সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ২য় পত্র | NCTB BOOK

যথাসময়ে যথাসিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর ব্যক্তিক ও প্রতিষ্ঠানিক সাফল্য নির্ভরশীল । তাই যেনোতেনোভাবে সিদ্ধান্ত নিলে তার ফল উল্টো হতে বাধ্য। সে কারণেই সিদ্ধান্ত নিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীকে অবশ্যই অত্যন্ত সচেতনতার সাথে সুবিধা-অসুবিধাসহ নানান বিষয় বিবেচনা করতে হয়। একজন চাকরিজীবীর কিছু টাকা জমেছে । সে এই টাকা দিয়ে সন্তানকে ভালো স্কুলে ভর্তি করে তার পিছনে অর্থ ব্যয় করতে পারে অথবা আরও কিছু টাকা আত্মীয়-স্বজন থেকে ঋণ করে একটা সস্তা ফ্ল্যাট বুকিং দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি কিস্তি বহনের ভার মাথায় নিতে পারে । এক্ষেত্রে অবশ্যই তাকে বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে । ব্যক্তির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতেই যেখানে নানান বিষয় বিবেচ্য সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অবশ্যই আরও গভীরভাবে নানান বিষয় ভাবতে হয় । অবশ্য সবক্ষেত্রেই এমন কিছু সিদ্ধান্ত থাকে যা সাধারণমানের এবং যেগুলো বিষয়ে প্রায়শই সিদ্ধান্ত দিতে হয় । এমন সকল ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়াটা কিছুটা সহজ। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রসমূহে সিদ্ধান্ত দিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীকে অবশ্যই অনেক বিষয় ভাবতে হয় এবং যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে কতকগুলো ধারাবাহিক পদক্ষেপ বিবেচনার বা প্রক্রিয়ার অনুসরণের প্রয়োজন পড়ে । সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার পদক্ষেপগুলো নিম্নে সংক্ষেপে আলোচিত হলো:

১. সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সংজ্ঞায়িতকরণ (Identifying and defining problems): জটিল বা অসুবিধাজনক কোনো বিষয় যা উত্তরণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ আবশ্যক এমন কোনো বিষয়কে সমস্যা হিসেবে দেখা হয়ে থাকে । কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সেটি যদি সঠিক সময়ে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা না যায় তবে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয় না । সমস্যা সামনে আসলে তাকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করার অর্থাৎ সমস্যার প্রকৃতি, করণীয় নির্ধারণের আবশ্যকতা ইত্যাদি বিষয়ও ভেবে দেখতে হয় । এভাবে সমস্যা ও করণীয়কে যদি সঠিকভাবে চিহ্নিত ও অনুধাবন করা সম্ভব হয় তবে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ সহজ হয়ে থাকে ।

২. অগ্রাধিকার নির্ধারণ (Determination of priority): সমস্যার পরিমাণ একাধিক হলে এবং সবগুলো একসাথে সমাধান সম্ভব না হলে কোনটি আগে এবং কোনটি পরে করা হবে এ বিষয় নির্ধারণকেই অগ্রাধিকার নির্ধারণ বলে । এ ধরনের ক্ষেত্রে প্রথমে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা করণীয় নির্ধারণ করতে হবে এবং এরপর পরম্পরা কী হবে তাও ঠিক করার প্রয়োজন পড়ে । ধরা যাক, মেশিন আর কাজ করছে না তাই তা পুনঃস্থাপন করা প্রয়োজন, বিল্ডিং সম্প্রসারণের কাজ চলছে তাও চালানো দরকার এবং কাঁচামাল সরবরাহকারীদের অগ্রিম দিতে হবে- এই তিনটা বিষয়কে সামনে রেখে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার । এক্ষেত্রে যেহেতু কোনোটিই বাদ দেয়া যাচ্ছে না, তাই ফান্ড বিবেচনায় সিদ্ধান্তের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হবে । অন্যথায় কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে গেলে পরে তা সমস্যার কারণ হতে পারে ।

৩. তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ (Collection of data and information): কোনো বিষয়ে প্রকৃত অবস্থা, জ্ঞান, বিষয় বা সংবাদকে তথ্য বলে । এরূপ অবস্থা জানা বা সংবাদ সংগ্রহকে তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ বলা হয়ে থাকে । এরূপ তথ্য ও উপাত্ত হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের মুখ্য অবলম্বন । সিদ্ধান্তগ্রহণকারী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যতবেশি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে সমর্থ হন তত বেশি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন । এরূপ তথ্য সংগ্রহ চিহ্নিত সমস্যা বা করণীয় বুঝতে যেমনি সহায়তা করে তেমনি সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন উপায় অনুসন্ধানেও সহায়তা দেয় । উল্লেখ্য, নতুন নতুন প্রযুক্তি, উপায় ও পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে তথ্য লাভ অনেক সহজ হয়েছে; যা সংগ্রহ ও বিবেচনা করা না গেলে সমস্যার গভীরতা উপলব্ধি এবং সমস্যা সমাধানে সঠিক সিদ্ধান্ত দেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায় ।

