হজ ( أَلْحَجَّ )
হজ ইসলামি শরিয়তের অন্যতম ফরয ইবাদাত। শাওয়াল, জিলকদ ও যিলহজের প্রথম ১০ দিনকে হজের সময় ধরা হলেও মূলত ৮ থেকে ১২ যিলহজ পর্যন্ত পাঁচ দিনই হজের আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়। হজের নির্ধারিত স্থান হলো কাবা শরিফ, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফা ও মুযদালিফা। হজের প্রতি গুরুত্বারোপ করে আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে সূরা হজ নামে একটি সূরা নাযিল করেছেন। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে হজের নির্দেশ দিয়ে বলেন,
وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا
অর্থ: মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ গৃহের হজ করা তার অবশ্য কর্তব্য (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭)
হজে আর্থিক ও শারীরিক শ্রমের সমন্বয় রয়েছে যা অন্য কোনোটিতে নেই। ফরয হজ আদায় না করলে ইহুদি- নাসারার মতো মৃত্যু হবে বলে হাদিসে সতর্ক করা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি হজ করার সামর্থ্য রাখে, তবুও হজ করে না, সে ইহুদি হয়ে মৃত্যুবরণ করল কি খ্রিষ্টান হয়ে, তার কোনো পরোয়া আল্লাহর নেই।
অন্যদিকে হজের ফযিলত সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, 'যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ করল এবং এসময় অশ্লীল ও গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকল, সে নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসবে' (বুখারি)। আর 'মাবরুর হজের বিনিময় জান্নাত ভিন্ন অন্য কিছু নয়।' (বুখারি) হজ মানুষকে সচ্ছলতা প্রদান করে। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, 'হজ ও ওমরাহ পর পর করতে থাকো। কারণ, হজ ও ওমরাহ উভয়ই দারিদ্র্য, অভাব এবং গুনাহগুলোকে এমনভাবে দূর করে দেয়; যেমন আগুনের ভাট্টি লোহা, সোনা ও রূপার ময়লা দূর করে দেয়।'
হজ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য অনুসন্ধান (প্রিয় শিক্ষার্থী, তুমি ধর্মীয় গ্রন্থ, অনলাইন সোর্স বা সাক্ষাৎকার এর মাধ্যমে হজ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করো। তোমার সংগৃহিত তথ্যগুলো খাতায় লিখে নাও)। |
হজের সচিত্র কার্যাবলি |
চিত্র: হজের স্থানসমূহ
হজের প্রথম দিন (মিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা)
৮ যিলহজ থেকে ১২ যিলহজ পর্যন্ত এই পাঁচ দিনকে হজের দিন বলা হয়। ৮ যিলহজ সকালে হাজিগণ ইহরাম বাঁধা অবস্থায় মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। ৮ যিলহজের যোহর, আসর, মাগরিব, এশা এবং ৯ যিলহজের ফজরের নামায মিনায় আদায় করা এবং রাতে মিনায় অবস্থান করা সুন্নাত।
হজের দ্বিতীয় দিন (আরাফায় অবস্থান)
হজের দ্বিতীয় দিন ৯ যিলহজ আরাফায় অবস্থান করা ফরয। ফজরের নামায মিনায় পড়ে আরাফার ময়দানের দিকে রওনা করতে হয়। প্রয়োজনে ফজরের আগে রাতেও আরাফার উদ্দেশ্যে রওনা করা যায়। আরাফার ময়দানে দুপুর ১২টার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করতে হয়। আরাফার ময়দানে দোয়া কবুল হয়।
