এই অধ্যায় পাঠ করে আমরা ধারণা নিতে পারব-
১. পরমতসহিষ্ণুতা বলতে কী বোঝায়;
২. পরমতসহিষ্ণুতার প্রয়োজনীয়তা:
৩. পরমতসহিষ্ণুতার গুরুত্ব।
শ্রেণিতে সবাই মিলে যেকোনো বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবাই তোমাদের নিজ নিজ মতামত চিরকুটে লিখে মতামত বাক্সে জমা দাও।
বিভিন্ন মতামত থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভিজ্ঞতাটি লেখো।
|
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
তোমরা ইতিমধ্যে গৌতমবুদ্ধের জীবন ও বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে জেনেছ। বুদ্ধ কোনো নির্দিষ্ট জাতি, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের জন্য আবির্ভূত হননি। তিনি ছিলেন জগতের সব সত্তার জন্য শান্তি ও কল্যাণকামী মহামানব। তাঁর কোনো বাণীর আবেদনও কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ছিলেন সর্বজনীন মূল্যবোধের মূর্ত প্রতীক। সব সত্তার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলই তাঁর ধ্যান, জ্ঞান ও দর্শনের মূল ভিত্তি। জগতের সবাই তাঁর আপন। তিনি সব সময় সব সত্তার কল্যাণেই নিবেদিতপ্রাণ। অপরের মত ও ধারণা তাঁর চিন্তার বিষয় নয়। অপরের মঙ্গল ও দুঃখমুক্তিই ছিল তাঁর ভাবনার বিষয়। তাঁর অন্তরে সব সময় বিরাজিত ছিল পরমতসহিষ্ণুতা।
গৌতমবুদ্ধের আবির্ভাব খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে; প্রাচীন ভারতের সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবেশে। সে সময় জাতিভেদ ও বর্ণবৈষম্য প্রথার প্রচলন ছিল। শ্রেণি বিভাজনের প্রকোপ ছিল সমাজ প্রগতির প্রধান অন্তরায়। কিন্তু সে প্রাচীন কুসংস্কার গৌতমবুদ্ধকে স্পর্শ করেনি। তথাগত বুদ্ধ প্রচার করলেন মানুষে মানুষে কোনো ভেদ নেই। জন্ম দিয়ে মানুষের শ্রেণি বিভাজন হয় না। মানুষের প্রকৃত পরিচয় তার কর্মে। তিনি মনে করতেন যেকোনো ব্যক্তি জন্মগত পরিচয়ে ভিন্ন মতাদর্শের হলেও মানুষ হিসেবে সবাই অখণ্ড মানব সমাজের উপাদান। সে অর্থে মানুষ পরস্পর সম্পর্কিত ও নির্ভরশীল। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় ও গোত্র ইত্যাদি ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করার জন্য পরিচায়ক শব্দমাত্র। তথাগত বুদ্ধ সর্বজনীন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে আত্মসচেতন হতে পরামর্শ দিয়েছেন। আত্মপ্রদীপ প্রজ্বালনের কথা বলেছেন: বিবেক জাগ্রত করার উপদেশ দিয়েছেন। যার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে চিনতে পারবে। নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। সমাজে বসবাসের ক্ষেত্রে নিজের করণীয় বা আচরণ সম্পর্কে সচেতন হবে। একইসঙ্গে পারস্পরিক মূল্যবোধ ও সম্মানবোধ সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে সবাই সচেষ্ট হবে। বুদ্ধের বাণী ও শিক্ষা-এ আহ্বান নিয়েই বিকশিত হয়েছে। মানুষে মানুষে এই অকৃত্রিম আন্তরিক সম্পর্ক হলো পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতার পরিচায়ক। এরকম আন্তঃসম্পর্কের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে যে পারস্পরিক সহায়তা ও সহানুভূতির বোধ সৃষ্টি হয়, সেটিই হলো পরমতসহিষ্ণুতা। পারস্পরিক প্রীতি সম্পর্ক সৃষ্টিতে এর চর্চার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। এই চর্চা হবে অসাম্প্রদায়িক এবং সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে, যা মানুষের - মনুষ্যত্ববোধ ও মানবিকতাকে বিকশিত করবে। এর জন্য মানুষের সৎ ও ন্যায়পরায়ণ হওয়া যেমন প্রয়োজন, - তেমনি পরমতসহিষ্ণু হওয়াও একান্ত আবশ্যক। এই পরমতসহিষ্ণুতা হলো অপরের মতাদর্শ বা মতামতকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে বিবেচনা করা। পরমতসহিষ্ণুতা ছাড়া পরস্পরের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে না; আন্তঃ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও সৃষ্টি হয় না। পরমতসহিষ্ণুতা ঐক্য ও সম্প্রীতির অনন্য উৎস।
অন্যেরা যখন মতামত দেয়, তখন আমাদের কী করা উচিত?
