১১.১ স্নায়ুতন্ত্র
মানুষের দেহের যে তন্ত্র শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কাজকর্ম পরিচালনা করে, সমন্বয় সাধন করে এবং বাইরের উদ্দীপনায় সাড়া দেয় তাকে স্নায়ুতন্ত্র (Nervous system) বলে। মানুষের দেহের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রীয় অংশে রয়েছে মস্তিষ্ক আর ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী স্নায়ুতন্ত্র। স্নায়ুতন্ত্র প্রধান দুটি ভাগে বিভক্ত- কেন্দ্রীয় এবং প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্র।
১১.১.১ কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র (Central nervous system)
মস্তিষ্ক এবং মেরুরজ্জু বা সুষুম্নাকাণ্ড (Spinal cord) দিয়ে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র গঠিত। মস্তিষ্ক করোটিকার ভেতরে এবং মেরুরজ্জু মেরুদণ্ডের ভেতরে সুরক্ষিত থাকে।
মস্তিষ্ক (Brain)
তোমরা সবাই মস্তিষ্ক কী সেটি জান, এটি মেরুরজ্জু বা স্পাইনাল কর্ডের উপরে করোটিকার মাঝে থাকা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের স্ফীত অংশটি। মানুষের মস্তিষ্ক শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। মস্তিষ্ক স্নায়ুতন্ত্রের পরিচালক, এটি শরীরের প্রতিটি অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে, শুধু তাই নয় এটি মানুষের অনুভূতি এবং চিন্তাকেও নিয়ন্ত্রণ করে। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের ওজন 1.4 kg। মস্তিষ্ক তিনটি অংশে বিভক্ত, সেরিব্রাম, স্টেম এবং সেরিবেলাম (চিত্র ১১.১)।
চিত্র: ১১.১: মস্তিষ্কের লম্বচ্ছেদ
সেরিব্রাম: মস্তিষ্কের উপরের সবচেয়ে বড়ো অংশটিকে বলে সেরিব্রাম। সেরিব্রামের ডান ও বাম অংশদুটি সম্পূর্ণভাবে বিভক্ত। দুটি অংশের মাঝখানে বিভেদক খাঁজ থাকায় এ বিভক্তি ঘটে। এই দুই ভাগকে সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার (Cerbral hemisphere) বলা হয়। সেরিব্রামের ডান ও বাম হেমিস্ফিয়ারের মধ্যে খাঁজ থাকলেও এ দুটি অংশ একগুচ্ছ নিউরন দিয়ে সংযুক্ত থাকে, যার নাম কর্পাস ক্যালেসাম। বাম সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার দেহের ডান অংশ এবং ডান সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার দেহের বাম অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে। সেরিব্রামের উপরে অনেক রকম খাঁজ এবং ভাঁজ রয়েছে। সেরিব্রাম আমাদের চিন্তা, চেতনা, জ্ঞান, স্মৃতি, ইচ্ছা, বাকশক্তি ও ঐচ্ছিক পেশির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া কোনো উদ্দীপকের প্রতি কী ধরনের সাড়া দেবে সে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
স্টেম: মস্তিষ্কের যে অংশটি স্পাইনাল কর্ড বা মেরুরজ্জুর সঙ্গে যুক্ত থাকে তাকে স্টেম বলে। মানুষের শরীরের যে কাজগুলো নিজ থেকে ঘটতে থাকে-যেমন- হৃদস্পন্দন, শ্বাসপ্রশ্বাস, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, তাপমাত্রা ইত্যাদি স্টেম নিয়ন্ত্রণ করে।
সেরিবেলাম: মাথার পিছন দিকে স্টেম এবং সেরিব্রামের মাঝখানে রয়েছে সেরিবেলাম। এটি দেহের পেশির টান নিয়ন্ত্রণ, চলনে সমন্বয় সাধন, দেহের ভারসাম্য রক্ষা, দৌড়ানো এবং লাফানোর কাজে জড়িত পেশিগুলোর কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করে।
মস্তিষ্ক থেকে বারো জোড়া করোটিক স্নায়ু বের হয়ে মাথা, ঘাড়, মুখমণ্ডল, মুখগহ্বর, জিহ্বা, চোখ, নাক, কান ইত্যাদি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এর স্নায়ু খাদ্য গলাধঃকরণ এবং হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, গলবিল ইত্যাদির কিছু কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া এই স্নায়ুগুলো শ্রবণ এবং ভারসাম্য রক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গেও জড়িত।
মেরুরজ্জু (Spinal cord):
মেরুরজ্জু করোটির পিছনে অবস্থিত ছিদ্র থেকে দিয়ে বের হয়ে মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে সুরক্ষিত অবস্থায় কটিদেশ পর্যন্ত গিয়েছে। মেরুদণ্ডের হাড়ের মধ্যবর্তী ছিদ্র দিয়ে মেরুরজ্জু থেকে 31 জোড়া মেরুরজ্জীয় স্নায়ু (Spinal nerves) বের হয়। এসব ঘাড়, গলা, বুক, পিঠ, হাত ও পায়ের স্নায়ু।
১১.১.২ প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্র (Peripheral nervous system)
মস্তিষ্ক থেকে 12 জোড়া এবং মেরুমজ্জা বা সুষুম্না কাণ্ড থেকে যে 31 জোড়া স্নায়ু বের হয়ে আসে সেগুলো সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর শাখায় বিভক্ত হয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এগুলোকে একত্রে প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্র বলে (চিত্র ১১.২)। মস্তিষ্ক থেকে উৎপন্ন করোটিক স্নায়ু চোখ, নাক, কান, জিহ্বা, দাঁত, মুখমণ্ডল, হৃৎপিণ্ড, পাকস্থলি প্রভৃতি অঙ্গের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। মেরুরজ্জু থেকে বের হওয়া স্নায়ুগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চালনা করে এবং দেহের বাকি অংশ থেকে সকল অনুভূতি মস্তিষ্কে বয়ে নিয়ে যায়।
প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আবার সোমাটিক স্নায়ুতন্ত্র এবং স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
সোমাটিক স্নায়ুতন্ত্র (Somatic Nervous System)
প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্রের যে অংশ আমাদের শরীরের হাড় বা অস্থির সঙ্গে সংযুক্ত মাংসপেশি ব্যবহার করে নাড়াচাড়া করে তাকে সোমাটিক স্নায়ুতন্ত্র বলে। আমরা সজ্ঞানে আমাদের শরীরের হাত, পা কিংবা অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো কোনো অংশ যখন চালনা করি বা নাড়াই তখন সোমাটিক স্নায়ুতন্ত্র সেটিকে চালনা করে। আমরা যখন হাত দিয়ে কিছু ধরতে চাই কিংবা পা দিয়ে ধাক্কা দিতে চাই তখন সোমাটিক স্নায়ুতন্ত্র হাত কিংবা পায়ের মাংসপেশিতে প্রয়োজনীয় সিগনাল পাঠায়।
স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র (Autonomic nervous system):