মুযদালিফায় অবস্থান
মিনা ও আরাফার মাঝখানে অবস্থিত ময়দানের নাম মুযদালিফা। এখানে ১০ যিলহজ রাত (৯ যিলহজ দিবাগত রাত) অতিবাহিত করা হাজিদের জন্য ওয়াজিব। মুযদালিফায় পৌঁছে এশার ওয়াক্ত হলে এক আজান ও এক ইকামতে প্রথমে মাগরিবের ফরয তারপর এশার ফরয পড়তে হয়। এরপর মাগরিব ও এশার সুন্নাত এবং বিতর পড়তে হয়। মাগরিব ও এশার সালাত আদায়ের পর সুবহে সাদিক পর্যন্ত মুযদালিফায় অবস্থান করা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। এখানে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত অবস্থান করা ওয়াজিব। এ রাতে জাগ্রত থাকা ও ইবাদাতে নিমগ্ন হওয়া মুস্তাহাব।
হজের তৃতীয় দিন (পাথর নিক্ষেপ, কুরবানি, চুল মুণ্ডন ও তাওয়াফ)
হজের তৃতীয় দিন ১০ যিলহজ মিনায় পৌঁছার পর এ দিনের চারটি কাজ ধারাবাহিকভাবে পালন করতে হয়:
১. পাথর নিক্ষেপ করা: এই দিনের প্রথম কাজ হলো জামারায়ে আকাবায় গিয়ে সাতটি পাথর নিক্ষেপ করা (ওয়াজিব)। এটাকে জামারাতুল কুবরাও বলা হয়।
২. কুরবানি করা : এই দিনের দ্বিতীয় কাজ হলো দমে শোকর বা হজের শুকরিয়া স্বরূপ কুরবানি করা (ওয়াজিব)। কিরান ও তামাত্তু হজ পালনকারীদের জন্য এটা ওয়াজিব। আর ইফরাদ হজ পালনকারীদের জন্য মুস্তাহাব।
৩. চুল মুণ্ডন বা কর্তন করা: এই দিনের তৃতীয় কাজ হলো হলক বা কসর করা। চুল মুণ্ডন বা কর্তন করা ওয়াজিব। কুরবানি করার পর পুরো মাথার চুল মুণ্ডন করে ফেলা উত্তম। মুণ্ডনকারীদের জন্য রাসুল (সা.) তিনবার দোয়া করেছেন। তাই এতে ফযিলত বেশি। তবে মহিলারা চুলের অগ্রভাগ থেকে সামান্য পরিমানে কেটে ফেলবেন।
৪. তাওয়াফে যিয়ারত: এ দিনের চতুর্থ কাজ হলো তাওয়াফে যিয়ারত (ফরয)। একে 'তাওয়াফে ইফাযা'ও বলা হয়। এটা হজের শেষ রুকন। মিনায় উপরোক্ত কাজগুলো সেরে হাজিগণ মক্কা শরিফে গিয়ে তাওয়াফ-ই-যিয়ারত করেন। তাওয়াফে যিয়ারতের কোনো বদলা নেই, এ তাওয়াফ করতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।
হজের চতুর্থ দিন (মিনায় রাতযাপন এবং পাথর নিক্ষেপ)
১১ যিলহজ মিনায় রাতযাপন সুন্নাত। এদিন মিনায় তিন জামারায় পাথর মারা ওয়াজিব। দুপুরের পর প্রথমে জামারায়ে সুগরা, (মসজিদে খাইফের সন্নিকটে) অতঃপর জামারায়ে উসতা, সর্বশেষ জামারায়ে আকাবায় ৭টি করে মোট ২১টি পাথর নিক্ষেপ করতে হবে। প্রতিটি পাথর নিক্ষেপের সময় তাকবির বলতে হবে।
হজের পঞ্চম দিন (মিনায় রাতযাপন এবং পাথর নিক্ষেপ)
১২ যিলহজের আগের দিনের মতো মিনায় রাতযাপন সুন্নাত। মিনায় তিন জামারায় পাথর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব।
বিদায়ী তাওয়াফ
পবিত্র মক্কা থেকে বিদায়ের আগে বিদায়ী তাওয়াফ ওয়াজিব। প্রত্যেক হাজি সাহেবের উচিত মাকামে ইবরাহিমে দুই রাকা'আত নামায পড়ে মূলতাযাম, কাবার দরজা ও হাতিমে দোয়া করা; যমযমের পানি পান করেও দোয়া করা এবং বিদায়ের বেদনা দিয়ে কাবা ঘর থেকে বিদায় নেওয়া। তাওয়াফে বিদা না করলে দম দিতে হবে।