৪. বিকল্পসমূহ উদ্ভাবন (Generation of alternatives): অনুমিত অবস্থার আলোকে সমস্যা সমাধানে সম্ভাব্য উপায়সমূহ দাঁড় করানোর কাজকেই বিকল্প উদ্ভাবন বলে । সিদ্ধান্ত গ্রহণে একজন ব্যবস্থাপককে সম্ভাব্য বিকল্পসমূহ কি হতে পারে তা উদ্ভাবন বা নির্দিষ্ট করতে হয় । ধরা যাক, একটা মেশিন পুনঃস্থাপন করতে হবে । তথ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মেশিনের দাম কেমন তা জানা গেছে । এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান এজন্য কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে রাজি আছে সে সম্পর্কেও ধারণা থাকতে হয় । এরপর উদ্ভাবিত বিকল্পগুলোর মধ্য থেকে প্রয়োজনে একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা (Short list) তৈরি করা হয় । একজন ব্যক্তি অফিসের কাজে চট্টগ্রাম যাবেন । যাওয়ার বিকল্প কি হতে পারে তা প্রথমে জানা থাকলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হয়ে থাকে ।

৫. বিকল্পসমূহের মূল্যায়ন (Evaluation of alternatives): দাঁড় করানো প্রতিটা বিকল্প উপায় সুবিধা- অসুবিধার আলোকে কতটা গ্রহণযোগ্য তা বিবেচনা করার কাজকেই বিকল্পসমূহ মূল্যায়ন বলে । এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য ও সম্ভাবনা, দুর্বলতা ও ঝুঁকির দিকগুলো বিবেচনা করতে হয়। নতুন একটা শিল্প ইউনিট প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত, নতুন প্রকল্পে প্রয়োজনীয় মূলধন সংস্থানের সিদ্ধান্ত, নতুন বাজারজাতকরণ প্রসার কর্মসূচি গ্রহণের সিদ্ধান্ত ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিকল্পসমূহকে নানান বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করার প্রয়োজন পড়ে । চট্টগ্রামে বিভিন্ন পথে যাওয়ার বিকল্প মূল্যায়নে ব্যয় করার সামর্থ্যই শুধু নয় চট্টগ্রামে কাজের ধরন, যাত্রায় ব্যয়িত সময়ের পরিমাণ ইত্যাদি বিষয় সামনে রেখে বিকল্পসমূহ মূল্যায়ন করার প্রয়োজন পড়ে ।

৬. উত্তম বিকল্প গ্রহণ (Choosing proper alternative): মূল্যায়নকৃত বিকল্প হতে প্রতিষ্ঠানের বাস্তবতা বিবেচনায় উত্তম বিকল্প বাছাইয়ের কাজকেই উত্তম বিকল্প গ্রহণ বলে । এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপককে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে বিকল্পগুলোকে দেখতে হয়। মূল্যায়নে কোনো বিকল্প উত্তম মনে হলেও সামগ্রিক বিচারে তা প্রতিষ্ঠানের জন্য লাভজনক নাও হতে পারে। সাময়িকভাবে কোনো বিকল্প গ্রহণ লাভজনক মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে । বাংলাদেশে বিদ্যুত সমস্যা নিরসনে কুইক রেন্টাল পদ্ধতিতে বিদ্যুত উৎপাদন, গ্যাস ও কয়লা থেকে বিদ্যুত উৎপাদন এবং পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্পে বিদ্যুত উৎপাদনের বিভিন্ন বিকল্প রয়েছে। সরকার কুইক রেন্টাল পদ্ধতিকে সাময়িকভাবে উৎসাহিত করলেও সেই সাথে স্থায়ী বিদ্যুত প্লান্ট স্থাপনের বিষয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে । কারণ সাময়িক ব্যবস্থা দেশের জন্য মারাত্মক সংকট ডেকে আনতে পারে । এরূপ বিকল্প গ্রহণের পর সিদ্ধান্ত আকারে তা অধস্তনদের জানানো ও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়ে থাকে ।

Content added By
Promotion