ক) কথা বলা;
খ) জোরে আওয়াজ করা;
গ) ধৈর্যসহকারে শোনা;
ঘ) নিজের খুশিমতো কাজ করা।
তথাগত বুদ্ধের সমকালীন ভারতবর্ষে প্রায় বাষট্টি প্রকার ধর্মমতের প্রচলন ছিল। বিভিন্ন মুনি-ঋষির নিজস্ব সাধনা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে এই ধর্মমতগুলোর উদ্ভব। সেই ধর্মমত প্রবর্তনকারী অনেক মুনি-ঋষির সঙ্গে বুদ্ধের যোগাযোগ ছিল। তাঁদের মধ্যে জীবন ও জগতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনাও হতো। এই আলোচনার লক্ষ্য ছিল পরস্পরকে বোঝা। অন্যের মতাদর্শকে উপলব্ধি করা। বুদ্ধ অপর কোনো ধর্মীয় মত ও পথকে কেন্দ্র করে কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি বরং তাঁর নিজের ধর্ম-দর্শন সম্পর্কে বলেছেন, 'এসো, দেখো, উপলব্ধি করো, স্বীয় জ্ঞানে বিশ্লেষণ করো, প্রয়োজন মনে হলে গ্রহণ করো।' তিনি বলেছেন, কোনো অদৃশ্য শক্তির প্রতি নিজেকে সমর্পণ নয়, আপন কর্মের মাধ্যমে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হতে; প্রত্যেকের নিজ নিজ অন্তর চৈতন্যে জ্ঞানের আলোয় প্রদীপ্ত করতে। যার মাধ্যমে মানুষ কর্মে ও চিন্তায় সত্য, সুন্দর ও নিষ্ঠাবান হয়। অর্থাৎ, কে কোন ধর্মমতের অনুসারী সেটি বড় কথা নয়, নিজের চেতনা ও কর্মকে আদর্শবান ও নৈতিকতাসম্পন্ন করা একান্ত আবশ্যক। এভাবে তিনি সব মতাদর্শের সঙ্গে তাঁর চিন্তার সমন্বয় করতেন। সে কারণে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তাঁর ধর্মাদর্শে স্থান পেয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা ছাড়া সর্বজনীন সম্প্রীতি গড়ে ওঠে না। আবার এই বোধ ছাড়া পরিবার, সমাজ এমনকি ব্যক্তিগত জীবনেও শান্তিময় পরিবেশ সৃষ্টি হয় না। তাই মানুষের জীবনে পরমতমহিষ্ণুতার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। বলা যায় মানুষের জীবনে পরিবার ও সমাজে পারস্পরিক সম্প্রীতি গড়ে তোলার জন্য পরমতসহিষ্ণুতার প্রয়োজন অপরিসীম।
নিচের ছক দুটি পূরণ করো।
নিজের মত জোর করে অন্যের ওপর চাপিয়ে দিলে কী ঘটে? | অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দিলে কী ঘটে? |
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
বুদ্ধ বলেছেন-
মা জাতিং পুচ্ছি চরণঞ্চ পুচ্ছ, কণ্ঠ হবো জাযতি জাতবেদো;
নীচাকুলীনোপি মুনী ধিতীমা, আজানিষ হোতি হিরীনিসেধো।
অর্থাৎ, কারো জাতি-সম্প্রদায় পরিচয় জানার প্রয়োজন নেই, ব্যক্তির কর্ম ও আচরণ হলো অনুসন্ধানের বিষয়, কাঠ থেকে যেমন আগুনের উৎপত্তি হয়; তেমনি কেউ নীচকুলে জন্ম নিলেও বিবেক, সংযম ও নৈতিকতার মাধ্যমে উচ্চবংশীয় আচরণ বা নিজের আচরণ পরিশীলিত ও উন্নত করতে পারেন।
বুদ্ধ আরও বলেছেন-
পরম্স চে ধম্মমনানুজানং, বালো'মকো হোতি নিহীনপঞ্চো:
সন্ধেব বালা সনিহীন পঞ্চা, সব্বেবিমে দিষ্ঠিপরিক্সসানা।
নিজ নিজ দৃষ্টির অনুগামী মানুষ কলহে নিযুক্ত হয়ে নিজেদের (জাহির করে) পণ্ডিত হিসেবে ঘোষণা করে- এটি অনুচিত, যার এ জ্ঞান আছে, ধর্ম তাঁর জানা; যে এর বিরুদ্ধাচরণ করে, সে পরিপূর্ণতাহীন। পরের ধর্ম স্বীকার না করা মানে জ্ঞানহীনতার পরিচয়, নিজ নিজ দৃষ্টির দাস।
বুদ্ধ বলেছেন-
সকচ্ছি ধম্মং পরিপুগ্নমাহ, অঞ্চস্প ধম্মং পন হীনমাহ;
এবম্পি বিগ্নহ বিবাদযন্তি, সকং সকং সম্মুতিমাহ সচ্চং।
নিজের ধর্ম সর্বাঙ্গ পরিপূর্ণ, অন্যের ধর্ম নিকৃষ্ট বা হীন, মানুষ এভাবে ভিন্নমত হয়ে বিবাদ করে, তারা নিজ নিজ মতকে সত্য বলে মনে করে। এভাবে নিজের ধর্মকে সত্য বলে দাবি করে অন্যদের হীন ভাবা অনুচিত।
