হিন্দুধর্মের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - হিন্দুধর্ম শিক্ষা - প্রথম অধ্যায় | | NCTB BOOK

 

এখানে আমরা একটা পরিবারবৃক্ষ বা ফ্যামিলি ট্রির ছবি দেখতে পাচ্ছি। ছবিটা ভালো করে দেখো।

 

 

এবার তোমরাও নিজেদের পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়দের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে নিজের 'ফ্যামিলি ট্রি' তৈরি করো।

ছক ১.১: আমার পরিবারবৃক্ষ

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

  • ফ্যামিলি ট্রির বিভিন্ন পর্যায়ে, তোমার পূর্বপুরুষ থেকে আজকের সময় পর্যন্ত মানুষের সাজ-পোশাক, ঘরবাড়ি, ব্যবহৃত জিনিসপত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। দলে/জোড়ায় পোস্টার পেপার বা অন্য কোনো মাধ্যম ব্যবহার করে তোমার পূর্বপুরুষেরা কী কী পোশাক পরতেন তা নিচের ছকে লেখো।

 

ছক ১.২: আমার পূর্বপুরুষ

প্রপিতামহ

প্রপিতামহী

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

পিতামহ

পিতামহী

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

  • উপস্থাপিত টাইমলাইনগুলো থেকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে বিষয়টি পেয়েছ তা নিচে লিখে রাখো। ছক ১.৩: মানুষের ক্রমবিকাশ

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

আমাদের পূর্বপুরুষদের সময় থেকে আজকের মানুষের যেমন ক্রমবিকাশ হয়েছে, হিন্দুধর্মেরও তেমন করে ক্রমবিকাশ ঘটেছে। চলো, আমরা হিন্দুধর্মের উদ্ভব এবং ক্রমবিকাশ সম্পর্কে জেনে নিই।

 

হিন্দুধর্মের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ

 

পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মেরই কোনো না কোনো প্রবর্তক আছেন। কিন্তু হিন্দুধর্মের আসলে কোনো প্রবর্তক নেই। এ ধর্ম কেউ প্রবর্তন করেননি। এ ধর্মবিশ্বাসটি এত প্রাচীন যে তখন অন্য কোনো ধর্মবিশ্বাসই এ অঞ্চলে ছিল না। অনেকেই আবার একে 'সনাতন' ধর্ম বলে। কারণ, এ ধর্ম হাজার বছর ধরে এ অঞ্চলের বাসিন্দারা বংশ পরম্পরায় পালন করে আসছে। ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টের জন্মের পাঁচ থেকে সাত হাজার বছর আগে সনাতনধর্ম বা হিন্দুধর্মের সূচনা। অর্থাৎ এটি সাত থেকে নয় হাজার বছরের পুরোনো ধর্মমত। এর সমসাময়িক প্রায় সকল ধর্মমত বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যেগুলো টিকে আছে সেসব ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা খুবই কম। অথচ পৃথিবীতে এখনো প্রায় ১২০ কোটি মানুষ হিন্দুধর্মাবলম্বী।

 

সিন্ধু, বিতস্তা, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা, শতদু, বিপাশা ও সরস্বতী- এই সাত নদীবিধৌত অঞ্চলকে প্রাচীনকালে সপ্তসিন্ধু বলা হতো। বর্তমানের কাশ্মীর, পাঞ্জাব, সিন্ধু ও আফগানিস্তানের কিছু এলাকা এর মধ্যে পড়ে। এখানেই বেদকে কেন্দ্র করে সনাতন ধর্মমত বিকশিত হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে পারস্যের (বর্তমান ইরান) রাজা সাইরাস এ অঞ্চলে আক্রমণ চালান। পারসিকরা সপ্তসিন্ধু উচ্চারণ করতে পারত না। তারা বলত 'হপ্তহিন্দু'। সেই থেকে ভারতীয় অঞ্চলের মানুষদের বহির্বিশ্বের মানুষ 'হিন্দু' বলে অভিহিত করত। আর তাদের ধর্মবিশ্বাসকে বলা হতো 'হিন্দুধর্ম'। এখন এটাই সর্বাধিক পরিচিত নাম।

 

হিন্দুধর্ম কেবল একটি ধর্মই নয়, এ অঞ্চলের সুমহান সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। বিভিন্ন ধর্মাচারের মধ্য দিয়ে এই ধর্মটি স্থানীয় সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চার পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। খাদ্যাভ্যাসে এবং বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীকে গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখছে।

