SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or
Log in with Google Account

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - ইংরেজ শাসন আমলে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন | NCTB BOOK

ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যুদয়:

ব্রিটিশ শাসন অবসানের পূর্ব কথা : ১৯৪২ সালে ক্রিপস মিশন প্রস্তাব সব মহল প্রত্যাখ্যান করলে সমগ্র ভারতে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। রাজনীতিতেও নেমে আসে চরম হতাশা। তখন পৃথিবীব্যাপী চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ। জার্মানির মিত্র রাষ্ট্র জাপানের ভারত আক্রমণ আশঙ্কায় ভারতীয়দের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয় । গান্ধীজি ভারতে ব্রিটিশ সরকারের উপস্থিতিকে এই আক্রমণের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন । সুতরাং ব্রিটিশ সরকার ভারত ছাড়লে জাপানের ভারত আক্রমণ পরিকল্পনার পরিবর্তন হতে পারে । এই চিন্তা করে এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে তাঁর প্রেরিত প্রস্তাবে তিনি ইংরেজদের ভারত ছেড়ে যেতে বলেন । শুরু হয় কংগ্রেসের 'ভারত ছাড়' আন্দোলন । গান্ধীজির ডাকে 'ভারত ছাড়' আন্দোলনে জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়ে । সমগ্র ভারতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রবল ব্রিটিশবিরোধী রূপ নেয় । ১৯৪২ সালের ৮ই আগস্ট বোম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির ঐতিহাসিক অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী এক ঘোষণায় বলেন 'আমি অবিলম্বে স্বাধীনতা চাই । এমনকি এই রাতের মধ্যেই, ঊষালগ্নের আগেই যদি তা সম্ভব হয়।' তিনি আরো বলেন, 'আমরা লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করব । আর এ হবে আমাদের জীবনে শেষ লড়াই' ।

কিন্তু ইংরেজ সরকার ঐ সময় কোনোভাবেই ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিল না। বরং সরকার এই আন্দোলন দমন করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে। ঐ দিনই মধ্যরাতে কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ—গান্ধীজি, আবুল কালাম আজাদ, জওহরলাল নেহরুসহ অনেকে গ্রেফতার হন । সরকার কংগ্রেসকে বেআইনি ঘোষণা করে এবং এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় সব নেতা কারাবন্দী হন । নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের খবরে অহিংস আন্দোলন সহিংস আন্দোলনে পরিণত হয়। নেতাদের মুক্তির দাবিতে সর্বত্র হরতাল, কলকারখানা, স্কুল-কলেজে ধর্মঘট পালিত হতে থাকে । উত্তেজিত জনতা স্থানে স্থানে রেললাইন উপড়ে ফেলা, চলন্ত ট্রেনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ, রেল স্টেশনে, সরকারি ঘর-বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। নেতৃত্বহীন আন্দোলন জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সারা ভারতে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অগ্রসর হতে থাকে । কোথাও কোথাও অস্থায়ী সরকার, কোথাও বা জাতীয় সরকার গঠন করা হয় । ভয়াবহ ঘটনা ঘটে তমলুক থানা দখল করার সময়। মাতঙ্গিনী হাজরা নামে এক বৃদ্ধা জাতীয় পতাকা হাতে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন ।

