স্কিল কোর্স- দুই: কেয়ার গিভিং-২

অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - জীবন ও জীবিকা - Life and Livelihood - | NCTB BOOK
11

এই কোর্স শেষে

নিরাপত্তা বজায় রেখে পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন ধরনের সেবা (ওষুধ সেবন, পালস রেট, রেসপিরেটরি রেট, রক্তচাপ, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ মাপা ইত্যাদি) দিতে পারব এবং যেকোনো প্রবীণ, শিশু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সঙ্গে মানবিক ও সহযোগিতামূলক আচরণে উদ্বুদ্ধ হব।

আফিয়া আজ খুব খুশি, কারণ একটু পরেই তার নানু আসবেন বাসায়। সারা দিন বসে গল্প করার একজন মানুষ পাওয়া যাচ্ছে- এ নিয়ে তার দাদিও বেশ উচ্ছ্বসিত। অবশেষে আফিয়ার কাঙ্ক্ষিত টিং টং (কলিং বেল) বেজে উঠল। এক দৌড়ে দরজা খুলে জাপটে ধরল নানুকে। নানুর পানখাওয়া লাল ঠোঁটে স্বর্গীয় হাসি যেন!

ঘরে ঢোকার পর শুরু হলো নানুর ঝাঁপি খোলা; প্রথমেই বের হলো এক কৌটা আমের আচার- এটা আফিয়ার; এরপর এক বাটি নারকেলের চিড়া- এটা আফিয়ার বাবার; মন্টু ভাইয়ার জন্য বের হলো গোটা দশেক নাড়ু আর মায়ের জন্য আন্ত দুখানা কলার মোচা। সব দেখে মন্টু বলে বসল, 'আমার দাদির জন্য কী এনেছ?' একগাল হেসে নানু একটা মাটির হাঁড়ি এগিয়ে দিয়ে বললেন, 'এটা তোমার দাদির জন্য'। মন্টু ঢাকনা খুলে দেখল, এর মধ্যে দুধ চিতই পিঠা। আফিয়া বলে উঠল, আরে এই পিঠা তো দাদির খুবই প্রিয়! মুচকি হেসে চিকন সুরে বলল, 'আমারও প্রিয়া' মন্টু আবার পাকড়াও করল তার নানুকে, 'আচ্ছা নানু, তুমি সব সময় সবার প্রিয় খাবার কীভাবে মনে রাখো?' নানু মন্টুর মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললেন, 'শোন ভাই, পরিবারের জন্য ভালোবাসা থাকলে এমনি এমনি সব মনে থাকে'।

রাতে আফিয়ারা সবাই মিলে খেতে বসল। আফিয়ার মা মন্টুকে বলল, 'নানু আর দাদির খাবারটা তাদের ঘরে দিয়ে এসো।' এটা শুনে আফিয়ার বাবা বললেন, 'আম্মাদের এখানেই আসতে বলো, সবাই মিলে একসঙ্গে খাবো'। মন্টু দুজনকেই টানতে টানতে খাবারের ঘরে নিয়ে এল। দুই বেয়ানের খুশি যেন উপচে পড়ছে! আফিয়ার বাবা লক্ষ্য করলেন তার শাশুড়ির হাঁটাচলায় বেশ কষ্ট হচ্ছে, তবু তার মুখে হাসি লেগে আছে। খেতে খেতে বললেন, 'আফিয়া তোমার তো আগামীকাল স্কুল ছুটি, তাই না? তুমি তোমার নানুকে কাল একটু হাসপাতালে চেকআপ করিয়ে এনো।'
আফিয়া পরদিন নানুকে ডাক্তার দেখাল। ডাক্তার তার নানুর নিয়মিত ব্লাড প্রেশার মাপা, ডায়াবেটিস টেন্ট করা, রুটিন অনুযায়ী ইনসুলিন নেওয়া, পরিমাণমতো খাবার খাওয়া এবং পিঠে ব্যথা কমানোর জন্য কিছু ব্যায়ামের পরামর্শ দিলেন। হাসপাতালের অভিজ্ঞ কেয়ার গিভার আফিয়াকে এগুলো সব এক এক করে শিখিয়ে দিলেন। বাড়ি এসে আফিয়া তার দাদি ও নানু দুজনকেই নিয়ম অনুযায়ী ব্যায়াম করাতে লাগল। এর পাশাপাশি অন্যান্য কাজও নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা শুরু করল।

প্রকৃতির নিয়মেই আমরা সবাই একসময় আমাদের দাদা-দাদি, নানা-নানিদের মতোই বৃদ্ধ হব। আমরা এখন যেভাবে চলাফেরা ও কাজকর্ম করতে পারছি, তখন হয়তো আমাদের পক্ষে তা করা সম্ভব হবে না। কিন্তু তাই বলে বৃদ্ধ অবস্থায় আমাদের পরিবারের স্বজনদের প্রতি ভালোবাসা, মায়া-মমতা, আবেগ-অনুভূতি ইত্যাদি কমে যাবে না নিশ্চয়ই। তখন পরিবারের আপনজন যদি আমাদের সময় না দেয়, প্রয়োজনীয় কাজে সহায়তা না করে, তাহলে কেমন লাগবে একবার ভেবে দেখি! নিজেকে তাদের জায়গায় ভাবলে বুঝতে পারবে, বৃদ্ধ বয়সে অন্যের সাহায্য কতটা জরুরি! তাই চলো, আমরা আমাদের পরিবারের দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানি অথবা যেকোনো বয়স্ক আত্মীয়ের সেবা-যন্ত্র করার দায়িত্ব কাঁখে তুলে নিই। আমরাই হয়ে উঠি একজন অভিজ্ঞ কেয়ার গিভার। বর্তমান বিশ্বে কেয়ারি গিভার হলো- দ্রুত চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে এমন ধরনের পেশা। বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাচ্ছে, একইসঙ্গে বয়স্ক মানুষের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বয়স্ক জনসাধারণের সেবা ও যন্ত্র নিশ্চিত করার জন্য কেয়ার গিভারের পেশার চাহিদা সারা বিশ্বেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে যেখানে অনেক পেশা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে, সেখানে কেয়ার গিভার পেশার চাহিদা আরো বাড়বে বলে মনে করা হয়। সপ্তম শ্রেণিতে আমরা বয়স্ক সেবার অনেকগুলো কাজ শিখেছিলাম এই শ্রেণিতে আমরা আরও নতুন কিছু অনুশীলন করব।