যেসব অঙ্গের উপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই সেগুলো স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র দিয়ে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। দেহের ভিতরের অঙ্গগুলো, যেমন- হৃৎপিণ্ড, অন্ত্র, পাকস্থলি, অগ্ন্যাশয় ইত্যাদির কাজ স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র দিয়ে পরিচালিত হয়। এসব তন্ত্রের কার্যকারিতার উপর মস্তিষ্ক ও মেরুরজ্জুর প্রত্যক্ষ প্রভাব না থাকায় এরা অনেকটা স্বাধীন এবং স্বতন্ত্রভাবে আপন কাজ সম্পাদন করে। স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র আবার সিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্র এবং প্যারাসিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্র এই দুই ভাগে বিভক্ত। হঠাৎ করে বিপজ্জনক কিংবা উত্তেজক কিছু কিছু দেখলে সিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্র সক্রিয় হয়ে আমাদের হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে তোলে, মাংসপেশি শক্ত করে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু একটা করার জন্য শরীরকে প্রস্তুত করে তোলে। শরীর হঠাৎ করে উত্তেজিত হওয়ার পর শরীরকে শান্ত করার জন্য প্যারাসিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্র কাজ করে থাকে।
১১.১.৩ নিউরন (neuron):
যে কলা বা টিস্যু দেহের সব ধরনের সংবেদন এবং উদ্দীপনা গ্রহণ করে এবং তা পরিবহণের মাধ্যমে উদ্দীপনা অনুসারে উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে সেটাই হচ্ছে স্নায়ুটিস্যু বা স্নায়ুকলা। স্নায়ুতন্ত্রের গঠন এবং কার্যক্রমের একককে বলে স্নায়ুকোষ বা নিউরন (চিত্র ১১.৩)। বহু সংখ্যক স্নায়ুকোষ বা নিউরন মিলে স্নায়ুটিস্যু গঠিত। প্রতিটি নিউরন দুটি অংশ নিয়ে গঠিত, কোষদেহ এবং প্রলম্বিত অংশ।
কোষদেহ:
প্লাজমামেমব্রেন, সাইটোপ্লাজম আর নিউক্লিয়াস নিয়ে গঠিত নিউরনের গোলাকার, তারকাকার, অথবা ডিম্বাকার অংশ কোষদেহ নামে পরিচিত। এখানে সাইটোপ্লাজমে, মাইটোকন্ড্রিয়া, গলজিবস্তু, লাইসোজোম, চর্বি, গ্লাইকোজেন, রঞ্জক কণাসহ অসংখ্য নিসল দানা থাকে।
প্রলম্বিত অংশ
কোষদেহ থেকে সৃষ্ট শাখা-প্রশাখাকেই প্রলম্বিত অংশ বলে। প্রলম্বিত অংশ দুই ধরনের:
(1) ডেনড্রন (Dendron): কোষদেহের চারদিকের শাখাযুক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রলম্বিত অংশকে ডেনড্রন বলে। ডেনড্রন থেকে যে শাখা বের হয় তাদের ডেনড্রাইট বলে। একটি নিউরনে ডেনড্রন সংখ্যা শূন্য থেকে শতাধিক পর্যন্ত হতে পারে। এক নিউরনের ডেনড্রাইট অন্য নিউরন থেকে স্নায়ু তাড়না গ্রহণ করে।
(ii) অ্যাক্সন (Axon) কোষদেহ থেকে উৎপন্ন বেশ লম্বা তন্তুটির নাম অ্যাক্সন। এর চারদিকে পাতলা আবরণটিকে নিউরিলেমা বলে। নিউরিলেমা এবং অ্যাক্সনের মাঝখানের অংশটিতে স্নেহ পদার্থের একটি স্তর থাকে, যাকে মায়েলিন (Myelin) বলে। অ্যাক্সনের শেষ মাথা অ্যাক্সন টারমিনালে বিভক্ত হয়ে যায়, এবং এই টারমিনালগুলো দিয়ে একটি নিউরন অন্য নিউরনের ডেনড্রাইটে স্নায়ু তাড়না পাঠায়।
একটি নিউরনের অ্যাক্সনের টারমিনালের সঙ্গে দ্বিতীয় একটি নিউরনের ডেনড্রাইট সরাসরি যুক্ত থাকে না, মাঝখানে একটু ফাঁকাস্থল থাকে। এই সূক্ষ্ম ফাঁকা সংযোগস্থলকে সিন্যাপস (Synapse) বলে, অর্থাৎ দুটি নিউরনের সন্ধিস্থল হলো সিন্যাপস। অ্যাক্সন টারমিনাল সিন্যাপসের মধ্য দিয়ে তড়িৎ রাসায়নিক (Electro chemical) পদ্ধতিতে স্নায়ু তাড়না প্রবাহিত হয়। কোনো একটি নিউরনের মধ্য দিয়ে স্নায়ু তাড়না প্রবাহিত হয়ে সিন্যাপস অতিক্রম করে পরবর্তী নিউরনে যায়। অর্থাৎ এর ভিতর দিয়ে স্নায়ু উদ্দীপনা বা স্নায়ু তাড়না একদিকে পরিবাহিত হয়। মানুষের মস্তিষ্কে প্রায় একশ বিলিওন নিউরন রয়ছে এবং প্রতিটি নিউরন অন্য সাত থেকে দশ হাজার নিউরনের সঙ্গে সিন্যাপস সংযোগ করে থাকে।
কেউ যখন চিন্তা করে তখন এক নিউরন অন্য নিউরনের সঙ্গে সিনান্সের মাধ্যমে সংযোগ করে, কাজেই কেউ যদি একটি বই পড়ে, কিংবা একটা সমস্যার সমাধান করে তাহলে সে তার সুনির্দিষ্ট সিনান্স সংযোগ উজ্জীবিত করে মস্তিষ্ককে আরও কার্যক্ষম করে তোলে।
উদ্দীপনা সঞ্চালন (Transmission of Impulse)
পরস্পর সংযুক্ত অসংখ্য নিউরনতন্তুর ভিতর দিয়ে উদ্দীপনা বা তাড়না শেষ পর্যন্ত মস্তিষ্কে এসে পৌঁছায়। প্রতি সেকেন্ডে এর বেগ প্রায় 100 মিটার, তবে স্নায়ুর উপর নির্ভর করে এর কিছু তারতম্য হতে পারে। পরিবেশ থেকে যে সংকেত স্নায়ুর ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছে তাকে স্নায়ু-তাড়না বা স্নায়ু- উদ্দীপনা বলে। নিউরনের কার্যকারিতার কারণে এই উদ্দীপনা প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলোতে পাঠানো হয়। এটি মাংসপেশিতে পৌঁছালে পেশি সংকুচিত হয়ে সাড়া দেয়, ফলে প্রয়োজনমতো দেহের বিভিন্ন অঙ্গ সঞ্চালিত হয়। এই তাড়না গ্রন্থিতে পৌঁছালে সেখানে রস ক্ষরিত হয়। অনুভূতিবাহী স্নায়ু উত্তেজিত হলে সেই উত্তেজনা মস্তিষ্কের দিকে অগ্রসর হয়ে দেখা, শোনা, ছোঁয়া বা যন্ত্রণাবোধের অনুভূতি উপলব্ধি করায়।
একটি টর্চ লাইট দিয়ে তোমার বন্ধুর চোখে আলো ফেললে দেখবে আলো ফেলার সঙ্গে সঙ্গে চোখের পিউপিল ছোটো হয়ে যাবে। উদ্দীপনার আকস্মিকতায় আলোর উদ্দীপনাজনিত তাড়না চোখের আলো সংবেদী কোষ রেটিনা থেকে মস্তিস্কে পৌঁছালে, মস্তিষ্কের নির্দেশে পিউপিল ছোটো করে ফেলার জন্য আইরিশের বৃত্তাকার বা গোলাকার পেশি সংকুচিত করে ফেলা হয়।
১১.১.৪ প্রতিবর্তী ক্রিয়া (Reflex action)
প্রতিবর্তী ক্রিয়া বলতে উদ্দীপনার আকস্মিকতা এবং তার কারণে স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়াকে বোঝায়। হঠাৎ করে আঙুলে সুচ ফুটলে অথবা হাতে গরম কিছু পড়লে আমরা অতি দ্রুত হাতটি উদ্দীপনার স্থান থেকে সরিয়ে নেই, এটি প্রতিবর্তী ক্রিয়ার ফল (চিত্র ১১.৪)। আমরা চাইলেও প্রতিবর্তী ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, কারণ প্রতিবর্তী ক্রিয়া মস্তিষ্ক দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয় না, এটি মেরুরজ্জু বা স্পাইনাল কর্ড দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। যেসব উদ্দীপনার প্রতিক্রিয়া মস্তিষ্ক দিয়ে না হয়ে মেরুরজ্জু দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয় তাকে প্রতিবর্তী ক্রিয়া বলে।
অসতর্কভাবে জ্বলন্ত মোমবাতির আলোকশিখায় আঙুল চলে তাৎক্ষণিকভাবে হাত অন্যত্র সরে যাওয়ার
প্রতিবর্তী ক্রিয়াটি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়:
১১.১.৫ স্নায়বিক বৈকল্যজনিত কয়েকটি শারীরিক সমস্যা
(ক) প্যারালাইসিস (Paralysis): শরীরের কোনো অংশের ঐচ্ছিক মাংসপেশি ইচ্ছেমতো নাড়াতে পারার ক্ষমতা নষ্ট হওয়াকে প্যারালাইসিস বলে। সাধারণত মস্তিষ্কের কোনো অংশের ক্ষতির কারণে ঐ অংশের সংবেদন গ্রহণকারী পেশিগুলো কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। অনেক সময় স্ট্রোকের কারণে প্যারালাইসিস হয়ে থাকে। এছাড়া মেরুদণ্ডের বা ঘাড়ের স্পাইনাল কর্ডের আঘাত বা দুর্ঘটনাজনিত কারণেও প্যারালাইসিস হতে পারে।
(খ) এপিলেপসি (Epilepsy): এপিলেপসি বা মৃগী রোগ মস্তিষ্কের একটি রোগ যাতে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে খিঁচুনি বা কাঁপুনি দিতে থাকে। অনেকক্ষেত্রে এই রোগের কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ করেই সাময়িকভাবে কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, শরীর কাঁপুনি ও খিঁচুনি দিতে দিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, অনেকক্ষেত্রে রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়। এপিলেপসির মূল কারণ এখনও সম্পূর্ণভাবে জানা যায়নি। মাথায় আঘাতজনিত কারণে ম্যানিনজাইটিস, এনসেফালাইটিস, জন্মগত মস্তিষ্কের বিকৃতি, টিউমার ইত্যাদি কারণেও এপিলেপসির উপসর্গ দেখা দেয়।
