পরিচিতি
হযরত সালেহ (আ.)-এর ইন্তেকালের পর মানুষ এক আল্লাহর পরিবর্তে মূর্তিপূজা ও নক্ষত্র পূজায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। তখন আল্লাহ তা'আলা মানুষকে সুপথে আনার জন্য ইবরাহিম (আ.)-কে নবিরূপে প্রেরণ করেন। তিনি পশ্চিম ইরাকের বসরার নিকটবর্তী 'বাবেল' শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আজর। তিনি একজন প্রসিদ্ধ নবি ও রাসুল ছিলেন। তাঁকে আবুল আম্বিয়া বা নবিগণের পিতা বলা হয়। তাঁর স্ত্রী সারার পুত্র ইসহাক (আ.)- এর বংশধর 'বনি ইসরাইল' নামে পরিচিত। অপর স্ত্রী হাজেরার পুত্র ইসমাইল (আ.) এর বংশে জন্ম নেন সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবি ও রাসুল মুহাম্মাদ (সা.)।
নবুওয়াত লাভ ও তাওহিদের দাওয়াত
হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির সঠিক সময় জানা যায়নি। তবে আল্লাহ তা'আলা তাঁকে বাল্যকাল হতেই সঠিক জ্ঞান ও হেদায়েত দান করেছিলেন। তাঁর উপর দশটি সহিফা নাযিল হয়। ইবরাহিম (আ.) দেখলেন তাঁর জাতি চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, মূর্তি ইত্যাদির পুজায় ব্যস্ত। এ পরিস্থিতিতে ইবরাহিম (আ.) তাদেরকে অভ্যন্ত নম্রভাবে যুক্তি ও বুদ্ধির দ্বারা এক আল্লাহর প্রতি ইমানের দাওয়াত দিলেন। আল্লাহর সাথে শিরক করতে নিষেধ করলেন। মূর্তিপূজা ত্যাগ করতে বললেন। কিন্তু তারা ইবরাহিম (আ.)-এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করল। অতঃপর তিনি বাদশাহ নমরুদকে ইমানের দাওয়াত দিলেন। এতে নমরুদ অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং ইবরাহিম (আ.)-কে আগুনে ফেলে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নমরুদের নির্দেশে ইবরাহিম (আ.)-কে হাত পা বেঁধে আগুনে নিক্ষেপ করা হলো। ইবরাহিম (আ.) তখনও আল্লাহর উপর ভরসা করলেন। আল্লাহ তা'আলা আগুনকে ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য শীতল হওয়ার নির্দেশ দিলেন। প্রজ্জ্বলিত আগুন ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য শীতল ও পরম আরামদায়ক হয়ে গেল। তাঁর হাত-পায়ের রশিগুলো আগুনে পুড়ে গেল। মহান আল্লাহর রহমতে নিরাপদে তিনি অগ্নিকুন্ড থেকে বের হয়ে আসলেন।
হিজরত
নমরুদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে মহান আল্লাহর হুকুমে হযরত ইবরাহিম (আ.) জন্মভূমি ত্যাগ করে অন্যত্র গিয়ে দ্বীন প্রচারের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি স্ত্রী সারা ও ভাতিজা হযরত লুতকে সঙ্গে নিলেন। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে সেখানে দ্বীন-ই-হানিফের প্রচার শুরু করেন। এভাবে দাওয়াত দিতে দিতে ইবরাহিম (আ.) সিরিয়া অথবা ফিলিস্তিনের পশ্চিমাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন।
স্ত্রী ও পুত্রকে সক্কায় নির্বাসন ও যমযম কূপের সৃষ্টি বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহ তা'আলা ইবরাহিম (আ.)-কে পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দেন। তাঁর স্ত্রী হাজেরার গর্ভে হযরত ইসমাইল (আ.)-এর জন্ম হয়। আল্লাহর নির্দেশে তিনি হাজেরা আর ইসমাইলকে বর্তমান কাবাগৃহের নিকটবর্তী একটি গাছের নিচে রেখে আসেন। তিনি তাঁদের সঙ্গে সামান্য পানি ও খেজুর রেখে আসেন।
কিছুদিন পর খেজুর ও পানি দু'টোই শেষ হয়ে গেল। তাঁর স্ত্রী হাজেরা পানি ও খাবারের জন্য সাফা-মারওয়া পাহাড়ে ছোটাছুটি করতে লাগলেন। সাতবার ছোটাছুটির পরও কোনো খাবার ও পানি পেলেন না। অতঃপর তিনি ইসমাইলের নিকট ফিরে আসলেন। এসে দেখলেন, শিশু ইসমাইল পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করছে। আর আল্লাহর কুদরতে সেখান থেকে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। হযরত হাজেরা পানি ধরে রাখার জন্য বাঁধ দিলেন। তিনি নিজে পানি পান করলেন এবং ইসমাইলকেও পান করালেন। এটাই হলো যমযম কূপের উৎস।
ইসমাইল (আ.)-এর কুরবানি
ইসমাইল (আ.)-যখন ১৩ বা ১৪ বছরের বালক, তখন হযরত ইবরাহিম (আ.) একাধারে তিনরাত স্বপ্নে পুত্র ইসমাইলকে কুরবানির জন্য আদিষ্ট হলেন। এ স্বপ্নের পর ইবরাহিম তাঁর। পুত্রকে বললেন, 'হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি কুরবানি করছি। এখন তোমার অভিমত কী?' ইসমাইল বললেন, 'হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন, তাই করুন।' পুত্রের সম্মতি পেয়ে ইবরাহিম (আ.) মিনা প্রান্তরে যান। সেখানে প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কুরবানি করতে শুরু করলেন।
কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় ইসমাইল (আ.)-এর স্থলে একটি দুম্বা কুরবানি হয়ে গেল। এটা ছিল আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে কঠিন পরীক্ষা। এ পরীক্ষায়ও তিনি সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হন।
কাবাঘর পুনর্নির্মাণ
ফেরেশতাগণ আল্লাহ তা'আলার নির্দেশে সর্বপ্রথম কাবাঘর নির্মাণ করেন। নূহ (আ.)-এর সময় প্লাবনে কাবার কাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীকালে মহান আল্লাহ ইবরাহিম (আ.)-কে কাবাঘর পুনর্নির্মাণের আদেশ দেন। ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) মিলে বায়তুল্লাহ তৈরির কাজ শুরু করেন। ইসমাইল (আ.) পাথর এনে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। এভাবে পবিত্র কাবাঘরের নির্মাণ কাজ সুসম্পন্ন হয়।
গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য
ধৈর্য, সহনশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা ইবরাহিম (আ.)-এর অন্যতম চারিত্রিক গুণাবলি। আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা, বিপদে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা, প্রতিকূল অবস্থায় ইমানের ওপর টিকে থাকা, হেকমতের সাথে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া প্রভৃতি চারিত্রিক গুণাবলির অধিকারী ছিলেন তিনি। হযরত ইবরাহিম (আ.) মেহমানদারিতে খুবই প্রসিদ্ধ ছিলেন। ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর খুবই প্রিয়ভাজন খলিল বা বন্ধু ছিলেন।
ইন্তেকাল
হযরত ইবরাহিম (আ.) ১৭৫ মতান্তরে ১৯৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁকে কানজানে অবস্থিত হেবরন নামক গ্রামে দাফন করা হয়। গ্রামটি বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে ১০/১২ মাইল দূরে অবস্থিত। বর্তমানে উক্ত স্থানের নামকরণ করা হয়েছে মদিনাতুল খলিল।
আরও দেখুন...