চিত্রাঙ্কন (বাড়ির কাজ)
'হজের কার্যাবলি সম্পন্ন করার জন্য নির্ধারিত স্থানসমূহ চিত্রাঙ্কন' (উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে তুমি মিনা, মুযদালিফা, আরাফা, বাইতুল্লাহ ইত্যাদি স্থান চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে হজের চিত্র আঁকো।) |
হজের প্রকারভেদ
হজ তিনভাবে আদায় করা যায়: তামাত্তু, কিরান ও ইফরাদ।
১. তামাত্তু হজ
হজের মাসগুলোতে হজের সফরে বের হওয়ার পর প্রথমে শুধু ওমরাহ এর ইহরাম বাঁধা এবং ওমরাহ সম্পন্ন করে হালাল হয়ে যাওয়া। এরপর ৮ যিলহজ তারিখে হজের ইহরাম বেঁধে হজের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করাকে তামাত্তু হজ বলে।
তামাত্তু হজের নিয়ম
হজ পালনকারী হজের মাসগুলোতে প্রথমে শুধু ওমরাহ এর জন্য তালবিয়া পাঠের মাধ্যমে ইহরাম বাঁধবেন। তারপর তাওয়াফ ও সাঈ সম্পন্ন করে মাথা মুণ্ডন অথবা চুল ছোট করার মাধ্যমে ওমরাহ পালন সম্পন্ন করে ইহরাম থেকে হালাল হয়ে যাবেন এবং স্বাভাবিক কাপড় পরে নেবেন। ইহরাম অবস্থায় হারাম কাজগুলো তার জন্য হালাল হয়ে যাবে। তারপর যিলহজ মাসের ০৮ তারিখ মিনা যাবার আগে নিজ অবস্থানস্থল থেকে হজের ইহরাম বাঁধবেন। তারপর যথাযথ নিয়মে হজের যাবতীয় কার্যাবলি সম্পন্ন করবেন।
তামাত্তু হজকারীর জন্য এক সফরে দুটি ইবাদাতের সুযোগ লাভের শুকরিয়াস্বরূপ হাদি বা পশু জবেহ করা ওয়াজিব।
২. কিরান হজ
এক সফর ও এক ইহরামে ওমরাহ ও হজ আদায় করাকে কিরান হজ বলে। অর্থাৎ হজের সফরে ইহরাম বেধে প্রথমে ওমরা আদায় করা এবং ঐ ইহরাম থেকে হজের নির্ধারিত দিনে হজের কার্যাবলি সম্পন্ন করাকে কিরান হজ বলে।
কিরান হজের নিয়ম
মিকাত থেকে ইহরাম বাঁধার সময় একই সঙ্গে হজ ও ওমরার জন্য لَبَّيْكَ عُمْرَةً وَحَجَّاً )লাব্বাইকা ওমরাতান ওয়া হজ্জান) বলে তালবিয়া পাঠ শুরু করা। তারপর মক্কায় পৌঁছে প্রথমে ওমরাহ আদায় করা এবং ইহরাম অবস্থায় মক্কায় অবস্থান করা। অতঃপর হজের সময় ৮ যিলহজ ইহরামসহ মিনা-আরাফা-মুযদালিফায় গমন এবং হজের যাবতীয় কাজ সম্পাদন করা।
কিরান হজকারীর জন্য এক সফরে দুটি ইবাদাতের সুযোগ লাভের শুকরিয়াস্বরূপ হাদি বা পশু জবেহ করা ওয়াজিব।
৩. ইফরাদ হজ
হজের মাসগুলোতে শুধু হজের ইহরাম বেঁধে হজের কার্যক্রম সম্পন্ন করাকে ইফরাদ হজ বলে।
ইফরাদ হজের নিয়ম
হজের মাসগুলোতে শুধু হজের ইহরাম বাঁধার জন্য لَبَّيْكَ حَبًّا )লাব্বাইকা হজ্জান) বলে তালবিয়া পাঠ শুরু করা। এরপর মক্কায় প্রবেশ করে তাওয়াফে কুদুম অর্থাৎ আগমনী তাওয়াফ এবং হজের জন্য সাঈ করা। অতঃপর ১০ যিলহজ কুরবানির দিন হালাল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ইহরাম অবস্থায় থাকা। এরপর হজের অবশিষ্ট কাজগুলো সম্পাদন করা।
উত্তম হজ
এ তিন প্রকার হজের মধ্যে সাওয়াবের দিক দিয়ে সর্বোত্তম হলো কিরান, এরপর তামাত্তু, এরপর ইফরাদ। তবে আদায় সহজ হওয়ার দিক থেকে প্রথমে তামাত্তু, এরপর ইফরাদ, এরপর কিরান। তামাত্তু হজ পালন করা সবচেয়ে সহজ হওয়ায় অধিকাংশ বাংলাদেশি তামাত্তু হজ আদায় করে থাকেন। আর যাঁরা অন্যের বদলি হজ করতে যান বা যাঁদের অবস্থান মিকাতের মধ্যে, তাঁরা সাধারণত ইফরাদ হজ করেন। এছাড়া কিছুসংখ্যক হাজি কিরান হজ করেন, যাঁদের সংখ্যা খুবই কম।