(গ) পারকিনসন রোগ (Parkinson's disease): পারকিনসন রোগ মস্তিষ্কের এমন এক অবস্থা যার কারণে হাতে ও পায়ের কাঁপুনি হয় এবং আক্রান্ত রোগীর নড়াচড়া, হাঁটাহাটি করতে সমস্যা হয়। এ রোগ সাধারণত 50 বছরের বয়সের পরে হয়। স্নায়ুকোষ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে থাকে, যার একটি হলো ডোপামিন। ডোপামিন শরীরের পেশির নড়াচড়ায় সাহায্য করে। পারকিনসন রোগাক্রান্ত রোগীর মস্তিষ্কে ডোপামিন তৈরির কোষগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। ডোপামিন ছাড়া ঐ স্নায়ু কোষগুলো পেশি কোষগুলোতে সংবেদন পাঠাতে পারে না বলে মাংসপেশি তার কার্যকারিতা হারায়।
১১.২ অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিতন্ত্র (Endocrine System):
মানব দেহের একটি অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ তন্ত্র হচ্ছে অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিতন্ত্র। এই গ্রন্থিতন্ত্র মানব দেহের বেশকিছু নালিবিহীন গ্রন্থির সমন্বয়ে গঠিত (চিত্র ১১.৫)। এই নালিবিহীন গ্রন্থি নিঃসৃত রসকে হরমোন বলে। বিভিন্ন ধরনের হরমোন রক্তের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে দেহের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। যেহেতু হরমোন পরিবহণের জন্য পৃথক কোনো নালি নেই তাই এটি রক্তস্রোতের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যকোষে পৌঁছে কোষের প্রাণরাসায়নিক কার্যকলাপকে প্রভাবিত করে এবং জৈবিক কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে। সুস্থ দেহের চাহিদা অনুসারে গ্রন্থি থেকে নিয়মিত হরমোন নিঃসৃত হয়, তবে প্রয়োজন অপেক্ষা কম অথবা বেশি পরিমাণ হরমোন নিঃসৃত হলে শরীরে নানারকম অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
১১.২.১ মানব দেহের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থি
(ক) পিটুইটারি গ্রন্থি (Pitutary gland): মানব দেহের সবচেয়ে ছোটো এই গ্রন্থিটি মস্তিষ্কের নিচের অংশে অবস্থিত। সবচেয়ে ছোটো হলেও পিটুইটারি গ্রন্থি মানব দেহের প্রধান হরমোন উৎপাদনকারী গ্রন্থি। একদিকে পিটুইটারি গ্রন্থি সবচেয়ে বেশি হরমোন নিঃসৃত করে, অপরদিকে অন্যান্য গ্রন্থির উপর এসব হরমোনের প্রভাবও বেশি। এটি অন্যান্য গ্রন্থিকে প্রভাবিত করা ছাড়াও মানব দেহের বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
(খ) থাইরয়েড গ্রন্থি (Thyroid gland): থাইরয়েড গ্রন্থি গলায় ট্রাকিয়ার উপরের অংশে অবস্থিত। এই গ্রন্থি থেকে প্রধানত থাইরক্সিন হরমোন নিঃসরণ হয়। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন থাইরক্সিন (Thyroxin) সাধারণত মানব দেহে স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বিপাকীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। থাইরয়েডের আরেকটি হরমোন মানব দেহে ক্যালসিয়াম বিপাকের সঙ্গে জড়িত।
(খ) থাইরয়েড গ্রন্থি (Thyroid gland): থাইরয়েড গ্রন্থি গলায় ট্রাকিয়ার উপরের অংশে অবস্থিত। এই গ্রন্থি থেকে প্রধানত থাইরক্সিন হরমোন নিঃসরণ হয়। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন থাইরক্সিন (Thyroxin) সাধারণত মানব দেহে স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বিপাকীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। থাইরয়েডের আরেকটি হরমোন মানব দেহে ক্যালসিয়াম বিপাকের সঙ্গে জড়িত।
(ঘ) থাইমাস গ্রন্থি (Thymus gland): থাইমাস গ্রন্থি গ্রীবা অঞ্চলে অবস্থিত। থাইমাস গ্রন্থি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিকাশে সাহায্য করে। শিশুকালে এই গ্রন্থি বিকশিত থাকে পরে বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ছোটো হয়ে যায়। পূর্ণবয়স্ক মানুষে সাধারণত এই হরমোন থাকে না। এ গ্রন্থি বেশ কয়েকটি হরমোন তৈরি করে যা থাইমাসে শ্বেতকণিকা তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
(৫) অ্যাডরেনাল গ্রন্থি (Adrenal gland): অ্যাডরেনাল গ্রন্থি কিডনির উপরে অবস্থিত। অ্যাডরেনাল গ্রন্থি দেহের অত্যাবশ্যকীয় বিপাকীয় কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এই গ্রন্থি মূলত কঠিন মানসিক ও শারীরিক চাপ থেকে উদ্ধার পেতে সাহায্য করে। এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোনগুলোর একটি হচ্ছে অ্যাডরেনালিন (adrenalin)। অ্যাডরেনালিন হরমোন হৃৎপিণ্ড ও ধমনির অনৈচ্ছিক পেশির সংকোচন নিয়ন্ত্রণ করে ভয়, আনন্দ ও শোক প্রকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
(চ) আইলেটস অফ ন্যাংগারহ্যানস (Islets of langerhans): আইলেটস্ অফ ল্যাংগারহ্যানস অগ্ন্যাশয়ের মাঝে অবস্থিত, এই কোষগুচ্ছ শরীরের শর্করা বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে। এই গ্রন্থি ইনসুলিন (insulin) নিঃসরণ করে যা রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। যেহেতু ইনসুলিন দেহের শর্করা পরিপাক নিয়ন্ত্রণ করে, তাই অগ্ন্যাশয়ে যদি প্রয়োজনমতো ইনসুলিন তৈরি না হয় তবে রক্তে শর্করার পরিমাণ স্থায়ীভাবে বেড়ে যায়।
(ছ) পিনিয়াল বডি (Pineal body): এটি মস্তিষ্কের সঙ্গে সংযুক্ত একটি গোলাকার গ্রন্থি। এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন হলো মেলাটোনিন যেটি দেহের দিন-রাতের চক্র নিয়ন্ত্রণ করে।
(জ) গোনাড বা জনন অঙ্গ গ্রন্থি (Gonads): এটি মেয়েদের ডিম্বাশয় এবং ছেলেদের শুক্রাশয়ে অবস্থিত। জনন অঙ্গ থেকে নিঃসৃত হরমোন দেহের পরিণত বয়সের লক্ষণগুলো বিকশিত করতে ভূমিকা রাখে। প্রাণীর জনন অঙ্গের বৃদ্ধির পাশাপাশি এটি জননচক্র এবং যৌন আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। জনন অঙ্গ থেকে পরিণত বয়সের পুরুষ-দেহে টেস্টোস্টেরন (testosterone) এবং স্ত্রী-দেহে ইস্ট্রোজেন (estrogens) নামক হরমোন উৎপন্ন হয়।
১১.২.২ হরমোনজনিত কয়েকটি অস্বভাবিকতা
(a) থাইরয়েড সমস্যা: আয়োডিনযুক্ত খাবার খেলে থাইরয়েড হরমোন তৈরি হয়। সমুদ্রের পানিতে আয়োডিন থাকায় সামুদ্রিক মাছ মানুষের খাদ্যে আয়োডিনের অন্যতম মূল উৎস। আয়োডিনের অভাবে গলগণ্ড বা গয়টার রোগ হয়ে থাকে, তাই সমুদ্র থেকে দূরে অবস্থিত এলাকায় এক সময় এই রোগীর সংখ্যা বেশি পাওয়া যেত। খাদ্যে আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহারের কারণে আজকাল এই রোগের প্রাদুর্ভাব দূর করা সম্ভব হয়েছে। গলগণ্ড ছাড়া থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি হলে শিশুদের মানসিক বিকাশও বাধা পায় এবং চেহারায় স্বাভাবিক শিশুদের থেকে বৈসাদৃশ্য থাকে, সামুদ্রিক মাছ ছাড়া কলা, ফলমূল, কচু ইত্যাদি খেলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