এই আন্দোলনের সময় ১৯৪৩ সালে কৃত্রিম সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ মানুষকে দিশেহারা করে তোলে । তাছাড়া দেশব্যাপী মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতি, দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি— সব মিলিয়ে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে হতাশ জনগণের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব তীব্র হতে থাকে । যখন দেশের অভ্যন্তরে রাজনীতিতে চরম হতাশা বিরাজ করছে, ব্যর্থ হয়েছে ইংরেজ তাড়ানোর প্রাণপণ প্রচেষ্টা, তখন যুদ্ধ করে ইংরেজ বিতাড়নের জন্য বাঙালিদের নেতৃত্বে দেশের বাইরে গঠিত হয় আজাদ হিন্দ ফৌজ বা Indian National Army (INA)। এই সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু । এই বাহিনী গড়তে সাহায্য করেন আরেক বাঙালি বিপ্লবী রাসবিহারী বসু । কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি ও ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রতিষ্ঠাতা সুভাষ চন্দ্র বসু কংগ্রেসে আপোসকামী রাজনীতির বিপক্ষে ছিলেন । প্রথম থেকেই স্বাধীনতা অর্জনের পদ্ধতির প্রশ্নে গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর মতানৈক্য ছিল । কিশোর বয়স থেকে বিপ্লবী মনোভাবাপন্ন সুভাষ বসু ছিলেন গান্ধীর অহিংস নীতির বিরোধী । ১৯৩৭ সালে গান্ধীর অনুমোদনে কংগ্রেসের সভাপতি হলেও গান্ধীই আবার দ্বিতীয় দফায় তাঁকে সভাপতি পদে মনোনয়ন দেননি । তিনি সুভাষ বসুকে এ পদে নির্বাচন করতে নিষেধ করেন । সুভাষ বসু এই নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করেন এবং গান্ধীর মনোনীত প্রার্থীকে হারিয়ে আবার সভাপতি নির্বাচিত হন । গান্ধীর প্রতি এই ধরনের চ্যালেঞ্জে জয়ী সুভাষ বসু পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসের রাজনীতিতে গান্ধীর সহযোগিতা পেতে ব্যর্থ হন । হতাশ হয়ে সুভাষ বসু কংগ্রেস ছেড়ে ফরওয়ার্ড ব্লক দল গঠন করেন । তাঁর রাজনীতি আপোসহীন পথে অগ্রসর হতে থাকে। সুভাষ বসুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভীত ইংরেজ সরকার বারবার তাঁকে কারারুদ্ধ করে। শেষ পর্যন্ত কারামুক্তি লাভ করে ১৯৪১ সালে সবার অলক্ষ্যে সুভাষ বসু দেশ ত্যাগ করেন । তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে । তিনি প্রথম ইংরেজদের শত্রু ভূমি জার্মানিতে গমন করেন । সেখানে ভারতের স্বাধীনতার জন্য জার্মান সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সেনাবাহিনী গঠনের চেষ্টা করেন ।

তিনিই প্রথম ভারতীয় রাজনীতিবিদ, যিনি বিদেশি শক্তির সাহায্য নিয়ে লড়াই করে মাতৃভূমি স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন । পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় ডুবোজাহাজে করে এক দুঃসাহসিক অভিযানের মাধ্যমে আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে তিনি জাপানে আসেন। সেখানে অবস্থানরত বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সহযোগিতায় জাপানে বন্দী ভারতীয় সেনাদের নিয়ে গঠিত হয় আজাদ হিন্দ ফৌজ । ১৯৪৩ সালে তিনি এই বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং ঐ বছরই ভারতীয় ভূখণ্ডের আন্দামান দ্বীপে গঠন করেন আজাদ হিন্দ সরকার বা স্বাধীন ভারত সরকার । ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এই সরকারের সেনাবাহিনী বিভিন্ন রণাঙ্গনে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে । আজাদ হিন্দ ফৌজ এবং সুভাষ বসু তখন ছিলেন ইংরেজদের কাছে আতঙ্ক । সুভাষ বসু কর্তৃক সশস্ত্র সংগ্রাম ভারতে ইংরেজ সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দেয় । এই দুঃসাহসী বাঙালির নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ ১৯৪৪ সালে বার্মা হয়ে ভারত ভূমিতে পদার্পণ করে। কোহিমা-ইম্ফলের রণাঙ্গনে বীরত্ব ও সাফল্যের সঙ্গে লড়াই করে আজাদ হিন্দ ফৌজ এসব অঞ্চল দখল করে নেয় । দুর্ভাগ্যক্রমে এই রণাঙ্গনে জাপানি বাহিনী ইংরেজ বাহিনীর তীব্র আক্রমণ মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে পিছু হটলে আজাদ হিন্দ ফৌজকেও পিছু হটতে হয়। ১৯৪৫ সালে জাপানের রেঙ্গুন ত্যাগের কারণে আজাদ হিন্দ ফৌজের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয় । ব্যর্থ হয় এক দুঃসাহসী বাঙালি দেশপ্রেমী লড়াই করে মাতৃভূমির স্বাধীনতা উদ্ধারের প্রচেষ্টা । নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু সফল হলে ভিন্নভাবে লিখতে হতো ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস । তখনই রচিত হতো বাঙালির দেশপ্রেম আর বীরত্বের আরেক গৌরবের ইতিহাস ।