এই সপ্তসিন্ধুর অববাহিকা থেকে বিকশিত হওয়া হিন্দু ধর্মমত একসময়ে সুমাত্রা, জাভা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। এখনো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাচীন হিন্দু-মন্দির 'আঙ্কোরওয়াট' কম্বোডিয়ায় টিকে আছে। এছাড়া মালয়েশি- য়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে হিন্দুসভ্যতার প্রচুর কীর্তি রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় প্রতীক বিষ্ণুর বাহন গরুড়। এখনো ইন্দোচীন, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় বিপুলসংখ্যক হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষ আছেন।

 

হিন্দুধর্মের ভিত্তি

 

'ধৃ' ধাতু থেকে 'ধর্ম' শব্দটি এসেছে। ধূ মানে ধারণ করা। কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা বিষয় যা ধারণ করে তাই তার ধর্ম। মানুষ যা ধারণ করে, মনুষ্যত্ব থেকে তাকে ভ্রষ্ট হতে দেয় না- তাই তার ধর্ম। মহর্ষি পতঞ্জলি 'যোগদর্শনে' বলেছেন, 'যে শক্তি পদার্থের গুণাবলি ধরে রাখে, সে শক্তিকে ধর্ম বলা যেতে পারে। মানুষের অন্তর্নিহিত যে শক্তি তাকে 'দেবত্বে' উত্তীর্ণ করে তাই তার ধর্ম। অন্যান্য ধর্মবিশ্বাস থেকে হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাসের দর্শনগত পার্থক্য রয়েছে। সে পার্থক্য অনুধাবন না করতে পারলে হিন্দুধর্মকে উপলব্ধি করা যায় না।

হিন্দুধর্ম গ্রহণের জন্য কোনো শপথবাক্য পাঠ করার প্রয়োজন হয় না। এ ধর্ম মুক্তচিন্তার ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয় হিন্দুধর্ম। এই ধর্ম নিজের মতকে শ্রেষ্ঠ এবং একমাত্র বলে দাবি করে না। এই ধর্মে বিভিন্ন ধরনের মতবাদের সহাবস্থান দেখা যায়। তাই সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে প্রায় বিনা বাধায় ভিন্ন ভিন্ন ধর্মমত বিকশিত হতে পেরেছে। অন্যের বৈচিত্র্যকে সম্মান করা হিন্দুধর্মের শিক্ষা। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য স্থাপনই হিন্দুধর্মের মূল লক্ষ্য। ধর্মের এই উদারনৈতিক ধারার জন্য ধর্মটি এত বছর ধরে স্বমহিমায় টিকে আছে। যুগে যুগে এর সংস্কার হয়েছে। 'যুগধর্ম' হিসেবে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা একে সহজভাবে মেনেও নিয়েছেন।

 

  • তোমার ভালো লাগে হিন্দুধর্মের এ রকম দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা নিচের ছকে লিখে রাখো।

ছক ১.৪: হিন্দুধর্মের কথা

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বেদ

 

প্রতিটি ধর্মের দুটি অংশ থাকে। ধর্মতত্ত্ব ও সাধনা। হিন্দুধর্মতত্ত্বের চারটি ধাপ রয়েছে। মনু বলেছেন-

বেদঃ স্মৃতিঃ সদাচারঃ স্বস্য চ প্রিয়মাত্মনঃ।

এতচ্চতুর্বিধং প্রাহুঃ সাক্ষাদ্‌ ধর্মস্য লক্ষণম্।।

(মনুসংহিতা, ২/১২)

 

অর্থাৎ বেদ, স্মৃতিশাস্ত্র, সদাচার ও বিবেকের বাণী- এ চারটি হচ্ছে ধর্মের সাক্ষাৎ বা সাধারণ লক্ষণ। এই চারটিকে ক্রমান্বয়ে অনুসরণ করলেই হিন্দুধর্মের স্বরূপ বোঝা যায়।