(b) বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস (Diabetes): অগ্ন্যাশয়ে যদি প্রয়োজনমতো ইনসুলিন তৈরি না হয় তবে রক্তে দেহের শর্করা পরিপাক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না বলে দেহে শর্করার পরিমাণ স্থায়ীভাবে বেড়ে যায়, যে অবস্থাকে বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস বলে। ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরনের, টাইপ-1 এবং টাইপ-২। টাইপ-1 -এ আক্রান্ত রোগীর দেহে একেবারেই ইনসুলিন তৈরি হয় না। তাই নিয়মিতভাবে ইনজেকশনের মাধ্যমে ইনসুলিন নিতে হয়। অন্যদিকে টাইপ-2 রোগীর দেহে আংশিকভাবে ইনসুলিন তৈরি হয়। এক্ষেত্রে ঔষধ, অগ্ন্যাশয় কোষকে শরীরের জন্য পরিমিত ইনসুলিন তৈরিতে সাহায্য করে। একজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তি সুশৃঙ্খল জীবন ব্যবস্থা, পরিমিত খাদ্য গ্রহণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম দিয়ে অনেক সময় এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
১১.২.৩ মানব শরীরের গুরুত্বপূর্ণ হরমোনসমূহ
মানব দেহে অনেক ধরনের হরমোন কার্যকর রয়েছে, তার ভেতরে অর্ধশতাধিক হরমোন বিজ্ঞানীরা গুরুত্বপূর্ণ হরমোন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এদের ভেতর থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোনের নাম, তাদের কাজ এবং সেটি কোন গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয় তা নিচে দেওয়া হলো :
১. ইনসুলিন: রক্তের গ্লুকোজ দেহকোষে প্রেরণ করে রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে; এটি অগ্ন্যাশয়ের আইলেটস্ অফ ল্যাংগারহ্যানস উৎপন্ন হয়।
২. থাইরয়েড হরমোন বা থাইরোক্সিন: দেহের বিপাক এবং শক্তি উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে; থাইরয়েড গ্রন্থিতে উৎপাদিত।
৩. কর্টিসোন: মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ, শরীরের বৃদ্ধি, এবং ইমিউন কার্যক্রম পরিচালনা করে; এড্রেনাল গ্রন্থি থেকে উৎপন্ন।
৪. অ্যাড্রেনালিন: কঠিন মানসিক ও শারীরিক চাপের জন্য প্রস্তুত করে; এড্রেনাল গ্রন্থি দ্বারা উৎপন্ন।
৫. টেস্টোস্টেরোন: পুরুষের জনন অঙ্গের বৃদ্ধির পাশাপাশি জননচক্র এবং যৌন আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। পুরুষের শুক্রাশয়ে উৎপন্ন হয়।
৬. এস্ট্রোজেন: মেয়েদের জনন অঙ্গের বৃদ্ধির পাশাপাশি জননচক্র এবং যৌন আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মেয়েদের ডিম্বাশয়ে উৎপন্ন হয়।
৭. প্রোজেস্টেরোন: সন্তান জন্মের জন্য গর্ভাশয়কে প্রস্তুত করে এবং গর্ভকালীন সময়ে সহায়তা করে; মেয়েদের ডিম্বাশয়, বিশেষভাবে কর্পাস লুটিয়ামে উৎপন্ন হয়।
৮. গ্রোথ হরমোন: দৈহিক বৃদ্ধি, কোষ বিভাজনে সহায়তা করে; পিটুইটারি গ্রন্থি দ্বারা উৎপন্ন।
৯. মেনাটনিন: ঘুম-জাগরণ চক্র এবং দিন-রাত অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে; পাইনিয়াল বডি দ্বারা উৎপন্ন।
১০. অক্সিটোসিন : সামাজিক বন্ধন উৎসাহিত করে, প্রসবে সহায়তা করে এবং মাতৃদুগ্ধ নির্গমনে সহায়তা করে; হাইপোথালামাস দ্বারা উৎপন্ন এবং পিটুইটারি গ্রন্থি দ্বারা মুক্ত।
১১.৩ হৃদ-সংবহন তন্ত্র (Blood Circulation):
রক্ত জীবনীশক্তির মূল। রক্তনালির মধ্য দিয়ে রক্ত দেহের সর্বত্র প্রবাহিত হয় ও কোষে অক্সিজেন এবং খাদ্য উপাদান সরবরাহ করে দেহের সব কোষকে সজীব এবং সক্রিয় রাখে। একই সঙ্গে রক্তের বর্জ্য পদার্থ দেহের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবাহিত করা হয়। যে তন্ত্রের মাধ্যমে রক্ত প্রতিনিয়ত দেহের বিভিন্ন অঙ্গ এবং অংশে চলাচল করে তাকে রক্ত সংবহনতন্ত্র বলে।
মানব দেহে রক্তপ্রবাহ কেবল হৃৎপিণ্ড এবং রক্তনালিগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, কখনও এর বাইরে আসে না। এ ধরনের সংবহনতন্ত্রকে বন্ধ সংবহনতন্ত্র (Close circulatory system) বলা হয়। সারাদেহে রক্ত একবার সম্পূর্ণ পরিভ্রমণের জন্য মাত্র এক মিনিট বা তার চেয়েও কম সময় লাগে। বদ্ধ সংবহনতন্ত্রের বড়ো সুবিধা হলো এ ব্যবস্থায়-
(ক) রক্ত সরাসরি দেহের বিভিন্ন অঙ্গে গিয়ে পৌঁছায়।
(খ) রক্তবাহী নালির ব্যাসের পরিবর্তনের মাধ্যমে দেহ কোনো বিশেষ অঙ্গে রক্তপ্রবাহের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
(গ) রক্ত বিভিন্ন অঙ্গে পরিভ্রমণ করে দ্রুত হৃৎপিণ্ডে ফিরে আসে
অন্যান্য তন্ত্রের তুলনায় রক্ত সংবহনতন্ত্র বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হলেও এর গঠন মোটামুটি সাধারণ।
১১.৩.১ রক্ত (Blood)
রক্ত একটি অস্বচ্ছ, মৃদু ক্ষারীয় এবং লবণাক্ত তরল পদার্থ। রক্ত হৃৎপিণ্ড, শিরা, উপশিরা, ধমনি, শাখা ধমনি এবং কৈশিকনালি পথে আবর্তিত হয়। লোহিত রক্তকণিকায় হিমোগ্লোবিন নামক রঞ্জক পদার্থ থাকার কারণে রক্তের রং লাল দেখায়। হাড়ের লাল অস্থিমজ্জাতে রক্তকণিকার জন্ম হয়।
চিত্র ১১.৬: বিভিন্ন ধরনের রক্তকণিকা
রক্তের উপাদান
রক্ত এক ধরনের তরল যোজক কলা। এটি রক্তরস এবং কয়েক ধরনের রক্তকণিকা (চিত্র ১১.৬) দিয়ে গঠিত।
(ক) রক্তরস (Plasma)
রক্তের বর্ণহীন তরল অংশকে রক্তরস বলে। সাধারণত রক্তের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ রক্তরস। রক্তরসের প্রধান উপাদান পানি। এছাড়া বাকি অংশে যে পদার্থগুলো থাকে সেগুলো হচ্ছে: প্রোটিন, গ্লুকোজ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চর্বিকণা, খনিজ লবণ, ভিটামিন, হরমোন, এন্টিবডি। বর্জ্যপদার্থ হিসেবে থাকে কার্বন ডাইঅক্সাইড, ইউরিয়া, ইউরিক অ্যাসিড ইত্যাদি। আমরা খাদ্য হিসেবে যা গ্রহণ করি তা পরিপাক হয়ে অন্ত্রের গাত্রে শোষিত হয় এবং রক্তরসে মিশে দেহের সর্বত্র সঞ্চালিত হয়। এভাবে দেহকোষগুলো পুষ্টিকর দ্রব্যাদি গ্রহণ করে দেহের পুষ্টির সাধন এবং ক্ষয়পূরণ করে।
খ) রক্তকণিকা (Blood corpuscles)
মানব দেহে তিন ধরনের রক্তকণিকা দেখা যায়- লোহিত রক্তকণিকা (Red Blood Corpuscles), শ্বেত রক্তকণিকা (White Blood Corpuscles) এবং অণুচক্রিকা (Blood Platelets)। যদিও এগুলো সবই কোষ, তবে রক্তের প্লাজমার মধ্যে ভাসমান কণার সঙ্গে তুলনা করে এদেরকে অনেকদিন আগে রক্তকণিকা নাম দেওয়া হয়েছিল, সেই নাম এখনও প্রচলিত।