ক) ওষুধ সেবনের নিয়মকানুন

সপ্তম শ্রেণিতে আমরা ডাক্তারের পরামর্শ বা চিকিৎসাপত্র অনুযায়ী রোগীকে ওষুধ সেবনে সহায়তা করার অল্প কিছু নিয়ম শিখেছিলাম। এবার আমরা আরও একটু বিস্তারিত শিখব।

চিত্র ৮.২: দাদিকে ওষুধ সেবনে সহায়তা করা হচ্ছে

বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিছুটা কমতে থাকে। বাড়িতে বয়স্ক কেউ থাকলে মাঝে মাকে দেখা যায় তারা কোনো না কোনো রোগে ভুগছেন। কিছু রোগের নিরাময় কিংবা সহনশীল মাত্রায় রাখার জন্য ওষুধ ব্যবহার করা হয়। ওষুধ সাধারণত মুখে খাওয়ানো হয়, কিছু ওষুধ ত্বকের উপর দেওয়া হয় এবং কিছু ওষুধ ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো হয়। আমরা ওষুধ যে রোগের নিরাময়ের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করি তা উক্ত রোগের নিরাময়ে কাজ করলেও মাঝে মাঝে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করে। কারণ রক্তের প্রবাহ ওষুধকে দেহের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে দেয়। ফলে দেখা যায়, দেহের বিভিন্ন অংশেও উক্ত ওষুধ অযাচিতভাবে কাজ করতে পারে। এজন্য চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ কাউকে সেবন করানো উচিত নয়।

ওষুধ সেবন করানোর বিষয়ে আমাদেরকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। ওষুধ সেবনের সময় কিছু ভুলের কারণে এর সম্পূর্ণ উপকারিতা থেকে আমরা বঞ্চিত হই। এসব ভুলের কারণে পরবর্তীকালে রোগীর শরীরের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। এমনকি রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই চলো এবার আমরা ওষুধ খাওয়ানোর 

  •  হাত জীবাণুমুক্তকরণ: ওষুধ খাওয়ার আগে রোগীর হাত ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। তিনি নিজ হাতে খেতে অক্ষম হলে আমরা (কেয়ার গিভার) ওষুধ খাওয়ানোর আগে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করে নেব।
  •  সঠিক ওষুধ: এবার চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী চিকিৎসাপত্রে (প্রেসক্রিপশনে) লিখিত ওষুধের সঙ্গে ফার্মেসি থেকে আনা ওষুধ ভালোভাবে মিলিয়ে নিতে হবে।
  •  ওষুধের মেয়াদ: ওষুধের মোড়কে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার তারিখ দেখতে হবে। মেয়াদ না থাকলে তা খাওয়ানো যাবে না।
  • ওষুধের ডোজ, রুট ও সময়: ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী সঠিক রুটের মাধ্যমে সঠিক সময়ে ওষুধ খাওয়াতে হবে। যেমন, কিছু ওষুধ খাওয়ার আগে খেতে বলা হয়; আবার কোনটি বলা হয় খাওয়ার পরে। এই সব নির্দেশনা সাধারণত ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনে দেওয়া থাকে। আমাদের সেসব নির্দেশনা ভালোমতো পড়ে, বুঝে অনুসরণ করতে হবে। কোনো কিছু বুঝতে অসুবিধা হলে ডাক্তার বা নার্সকে জিজ্ঞেস করতে হবে। ডাক্তাররা সাধারণত ১+১+১ এভাবে সকাল, দুপুর ও রাত নির্দেশ করে থাকেন।

চিত্র ৮.৩: সাপ্তাহিক বেলাভিত্তিক চার্ট

একক কাজ

বাড়িতে কিংবা বাড়ির আশেপাশে একজন রোগীর প্রেসক্রিপশন সংগ্রহ করো। উক্ত প্রেসক্রিপশনে ওষুধের মাত্রা, সঠিক নিয়মে খাওয়ার নির্দেশনা, সংকেত/সিম্বল ও পরামর্শ রয়েছে, তা পড়তে পারছ কি না যাচাই করো এবং উক্ত রোগী ব্যক্তির জন্য এক সপ্তাহের একটি বেলাভিত্তিক চার্ট তৈরি করো।

আমার কথা (কাজটি করতে তোমার গিয়ে তোমার অভিজ্ঞতা/অনুভূতি লেখো।)

 

 

 

 

পাল্‌ল্স রেট মেপে দেখি

কেউ হঠাৎ করে অসুস্থ বোধ করলে বাড়িতে অনেক সময় আমরা হার্টবিট ঠিক আছে কি না, তা লক্ষ করার চেষ্টা করে থাকি। তোমরা নিশ্চয়ই জানো, মানবদেহের হৃৎপিন্ড একটি স্বয়ংক্রিয় পাম্পের মতো দেহাভ্যন্তরে সারাক্ষণ সংকোচন-প্রসারণের মাধ্যমে স্পন্দিত হয়, যা পালস নামে পরিচিত। অর্থাৎ কারো পালস দেখা বলতে তার হার্টবিটের রেট অনুভব করাকে বুঝায়। একজন সুস্থ মানুষের প্রতি মিনিটে ৬০-৬০ বা ৬০-১০০ বার হার্টবিট হয়। সাধারণত পুরুষদের তুলনায় নারীদের পালস রেট বেশি থাকে। আবার বড়দের তুলনায় বাচ্চাদের পালস রেট আরও বেশি হয়। মানবদেহে কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানে হাতের আঙুলের সাহায্যে সহজেই পাল্‌ল্স রেট মাপা যায়। স্থানের নাম অনুযায়ী ঐ পালসের নামকরণ করা হয়। যেমন-