হিন্দুধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ। এটিকে মানবসভ্যতার অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। বেদকে কেন্দ্র করে হিন্দুধর্ম বিকশিত হয়েছিল। শিষ্য গুরুর কাছ থেকে শুনে আত্মস্থ করতেন বলে বেদকে শ্রুতিও বলা হয়। বেদের জ্ঞান ও দর্শন ঋষিদের মাধ্যমে জগতে এসেছে। ঋষিরা নিজেদেরকে বেদের রচিয়তা মনে করেননি । তাই বেদকে অপৌরুষেয় বলা হয়।

 

মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব সমগ্র বেদকে চার ভাগে বিভক্ত করেছেন- ঋক্, সাম, যজুঃ ও অথর্ব। প্রতিটি বেদের আবার চারটি ভাগ রয়েছে। সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। সংহিতায় মন্ত্র বা স্তব আছে। সংহিতা অংশের ব্যাখ্যা আছে ব্রাহ্মণে। আরণ্যক অংশে ব্রাহ্মণ অংশের নিগূঢ় তত্ত্বগুলো নিয়ে আলোচনা রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শাস্ত্রবিদ যে তাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন তার সংকলন উপনিষদ। বেদের ছয়টি অঙ্গ রয়েছে

 - শিক্ষা, কল্প, নিরুক্ত, ব্যাকরণ, ছন্দ ও জ্যোতিষ। এগুলো বেদ পাঠের সহায়ক গ্রন্থ।

শ্রুতির পর স্মৃতির স্থান। অন্যতম বেদাঙ্গ হলো কল্প বা কল্পসূত্র। এই কল্পসূত্রের মধ্যে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের নিয়মকানুন রয়েছে। পরবর্তীকালে সেগুলোকে অনুসরণ করে নানা গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এসব গ্রন্থগুলোকে একসঙ্গে স্মৃতিশাস্ত্র বলা হয়। যেমন: মনুসংহিতা, যাজ্ঞবন্ধ্যসংহিতা, পরাশরসংহিতা ইত্যাদি।

এছাড়া বাল্মীকি ও ব্যাসদেব রচিত যথাক্রমে রামায়ণ ও মহাভারত নামের মহাকাব্য দুটিকে হিন্দুধর্মে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। এ দুটি গ্রন্থে হিন্দুধর্মের বিভিন্ন তত্ত্ব ও রীতিনীতির আলোচনা এবং প্রয়োগ বা ব্যবহার পাওয়া যায়। তাই গ্রন্থ দুটিকে মহাকাব্যের পাশাপাশি ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা দেওয়া হয়। এছাড়া ১৮টি পুরাণ ও ১৮টি উপপুরাণ রয়েছে।

বেদ-এর চারটি ভাগের বিষয়বস্তু সম্পর্কে দলে/জোড়ায় তথ্য সংগ্রহ করে এককভাবে নিচের তথ্যছকটি পূরণ করো।

 

ছক ১.৫: বেদ-এর কথা

বেদ-এর ভাগসমূহ

বিষয়বস্তু

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বিবর্তন ও দেবতার শ্রেণিবিভাগ

 

হিন্দুধর্মের আদি ধর্মগ্রন্থ হলো ঋগ্বেদ। ঋগ্বেদে দেবতাদের মোট সংখ্যা ৩৩ বলা হয়েছে।

যে দেবাসো দিব্যেকাদশস্থ পৃথিব্যা মধ্যেকাদশ স্থ। 

যে অঙ্গুক্ষিতা মহিনৈকাদশ স্থ তে দেবাসো যজ্ঞমিমং যুষধ্বস্।।

 

অর্থ: দ্যুলোকের অর্থাৎ সুদূর আকাশের দেবতা ১১ জন, পৃথিবীর দেবতা ১১ জন এবং অন্তরীক্ষের দেবতা ১১ জন। এরা স্বমহিমায় যজ্ঞ গ্রহণ করেন।

 

কিন্তু এই বিভিন্ন দেব-দেবী মূলত একই শক্তি বা ঈশ্বরের বিভিন্ন প্রকাশ। সেটা প্রাচীন ঋষিরা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তাই ঋগ্বেদে বলা হয়েছে: 'মুধা ভুবো ভবতি নক্তমগ্নিস্ততঃ সূর্যো জায়তে প্রাতরুদান' (১০/৮৮/৬)।

অর্থ: অগ্নি রাতে পৃথিবীর মস্তক, প্রাতে তিনি সূর্য হয়ে উদিত হন।

ঋগ্বেদের প্রথম মন্ডলে বলা হয়েছে: 'একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি।' অর্থাৎ একইজন বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছেন।