সুতরাং, জগতের সব জাতি, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সম্মিলনে গঠিত হয় বৃহত্তর মানব জাতি। যেখানে জন্ম ও কোনো ধর্মীয় মতাদর্শ বিশ্বাসের জন্য আমরা পৃথক পরিচয় সৃষ্টি করি। এই পরিচয় মূলত মানবতাকেই খণ্ডিত করে। তাই মানুষ হিসেবে সবার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার দায়িত্ব কর্তব্যবোধে আমাদের উজ্জীবিত হওয়া আবশ্যক। সবার ধর্ম বিশ্বাস থাকবে নিজের অন্তরে, আচরণ হবে সর্বজনীন কল্যাণ ও মঙ্গলমূলক। এর জন্য পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা অত্যাবশ্যক। পরমতসহিষ্ণুতা ছাড়া এরকম সর্বজনীন সর্বঙ্গীণ কল্যাণময় লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।
পরমতসহিষ্ণুতা, সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতাবোধ মানবজীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর চর্চা ছাড়া পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে কখনো সুন্দর মানবিক পরিবেশ গড়ে ওঠে না। তাই তথাগত বুদ্ধ সর্বক্ষেত্রে পারস্পরিক মৈত্রী ও সম্ভাব বজায় রাখার উপদেশ দিয়েছেন। এর মাধ্যমে মানুষের মন উদার ও সংকীর্ণতাহীন হয়। আমাদের জীবনে এই পারস্পরিক সুসম্পর্ক বা সৌহার্দ্যবোধের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। এই সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতাবোধের কারণেই মানুষের অন্তর থেকে শত্রুতা ও হিংসাভাব দূর হয়। মনে হিংসার পরিবর্তে সম্প্রীতিবোধ সৃষ্টি হয়। মানবিক মূল্যবোধে উদ্বোধিত মানুষের অন্তর্জগৎ। এ প্রজ্ঞার আলোয় একে অন্যের মত ও আদর্শকে বিবেচনা করবে। কর্ম ও পরিশীলিত আচরণেই ব্যক্তির প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়। তথাগত বুদ্ধ কথা বলেছেন-
কম্মুনা বত্ততি লোকে, কম্মুনা বত্ততি পজা,
কম্ম নিবন্ধনা সত্তা, রথস্পাণীব যাযতো। (বাসেষ্ঠ৬১)
কর্মের দ্বারা জগতের উৎপত্তি, কর্মের দ্বারাই মানব জন্মের সৃষ্টি; চলন্ত রথের চাকার মতো সত্ত্বগণ কর্মের মধ্যেই আবদ্ধ থাকে।
সুতরাং এখানে জন্ম বা সম্প্রদায়ভিত্তিক পরিচয় দিয়ে মানুষকে বিভাজন করা যায় না; এতে মূলত মানবতারই বিভাজন হয়, মনুষ্যত্ব ও মানবিক মূল্যবোধের অখণ্ডতাই বিভাজিত হয়। পরমতসহিষ্ণুতা এই বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে। সেজন্য পরমতসহিষ্ণুতার অনুশীলনের গুরুত্ব অপরিসীম। তথাগত বুদ্ধ আরোও বলেছেন-
ন পরো পরং নিকুক্সেথ নাতিমঞ্চেথ কথচি নং কিঞ্চি,
ব্যারোসনা পটিঘসঞ্চা নাঞ্চমঞ্চস্স দুদ্ধমিচ্ছেয্য। (করণীয় মৈত্রীসূত্র-৬)
অর্থাৎ, একে অপরকে বঞ্চনা করো না, কাউকে কিছুতেই কায়বাক্য দিয়ে ঘৃণা করো না, ক্রোধ ও হিংসার কারণে কাউকে অনিষ্ট করার ইচ্ছা করো না। এভাবে বুদ্ধ পারস্পরিক সমন্বয় সাধন করে পরমতসহিষ্ণুতা জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনুশীলন করার উপদেশ দিয়েছেন। আমাদের বর্তমান সামাজিক সংস্কৃতিতে পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা করা অপরিহার্যভাবে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে আন্তঃসামাজিক ও আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে এটির অনুশীলনের অশেষ গুরুত্ব রয়েছে
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
সাত দিনের কার্যক্রম ছক পূরণ করে তোমার ডায়েরিতে লাগিয়ে শিক্ষককে দেখাবে।
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
ফিরে দেখা: নিচের তালিকার সকল কাজ কি আমরা শেষ করেছি? হ্যাঁ হলে হ্যাঁ ঘরে এবং না হলে না এর ঘরে (✔) চিহ্ন দাও।
অংশগ্রহণমূলক কাজ নং | সম্পূর্ণ করেছি | |
হ্যাঁ | না | |
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
আরও দেখুন...