  •  রেডিয়াল পালুস: বেজ অব খাদ (base of thumb) অর্থাৎ বৃদ্ধাঙ্গুলির গোড়ায় এটি পাওয়া যায়।
  •  টেম্পোরাল পালুস: সাইড অব ফোরহেড (side of forehead) অর্থাৎ কপালের দুই পাশে এটি পাওয়া যায়।
  • ক্যারোটিড পালুস: সাইড অব নেক (side of neck) অর্থাৎ ঘাড়ের দুই পাশে এটি পাওয়া যায়।
  •  এ্যাফিয়াল পালুস: ইনার অ্যাম্পেক্ট অব এলবো (Inner aspect of elbow) অর্থাৎ, দুই কনুইয়েরই ভেতরের দুই পাশে এটি পাওয়া যায়।

পাল্স‌ রেট পরিমাপ করব যেভাবে

উল্লিখিত স্থানগুলোর যেকোনোটিতে নির্দিষ্ট কৌশলে স্পর্শের সাহায্যে পালস রেট পরিমাপ করা যায়। তবে আমরা সাধারণত রেডিয়াল পালস রেটই বেশি পরিমাপ করে থাকি। নিচে রেডিয়াল পালস পরিমাপ করার ধারাবাহিক পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো-

  • শুরুতেই রোগীকে একটি আরামদায়ক অবস্থানে রাখতে হবে।
  •  রেডিয়াল পাল্‌ল্স পাওয়ার জন্য রোগীর কবজির হাড় এবং কবজির বৃদ্ধাঙ্গুলির গোড়ায় টেন্ডনের মধ্যে তিনটি আঙুলের সাহায্যে আলতো চাপ ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে তর্জনী, মধ্যমা এবং তৃতীয় আঙুলের ডগা ব্যবহার করতে হবে। রেডিয়াল পালস রোগীর উভয় কবজিতে নেওয়া যেতে পারে।
  •  আঙুলের ডগা ব্যবহার করে এমনভাবে চাপ প্রয়োগ করতে হবে, যাতে প্রতিটি বিট অনুভব করা যায়। খুব জোরে চাপ দিলে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে পাস ঠিকমতো পাওয়া যাবে না।
  •  এভাবে আলতো চাপ প্রয়োগ করে ছড়ির দিকে লক্ষ রেখে এক মিনিট পর্যন্ত নাড়ির স্পন্দন গণনা করতে হবে। এই এক মিনিটে প্রাপ্ত ফলাফলই হচ্ছে পালস রেট। প্রয়োজনে প্রাপ্ত রেট রেকর্ড রাখতে হবে।

 

চিত্র ৮.৪: আঙ্গুল/হাত দিয়ে পাল্ল্স পরিমাপ

দলগত কাজ

পাশাপাশি দুজন মিলে জোড়া তৈরি করো। এরপর একজন অন্যজনের পাল্‌স রেট পরিমাপ করো। সঙ্গে ঘড়ি না থাকলে একজন ১-৬০ পর্যন্ত গুনে এর মধ্যে পাল্ল্স সংখ্যার হিসাব করো। বাড়িতে ঘড়ি দেখে অনা সদস্যদের পাল্স রেট নেওয়া অনুশীলন করো।

তোমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, কোভিডের সময় আমরা অনেকেই একটা বিশেষ যন্ত্রের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম; সেটি হলো অক্সিমিটার। পাল্‌ল্স অক্সিমিটার যন্ত্রের সাহায্যে খুব সহজেই পালস রেটের পাশাপাশি অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাপা যায়। রক্তে অক্সিজেনের শতকরা মাত্রাকেই মেডিকেলের ভাষায় বলা হয় অক্সিজেন স্যাচুরেশন।

একজন সুস্থ ব্যক্তির রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা থাকা উচিত ৯৫ থেকে ১০০ শতাংশ। অক্সিজেন ৯০ শতাংশের নিচে নেমে গেলেই সমস্যা শুরু হয়। মাত্রা বেশি কমে গেলে রোগীকে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন দিতে হয়। পাস অক্সিমিটারের সাহায্যে পালস ও অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাপার জন্য রোগীর আঙ্গুলে চিত্রের মতো ডিজিটাল মেশিনটিতে লাগিয়ে দিতে হয়। তারপর সুইচ টিপে সেটি চালু করলে এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডিসপ্লেতে পাল্স রেট ও অক্সিজেনের মাত্রা চলে আসে।

রেসপিরেটরি রেট (Respiratory Rate) বা শ্বাস-প্রশ্বাসের হার নির্ণয়

ডাক্তাররা সাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় প্রায়ই রোগীর রেসপিরেটরি রেট লক্ষ্য রাখতে বলে থাকেন। এটি পরিমাপ করা তেমন কঠিন কিছু নয়। আমরা ফুসফুসে অক্সিজেন নেওয়ার জন্য শ্বসনযন্ত্রের মাধ্যমে বাতাস নিই, এটিকে নিশ্বাস বা শ্বাস বলে আবার যখন কার্বন-ডাই-
অক্সাইডযুক্ত বাতাস বের করে দিই, সেটিকে বলে প্রশ্বাস। এই শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার সময় রোগীর বুক প্রতি মিনিটে কতবার ওঠা-নামা করে তা পরিমাপ করাই হলো তার শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বা রেসপিরেটরি রেট। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ ব্যক্তির বিশ্রামরত অবস্থায় স্বাভাবিক রেসপিরেটরি রেট হলো মিনিটে ১২ থেকে ২০টি। তবে বয়সভেদে শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বিভিন্ন হয়। যেমন: নবজাতকের প্রতি মিনিটে শ্বাস-প্রশ্বাসের হার সাধারণত ৩০-৬০ বার। যদি স্বাভাবিকের চেয়ে এই হার কম বা বেশি হয়, তবে সেই ব্যক্তির শারীরিক বা মানসিক সমস্যা আছে বলে সাধারণত ধরে নেওয়া হয়।