ইহরাম দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে নিষেধাজ্ঞাবলি সঠিকভাবে মেনে চলতে না পারার আশঙ্কা থাকলে হজ্জে তামাত্তুই উত্তম।
বদলি হজ
ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হচ্ছে হজ। এটি মুসলিম উম্মাহর অন্যতম ইবাদাত। একে জিহাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এতে সাওয়াব বেশি এবং উপকারিতাও অনেক। এ ইবাদাতের জন্য রয়েছে বিশেষ দুটি শর্ত। একটি হলো সম্পদশালী হওয়া আর অন্যটি হলো শারীরিকভাবে সক্ষম হওয়া। বিধানগত দিক থেকে হজ আদায় করা সহজ, কিন্তু এর জন্য সফর করতে হয়। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জমায়েত। বিশেষ বিশেষ স্থানে একসঙ্গে এই ইবাদাত আদায় করতে হয়। তাই এটি কঠিন ও কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে অনেক মানুষের আর্থিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও শারীরিক অক্ষমতার কারণে তা আদায় করা সম্ভব হয় না। এ ধরনের মাজুরদের প্রতি দয়া করে আল্লাহ তা'আলা বদলি হজ-এর অবকাশ দান করেছেন।
অনেকে মনে করেন, বদলি হজের জন্য আলাদা কোনো নিয়ম আছে। তা ঠিক নয়। যেভাবে নিজের হজ আদায় করা হয় সেভাবেই বদলি হজ আদায় করা হয়। পার্থক্য শুধু এইটুকু যে, নিয়ত ও তালবিয়ার সময় বদলি হজে প্রেরণকারীর পক্ষ থেকে হজের নিয়ত করা হয়। এরপর হজের সকল কাজ এক ও অভিন্ন। হজের নিয়ম এক হলেও বদলি হজ সংক্রান্ত কিছু বিষয় এমন আছে, যা বদলি হজে প্রেরণকারী ও প্রেরিত উভয়েরই জানা থাকা জরুরি।
বদলি হজের প্রামাণ্যতা
যদি কোনো ব্যক্তি ফরয হজ আদায় করতে অক্ষম হন তাহলে তাঁর পক্ষ থেকে দায়িত্ব নিয়ে অন্য কোনো ব্যক্তির হজ পালনকে বদলি হজ বলে। কয়েকটি হাদিস থেকে বদলি হজের বিধান পাওয়া যায়। যেমন:
১. খাসআম গোত্রের জনৈক মহিলা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বললেন, 'ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! আল্লাহ তা'আলা তাঁর বান্দাদের ওপর যে ফরয আরোপ করেছেন, তা আমার পিতাকে খুব বৃদ্ধ অবস্থায় পেয়েছে। তিনি বাহনের ওপর স্থির হয়ে বসতে পারেন না। তবে কি আমি তার পক্ষ থেকে হজ আদায় করে দেব? তিনি বললেন, হ্যাঁ। ঘটনাটি ছিল বিদায় হজের সময়কার। (বুখারি)
২. রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে বলতে শুনলেন, শুবরামার পক্ষ থেকে লাব্বাইক। তিনি বললেন, শুবরামা কে? লোকটি বলল, আমার ভাই বা আত্মীয়। তিনি বললেন, তুমি কি নিজের হজ করেছ? সে বলল, না। তিনি বললেন, আগে নিজের হজ করো। তারপর শুবরামার হজ। (মুসনাদে আহমাদ)
তিন প্রকার হজের মধ্যে বদলি হজ কোন প্রকার হবে তা যে ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজ করা হচ্ছে তিনি নির্ধারণ করে দেবেন। যদি ইফরাদ করতে বলেন তাহলে ইফরাদ করতে হবে, যদি কিরান করতে বলেন তাহলে কিরান করতে হবে, আর যদি তামাত্তু করতে বলেন তাহলে তামাত্তু করতে হবে। এর অন্যথা হলে হবে না। বদলি হজ ইফরাদ হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই।
