আদি রূপ দেখা যায় এই সভ্যতাগুলোতেই। রাজা ছিলেন একজন যোদ্ধা ও যোদ্ধাদের প্রধান। তার জীবন ছিল অসীম সম্পদ আর ক্ষমতায় পূর্ণ। রাজার সহযোগী ধর্মগুরু, উপদেষ্টা এবং সেনাপতিরাও ছিলেন সেই ক্ষমতার অংশ। তারা ছিলেন অভিজাত শ্রেণির অন্তর্গত। রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধির আরও একটি প্রধান উপায় ছিল যুদ্ধবিগ্রহ। বিভিন্ন নতুন অঞ্চলে আক্রমণ করে, ধন-সম্পদ লুট করে রাজারা নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি করতেন। পরাজিত এলাকা থেকে সাধারণ মানুষদের বন্দি করে নিয়ে এসে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিতেন। নিজেদের সেবায় নিয়োজিত করতেন। অন্যদিকে রাজা ও পুরোহিতেরা সাধারণ মানুষের জন্য রচনা করতেন এমনকিছু আইন যার ফলে রাজা ও রাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের আনুগত্য বৃদ্ধি পেত। নিয়মিত কর-খাজনা দিয়ে, রাজার আদেশ মেনে চলতে বাধ্য হতো।
প্রাচীন মিশরের রাজা (ফারাও): নিজেদের দাবি করতেন তারা দেবতার বংশধর
কৃষির উপর ভিত্তি করে প্রাচীন মিশরে যখন নগর গড়ে ওঠে তখনই সেখানে রাজা এবং রাজতন্ত্রের সূচনা হয়। মিশরীয় রাজাদের উপাধি ছিল ফারাও বা ফেরাউন। ফারাও শব্দের অর্থ হচ্ছে, সুবৃহৎ বাড়ি। মিশরের রাজাগণ সুবিশাল প্রাসাদে বসবাস করতেন বলেই হয়তো তাদের এই নাম দেওয়া হয়। আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে মিশরে রাজতন্ত্রের সূচনা হয় এবং একে একে অনেকগুলো রাজবংশের উত্থান ঘটে সেখানে। মিশরের বিখ্যাত ফারাওদের মধ্যে মেনেস, কুফু, আমেন হোটেপ এবং তুতেনখামেনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
নেফারতিতির সমাধি-মন্দিরের দেয়ালে আঁকা চিত্রে দেখানো হয়েছে, তিনি বসে 'সেনেট' নামের একটা খেলা খেলছেন। অনুমান করা হয়, খেলাটা বর্তমান দাবা খেলার মতন কোনো খেলা ছিল।