বৈদিক যুগে অগ্নিকে দেবতাদের দূতরূপে গ্রহণ করে যজ্ঞের আয়োজন করা হতো। এতে বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশে হবিদ্রব্য (ঘি, পিঠা, পায়েস প্রভৃতি) অর্পণ করা হতো-বিশ্বব্রহ্মান্ডের সকল কর্মকান্ড যজ্ঞরূপে উপস্থাপন করতেন ঋষিগণ। এজন্যই হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, 'জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ-ধন্য হলো ধন্য হলো মানবজীবন'। তখন দেবতাদের তুষ্টির পাশাপাশি ঋষিগণ আত্মজ্ঞান লাভের সাধনা করতেন। বহু দেবতার পরিবর্তে সর্বত্র এক ঈশ্বরের উপস্থিতি তাঁরা উপলব্ধি করলেন। নিরাকার সর্বময় ব্রহ্মের ধারণা সবার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তাই ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণ ও কর্ম অনুসারে এক এক দেবতার উপাসনা করেছেন। বেদে উল্লিখিত দেবতাদের বৈদিক দেবতা বলা হয়।

বেদে পৃথিবীর দেবতা হিসেবে অগ্নিকে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি পৃথিবীতে সবসময় থাকেন। বৈদিক দেবীদের মধ্যে অন্যতম হলেন উষা। রাতের অন্ধকারের অবসান ঘটিয়ে নতুন সূর্য উদয়ের মাধ্যমে দিনের সূচনা করেন দেবী উষা। বেদে স্বর্গের দেবতা হিসেবে ইন্দ্রকে উল্লেখ করা হয়েছে। ঈশ্বরের বর্ষণশক্তির প্রকাশ হলো ইন্দ্র।

বর্তমানে যেসব দেবদেবীর পূজা করা হয়, তাঁদের অনেকের নাম বেদে পাওয়া যায় না। তাঁদের নাম জানা যায় পুরাণে। পুরাণে বর্ণিত দেবদেবীকে পৌরাণিক দেবদেবী বলা হয়। পৌরাণিক যুগে দেবদেবীর বিগ্রহ বা প্রতিমা নির্মাণ করে পূজার প্রচলন হয়। বর্তমানে অনেক দেব-দেবীর রূপে অনেক বিবর্তন হয়েছে। আবার অনেক নতুন দেবদেবীর পূজাও প্রচলিত হয়েছে। প্রধান তিনজন পৌরাণিক দেবতা হলেন-ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব বা মহেশ্বর।

মন্ত্রে যেভাবে দেবদেবীর রূপ কল্পনা করা হয়েছিল, বিগ্রহও ঠিক সেই রূপে নির্মিত হয়ে আসছে। পৌরাণিক যুগে মন্দির নির্মাণ করে তাতে দেবদেবীর প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠিত দেবদেবীকে পত্র-পুষ্পের অঞ্জলি ও ভোগারতি দিয়ে শঙ্খ, ঘণ্টা ও অন্যান্য বাদ্য বাজিয়ে পূজা করা হয়। বিষ্ণু, শিব, লক্ষ্মী, কালী প্রভৃতি দেবতার নিত্যপূজা করা হয়। বিশেষ বিশেষ তিথিতে পূজা হয় ব্রহ্মা, দুর্গা, সরস্বতী প্রভৃতি দেবদেবীর। অবশ্য প্রতিদিন যে সকল দেবদেবীর পূজা হয়, বিশেষ তিথিতেও তাঁদের অনেকের পূজা করা হয়। যেমন- বিষ্ণু, গণেশ, শিব। আবার বেদ এবং পুরাণে না থাকলেও আরও কিছু দেবদেবীর পূজা করা হয়ে থাকে, যাদেরকে আমরা লৌকিক দেবদেবী বলে থাকি। মূলত বিশ্বাস থেকে যে সকল দেবদেবীর পূজা করা হয়, তাঁদের লৌকিক দেবদেবী। মনসা, শীতলা, বনবিবি, দক্ষিণ রায় প্রভৃতি স্থানীয় লৌকিক দেবতার পূজা বিশেষ তিথিতে করা হয়।

 

