জন্ম ও পরিচয়
হযরত উসমান (রা.) ছিলেন ইসলামের তৃতীয় খলিফা। তিনি মক্কার কুরাইশ বংশের উমাইয়া গোত্রে ৫৭৩ মতান্তরে ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তাঁর ডাকনাম ছিল আবু আমর এবং আবদুল্লাহ। তাঁর উপাধি 'বুননুরাইন' ও 'জামেউল কুরআন'। তাঁর পিতার নাম আফফান এবং মাতার নাম আরওয়াহ। উসমান (রা.) বড় ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। এজন্য তিনি 'উসমান গনি' নামে পরিচিত ছিলেন।
ইসলাম গ্রহণ
হযরত উসমান (রা.)- এর বয়স যখন ৩৪ বছর তখন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) আবির্ভূত হন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর সাথে হযরত উসমান (রা.)-এর গম্ভীর বন্ধুত্ব ছিল। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এর দাওয়াতে তাঁর মন ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং তিনি রাসুল (সা.)- এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন।
বিবাহ
তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দুই কন্যা রুকাইয়া এবং উম্মে কুলসুমকে বিয়ে করেন। প্রথমে রাসুল (সা.) তাঁর কন্যা রুকাইয়াকে হযরত উসমান (রা.)-এর নিকট বিয়ে দেন। বুকাইয়া মারা গেলে হযরত উসমান (রা.) হযরত উম্মে কুলসুমকে বিয়ে করেন। এ কারণে তাঁকে উপাধি দেওয়া হয় 'ঘুননুরাইন' বা দুই জ্যোতির অধিকারী। রাসুল (সা.) তাঁকে এত পছন্দ করতেন যে, উম্মে কুলসুমের ইন্তেকালের পর বলেছিলেন, 'যদি আমার আরও কন্যা থাকত, তাকেও আমি হযরত উসমান (রা.) এর কাছে বিয়ে দিতাম। রাসুল (সা.) আরো বলেন, বেহেশতে প্রত্যেক নবিরই একজন বন্ধু থাকবে, আর আমার বন্ধু হবে হযরত উসমান (রা.)।
প্রথম হিজরতকারী
ইসলাম গ্রহণের পর হযরত উসমান (রা.)-কে তাঁর চাচা হাকাম নানাভাবে কষ্ট দিতে লাগল। যখন শাস্তির মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগল, রাসুলুল্লাহ (সা.) হযরত উসমান (রা.)-কে তাঁর স্ত্রী রুকাইয়াকে নিয়ে অন্যান্য সাহাবিসহ আবিসিনিয়ায় বর্তমান ইথিওপিয়ায় হিজরত করার অনুমতি প্রদান করেন। সেখানে দুই বছর থাকার পর মক্কায় ফিরে এসে তিনি মদিনায় হিজরত করেন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সাথে মিলিত হন।
কূপ ক্রয় ও মসজিদ সম্প্রসারণ
মুহাজিরগণ যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখন সেখানে বিশুদ্ধ পানির খুবই অভাব ছিল। মদিনায় এক ইহুদির মালিকানাধীন 'বীরে বুমা' নামক একটি কূপ ছিল। ইহুদি এ কূপের পানি চড়া দামে বিক্রি করত। মুহাজিরগণের পানি ক্রয় করে পান করার সামর্থ্য ছিল না। মুসলমানরা মহানবি (সা.) এর কাছে এসে পানির সংকটের কথা জানালেন। মহানবি (সা.) ঘোষণা করলেন, 'তোমাদের মধ্যে কেউ কি আছে যে এই কূপটি কিনে মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ করে দিবে? এটা যে করবে আল্লাহ তা'আলা তাকে জান্নাতে একটি করনা দান করবেন।' তখনই হযরত উসমান (রা.) কূপটি ক্রয় করে মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ করে দেন। এছাড়াও হযরত উসমান (রা.) মসজিদে নববির পাশের জায়গা উচ্চমূল্যে ক্রয় করে মসজিদ সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে দান করেন।
ইসলামের সেবা
