পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হবার পর শাসক গোষ্ঠী রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক নীতি অবলম্বন করে। এ সময়ে সামরিক সরকার সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ করে এবং কালো আইনের আওতায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাঁধাগ্রস্থ করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতি অবলম্বন করে । ফলে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে শীর্ষ পদে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব ছিল অতি নগণ্য। দেশের সামরিক বাজেটের সিংহভাগ দায়ভার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বহন করলেও এ অঞ্চলের প্রতিরক্ষার বিষয় চরমভাবে অবহেলিত হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রেও ছিল চরম বৈষম্য। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ২০৮৪ মিলিয়ন রুপি, অপরদিকে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ৭৯৭ মিলিয়ন রুপি ।
শুরুতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে পূর্ব বাংলার অবস্থা ছিল অপেক্ষাকৃত ভালো। কিন্তু এই অবস্থা বেশি দিন টিকে থাকেনি। ক্রমান্বয়ে দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি এবং ব্যবধানের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় পশ্চিম পাকিস্তানীর জন্য অধিক ব্যয় বরাদ্দ করা হতো। অপরদিকে মোট সরকারি ব্যয়ের অল্প পরিমাণে বরাদ্দ করা হতো পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য। ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তান প্লানিং কমিশনের প্রধান অর্থনীতিবিদ মাহবুবুল হক তথ্য প্রকাশ করেন যে, দেশের শতকরা ৬৬ ভাগ শিল্প, ৭৯ ভাগ বীমা এবং ৮০ ভাগ ব্যাংক সম্পদ মাত্র ২২টি পরিবারের হাতে (যার মধ্যে ১টি বাদে বাকি সব পশ্চিম পাকিস্তানি) কেন্দ্রীভূত । জেনারেল আইয়ুব খানের এক দশকের শাসন আমলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যায় । এর সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ হয় । পাকিস্তানের পূর্ব অংশের পুঁজি পশ্চিম অংশে পাচার হয়ে যায় ।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি এমন অন্যায় ও বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ডকে সামনে রেখে ১৯৬৬ সালের ৫-৬ই ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে বিরোধী দলের এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ কনভেনশনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন ।
৬ দফা কর্মসূচি ছিল সংক্ষেপে নিম্নরূপ-
দফা-১ : লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্র। সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত আইন পরিষদের প্রাধান্যসহ সংসদীয় পদ্ধতির সরকার গঠনের ব্যবস্থা থাকতে হবে ।
দফা-২ : বৈদেশিক সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষা ছাড়া সকল বিষয় স্টেট বা প্রদেশের হাতে ন্যস্ত থাকবে । উল্লেখিত দু'টি বিষয় ন্যস্ত থাকবে কেন্দ্রীয় বা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের হাতে ।
দফা-৩ : পাকিস্তানের দু'টি অঞ্চলের জন্য পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রাব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে । অথবা সমগ্র দেশে একটি মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে, তবে সে ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার রোধের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য একটি ফেডারেল ব্যাংকের অধীনে কার্যকরী ব্যবস্থা থাকতে হবে ।
দফা-৪ : অঙ্গরাজ্য বা প্রদেশগুলোর কর বা শুল্ক ধার্য করার ক্ষমতা থাকবে। তবে ব্যয় নির্বাহের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এর একটি অংশ পাবে ।
দফা-৫ : পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পৃথক হিসাব রাখা হবে । অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা স্ব স্ব অঞ্চলের বা অঙ্গরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকবে । এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের বৈদেশিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অঙ্গরাজ্যগুলো বিদেশে বাণিজ্য প্রতিনিধি প্রেরণ এবং যেকোনো চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে।
দফা-৬ : নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অঙ্গরাষ্ট্রসমূহ প্যারামিলিশিয়া বা আধাসামরিক বাহিনী গড়ে তুলতে পারবে ।
ছয় দফার গুরুত্ব:
১৮-২০ শে মার্চ, ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে ছয় দফা গৃহীত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ছয় দফার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন স্থানে ২০ মার্চ থেকে ৮ মে পর্যন্ত ৩২ টি জনসভায় বক্তব্য দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উপস্থাপিত ৬ দফা কর্মসূচি ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তির সনদ বা ‘ম্যাগনাকার্টা'। কার্যত এই ৬ দফার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি ধাঁচের বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙে বাঙালির জাতীয়-মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য স্থির হয় । জেনারেল আইয়ুব খান ৬ দফাকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী,’ ‘বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠার' কর্মসূচি হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং তা নস্যাৎ করতে যেকোনো ধরনের শক্তি প্রয়োগের হুমকি দেন ।
আরও দেখুন...