চিত্র ৮.৫: অক্সিমিটারের সাহায্যে অক্সিজেন স্যাচুরেশন পরিমাপ

খাস-প্রখাসের হার বা রেসপিরেটরি রেট পরিমাপের পদ্ধতি

  • বিশ্রামরত অবস্থায় চেয়ারে বা বিছানায় আরামদায়কভাবে বসিয়ে বা শুইয়ে নিলে ভালো হয়।
  • রেসপিরেটরি রেট পরিমাপের সময় রোগীকে বলা যাবে না যে, তার রেসপিরেটরি রেট পরিমাপ করা হচ্ছে।
  • বুক বা পেটের লেভেলে চোখ রেখে এক মিনিটের ব্যবধানে বুক বা পেট যে পরিমাণ ওঠা-নামা করে, তার সংখ্যা গণনা করে শ্বাস-প্রশ্বাসের হার পরিমাপ করে নিতে হবে।
  • এরপর তা রেকর্ড শিটে নোট করতে হবে।

চিত্র ৮.৬: রেসপিরেটরি রেট পরিমাপ

রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেশার পরিমাপ করি

হৃৎপিন্ডের সংকোচন ও প্রসারণের ফলে হৃৎপিন্ড থেকে রক্ত ধমনির মধ্য দিয়ে সমগ্র শরীরে প্রবাহিত হওয়ার সময় ধমনির ভেতরের দেয়ালে যে পার্শ্বচাপ বা প্রেশার উৎপন্ন করে, তাকে রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেশার নামে পরিচিত। রক্তচাপ হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতা, ধমনির প্রাচীরের স্থিতিস্থাপকতা, রক্তের ঘনত্ব ও পরিমাপের উপর নির্ভর করে। হৃৎপিন্ড যখন সংকুচিত (systolic phase) হয় তখন রক্তনালীতে চাপ বেশি থাকে, এটা হলো সিস্টোলিক প্রেশার (systolic pressure)। আবার হৃৎপিণ্ড যখন প্রসারিত (diastolic phase) হয় তখন রক্তনালীতে চাপ কম থাকে, এটা হলো ডায়াস্টোলিক প্রেশার (diastolic pressure) 1

সিস্টোলিক চাপ ওপরে এবং ডায়াস্টোলিক চাপ নিচে লিখে রক্তচাপ প্রকাশ করা হয়। যেমন, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ মানুষের আদর্শ রক্তচাপ হলো ১২০/৮০ মি.মি. পারদ চাপ (mm/Hgi; এর অর্থ হলো সিস্টোলিক চাপ ১২০ এবং ডায়াস্টোলিক চাপ ৮০ মি.মি. পারদ চাপ। তবে এই পরিসীমা বয়স এবং রোগীভেদে সিস্টোলিকের ক্ষেত্রে ৯০-১৪০ এবং ডায়াস্টোলিকের ক্ষেত্রে ৬০-৯০৬ হতে পারে। সব সময় মনে রাখবে, কারও রক্তচাপে এই মাপের বেশি বা কম হলে বাড়ির বড়দেরকে অথবা ডাক্তারকে জানাতে হবে।

রক্তচাপ পরিমাপ করার যন্ত্রপাতির সাথে পরিচয়

সাধারণত যাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তাদের নিয়মিতই তা পরিমাপ করতে হয়। তবে যদি কেউ মাথার পেছনে ও ঘাড়ের দিকে ব্যথা অনুভব করে, কিংবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাহলে ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী রক্তচাপ মাপা হয়ে থাকে। রক্তচাপ মাপার জন্য স্ফিগমোনেনোমিটার নামের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়ে থাকে। স্ফিগমোমেনোমিটার সাধারণত তিন প্রকারের হতে পারে-

চিত্র ৮.৭: বিভিন্ন ধরনের স্ফিগমোমেনোমিটার

ক. এনারয়েড স্ফিগনোমেনোমিটার
ঘ. পারদ স্ফিগমোমেনোমিটার ও
গ. ডিজিটাল স্ফিগমোমেনোমিটার।

এনারয়েড স্ফিগমোমেনোমিটারের সাহায্যে রক্তচাপ পরিমাপের জন্য স্টেথিস্কোপ নামের যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। এর সহায়তায় শব্দের মাধ্যমে সিস্টোলিক ও ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ নির্ধারণ করা হয়। পারদ স্ফিগমোমেনোমিটারে ফলাফলটি প্রদর্শিত হয় একটি পারদ মিটারে। ডিজিটাল স্ফিগমোনেনোমিটার সরাসরি রক্তচাপ পরিমাপ করে একটি ডিজিটাল স্ক্রিনে ফলাফল প্রদর্শন করে। তবে আমদের দেশে এনারয়েড স্ফিগমোনেনোমিটারের ব্যবহার বেশি দেখা যায়। রক্তচাপ পরিমাপ করার জন্য আমরা এখন একটি এনারয়েড স্ফিগমোমেনোমিটারের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে পরিচিত হব।

বিপি বা ব্লাড প্রেশার কাফ (BP Cuff or Blood Pressure Cuff): রোগীর হাতে পেঁচিয়ে দেওয়া হয় যা ধমনিকে আটকানোর উদ্দেশ্যে হাতকে সংকুচিত করতে ব্যবহৃত হয়। বয়স্ক ও শিশুদের জন্য পৃথক বিপি কাফ ব্যবহার করতে হতে পারে।

 

চিত্র ৮.৮: এনারয়েড স্ফিগনোমেনোমিটারের বিভিন্ন অংশ

এয়ার রিলিজ বাষ (air release hulb): এয়ার রিলিজ বাল ঘুরিয়ে বিপি কাফের ভেতরে বাতাসের আসা যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

ইনফ্লেশন বাথ (inflation bulb): এয়ার রিলিজ বাধ বন্ধ রেখে ইনফ্লেশন বাল হাত দিয়ে চেপে চেপে বিপি কাফের ভিতরে প্রয়োজন অনুযায়ী পাম্প করে বাতাস প্রবেশ করানো হয়।

এনাররেড ম্যানোমিটার (anaroid manometer): এটি একটি চাপ পরিমাপক যন্ত্র যেটি মি.মি. পারদ চাপ এককে রক্তচাপ পরিমাপ করে।

টিউব কানেক্টর (tube connector): টিউব কানেকটরের সাহায্যে এনারয়েড ম্যানোমিটার ও ইনফ্লেশন বাল বিপি কাফের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এর মাধ্যমে বাতাস ভেতরে প্রবেশ করে ও বাহিরে যায়, আবার চাপের কারণে ন্যানোমিটারের কাটা ওঠা-নামা করানো যায়।