লোহিত রক্তকণিকা (RBC: Red Blood Corpuscles) মানব দেহে তিন ধরনের রক্তকণিকার মধ্যে লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি (চিত্র ১১.৭)। লাল অস্থিমজ্জায় লোহিত রক্তকণিকা তৈরি হয়। এর গড় আয়ু 120 দিন। মানুষের লোহিত রক্তকণিকায় নিউক্লিয়াস থাকে না, এবং দেখতে অনেকটা দ্বি-অবতল বৃত্তের মতো। পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির রক্তে লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা প্রতি কিউবিক মিলিমিটারে প্রায় 50 লক্ষ। সংখ্যায় এটি শ্বেত রক্তকণিকার চেয়ে প্রায় 500 গুণ বেশি। পুরুষের তুলনায় মহিলাদের রক্তে লোহিত রক্তকণিকা কম থাকে। তুলনামূলকভাবে শিশুদের দেহে লোহিত রক্তকণিকার পরিমাণ বেশি থাকে। আমাদের জীবনের প্রতি মুহূর্তে লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস হয়, আবার সমপরিমাণে তৈরিও হয়। লোহিত রক্তকণিকা শ্বাসকার্যে অক্সিজেন পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এর হিমোগ্লোবিন অক্সিজেন পরিবহণ করে। হিমোগ্লোবিন এক ধরনের রঞ্জক পদার্থ, লোহিত রক্তকণিকায় হিমোগ্লোবিনের উপস্থিতির কারণে রক্ত লাল দেখায়। রক্তে উপযুক্ত পরিমাণ হিমোগ্লোবিন না থাকলে রক্তস্বল্পতা বা রক্তশূন্যতা (anemia) দেখা দেয়।
শ্বেত রক্তকণিকা বা লিউকোসাইট (WBC White Blood Cell):
শ্বেত রক্তকণিকা হিমোগ্লোবিনবিহীন এবং নিউক্লিয়াসযুক্ত বড়ো আকারের কোষ, হিমোগ্লোবিন না থাকার কারণে এদের শ্বেত রক্তকণিকা বলে। শ্বেত রক্তকণিকায় DNA থাকে। শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা RBC -এর তুলনায় অনেক কম। শ্বেত রক্তকণিকার নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই, এরা অ্যামিবার মতো দেহের আকারের পরিবর্তন করে (চিত্র ১১.৮)। ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় (চিত্র ৩.০৩) এগুলো জীবাণুকে ধ্বংস করে।
শ্বেত রক্তকণিকাগুলো রক্তরসের মধ্য দিয়ে নিজেরাই চলতে পারে এবং রক্ত জালিকার প্রাচীর ভেদ করে টিস্যুর মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। শ্বেত রক্তকণিকার গড় আয়ু 1-15 দিন। দেহ বাইরের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে, দ্রুত শ্বেতকণিকার সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটে। মানব দেহে প্রতি ঘনমিলিমিটার রক্তে 4-10 হাজার শ্বেত রক্তকণিকা থাকে। অসুস্থ মানব দেহে এর সংখ্যা বেড়ে যায়।
অণুচক্রিকা (Platelet)
অণুচক্রিকা গোলাকার, ডিম্বাকার অথবা রড আকারের হতে পারে। এদের সাইটোপ্লাজম দানাদার এবং সাইটোপ্লাজমে কোষ অঙ্গাণু মাইটোকন্ড্রিয়া, গলগি বস্তু থাকে; কিন্তু নিউক্লিয়াস থাকে না। অনুচক্রিকাগুলোর গড় আয়ু 5-10 দিন। পরিণত মানব দেহে প্রতি ঘনমিলিমিটার রক্তে অণুচক্রিকার সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ।
অনুচক্রিকার প্রধান কাজ হলো রক্ত জমাট বাঁধাতে (blood clotting) সাহায্য করা। যখন কোনো রক্তবাহিকা বা কোনো টিস্যু আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে কেটে যায়, তখন সেখানকার অনুচক্রিকাগুলো সক্রিয় হয়ে উঠে অনিয়মিত আকার ধারণ করে (চিত্র ১১.৯) এবং ক্ষতস্থানে রক্তকে জমাট বাঁধাতে সাহায্য করে রক্তক্ষরণ বন্ধ করে। রক্তে উপযুক্ত পরিমাণ অণুচক্রিকা না থাকলে রক্তপাত সহজে বন্ধ হয় না।
রক্তের কাজ
রক্ত দেহের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি দেহের নানাবিধ কাজ করে থাকে, যেমন-
(১) অক্সিজেন পরিবহণ লোহিত রক্তকণিকা কোষে অক্সিজেন পরিবহণ করে।
(২) কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণ: রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে কোষগুলোতে যে কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন হয় তা রক্তরস এবং লোহিত রক্তকণিকার সমন্বয়ে সংগ্রহ করে ফুসফুসে নিয়ে আসে সেগুলো নিঃশ্বাসের সঙ্গে দেহের বাইরে বের করে দেয়।
(৩) খাদ্যসার পরিবহণ: রক্তরস গ্লুকোজ, অ্যামাইনো অ্যাসিড, চর্বিকণা ইত্যাদি কোষে সরবরাহ করে।
(৪) তাদের সমতা রক্ষা। দেহের মধ্যে অনবরত দহনক্রিয়া সম্পাদিত হচ্ছে, এতে করে বিভিন্ন অঙ্গে বিভিন্ন মাত্রার তাপ সৃষ্টি হয় এবং তা রক্তের মাধ্যমে দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে দেহের সর্বত্র তাপের সমতা রক্ষা হয়।
(৫) বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন: রক্ত দেহের জন্য ক্ষতিকর বর্জ্য পদার্থ বহন করে এবং বিভিন্ন অঙ্গের মাধ্যমে সেসব ইউরিয়া, ইউরিক অ্যাসিড ও কার্বন ডাইঅক্সাইড হিসেবে নিষ্কাশন করে।
(৬) হরমোন পরিবহণ: হরমোন সরাসরি রক্তে মিশে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন অঙ্গে সঞ্চালিত হয় এবং বিভিন্ন জৈবিক কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(৭) রোগ প্রতিরোধ: কয়েক প্রকারের শ্বেত রক্তকণিকা ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় দেহকে জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। এন্টিবডি ও এন্টিজেন উৎপাদনের মাধ্যমে রক্ত দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
(৮) রক্ত জমাট বাধা: দেহের কোনো অংশ কেটে গেলে অণুচক্রিকা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে এবং দেহের রক্তক্ষরণ বন্ধ করে।
রক্ত আর নিলয়ে ফিরে আসতে পারে না। এভাবে হৃৎপিণ্ডে পর্যায়ক্রমিক সংকোচন এবং প্রসারণের ফলে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে (চিত্র ১১.১২)।হৃৎপিণ্ডের কাজ: রক্ত সংবহনতন্ত্রের প্রধান অঙ্গ হচ্ছে হৃৎপিণ্ড। এর সাহায্যেই সংবহনতন্ত্রের রক্ত প্রবাহ সচল থাকে। হৃৎপিণ্ডের প্রকোষ্ঠগুলো সম্পূর্ণ বিভক্ত থাকায় এখানে অক্সিজেনযুক্ত ও অক্সিজেনবিহীন রক্তের সংমিশ্রণ ঘটে না।
১১.৩.৪ রক্ত সংবহনতন্ত্রের কয়েকটি রোগ
উচ্চ রক্তচাপ (High blood pressure): হৃৎরোগ এবং স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান কারণ হলো উচ্চ রক্তচাপ। রক্ত চলাচলের সময় রক্তনালি গাত্রে যে চাপ সৃষ্টি হয় তাকে রক্তচাপ বলে। আর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি রক্তচাপকে উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে সাধারণত সিস্টোলিক চাপ 120 মিলিমিটার পারদের নিচে এবং ডায়াস্টলিক চাপ ৪০ মিলিমিটার পারদের নিচের মাত্রাকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রা হিসেবে ধরা হয়। আর এই রক্তচাপ যখন মাত্রাতিরিক্ত হয় তখনই আমরা তাকে উচ্চ রক্তচাপ বলে থাকি।
হার্ট অ্যাটাক: যখন কারও হৃদযন্ত্রের কোনো অংশে রক্ত জমাট বাঁধার কারণে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় কিংবা বাধাগ্রস্ত হয়, তখন হৃৎপিণ্ডের কোষ কিংবা হৃৎপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার ফলে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় যেগুলোকে এক নামে হার্ট অ্যাটাক নামে ডাকা হয়। হৃৎপিণ্ড রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন এবং খাবারের সারবস্তু অর্থাৎ পুষ্টিকর পদার্থ রক্তনালির মধ্য দিয়ে দেহের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেয়। নিজের কাজ সঠিকভাবে করার জন্য অর্থাৎ তার হৃদপেশির অক্সিজেন এবং পুষ্টি অর্জনের জন্য হৃৎপিণ্ডের তিনটি প্রধান রক্তনালি আছে। এগুলোর মধ্যে অনেক সময় চর্বি জমে রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। ফলে প্রাণঘাতী রোগ হার্ট অ্যাটাক হয়। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস যেমন- অধিক তেলযুক্ত খাবার অলস জীবনযাপন এবং শারীরিক পরিশ্রম না করার ফলে এই রোগ দেখা যায়।