বদলি হজ যখন করতে হয়
১. হজ ফরয হওয়ার পর আদায় না করে মৃত্যুবরণ করলে;
২. হজ ফরয হওয়ার পর তা আদায়ের আগে বন্দি হলে;
৩. এমন অসুস্থ হলে, যাতে আরোগ্য হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই;
8. শারীরিকভাবে চলাচলে অক্ষম হয়ে গেলে;
৫. দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেললে বা একেবারেই অন্ধ হয়ে গেলে;
৬. এমন বয়োবৃদ্ধ হয়ে গেলে যে, বাহনে চলাচলের সক্ষমতাও নেই;
৭. নারী তার হজের সফরে স্বামী বা উপযুক্ত মাহরাম পুরুষ সঙ্গী না পেলে;
৮. কোনো কারণে রাস্তা অনিরাপদ হলে;
৯. সফর করতে গেলে জান-মালের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে।
এসব কারণে ঐ ব্যক্তিকে মাজুর বা অক্ষম গণ্য করা হবে এবং সে নিজের পক্ষ থেকে বদলি হজ করাতে পারবে।
বদলি হজ কে করবেন
যে ব্যক্তির নিজের জন্য হজ আদায় করা ফরয হয়ে গেছে, তার নিজের ফরয হজ আগে আদায় করতে হবে, তারপর অন্যের বদলি হজ আদায় করতে পারবেন। আর যে ব্যক্তির ওপর হজ ফরয হয়নি তিনি নিজে হজ না করলেও অন্যের বদলি হজ আদায় করতে পারবেন। তাই প্রত্যেক বিবেকবান মুসলিমের উচিত বদলি হজ করানোর আগে ব্যক্তি সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে জানা। তারপর ঐ ব্যক্তির মাধ্যমে বদলি হজ করানো।
যিনি বদলি হজ আদায় করবেন, তাঁকে ইহরামের সময় অবশ্যই যার বদলি হজ আদায় করছেন তার নামেই নিয়ত করতে হবে।
যে ব্যক্তি নিজের ফরয হজ আদায় করেছেন, তার জন্য নফল হজ করার চেয়ে অন্য কারো বদলি হজ করা উত্তম। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, 'কোনো ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে বদলি হজ করলে, সে-ও মৃতের সমপরিমাণ সাওয়াব পাবে।' (মাজমাউয যাওয়াইদ)
হযরত হাসান বসরি (র.) বলেন, 'যে ব্যক্তি কারো পক্ষ থেকে বদলি হজ করবে, তার জন্যও ঐ ব্যক্তির সমপরিমাণ সাওয়াবের আশা করা যায়।'
সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হজের গুরুত্ব
জুমুআ ও ঈদের সালাত সীমিত পরিসরে মুসলিমদের মাঝে সাম্য ও ঐক্য সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু বিশ্ব মুসলিমের মাঝে সাম্য ও ঐক্য সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে একমাত্র হজ। ইহরাম বেঁধে 'লাব্বাইক' বলে যখন হারাম শরীফের চতুর্দিক থেকে মানুষ ছুটে আসে এবং বায়তুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করতে থাকে, তখন সাদা-কালো, ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র সকল ভেদাভেদ লোপ পায়। জগৎসমূহের স্রষ্টা, আমাদের একমাত্র প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে তারা সেখানে হাজির হয়। সাম্য প্রতিষ্ঠায় সেখানে সুগন্ধি ব্যবহার করা, টুপি-পাজামা-পাগড়ি পরিধান করা নিষিদ্ধ, এমনকি মাথার চুল পর্যন্ত ছেঁটে ফেলতে হয়। হজ ব্যতীত এমন কোনো অনুষ্ঠান নেই, যা এত ভিন্ন ভিন্ন দেশের, এত ভিন্ন ভিন্ন বংশের ও বর্ণের মানুষকে একইরূপে চিত্রিত করতে পারে। সাম্যের অপূর্ব চিত্র ফুটে ওঠে যখন সবাই একত্রে চিরশত্রু শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করে, সাফা-মারওয়ায় দৌঁড়ায়, আরাফার ময়দানে অবস্থান করে, মিনায় গমন করে এবং আল্লাহর রাহে একত্রে পশু কুরবানি করে। ফলে দুনিয়ায় প্রচলিত ভেদাভেদের কথা মনে স্থান পায় না। এমন অকৃত্রিম সাম্য ও ঐক্য আর কোথাও দেখা যায় না।
বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হজ
মুসলমানদের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ইসলামী মহাসম্মেলন হচ্ছে হজ। এটি আদায়ের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলমান পবিত্র মক্কা নগরীতে মিলিত হয়। নানাবিধ ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও এ সময় সকলে ভাই ভাই হয়ে সম্মিলিতভাবে হজের কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে, একে অপরকে সহযোগিতা করে। ফলে মুসলমানদের মাঝে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব তৈরি হয়। মহান আল্লাহ বলেন,
وَأَذِّنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِيْنَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ
অর্থ: এবং মানুষের নিকট হজের ঘোষণা দিন; তারা আপনার নিকট আসবে (মক্কায়) পায়ে হেঁটে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উটের পিঠে আরোহণ করে। তারা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে। (সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত: ২৭)
হজ পালনের সময় সবার পোশাক একই ধরনের থাকে। সকলে সম্মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ করে বলতে থাকে লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক অর্থাৎ হাজির হে আল্লাহ! আমরা তোমার দরবারে হাজির। এক অতুলনীয় আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষ একত্রিত হয়। ফলে বিভিন্ন দেশের মানুষের বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি দেখার ও জানার সুযোগ হয়। তাদের মাঝে আলোচনা করার ও সমস্যা সমাধানের পথ তৈরি হয়।
যিলহজের নয় তারিখ আরাফার ময়দানে ইমাম সাহেব বিশ্ব মুসলিমের উদ্দেশ্যে জ্ঞানগর্ভ খুতবা দেন। তাতে আগামী বছরের জন্য মুসলিম উম্মাহর করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়ের দিকনির্দেশনা থাকে। হজ থেকে শিক্ষা লাভ করে আমরা বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হবো। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে সাম্য প্রতিষ্ঠার শপথ নেবো।
প্যানেল আলোচনা 'হজের ধর্মীয় ও সামাজিক তাৎপর্য' (উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে তোমরা প্যানেল আলোচনা করে সমাজে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হজের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে উপস্থাপন করো।) |
আরও দেখুন...