এবার আমরা স্টেথোস্কোপ সম্পর্কে জেনে নিই-

স্টেথোস্কোপ (stethoscope): স্টেথোস্কোপ হলো মানুষ অথবা প্রাণিদেহের হৃৎস্পন্দন কিংবা অন্যান্য অভ্যন্তরীণ শব্দ শোনার জন্য ব্যবহৃত একটি যন্ত্র। এটি প্রধানত হৃৎস্পন্দন এবং নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে ব্যবহার করা হয়। তবে এটি অস্ত্র, ধমনি এবং শিরার রক্ত বয়ে চলার শব্দ শোনার জন্যও ব্যবহৃত হয়। রক্তচাপ পরিমাণ শিখতে হলে স্টেথিস্কোপের বিভিন্ন অংশের সঙ্গেও আমাদের একটু পরিচিত হওয়া দরকার-

চিত্র ৮.৯: স্টেথোস্কোপের বিভিন্ন অংশ

ইয়ারপিস (carpiece): এই অংশটি কানের মধ্যে প্রবেশ করানোর পর ডায়াফ্রাম চালু থাকলে শরীরের অভ্যন্তরীণ শব্দ শোনা যায়।

টিউবিং (tubing): এটি একটি নমনীয় রাবার টিউব যেট ডায়াফ্রাম দ্বারা গৃহীত শব্দ ইয়ারপিসের মাধ্যমে আমাদের কানে/শ্রবণযন্ত্রে পৌঁছে দেয়।

বেল (bell): বেল ঘণ্টা ডায়াফ্রামের উল্টো পাশে লাগানো থাকে এবং এটি মৃদু ও অমসৃন শব্দ শুনতে সাহায্য করে। এটিকে ঘুরিয়ে ভায়াফ্রামের মুখ খোলা বন্ধ করা যায়।

অয়াজান (diaphragm): ডায়াফ্রাম মধ্যচ্ছদা স্টেথোস্কোপের এমন একটি সমতল অংশ, যেটি রোগীর শরীরের বিভিন্ন অংশে স্পর্শ করাতে হয়। এটিই মূলত শব্দ গ্রহণ করে টিউবের মাধ্যমে আমাদের কানে পৌঁছে দেয়।

 

রক্তচাপ পরিমাপের পদ্ধতি

সাধারণত বাহুতে রক্তচাপ পরিমাপ করা হয়। তবে কোনো ব্যক্তির দুটি হাত না থাকলে বা দুই হাতে কোনো সমস্যা থাকলে পায়ের হাটুর ওপরে রক্তচাপ পরিমাপ করা যায়।

রক্তের গ্লুকোজ বা শর্করা পরিমাপ করা

আমরা জানি, শর্করা মানবদেহের শক্তির মূল জোগানদাতা। আমরা যখন শর্করাজাতীয় খাবার খাই, সেটি গ্লুকোজ বা জটিল শর্করা হিসেবে শরীরে জমা হয়। শরীরের স্বাভাবিক কর্মকান্ড সুষ্ঠুভাবে বজায় রাখার জন্য খাবারের জটিল শর্করা ভেঙ্গে শরীরের ব্যবহার উপযোগী সরল শর্করা তৈরি হয়, যে কাজটি করে থাকে ইনসুলিন নামের হরমোন। সাধারণত খাওয়ার আগে প্রতি লিটার রক্তে ৪.২০৭.২ মিলিমোল এবং খাওয়ার ২ ঘন্টা পর ১০ মিলিমোলের নিচে গ্লুকোজের মাত্রা থাকলে তাকে স্বাভাবিক বলা হয়ে থাকে। এর বেশি হলে কোনো ব্যক্তির ডায়াবেটিস আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে বয়স, অন্যান্য অসুখ, ডায়াবেটিসজনিত বিভিন্ন জটিলতা, গর্ভাবস্থা এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ভিন্ন হতে পারে।

যেকোনো বয়সের মানুষের জন্যই নিয়মিত রক্তের গ্লুকোজ পরিমাপ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সপ্তাহে অন্তত এক দিন অবশ্যই রক্তের গ্লুকোজ মেপে দেখা উচিত। তবে ডায়াবেটিক বা বহুমূত্র রোগীর জন্য ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী রক্তের এই পরীক্ষা দিনের বিভিন্ন সময়ে করতে হতে পারে যেমন: সকালে খালি পেটে, নাশতার দুই ঘণ্টা পরে, দুপুরে খাওয়ার আগে ও পরে, রাতে খাওয়ার আগে ও পরে প্রভৃতি। গ্লুকোমিটার নামের একটি যন্ত্রের সাহায্যে এক ফোঁটা রক্ত ব্যবহার করে তাৎক্ষণিকভাবেই রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা করা যায়। আমরা এখন গ্লুকোমিটারের সাহায্যে রক্তের গ্লুকোজ পরিমাপ করা অনুশীলন করব। আমরা প্রথমে যন্ত্রপাতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিই-

আমরা এখন বর্ণিত ধাপগুলো অনুযায়ী গ্লুকোমিটার ব্যবহারের মাধ্যমে ব্লাড গ্লুকোজ পরিমাপের কাজটি অনুশীলন করব।

মানুষের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শরীরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এজন্য বাড়িতে কোনো বয়স্ক বা প্রবীণ ব্যক্তি থাকলে তার সেবার জন্য আমাদেরকে শরীরের তাপমাত্রা, ওজন, পালস রেট, রেসপিরেটরি রেট, রক্তচাপ, গ্লুকোজের মাত্রা পরিমাপ ইত্যাদি প্রায় সববিষয়ই ভালোভাবে শিখে রাখতে হবে বা অনুশীলনের মাধ্যমে ভালোভাবে আয়ত্ত্ব করতে হবে। আমরা দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা 'দক্ষতা উন্নয়নের জানালা'য় কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ধরনের কোর্স সম্পর্কে খানিকটা জেনেছিলাম। মজার বিষয় হলো, আমাদের এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) এর নবম ও দশম শ্রেণির জন্য বর্তমানে 'পেশেন্ট কেয়ার টেকনিক ১' ও 'পেশেন্ট কেয়ার টেকনিক ২' নামে একটি বিশেষ কোর্স প্রচলিত রয়েছে। উপরের অনেক তথ্যই আমরা সেখান থেকে নিয়েছি। সুতরাং কেয়ার গিভিং সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার জন্য কিংবা একজন ভালো কেয়ার গিভার হওয়ার জন্য উক্ত কোর্সের জন্য নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক থেকেও আমরা সহায়তা নিতে পারব।