সুভাষ বসু প্রতিষ্ঠিত আজাদ হিন্দ সরকার ছিল অসাম্প্রদায়িক । এই সরকার ও সেনাবাহিনীতে অনেক যোগ্য মুসলমান অফিসার ও সেনাসদস্য ছিলেন। তাঁর অত্যন্ত বিশ্বস্ত সেনাপ্রধান শাহনাওয়াজ ছিলেন মুসলমান। এই অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ প্রগতিশীল বাঙালি নেতা নেতাজি সুভাষ বসু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নিরুদ্দেশ হয়ে যান । তাঁর অন্তর্ধান সম্পর্কে নানা কাহিনি প্রচলিত থাকলেও প্রকৃত সত্য এখনও গবেষণার বিষয় । ব্যর্থ হলেও নেতাজির অভিযান ভারতীয় স্বাধীনতাকামী জনগণের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও সাহসের সঞ্চার করেছিল। তিনি ব্রিটিশ-ভারতে দেশীয় সেনাসদস্যদের মধ্যে আনুগত্যের ফাটল ধরাতে যেমন সক্ষম হয়েছিলেন, তেমনি তাদের বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে প্রেরণা জুগিয়েছিলেন । আজাদ হিন্দ ফৌজের ব্যর্থতার পর ১৯৪৬ সালের বোম্বাইয়ে নৌ-বিদ্রোহ দেখা দেয় । এসব আলামত প্রমাণ করে যে, ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ভারতীয়দের আয়ত্তে রাখা ক্রমশ অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ব্রিটিশ সরকার একের পর এক উদ্যোগ গ্রহণ করতে থাকে। ইতিপূর্বে যুদ্ধ চলাকালীন সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল । এই উদ্দেশ্যে ১৯৪৫ সালে সিমলায় ভারতীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেল এক পরিকল্পনা পেশ করেন, যা ‘ওয়াভেল পরিকল্পনা' নামে পরিচিত । কংগ্রেস-মুসলিম লীগের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রদায়ভিত্তিক প্রতিনিধির সংখ্যা নিয়ে তীব্র মতবিরোধের কারণে ‘ওয়াভেল পরিকল্পনা' ব্যর্থ হয় ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর ইংল্যান্ডের সাধারণ নির্বাচনে শ্রমিক দল জয়লাভ করে । এই পরিবর্তনের ধারা ভারতের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলে । শ্রমিক দল ভারতের স্বাধীনতা দানের এবং ভারতীয়দের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ইংল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি ১৯৪৬ সালে ভারতে সাধারণ নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেন। সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে নেতৃত্বে দ্বন্দ্বের ফলে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ দুইটি উপদলে বিভক্ত হয়ে যায় । খাজা নাজিমুদ্দীন ছিলেন অবাঙালি ব্যবসায়ী ও রক্ষণশীলদের নেতা। অপরদিকে আবুল হাশিম এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন প্রগতিশীল বাঙালিদের নেতৃত্বে । শেষ পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দীই বাংলার মুসলিম লীগের নেতা নির্বাচিত হন । এই নির্বাচনে মুসলমান তরুণ ছাত্রসমাজ মুসলিম লীগকে সমর্থন দেয় । পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিকে প্রধান নির্বাচনী কর্মসূচি করে মুসলিম লীগ প্রাদেশিক আইন সভায় অভূতপূর্ব বিজয় অর্জন করে। এই নির্বাচন এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । কারণ এ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলার মুসলমানদের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে সুস্পষ্ট রায় ঘোষিত হয় এবং মুসলিম লীগ নিজেকে বাংলার মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র দল হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য, এই নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তান মুসলিম লীগ গরিষ্ঠ ভোট পায়নি । অর্থাৎ বাঙালি মুসলমানের ভোটে পাকিস্তান প্রস্তাব জয়ী হয়েছিল । এই জয়ের পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ।

নির্বাচন-উত্তর উপমহাদেশের রাজনীতিতে ভিন্ন পরিস্থিতির সম্ভাবনা দেখা দেয়। বিচক্ষণ অ্যাটলি সরকার বুঝতে পারে যে, সম্মানজনকভাবে খুব বেশি দিন ব্রিটেনের পক্ষে ভারত শাসন করা সম্ভব হবে না। ফলে ১৯৪৬ সালে ভারত সচিব পেথিক লরেন্সের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ভারতে আসে । যাকে বলা হয় ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনা। এ সময় দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের কনভেনশন পাকিস্তান দাবি মেনে নিয়ে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য ক্যাবিনেট মিশনের প্রতি আহ্বান জানায়। ক্যাবিনেট মিশন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মে মাসে ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করে ।