রক্তে উচ্চ কোলেস্টেরোন দেহের অন্যান্য অঙ্গের মতো হৃৎপিণ্ডে অক্সিজেন এবং খাদ্যসার সবরাহের প্রয়োজন হয়। হৃৎপিণ্ডের করোনারি ধমনির গায়ে চর্বি জমা হলে ধমনিতে স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহে বিঘ্ন ঘটে ফলে হৃৎপিণ্ড পর্যাপ্ত অক্সিজেন এবং খাদ্যসার না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রগ্রস্ত হয়। রক্ত চলাচল কমে যাওয়ার কারণে বুকে ব্যথা অনুভূত হয়। এই অবস্থাকে অ্যানজিনা (Angina) বলা হয়। এছাড়া ধমনির গায়ে বেশি চর্বি জমা হলে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় ফলে করোনারি হৃদরোগের সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায়।
নিউকেমিয়া (Leukemia): যদি কোনো কারণে রক্তে অস্বাভাবিকভাবে শ্বেত রক্তকণিকার বৃদ্ধি ঘটে তাহলে এই রোগের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। অস্থিমজ্জা অত্যধিক হারে শ্বেত রক্তকণিকা উৎপাদন করার কারণে পরোক্ষভাবে লোহিত রক্তকণিকা এবং অনুচক্রিকার উৎপাদন কমে যেতে পারে। লোহিত রক্তকণিকার অভাবে অক্সিজেনের ঘাটতি হয় যার ফলে রোগী দুর্বল বোধ করে, ফ্যাকাশে হয়ে যায় এবং শ্বাসকষ্ট হয়। অনুচক্রিকার অভাবে রক্ত জমাট বাঁধতে না পেরে অনেক সময় কোনো আঘাত ছাড়াই অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হয়। অধিক হারে শ্বেত রক্তকণিকা উৎপন্ন হলেও সেগুলো আসলে ক্যান্সার কোষ এবং শ্বেত রক্তকণিকার স্বাভাবিক কাজ রোগপ্রতিরোধে অক্ষম। তাই লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি সহজেই বিভিন্ন রোগজীবাণু দিয়ে আক্রান্ত হন। এভাবে রক্তের তিন ধরনের কোষের প্রায় প্রতিটিরই স্বাভাবিক কাজ ঠিকমতো না করতে পারা এ রোগের লক্ষণ, তবে লিউকেমিয়ার প্রকারভেদ অনুসারে লক্ষণের তারতম্য হতে পারে।
১১.৪ মানব দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (Defense Mechanism)
মানব দেহের দৃশ্যমান গঠন এবং তার দেহের নানা ধরনের সমন্বিত কার্যক্রম আমরা প্রতিমুহূর্তে দেখতা পাই, এবং বিস্মিত হই, কিন্তু আমাদের চোখের আড়ালে চারপাশের অসংখ্য রোগ জীবাণু বা বিষাক্ত এবং দূষিত পদার্থের আক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষা করার জন্য আমাদের দেহ যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি গড়ে তুলেছে সেটি আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু যে কোনো হিসেবে সেটি একটি চমকপ্রদ ব্যবস্থা। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় একদিকে যেরকম বাহ্যিক ভৌত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে ঠিক একই রকম অত্যন্ত নিখুঁত ইমিউন ব্যবস্থা রয়েছে যেটি রোগ, জীবাণু ভাইরাস ভরপুর এই পৃথিবীর প্রতিকূল পরিবেশে আমাদের রক্ষা করে যাছে। কাজেই আমরা বলতে পারি, মানব দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হলো বিভিন্ন জৈবিক কাঠামো সহযোগে গঠিত একটি ব্যবস্থা যা জীবদেহকে রোগব্যাধির বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে। মানব দেহের এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় এই তিনটি প্রতিরক্ষা স্তর (defense lines) হিসেবে ভাগ করা যায়।
১১.৪.১ প্রথম প্রতিরক্ষা স্তর (First line of Defense)
মানব দেহের প্রতিরক্ষায় প্রথম প্রতিরক্ষা স্তরটি একটি রাসায়নিক ও ভৌত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে, যেন বাইরের কোনো অণুজীব বা কণা দেহের ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে। এটি যেহেতু সুনির্দিষ্ট কোনো অণুজীব বা কণার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি না করে একটি সাধারণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে তাই এই প্রতিরক্ষা স্তরটি অনির্দিষ্ট বা নন-স্পেসিফিক স্তর নামেও পরিচিত। নিচের অঙ্গগুলো (চিত্র ১১.১৩) এই প্রতিরক্ষা স্তরের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ গড়ে তুলে।
ক. ত্বক (skin): ত্বক আমাদের শরীরের সবচেয়ে বড়ো অঙ্গ এবং এটি বায়ুরোধী, জলাভেদ্য (waterproof) এবং অধিকাংশ পদার্থের জন্য অভেদ্য। আমাদের শরীরকে আক্রমণকারী ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস অথবা ফানজাইয়ের বিরুদ্ধে ত্বক সবার প্রথম কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলে। কতকগুলো ভাইরাস ছাড়া এমন কোনো রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু নেই যা অক্ষত ত্বকের ভিতর দিয়ে দেহে প্রবেশ করতে পারে। মানবত্বকে উপকারী ব্যাকটেরিয়া সব সময়ই থাকে, কিন্তু ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া সেখানে বাঁচতে পারে না। কারণ ত্বকের স্বেদ ও ঘাম গ্রন্থি থেকে যে তেল ও ঘাম বের হয় তা ত্বককে এসিডিক করে তুলে, যে পরিবেশে জীবাণু বাঁচতে বা বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। অন্যদিকে, ত্বকে যেসব উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে সেগুলোও যে অ্যাসিড ও বিপাকীয় বর্জ্য ত্যাগ করে সেসব পদার্থও ত্বকের উপরে ব্যাকটেরিয়া দমনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। স্বেদ ও ঘাম গ্রন্থির ক্ষরণেও জীবাণুনাশক পদার্থ থাকে। এসব পদার্থ থাকায় মানুষের ত্বক একটি রোগজীবাণুনাশক অঙ্গ হিসেবে কাজ করে।
খ. লোম (Hairs): নাকের ভিতরে যে লোম রয়েছে সেগুলো ধুলা-ময়লা আটকে শরীরের ভেতরে ক্ষতিকর পদার্থকে প্রবেশ করতে বাধা দেয়।
গ. সিনিয়া (Cilia): দেহের উন্মুক্ত প্রবেশ পথগুলো মিউকাসের ঝিল্লি দিয়ে ঢাকা থাকে। বাইরের দূষিত কণা ও অণুজীব ঝিল্লির এই আঠালো মিউকাসে আটকে যায়। শ্বাসনালিতে মিউকাস ঝিল্লিময় এই অংশ আণুবীক্ষণিক ক্ষুদ্র চুলের মতো আন্দোলনরত সিলিয়া দিয়ে আবৃত থাকে, সেগুলো এই বহিরাগত কণা ও অণুজীবকে সরিয়ে দিয়ে দেহের এই প্রবেশপথকে উন্মুক্ত রাখে।
ঘ. সিরুমেন (Cerumen or Ear wax): কানের বাইরের প্রাচীর থেকে বের হওয়া হলদে-বাদামি রঙের মোমের মতো পদার্থকে সিরুমেন বলে। কানের পর্দায় যেন ময়লা ও অণুজীবের সংক্রমণে শ্রবণে কোনো রকম ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য ময়লা বা অণুজীব সিরুমেনে আটকে গিয়ে কানের খইলে পরিণত হয়।