একক কাজ

আগামী এক সপ্তাহ তোমাদের বাড়িতে আছেন এমন কোনো বয়স্ক ব্যক্তির (দাদা/দাদী, নানা/নানী, আত্মীয়, গৃহকর্মী, দাড়োয়ান) নিয়মিত যত্ন নাও। যদি সেরকম কেউ না থাকেন তাহলে তোমাদের বিদ্যালয়ের কারো অথব্য প্রতিবেশি বা নিকট কোনো আত্মীয় যিনি তোমাদের বাড়ির কাছাকাছি থাকেন তার অথবা নিজের বাবা-মায়ের নিয়মিত যন্ত্র নাও। তাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য কী কী কাজ করছো তা একটি তালিকায় লিপিবদ্ধ করো। (নিচের ছকটির মতো একটি ছক নিজেদের জীবন ও জীবিকা খাতায় বানিয়ে নাও এবং সেখানে নিয়মিত তথ্যগুলো লিখে রাখো। বিদ্যালয়ে রক্তচাপ পরিমাপ যন্ত্র থাকলে তা দিয়ে নিজেদের শিক্ষক বা বিদ্যালয়ের কোনো বয়স্ক ব্যক্তির রক্তচাপ পরিমাপ করে তথ্য জমা করা যেতে পারে।)

পরিবারে শিশু সদস্যদের জন্য জামরা যা করব

আমাদের পরিবারের শিশু সদস্যদের হাসিমাখা মুখ আমাদের ঘরে ফেরার আকর্ষণ। তারা সবার আদর ও ভালোবাসায় বেড়ে উঠে। তাদের উচ্ছলতা, দুষ্টুমি ও খেলাধুলা পরিবারে আনন্দময় পরিবেশ তৈরি করে। এই শিশুটিকে ভালো রাখার দায়িত্ব শুধু বাবা-মায়ের একার নয়; আমরা যারা তাদের চেয়ে বয়সে একটু বড়, তাদের সবারই কিছু কিছু দায়িত্ব রয়েছে, যা পালন করা খুব জরুরি।

দলগত কাজ

দলের জন্য নির্বাচিত কেস ভালোভাবে পড়ে ঘটনাটি বুঝে নাও। এই ধরনের পরিস্থিতিতে তুমি কীভাবে দায়িত্ব পালন করবে, তা দলের সবাই মিলে আলোচনা করো। আলোচনার ভিত্তিতে ছোট একটি অভিনয়ের স্ক্রিপ্ট বানাও এবং ক্লাসে তা অভিনয় করে দেখাও।

আমরা এখন পরিবারের ছোট ছোট অনেক দায়িত্ব নিতে শিখেছি। আমাদের পরিবারে যদি ছোট কোনো ভাই, বোন বা আত্মীয় স্বজন থাকতে পারে। তাদের কিছু কিছু যত্ন আমাদের করা উচিত। বাড়ির ছোট শিশুদের যত্নে আমাদের যা করণীয়-

কাজের প্রশংসা করা: বাড়ির ছোটরা যখন কোনো ভালো কাজ করবে তখন তার কাজের জন্য আমরা প্রশংসা করব, তাতে সে আরও ভালো করার অনুপ্রেরণা অনুভব করবে।

হাসিমুখে ভুল শুধরে দেওয়া: ছোটদের ভুলের জন্য শাস্তি বা তিরস্কার না করে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলব যাতে কাজটি করায় কী ক্ষতি হচ্ছে তা সে বুঝতে পারে। ছোটদের সাথে একবারেই ধমক দিয়ে কথা বলব না, চেঁচামেচিও করব না। ধমক দেওয়া হলে অনেক সময় বাচ্চাদের জিদ চেপে যায় এবং তা পুনরায় করতে থাকে। তাদের সাথে কখনও উত্তেজিত হয়ে কথা বলব না; তাদের সামনে অন্যদের সাথে কোনও বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাটি করব না। এরকম কোনও পরিস্থিতিতে পড়লে তাদেরকে আড়ালে সরিয়ে নিতে হবে, যাতে তারা তা দেখতে বা শুনতে না পায়। তারা কারো সাথে ঝগড়া করলে তার সাথে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব, শান্ত রাখার ব্যবস্থা করব; এতে তারা সহনশীল হতে শিখবে।

চিত্র:৮.১০: ধারালো জিনিস নিয়ে খেলার সময় শিশুদের সতর্ক করা

সবসময় সতর্ক দৃষ্টি রাখা: ছোটরা বিপদজ্জনক জিনিস যেমন আগুন, ছুরি-কাচি, বৈদ্যুতিক তার, সুইচ ইত্যাদি নিয়ে খেলা করছে কিনা, গিলে ফেলতে পারে এমন শত্রু কিছু (তেঁতুল, বরই, খেজুরের বিচি, কয়েন, মার্বেল, পুঁতি, কড়ি ইত্যাদি) মুখে নিচ্ছে কি না কিংবা আঘাত পেতে পারে এমন কিছু নিয়ে খেলছে কি না, সবসময় তা লক্ষ্য রাখব। এগুলো নিয়ে খেলা করলে কী ধরনের বিপদ হতে পারে তা বুঝিয়ে বলব, নিজেকে নিরাপদ রাখার কৌশল ভালোভাবে শিখয়ে দেব।

স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গঠনে সহায়তা করা: পরিবারে ছোটদের স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গঠনে নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করা, খাবারের আগে ও পরে হাত ধোয়া, খাবার গ্রহণের আদবকায়দা অনুসরণ করা, নখ কাটা, বাথরুম ও টয়লেট  পরিচ্ছন্নভাবে ব্যবহার করা, সময়মতো ঘুমানো, নিজের ছোট ছোট কাজগুলো নিজেই যেন করতে পারে সেজন্য তা শিখিয়ে দেওয়া ও মনে করিয়ে দেওয়া ইত্যাদি দায়িত্ব আমাদের সবার পালন করা জরুরি। 