তোমার এলাকার অথবা তোমার জানা লৌকিক দেবদেবী সম্পর্কে নিচের তথ্যছকটি পূরণ করো। ছকের শিরোনামে তোমার নির্বাচিত লৌকিক দেবদেবীর নাম লেখো।

 

 

ধর্মীয় প্রতীক, তাৎপর্য এবং মূর্তিপূজা

হিন্দুধর্মে প্রতীক খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। নিরাকার ব্রহ্মকে আমরা 'ওঁ' এই শব্দ প্রতীকের মাধ্যমে প্রকাশ করি। নির্গুণ ব্রহ্মের প্রতীক হিসেবে শিবলিঙ্গ ব্যবহার করা হয়। শিব শব্দের অর্থ মঙ্গলময় এবং লিঙ্গ শব্দের অর্থ প্রতীক: এ কারণে শিবলিঙ্গ সর্বমঙ্গলময় বিশ্ববিধাতার প্রতীক। শিব শব্দের অপর একটি অর্থ হলো যাঁর মধ্যে প্রলয়ের পর বিশ্ব নিদ্রিত থাকে। বলা হয়েছে 'লয়ং যাতি ইতি লিঙ্গম্'। অর্থাৎ সমস্ত কিছু যেখানে লয়প্রাপ্ত হয় তাই লিঙ্গ। লিঙ্গ-এর উপরে ত্রিপুণ্ড্র বা তিনটি সাদা দাগ থাকে। এ ত্রিপুণ্ড্র শিবের কপালে থাকে।

হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রাচীন প্রতীক স্বস্তিকা চিহ্ন। সংস্কৃতে স্বস্তিকা শব্দের অর্থ কল্যাণ বা মঙ্গল। মঙ্গলের প্রতীক হিসেবে এই চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। এছাড়া আমাদের প্রধান তিন দেবতা- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের মিলিত প্রতীক হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের প্রতীক।

 

নিরাকার ব্রহ্মের বিভিন্ন শক্তি হিসেবে আমরা দেবতাদের উপাসনা করি। যাঁদেরকে বিভিন্ন প্রতীকে উপস্থাপন করা হয়। পুরাণের বর্ণনা অনুসারে দেবতাদের যে মূর্ত রূপ দেওয়া হয় তাকে মূর্তি বা প্রতিমা বলা হয়। এই মূর্তিতে হিন্দুদর্শন ও শিল্পবোধের অপূর্ব প্রতিফলন ঘটেছে।

শুক্রাচার্য রচিত 'শুক্রান্তি' শাস্ত্রে তিন শ্রেণির মূর্তির কথা বলা হয়েছে।

সাত্ত্বিক: এ ধরনের মূর্তিতে দেবদেবী ভক্তকে কাঙ্ক্ষিত বস্তু প্রদানের মুদ্রায় হাত বিন্যস্ত রেখে যোগাসনে বসে থাকেন।

রাজসিক: এতে দেবদেবী ভক্তকে কাঙ্ক্ষিত বস্তু প্রদানের মুদ্রাসহ যুদ্ধাস্ত্র ও অলংকারসজ্জিত দেহে নিজ বাহনের উপরে উপবিষ্ট থাকেন।

তামসিক: এতে দেবদেবী অস্ত্রসজ্জিত ভয়ানক চেহারায় আবির্ভূত হন।

পুরাণে দেবদেবী সম্পর্কে যে বিবরণ আছে, সে অনুসারে মূর্তি গড়তে হয়। প্রত্যেক দেবদেবীর নিজস্ব মূর্তরূপ রয়েছে। সে মূর্তরূপে দেবদেবীর গড়ন-বিন্যাস, শারীরিক অবস্থান, গহনা, বাহন, আয়ুধ, পোশাক, কারুকাজ, সহচর, অনুচর প্রভৃতির বর্ণনা থাকে। আবার দেবতার ওপর দেবত্ব প্রকাশের জন্য মূর্তিতে জ্যোতির্বলয় ব্যবহার করা হয়।