ঙ. অশ্রু ও নানা (Tears and Saliva): অশ্রু ও লালায় লাইসোজাইম (lysozyme) নামে একটি এনজাইম রয়েছে যেটি ব্যাকটেরিয়ানাশক হিসেবে কাজ করে। অশ্রু চোখকে বারবার ভিজিয়ে দিয়ে সেটিকে বহিরাগত কণা ও অণুজীবের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। লালা মুখগহ্বরকে সিক্ত ও পিচ্ছিল রাখে, একই সঙ্গে মুখগহ্বরের প্রাচীর যেন শুকিয়ে না যায় সে কাজটিও করে থাকে। এ কারণে কোনো জীবিত ব্যাকটেরিয়া সহজে মুখের ক্ষতি করতে পারে না।
চ. পৌষ্টিকনানির অ্যাসিড (Acid of Alimentary canal): আমাদের দৈনন্দিন খাবার ও পানির সঙ্গে অনেক ধরনের ক্ষতিকর অণুজীব পাকস্থলিতে পৌঁছালেও, পাকস্থলির শক্তিশালী হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ও প্রোটিওলাইটিক এনজাইমের ক্রিয়ায় সেগুলো টিকে থাকতে পারে না এবং সেখানে ধ্বংস হয়ে যায়।
ছ. রেচন-জননতন্ত্রের অ্যাসিড (Acid of Excretory-reproductive system): রেচন ও জননতন্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অঙ্গের ক্ষরণ এসিডিক ও আঠালো বলে দেহের ভেতরে কোনো অণুজীব প্রবেশ করতে চাইলে সেগুলো আঠালো এই ক্ষরণে আটকে যায়। পরে এগুলো মূত্রের সঙ্গে বের হয়ে যায় কিংবা ফ্যাগোসাইট এসে এগুলোকে গ্রাস করে। যোনিতে যে উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে সেগুলো ল্যাকটিক অ্যাসিড ক্ষরণ করে পিএইচ (pH) সাম্যতা রাখার পাশাপাশি অণুজীবের বংশবৃদ্ধি হতে বাধা দেয়।
১১.৪.২ দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা স্তর (Second line of Defense)
প্রথম প্রতিরক্ষা স্তর ভেদ করে যদি দেহের ভেতরে কোনো অণুজীব বা অণুকণা প্রবেশ করতে পারে তখন দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা স্তর হিসেবে শরীরের ইমিউন ব্যবস্থা সেগুলোর বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কোষীয় ও রাসায়নিক প্রতিরক্ষা নিয়ে গঠিত এই স্তরটিও প্রথম প্রতিরক্ষা স্তরের মতোই অনির্দিষ্ট বা নন- স্পেসিফিক। এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা শরীরের নিজের কোষ এবং বাইরের অণুজীবের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে, তাই শরীরের নিজের সুস্থ কোষের কোনো ক্ষতি না করে শুধু বাইরের অণুজীবকে ধ্বংস করে দেয়। দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা স্তর নিচের প্রতিরক্ষা পদ্ধতিগুলো নিয়ে নিয়ে গঠিত।
ক. ফ্যাগোসাইট (Phagocytes): ফ্যাগোসাইট হচ্ছে অস্থিমজ্জা থেকে উৎপন্ন হওয়া এক ধরনের বড়ো আকারের শ্বেত রক্তকণিকা যেগুলো অন্য অণুজীব বা বহিরাগত কণা গ্রাস করে দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সহায়তা করে। দুটি প্রধান ফ্যাগোসাইটিক কণিকা হচ্ছে নিউট্রোফিল ও ম্যাক্রোফেজ। দেহে জীবাণুর সংক্রমণ হলে নিউট্রোফিল রক্তে, আর ম্যাক্রোফেজ নির্দিষ্ট টিস্যুতে হাজিয়ে হয়ে ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় জীবাণুকে গ্রাস করতে শুরু করে। ম্যাক্রোফেজ শুধু যে জীবাণু গ্রাস ও হজম করে তা নয়, এটি পুরোনো রক্তকণিকা, মৃত টিস্যু-খণ্ড ও কোষীয় আবর্জনা গ্রাস করে আবর্জনাভুক হিসেবে বর্জ্য পরিষ্কার করার দায়িত্ব পালন করে।
খ. সহজাত মারণকোষ (NK: Natural killer cells): সহজাত মারণকোষ বা NK-কোষ হচ্ছে লিম্ফোসাইট জাতীয় বিশেষ এক ধরনের শ্বেত রক্তকণিকা যা টিউমার কোষ ও ভাইরাসে আক্রান্ত কোষের প্লাজমাঝিল্লিতে কিছু নির্দিষ্ট পরিবর্তনকে শনাক্ত করে সেইসব কোষগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। NK-কোষের আক্রমণে টার্গেট কোষের ঝিল্লিতে ছিদ্র সৃষ্টি হয় এবং কোষটিকে ধ্বংস করার জন্য NK-কোষ সেই ছিদ্রপথে কোষের ভেতরে বিশেষ এনজাইম প্রবেশ করিয়ে দেয়, যেটি কোষটিকে ধ্বংস করে দেয়।
গ. প্রদাহ (Inflammation): আমরা সবাই শরীর আঘাতপ্রাপ্ত হলে যে প্রদাহ হয় তার সঙ্গে পরিচিত (চিত্র ১১.১৪)। শরীরের টিস্যুতে দহন, রাসায়নিক বা আঘাতজনিত যন্ত্রণাদায়ক ক্ষত বা অন্য কোনো ধরনের সংক্রমণজনিত ক্ষত হলে সেখানে প্রদাহ হয়, অর্থাৎ ক্ষতস্থানটি লাল হয়ে যায়, উত্তপ্ত হয়, ফুলে যায় এবং ব্যথা অনুভূত হয়। এটি আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একধরনের বহিঃপ্রকাশ। যখন টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন সেখানে এক ধরনের রাসায়নিক নিষ্ক্রমণ হয় যেটি ক্ষতস্থানে রক্তের বাড়তি প্রবাহ সৃষ্টি করে। এই বাড়তি রক্তপ্রবাহ ক্ষতস্থানে প্রয়োজনীয় ইমিউন কোষ এবং পুষ্টি নিয়ে আসে যা ক্ষতস্থানের নিরাময় দ্রুততর করে থাকে।
ঘ. কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম (Complement system):
কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম হচ্ছে রক্তে উপস্থিত ত্রিশটি থেকে বেশি প্লাজমা প্রোটিন দিয়ে গঠিত একটি গ্রুপ যা অন্যান্য প্রতিরক্ষা পদ্ধতিকে সাহায্য করে, যে কারণে এটিকে কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম বলা হয়ে থাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় এসব প্রোটিন নিষ্ক্রিয় থাকে তবে একবার যদি কমপ্লিমেন্ট সিস্টেমের কোনো একটি প্রোটিন সক্রিয় হয়ে উঠে তাহলে সেটি অন্য প্রোটিনকেও সক্রিয় করে তুলে। এভাবে সমস্ত প্রোটিন পরস্পরকে সক্রিয় করে নির্দিষ্ট এবং অনির্দিষ্ট দুই ধরনের প্রতিরক্ষা পদ্ধতিকেই উজ্জীবিত করে দেয়। যার কারণে মারণকোষ তখন দক্ষতার সঙ্গে অবাঞ্ছিত কোষ ধ্বংস করতে পারে। অণুজীবের গায়ে কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম আটকে থেকে সেটি চিনিয়ে দেয় বলে নিউট্রোফিল ও ম্যাক্রোফেজ দ্রুত সেই আক্রান্ত স্থানে পৌঁছে কোষকে আক্রমণ করতে পারে। শুধু তাই নয়, প্রদাহকে ত্বরান্বিত করার জন্য কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম রক্তনালিকার প্রসারণ ঘটিয়ে থাকে।
ঙ. ইন্টারফেরন (Interferon):