খেলাধুলা ও বিনোদনে সঙ্গী হওয়া: আমাদের ছোট ভাই-বোনেরা যেন একাকীত্ব অনুভব না করে সেজন্য আমাদের ব্যস্ততা বা কাজের ফাঁকে তাদের একটু সময় দেব। যেমন-তাদের সাথে গল্প করা, তাদের পছন্দের খেলনা দিয়ে তাদের সাথে খেলা করা, পছন্দের কমিকস পড়া, গল্পের বই পড়ে শোনানো, বাইরে প্রকৃতিতে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি কাজগুলো করার চেষ্টা করব।

সামাজিক রীতিনীতিতে অভ্যস্থ করে তোলা: শিশুরা অনুকরণপ্রিয়, তারা আমাদের আচরণ দেখে নিজেরাই শিখে নেবে। এজন্যে তাদের সঙ্গে সবসময় সতা কথা বলা, হাসিমুখে কথা বলা, কোনো ভুল করলে দুঃখিত বলা এবং তাদের যেকোনো ভালো কাজের জন্য ধন্যবাদ জানানো উচিত। এতে তারাও এই আচরণগুলো নিয়মিত চর্চা করবে।

একক কাজ

আমরা আমাদের পরিবারের ছোট সদস্যদের জন্য কী কী কাজ করি তার একটা তালিকা বানাই। এবার তা উপরের তালিকার সাথে মিলিয়ে দেখি। যেগুলো আমরা করি, সেগুলোতে টিকা) চিহ্ন দিই এবং যেগুলো করি না, সেগুলো নিয়ে একটু ভেবে দেখি কেন আমরা তা করিনা, কিংবা করলে কী কী সুবিধা হতো, না করায় কী কী সমস্যা তৈরি হচ্ছে তা খুঁজে বের করি। এরপর আমরা এখন থেকে আমাদের ছোট ভাইবোন বা ছোট শিশুদের সাথে কী ধরনের আচরণ করব, তা নির্ধারণ করে বাড়িতে নিয়মিত অনুশীলন শুরু করি।

পরিবারের প্রতিবন্ধী সদস্যদের জন্য আমরা যা করব

প্রতিটি মানুষের সক্ষমতা ও চাহিদার ভিন্নতা রয়েছে। সেরকম ভিন্নতার মধ্যে একটি হলো- মানুষের বিভিন্ন রকমের প্রতিবন্ধিতা। মানুষের এই প্রতিবন্ধিতা আমাদের বৈচিত্র্যেরই অংশ। প্রতিবন্ধিতা মানেই তার সক্ষমতা নেই, তা কিন্তু নয়। এদের মধ্যেও মেধাবী ও অভিমেধাবী মানুষ রয়েছে। আমাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী কেউ থাকতে পারে। বিভিন্ন সময়ে তাদের বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। পরিবারের সদস্য হিসেবে আমাদেরকে অবশ্যই তাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া কর্তব্য।

দৃশ্যপট ১

টিফিনের ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে ক্লাসের সবাই দৌড়ে মাঠে চলে গেল। ভেসে আসছে উল্লাস, আনন্দ আর হইচইয়ের শব্দ। ঝুমন টিফিন বক্সটা এক হাতে ধরে অন্যহাতে হইল ঘুরিয়ে বারান্দার দিকে আসছিল। হঠাৎ ওপাশ থেকে ছুটে আসা এক শিক্ষার্থীর ধাক্কায় বক্সটা পড়ে গেল। কুমন মেঝেতে পড়ে থাকা টিফিনের দিকে খানিকটা তাকিয়ে একটা বড় শ্বাস ছাড়ল। এরপর একদৃষ্টে চেয়ে থাকলো মাঠের পানে- বাচ্চারা সব সেখানে দৌড়াচ্ছে, খেলছে, আনন্দে মেতে আছে। ওর ভেতর থেকে কেমন যেন একটা গুমোট কান্না বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে!

দলগত কাজ

কুমনের জন্য আমরা কী কী করতে পারি, তার একটি তালিকা বানাও। কুমনের মতো অন্য যারা আছে, তাদের জন্য আজ থেকে আমরা কী কী করব, তা নির্ধারণ করো।

একজন প্রতিবন্ধী সদস্যের বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন হতে পারে। যেমন- নিত্যদিনের কাজে সহায়তা, যোগাযোগে সহায়তা, থেরাপির কাজে সহায়তা, সামাজিক ও বিনোদনমূলক কাজে সহায়তা, চাকুরির ক্ষেত্রে সহায়তা, গাইডেন্স ও কাউন্সিলিং এর কাজে সহায়তা ইত্যাদি। আমাদের পক্ষে হয়তো তাদের সব ধরনের

সহায়তা করা সম্ভব হবে না। যেটুকু আমাদের পক্ষে করা সম্ভব, আমরা সেটুকুই করব। যেমন-

  • তাদের প্রতিবন্ধিতা নিয়ে কখনও হাসি-ঠাট্টা বা বিদ্রূপ করব না। তারা লজ্জা পেতে পারে, অস্বস্থিবোধ করতে পারে কিংবা দুঃখ পেতে পারে এমন কোনো কথা বা কাজ তাদের সামনে করব না।
     
  • আমরা খেলাধুলার সময় অবশ্যই তাদেরকেও সঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা করব। সামাজিক যেকোনো অনুষ্ঠান বা আয়োজনে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরিতে সচেষ্ট থাকব। 
  • বন্ধুদের সাথে তারাও যেন সহজেই মিশতে পারে সেরকমের পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখব।
  •  রাস্তা পারাপার, যানবাহনে ওঠা-নামা, খাবার সংগ্রহ, বোঝা বা ব্যাগ বহন ইত্যাদি কাজে তাদের সাধ্যমতো সহায়তা করব।