হযরত উসমান (রা.) ছিলেন প্রথম ওহি লেখক। তিনি নিজের ধন-সম্পদের সর্বস্ব দিয়ে ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তাবুক অভিযানের ব্যয় বহনের জন্য তিনি নগদ ১০০০ দিনার, ১০০০টি উট, ৭০টি ঘোড়া এবং সেনাবাহিনীর এক তৃতীয়াংশের ব্যয়ভার বহন করেন। শুধু বদরের যুদ্ধে স্ত্রী অসুস্থ থাকার কারণে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারেননি। এছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় অনুষ্ঠিত সকল যুদ্ধেই তিনি অংশগ্রহণ করেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় তিনি মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কুরাইশদের সাথে শান্তি আলোচনা করতে গিয়েছিলেন।
খলিফা হিসেবে দায়িত্বলাভ
হযরত ওমর (রা.)-এর মৃত্যুর সময় যখন ঘনিয়ে আসল, তখন তিনি পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের জন্য ৬ সদস্যের নির্বাচনী পরিষদ গঠন করেন। তাঁদের মধ্যে এ পরিষদের ৬জন ছিলেন হযরত উসমান (রা.), হযরত আলী (রা.), হযরত জোবায়ের (রা.), হযরত তালহা (রা.), হযরত সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) এবং হযরত আবদুর রহমান (রা.)। হযরত আবদুর রহমান (রা.) স্বীয় দাবি প্রত্যাহারপূর্বক ভোটদানে বিরত থেকে রাত জেগে নির্বাচনী পরিষদের প্রতিটি সদস্যের গৃহে গমন করেন এবং তাদের মতামত গ্রহণ করেন। অধিকাংশের মতামতের ভিত্তিতে ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে হযরত উসমান (রা.) খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন।
কুরআন সংকলন
হযরত উসমান (রা.)- এর অসামান্য কৃতিত্ব হলো কুরআন মাজিদ সংকলন। হযরত ওমর (রা.) ও হযরত উসমান (রা.) এর সময় ইসলামি সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি সুদূর আফ্রিকা পর্যন্ত পৌঁছে। তিনি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে পবিত্র কুরআন মাজিদ পাঠ ও উচ্চারণে অসঙ্গতি নিরসনে যায়েদ বিন সাবিত (রা.) এর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন। এ কমিটি হযরত হাফসা (রা.)- এর নিকট সংরক্ষিত কুরআন মাজিদের পাণ্ডুলিপি থেকে অনুরূপ আরো ৬টি কপি সংকলন করেন। ৪টি কপি বসরা, কুফা, দামেস্ক ও মক্কায় প্রেরণ করেন এবং বাকি ২টি কপি মদিনায় রাখেন। এভাবে তিনি পবিত্র কুরআন সংকলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
চারিত্রিক গুণাবলি
হযরত উসমান (রা.) জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অন্যতম। তিনি রাসুল (সা.) এর জামাতা ও ফুফাতো ভাই ছিলেন। তিনি কোমল হৃদয়ের অধিকারী, দানশীল ও পুণ্যবান ছিলেন। আল্লাহ তা'আলার ভয়ে সর্বদা তাঁর চক্ষু সজল থাকত। মহানবি (সা.) যখন কবরের আলোচনা করতেন, তখন তাঁর চোখের পানিতে দাড়ি ভিজে যেত। সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করতেন, 'আপনি জান্নাত জাহান্নামের আলোচনা শুনলেও এত কাঁদেন না। অথচ কবরের আলোচনায় এত কাঁদেন কেন?' তখন তিনি বলতেন, ‘কবর হলো পরকালের প্রথম ধাপ, যদি এখানে আমি বিপদগ্রস্ত হই, তবে পরবর্তী সকল ধাপে বিপদগ্রস্ত হব।’
তিনি অত্যন্ত দানশীল ও জনসেবক ছিলেন। তাঁর সময়ে তাঁর অর্থ ও পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক রাস্তা, সেতু, মসজিদ, বাসগৃহ ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়।
ইন্তেকাল: হযরত উসমান (রা.) ১২ বছর খিলাফতে অধিষ্ঠিত থেকে ৮২ বছর বয়সে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে শাহাদতবরণ করেন।
একক কাজ হযরত ওসমান (রা.) এর জীবনাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তুমি যে যে কাজ বাস্তব জীবনে চর্চা/অনুশীলন করবে' |
আরও দেখুন...