ইন্টারফেরন মানব দেহের সহজাত ইমিউন ব্যবস্থাপনার অংশ। ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এবং ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি বন্ধ করতে আক্রান্ত কোষ থেকে ইন্টারফেরন নামে এই বিশেষ এক ধরনের ক্ষুদ্র সিগনালিং প্রোটিন উৎপন্ন হয়। ব্যাপনের মাধ্যমে ইন্টারফেরন আশপাশের সুস্থ কোষে ছড়িয়ে পড়ে, ওইসব কোষের ঝিল্লিতে যুক্ত হয় এবং সুস্থ কোষগুলোকে আরও ইন্টারফেরন তৈরি করতে প্রেরণা দিয়ে থাকে, যার ফলে ভাইরাস অন্য সুরক্ষিত কোষগুলোকে আক্রমণ করতে পারে না। ইন্টারফেরন চিকিৎসার কাজেও ব্যবহার হয়। কৃত্রিম উপায়ে ইন্টারফেরন-আলফা এবং ইন্টারফেরন- বেটা তৈরি করা হয়েছে যেগুলো হেপাটাইটিস বি এবং সি-এর মতো ভাইরাল সংক্রমণ প্রতিরোধের কাজে ব্যবহৃত হয়।কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম হচ্ছে রক্তে উপস্থিত ত্রিশটি থেকে বেশি প্লাজমা প্রোটিন দিয়ে গঠিত একটি গ্রুপ যা অন্যান্য প্রতিরক্ষা পদ্ধতিকে সাহায্য করে, যে কারণে এটিকে কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম বলা হয়ে থাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় এসব প্রোটিন নিষ্ক্রিয় থাকে তবে একবার যদি কমপ্লিমেন্ট সিস্টেমের কোনো একটি প্রোটিন সক্রিয় হয়ে উঠে তাহলে সেটি অন্য প্রোটিনকেও সক্রিয় করে তুলে। এভাবে সমস্ত প্রোটিন পরস্পরকে সক্রিয় করে নির্দিষ্ট এবং অনির্দিষ্ট দুই ধরনের প্রতিরক্ষা পদ্ধতিকেই উজ্জীবিত করে দেয়। যার কারণে মারণকোষ তখন দক্ষতার সঙ্গে অবাঞ্ছিত কোষ ধ্বংস করতে পারে। অণুজীবের গায়ে কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম আটকে থেকে সেটি চিনিয়ে দেয় বলে নিউট্রোফিল ও ম্যাক্রোফেজ দ্রুত সেই আক্রান্ত স্থানে পৌঁছে কোষকে আক্রমণ করতে পারে। শুধু তাই নয়, প্রদাহকে ত্বরান্বিত করার জন্য কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম রক্তনালিকার প্রসারণ ঘটিয়ে থাকে।
চ. জ্বর (Fever): দৈহিক তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে তাকে জ্বর বলা হয় এবং এটি দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের পাশাপাশি দেহের তাপমাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ম্যাক্রোফেজ নামে শ্বেতকণিকা যখন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা বহিরাগত কণাকে শনাক্ত ও আক্রমণ করে তখন কোষগুলো রক্তপ্রবাহে পাইরোজেন (pyrogen) নামক একধরনের জৈব অণু ক্ষরণ করে। এই পাইরোজেন হাইপোথ্যালামাসের বিপাকীয় পরিবর্তন ঘটিয়ে দেহের তাপমাত্রাকে উচ্চতর মাত্রায় নির্ধারণ করায়, আমরা যেটাকে জ্বর বলে থাকি। জ্বর হলে দেহকোষের বিপাকীয় হার বেড়ে যায়, প্রতিরক্ষা পদ্ধতি ও টিস্যুর ক্ষয়পূরণ দ্রুততর হয় এবং উচ্চ তাপমাত্রায় রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর বেঁচে থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। জ্বরশেষে যখন পাইরোজেনের ক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়, তখন দেহের তাপমাত্রা আবার স্বাভাবিক হয়ে আসে।
১১.৪.৩ তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তর (Third line of Defense)
প্রথম ও দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা স্তর অনির্দিষ্ট বা নন-স্পেসিফিক, অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট রোগসৃষ্টিকারী অণুজীব বা কণাকে লক্ষ বা টার্গেট করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলে না। সেদিক দিয়ে তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তর ব্যতিক্রম কারণ এই প্রতিরক্ষা স্তর দেহে প্রবেশকারী সুনির্দিষ্ট ধরনের বহিরাগত রোগসৃষ্টিকারী অণুজীব বা কণাকে শুধু ধ্বংস করে না, প্রথমবার আক্রান্ত হওয়ার পর এসব নির্দিষ্ট ক্ষতিকর টার্গেটকে আজীবন মনে রেখে পরবর্তী যে কোনো আক্রমণের সময় দ্রুত ও কার্যকরভাবে সাড়া দিতে পারে। তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তরের কর্মকাণ্ড ইমিউন সাড়া (immune response) বলা হয়ে থাকে।
তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তরে বৈশিষ্ট্যগুলো এরকম:
(ক) টার্গেট: এই প্রতিরক্ষা স্তর বহিরাগত অণুজীব বা কণা শনাক্ত করে টার্গেটে পরিণত করতে পারে, একই সঙ্গে নিজের স্বাস্থ্যবান কোষকে ক্যান্সার কোষের মতো অসুস্থ, মৃতপ্রায় বা মৃতকোষ থেকে পৃথক করতে পারে। রোগসৃষ্টিকারী জীবাণুকে টার্গেট করার জন্য সেগুলোর পৃষ্ঠদেশের সুনির্দিষ্ট আণবিক মার্কারকে শনাক্ত করার প্রয়োজন হয়। টার্গেট শনাক্ত করার পর ঐ জীবাণুকে ধ্বংস করার উপযোগী ইমিউন কোষ তৈরি করা হয়।
(খ) মেমরি কোষ: তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তরের সবচেয়ে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি বহিরাগত অণুজীব বা কণার সংক্রমণ স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারে। প্রথমবার কোনো একটি রোগসৃষ্টিকারী জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পর এই প্রতিরক্ষা স্তর দেহে মেমরি কোষ সৃষ্টি করে। যদি পরবর্তী কালে একই জীবাণু আবার সংক্রমণের চেষ্টা করে তাহলে মেমরি কোষ সঙ্গে সঙ্গে সেটিকে শনাক্ত করে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলে। এভাবে তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তর বছরের পর বছর নির্দিষ্ট বহিরাগতের অনুপ্রবেশ দ্রুত ঠেকানোর চেষ্টা করে।
(গ) সামগ্রিক প্রতিরক্ষা: তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তর সমগ্র দেহকে রক্ষা করে। অনুপ্রবেশকারী জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা শুধু দেহের নির্দিষ্ট অংশে কার্যকর না থেকে শরীরের যে কোনো অংশে কার্যকর হতে পারে।
(ঘ) বি-সেন: বি-সেল এবং টি-সেল মানুষের ইমিউন প্রক্রিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুইটি উপাদান। এই শ্বেতকণিকাগুলো অভিযোজিত ইমিউন প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। প্রত্যেকটি বি-সেল নির্দিষ্ট এন্টিজেনকে (একটি জীবাণুর পৃষ্ঠদেশের সুনির্দিষ্ট আণবিক গঠন বা মার্কার) শনাক্ত করতে পারে এবং শনাক্ত করার পর সেটি কার্যকর হয়ে উঠে দ্রুত বিভাজিত হতে শুরু করে। বি-সেল শনাক্তকারী জীবাণুকে প্রতিরোধ করার জন্য এন্টিবডি তৈরি করে সেগুলোকে রক্তের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। এ ছাড়াও প্রতিরোধ শেষে এই জীবাণুকে পরবর্তী কালে শনাক্ত করার জন্য কিছু বি-সেল পরিবর্তিত হয়ে মেমরি কোষে পরিণত হয়।
(ঙ) টি-সেন:
টি-সেল কোনো এন্টিবডি তৈরি করে না কিন্তু ইমিউন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কখনো কখনো এগুলো সরাসরি সংক্রামিত কোষকে আক্রমণ করে কখনো কখনো NK-কোষ বা অন্য ধরনের ইমিউন কোষকে উজ্জীবিত করে। বি-সেলের মতো এই কোষগুলোও মেমোরি সেল তৈরি করে পরবর্তী সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত থাকে।
টীকা বা ভ্যাক্সিন দিয়ে পৃথিবীর অসংখ্য জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। এই টীকা বা ভ্যাক্সিন তৈরি করার পিছনে তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তরের অভিযোজন প্রক্রিয়ার ধারণাটি কাজ করে থাকে। যে জীবাণুর বিরুদ্ধে টীকা তৈরি করা হয় সেই জীবাণুটি কিংবা তার এন্টিজেনকে দুর্বল বা অকার্যকর হিসেবে শরীরে প্রবেশ করানো হয়। শরীরের তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তর সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে প্রয়োজনীয় এন্টিবডি এবং মেমোরি কোষ তৈরি করে। পরবর্তী কালে সেই জীবাণুর সত্যিকারের সংক্রমণ হলে সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ইমিউন প্রক্রিয়া কার্যকর হয়ে উঠে আমাদের সুরক্ষা দিয়ে থাকে।
আরও দেখুন...