প্রত্যেক দেবদেবীর কোনো না কোনো বাহন থাকে। এই বাহনগুলো দেবদেবীর শক্তিমত্তা ও দর্শনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়। যেমন সরস্বতীর বাহন রাজহাঁস। কারণ, রাজহাঁস অসারকে বাদ দিয়ে কেবল সার অংশটুকু বেছে নিতে পারে। জল মেশানো দুধ থেকে রাজহাঁস শুধু দুধটুকু হেঁকে পান করতে পারে। গণপতি গণেশের বাহন ইঁদুর। বিশালকায় দেবতা গণেশকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বস্তু দেখার সুযোগ করে দেয় ক্ষুদ্র বাহনটি। এভাবে বিষ্ণুর বাহন গরুড়, শিবের বাহন বৃষভ, দুর্গার বাহন সিংহ। এসব বাহন হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কাছে বিশেষ সম্মানের। এভাবে দেবদেবীর পূজার মাধ্যমে হিন্দুরা প্রাণিকুলের প্রতি সম্মান জানায়। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে।

 

দেবদেবীদের হাতে থাকা বিভিন্ন বস্তুকে আয়ুধ বলে। এসব আয়ুধ বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনির প্রতিনিধিত্ব করে। সাধারণত দেবদেবীর আয়ুধ হিসেবে দেখা যায় পুস্তক, কমণ্ডলু, চক্র, শঙ্খ, গদা, পদ্ম, ঢাল, খড়া, লাঙ্গল, তীর, ধনুক, কুঠার, ত্রিশূল ইত্যাদি।

হিন্দু দেবদেবীদের অধিক অঙ্গও কোনো না কোনো তাৎপর্য বহন করে। যেমন- নারী শক্তি যে অজেয় তার প্রতীক দুর্গা। মায়েরা যেভাবে ২ হাতে ১০ হাতের কাজ করে সংসার সামলান, তার প্রতীক স্বরূপ দেবী দুর্গার ১০ হাত। আধুনিক চিত্রকলাতেও এভাবে প্রতীকের ব্যবহার দেখা যায়।

 

  • দলে/জোড়ায় আলোচনা করে ছকটি পূরণ করো।

 

ছক ১.৭: দেবদেবীর মূর্তরূপ

 

দেবদেবীর নাম

ঈশ্বরের যে শক্তির প্রকাশ

বাহন

দৈহিক বৈশিষ্ট্য

আয়ুধ

সাত্ত্বিক/ তামসিক/ রাজসিক

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

ধর্মের বাহ্যলক্ষণ

মনুসংহিতায় ধর্মের বিশেষ লক্ষণ হিসেবে ১০টি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে:

ধৃতিঃ ক্ষমা দমোহস্তেয়ং

শৌচমিন্দ্রিয়নিগ্রহঃ

ধীর্বিদ্যা সত্যমক্রোধো

দশকং ধর্মলক্ষণম্ ॥

(মনুসংহিতা, ৬/৯২)

 

 

অর্থাৎ সহিষ্ণুতা বা ধৈর্য, ক্ষমা, আত্মসংযম, চুরি বা অপহরণ না করা, শুচিতা বা পবিত্রতা, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ, প্রজ্ঞা, বিদ্যা, সত্য ও অক্রোধ- এই ১০ টি ধর্মের বিশেষ লক্ষণ।

 

  • দলে/ জোড়ায় ধর্মের লক্ষণসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করে এককভাবে ছকটির উপযুক্ত ঘরে টিক চিহ্ন দিয়ে পূরণ করো।

 

ছক ১.৮: আমার ধর্ম

ধর্মের লক্ষণ

মানি না

মানার চেষ্টা করি

মেনে চলি

আমার কিছু বলার আছে

সহিষ্ণুতা

 

 

 

 

ক্ষমা

 

 

 

 

আত্মসংযম

 

 

 

 

চুরি না করা

 

 

 

 

শুচিতা

 

 

 

 

ইন্দ্রিয়নিগ্রহ

 

 

 

 

প্রজ্ঞা

 

 

 

 

বিদ্যা

 

 

 

 

সত্য

 

 

 

 

অক্রোধ

 

 

 

 

 

  • দলে/জোড়ায় ইনফোগ্রাফিক্স (তথ্যবহুল ও নান্দনিক ছবি, চার্ট ও লেখা) পোস্টার উপস্থাপনের মাধ্যমে হিন্দুধর্মের ক্রমবিকাশ বর্ণনা করো।

 

  • হিন্দুধর্ম থেকে পাওয়া যে ইতিবাচক বিষয়গুলো তুমি নিজের জীবনে চর্চা করতে পারো, তা অনুচ্ছেদ আকারে লেখো।
Content added || updated By
Promotion