মন্ত্রী মিশন বা ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় তিন স্তরবিশিষ্ট যুক্তরাষ্ট্র গঠনের বিষয় উল্লেখ করা হয় । যথা-

ক. কেন্দ্রে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা ।
খ. ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলোকে নিয়ে একটি স্বায়ত্তশাসিত ভারত ইউনিয়ন গঠন করা ।
গ. হিন্দুপ্রধান গ্রুপ, মুসলমানপ্রধান গ্রুপ এবং বাংলা ও আসাম গ্রুপ- এ তিন ভাগে প্রদেশগুলোকে ভাগ করা এবং প্রত্যেক গ্রুপের জন্য একটি গণপরিষদ গঠন করা। তবে শর্ত দেয়া হয় যে, এ পরিকল্পনা গ্রহণ সার্বিকভাবে করতে হবে; অংশবিশেষ গ্রহণ করা যাবে না ।

মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনায় পাকিস্তান দাবি অগ্রাহ্য হলেও মুসলিম লীগ পরিকল্পনাটি গ্রহণ করে । কারণ মুসলিম লীগ মনে করে এই পরিকল্পনার মধ্যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নিহিত আছে। কংগ্রেস এ পরিকল্পনায় এককেন্দ্রিক সরকারের অখণ্ড ভারত গঠনের প্রতিফলন দেখতে পায় । কংগ্রেস নিজস্ব ব্যাখ্যা অনুযায়ী প্রস্তাবটি গ্রহণে রাজি ছিল । কিন্তু শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করলে মুসলিম লীগও তা প্রত্যাখ্যান করে । ফলে রাজনৈতিক সংকট সমাধানে মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনার প্রস্তাবগুলো অকেজো হয়ে যায় ।

বড়লাট ওয়াভেল মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস দলকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদানের আহ্বান জানান । কংগ্রেসের নবনির্বাচিত সভাপতি জহরলাল নেহেরু কর্তৃক মুসলিম লীগের স্বার্থবিরোধী বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম লীগ সরকারে যোগদানের পূর্ব সিদ্ধান্ত বাতিল করে। কিন্তু বড়লাটের আহ্বানে নেহরু সরকার গঠনে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এর প্রতিবাদে মুসলিম লীগ ১৬ই আগস্ট ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস' ঘোষণা করে। এই দিন ভয়াবহ দাঙ্গায় হাজার হাজার নিরীহ মানুষ নিহত হয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটলে ব্রিটিশ সরকার ভারতীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ঘোষণা করেন । ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোষণা করেন যে, ১৯৪৮ সালের জুন মাসের পূর্বে ভারতীয়দের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। ক্ষমতা হস্তান্তরের দায়িত্ব পালনের জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ভারতের বড়লাট হিসেবে পাঠানো হয় ।

লর্ড মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভারত বিভক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা থেকে দেশ রক্ষার জন্য শেষ পর্যন্ত নেতৃবৃন্দ দেশ বিভাগে সম্মত হতে বাধ্য হন । ৩রা জুন মাউন্টব্যাটন ভারত বিভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন । তিনি এও ঘোষণা করেন যে, ১৯৪৮ সালের পূর্বেই ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা হবে । অপরদিকে পাকিস্তান দাবি মেনে নেয়ায় মুসলিম লীগ সন্তোষ প্রকাশ করে ।

১৯৪৭ সালের ১৫ই জুলাই লন্ডনে কমন্স সভার এক ঘোষণায় ভারত-পাকিস্তান নামে দুইটি স্বাধীন ডোমিনিয়ন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয় । দুই দেশের সীমানা নির্ধারণের জন্য স্যার র‍্যাডক্লিফের নেতৃত্বে সীমানা নির্ধারণ কমিটি গঠন করা হয়। ৯ই আগস্ট র‍্যাডক্লিফ তাঁর সীমান্ত রোয়েদাদ সমাপ্ত করে ভাইসরয়ের কাছে জমা দেন, যা রহস্যজনক কারণে আলোর মুখ দেখেনি । ১৯৪৭ সালে ১৮ই জুলাই 'ভারত স্বাধীনতা আইন' প্রণয়ন করা হয়, যার ভিত্তিতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে । ১৯৪৭ সালে ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ই আগস্ট ভারত নামে দুইটি রাষ্ট্রের জন্ম হয় ।

 

Content added By
Promotion