মদিনা সনদ
মদিনায় এসে মহানবি (সা.) একটি আদর্শ জাতি ও রাষ্ট্র গঠনে মনোনিবেশ করেন। প্রথমে তিনি আরবদের চিরাচরিত গোত্রীয় পার্থক্য তুলে দেন। আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে একতা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করেন। তিনি অন্যান্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেন এবং সকলকে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেন। তিনি একটি কল্যাণকর সমৃদ্ধ জাতি গঠন ও সর্বধর্মীয় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য মদিনা ও আশেপাশের অঞ্চলসমূহের মুসলমান, ইহুদি ও পৌত্তলিকদের নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষর করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এটা মদিনা সনদ (The Charter of Medinal নামে পরিচিত। এ সনদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ধারা নিম্নরূপ:
মদিনা সনদ
১. বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, এটা মহানবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর পক্ষ থেকে লিখিত অঙ্গীকারনামা।
২. মদিনার পৌত্তলিক, ইহুদি এবং মুসলমান সবাই মিলে এক জাতি (উন্মাত)।
৩. মুসলিম, ইহুদি ও অন্যান্য সম্প্রদায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করবে না।
৪. চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী কোনো সম্প্রদায় বাইরের শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে মদিনার সকল সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবে সে আক্রমণকে প্রতিহত করবে।
৫. দুর্বল ও অসহায়কে রক্ষা ও সাহায্য করতে হবে।
৬. এখন হতে মদিনায় রক্তপাত, হত্যা ও রাহাজানি নিষিদ্ধ করা হলো।
৭. স্বাক্ষরকারী কোনো সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত হবে। সেজন্য অপরাধীর সম্প্রদায়কে দায়ী করা যাবে না।
৮. কেউ কুরাইশদের সাথে কোনো প্রকার গোপন সন্ধি করতে পারবে না; কিংবা মদিনাবাসীর বিরুদ্ধে কুরাইশদের সাহায্য করতে পারবে না।
৯. চুক্তিপত্রের পক্ষগুলোর বিরুদ্ধে কেউ লড়াই করলে পক্ষগুলো পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে তা প্রতিহত করবে এবং পক্ষগুলো নিজেদের মধ্যে পরামর্শ ও কল্যাণকামিতা বজায় রাখবে।
১০. চুক্তির পক্ষগুলোর জন্য ইয়াসরিব একটি সংরক্ষিত ও পবিত্র নগরী হিসেবে বিবেচিত হবে।
১১. ইয়াসরিবকে কেউ আক্রমণ করলে চুক্তির সকল পক্ষ পারস্পরিক সাহায্যের মাধ্যমে তা প্রতিহত করবে।
১২. প্রতিবেশীকে নিজের মতোই গণ্য করতে হবে। তার কোনো ক্ষতি বা তার প্রতি কোনো অপরাধ করা যাবে না।
১৩. কোনো বিষয়ে যখনই মতানৈক্য হবে, তখন তা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের কাছে ন্যস্ত করতে হবে।
১৪. অঙ্গীকার রক্ষা করতে হবে, ভঙ্গ করা যাবে না।
মদিনা সনদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
মদিনা সনদ মহানবি (সা.) -এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে। এই সনদে সকলের ধর্মীয় স্বাধীনতার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এর মাধ্যমে মদিনাবাসী একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত হয় এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়। মহানবি (সা.) মদিনা পুনর্গঠনের সুযোগ পান। ফলশ্রুতিতে তাঁর ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়।
এই সনদ মদিনার সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও নাগরিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এর ফলে শতধাবিভক্ত আরবদের মধ্যে ঐক্য স্থাপিত হয়। অনেক আগে থেকে চলে আসা গৃহযুদ্ধ ও অনৈক্যের পরিবর্তে ইয়াসরিবে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম অমুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে ওঠে। সকলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত হয়। সর্বোপরি এই সনদের মাধ্যমে ইসলামের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বিশ্ববাসীর নিকট ইসলামের সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব, পরমতসহিষ্ণুতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে।
ইসলামের বিধানসমূহ প্রবর্তন
মহানবি (সা.)-এর মদিনা জীবনের শুরুটা ছিল ইসলামের বিধান প্রবর্তনের সময়। মদিনা জীবনের শুরুতেই ৬২২ খ্রিস্টাব্দে আজানের রীতি প্রবর্তিত হয়। ৬২৩ খ্রিস্টাব্দে মহান আল্লাহ বায়তুল মুকাদ্দাস -এর পরিবর্তে বায়তুল্লাহকে কেবলা নির্ধারণ করেন। একই বছরে মুসলমানদের জন্য রমযানের এক মাস সাওম পালনের বিধান প্রবর্তিত হয়। এ বছরেই মুসলমানদের প্রধান দু'টি ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা উদযাপন শুরু হয়। এছাড়াও এই বছরে ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ যাকাতের বিধান নাযিল হয়।
আরও দেখুন...