চিত্র ৮.১১: পরিবারের সবাইকে নিয়ে আনন্দয়ন সময় কাটানো

বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণ ও মানসিক চাপ, দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন কারণে ইদানীং প্রতিবন্ধিতার হার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে 'ডিসএবিলিটি কেয়ার' নামে ভিন্নধর্মী একটি পেশা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই প্রচলন শুরু হয়েছে। প্রতিবন্ধীদের নিত্যদিনের কাজের জন্য স্পেশাল কেয়ার গিভার, শিক্ষা সহায়তার জন্য টিচিং এসিস্টেন্ট, যোগাযোগে সহায়তার জন্য অলটারনেটিভ ল্যাগুয়েজ ইন্টারপ্রেটর, শারীরিক ব্যায়াম ও থেরাপি সহায়তার জন্য থেরাপিটিক সাপোর্টার, চাকুরিতে কাজে সহায়তার জন্য অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, মানসিক পরিচর্যার জন্য গাইডিং কাউন্সিলর ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের পেশার চাহিদা বেড়েছে। প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন কাজে সক্ষম করে তোলার জন্য চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ ও সেবামূলক পেশাও দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশেও প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা ও চাকুরির জন্য রয়েছে বিশেষ কোটা সুবিধা। তাদের পিছনে রেখে সমাজ এগিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই মানবিক কারণে একজন মানুষ হিসেবে তাদেরকে সাধ্যমতো সহায়তা করে এগিয়ে নেওয়া আমাদের কর্তব্য। তাই চলো- পরিবারের শিশু, প্রতিবন্ধী, বয়স্ক সদস্যসহ সকলের প্রতি আমাদের মমতার হাত বাড়িয়ে দেই।]

প্রজেক্ট ওয়ার্ক

বিদ্যালয়ে একটি হেলথ ক্যাম্পের আয়োজন করো। হেলথ ক্যাম্প সমাপ্ত করার পর ক্যাম্পিং সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন লেখো।

হেলথ ক্যাম্পের পরিকল্পনার সময় প্রধান শিক্ষক, স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ের শিক্ষক, ওপরের ক্লাসের (সিনিয়র) শিক্ষার্থী, নিজেদের অভিভাবক এবং এই বিষয়ের শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সুন্দর পরিকল্পনা করো। কবে, কখন করবে; কীভাবে হেলথ ক্যাম্পের আইটেম সংগ্রহ করবে, ক্যাম্পিংয়ে কী কী সেবা প্রদান করা হবে, কাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হবে, কীভাবে ক্যাম্প সাজানো হবে ইত্যাদি বিষয়গুলো ভালোভাবে পরিকল্পনা করে নাও। এটি যেহেতু একটি বিশেষ ধরনের ইভেন্ট, তাই এর ম্যানেজমেন্টের বিষয়টিও একটু ভিন্নধর্মী হবে। সবাই মিলে পরিকল্পনা করে চমৎকার একটি আয়োজন করো।

দাদির কাছে রাতবিরেতে গল্প শোনা,
দাদার সঙ্গে ভরদুপুরে ঘাটে।
নানির কোলে আবদার বোনা,
নানার পিছে যত মেলা আর হাটে

পরিবারে দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানির সঙ্গে একসময় এমন মধুর সময় কাটানোর সুযোগ ছিল সবার। সময়ের সঙ্গে অনেক ব্যস্ততা বেড়েছে আমাদের। এই ব্যস্ততার অজুহাতে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের পরিবারের মিষ্টি- মধুর সম্পর্ক ও মুহূর্তগুলো। বাড়ির প্রবীণ সদস্যদের ঠাঁই হচ্ছে 'আনন্দ আশ্রয়'-এর নামে নির্বাসিত বৃদ্ধাশ্রমে। অথচ এই পরিবারের ভালো থাকা এবং ভালো রাখার জন্য একটা সময় তাঁরাই করেছেন প্রাণান্ত পরিশ্রম। শক্তি হারিয়ে তারা যেন কোনো পরিবারে বোঝা নামে উপাধি না পান, সেদিকে সতর্ক থাকা ভীষণ জরুরি। কারণ, দুদিন পরে আমরাও থাকব তাদের সারিতে। প্রবীণ বয়সে কেউ কেউ শিশুদের মতো সরল ও অবুঝ হয়ে ওঠেন। এটাই স্বাভাবিক; আগামীকাল একই অবস্থানে আমরাও থাকব। তাই তাঁদের সঙ্গে কখনো ধমকের সুরে কথা বলব না। তাঁরা কষ্ট পেতে পাবেন এমন কোনো আচরণও করব না। শত ব্যস্ততার মাঝেও তাদের সঙ্গে আমাদের সময় কাটাতে হবে, তাদের সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে যেতে হবে; তাদের শরীর ও মনকে সতেজ রাখার চেষ্টা করতে হবে। কারণ, আমাদের মনে রাখতে হবে, তাদের আদর-স্নেহ-ভালোবাসায়ই আমরা বেড়ে উঠেছি একসময়! তাই যত্নে থাকুক আমাদের পরিবারের প্রবীণ সদস্য, মমতায় ঘিরে থাকুক তাদের প্রতিটি মুহূর্ত! একইসাথে যত্ন নেবো বাড়িতে থাকা শিশুসহ সকল সদস্যের।

স্বমূল্যায়ন

ক) রক্তচাপ পরিমাপের সময় কী কী সতর্কতা মেনে চলা প্রয়োজন?
 

 

খ) ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী ওষুধ খাওনোর বিষয়ে কী কী দিক লক্ষ রাখতে হবে?
 

 

গ) কোনো পরিমাপ স্বাভাবিক মাত্রার বেশি বা কম পাওয়া গেলে আমাদের করণীয় কী?

 

ঘ) আমাদের পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের (বাবা, মা, ভাই, বোন, দাদা, দাদি, নানা, নানি বা অন্য যেকোনো স্থায়ী/অস্থায়ী আত্মীয়, গৃহকর্মী) জন্য তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গত এক বছরে আমি কী কী করেছি?

 

ঙ) আমার সেবা পেয়ে তাদের অনুভূতি কী?

 

শিক্ষকের মন্তব্য:

 

 

 

 

 

Content added || updated By
Promotion