SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - সত্তরের নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধ | NCTB BOOK

দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল মহান মুক্তিযুদ্ধ। স্বাভাবিক কারণেই মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্ৰ করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। বাম রাজনৈতিক দলগুলোর বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকলেও একটি অংশ বিরুদ্ধে ছিল। অন্যদিকে, পাকিস্তানি আদর্শে বিশ্বাসী ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো কেবল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে তাই নয়, তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অত্যাচার, নির্যাতন ও গণহত্যায় সহযোগিতা করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছে । মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল হলো আওয়ামী লীগ । বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত প্রথম বাংলাদেশ সরকার যথেষ্ট যোগ্যতা, দক্ষতা ও দূরদৃষ্টির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে ।

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সমমনা বাম রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে আওয়ামী লীগ একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে। এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (ন্যাপ-ভাসানী), মণি সিং (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি), মনোরঞ্জন ধর (বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস), অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ (ন্যাপ-মোজাফ্ফর) এবং আওয়ামী লীগ থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ । তবে পিকিংপন্থী হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি এবং পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (মতিন-আলাউদ্দিন) মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে । পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের দোসরদের অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা এদেশের জনগণকে আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ করেছে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, নারী, শিক্ষক, কবি, সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিল্পীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মুক্তির সংগ্রামে শামিল হয় ।

ছাত্রছাত্রী:

মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি ছিল ছাত্র। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন ছাত্ররা। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পাশাপাশি স্কুলপড়ুয়া কিশোররা ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। তারা যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যায় । মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী বাংলাদেশ সরকার ছাত্র-যুবকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের সংস্থান করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাত্র তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণ আর হালকা অস্ত্র নিয়ে অসীম সাহস, মনোবল আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে মুক্তিসেনার দল ।

কৃষক:
মুক্তিযুদ্ধে কৃষকদের অবদান ছিল অত্যন্ত গৌরবময়। স্বাধীনতা লাভের জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিলেন তাঁরা। শত্রুর বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রতিটি আক্রমণে তাঁরা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসাব তাঁদের কাছে গুরুত্ব পায়নি। একটাই লক্ষ্য- যেকোনো মূল্যে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে।

নারী:
মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল। ১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম থেকেই দেশের প্রতিটি অঞ্চলে যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, তাতে নারীদের বিশেষ করে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। দেশকে স্বাধীন করতে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। নারীরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মিছিল, মিটিং ও পণসমাবেশ করে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন । যুদ্ধের ৯ মাসে কয়েক লক্ষ মা-বোন পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের শিকার হন। তাঁদেরকে বঙ্গবন্ধু কন্যার মতো মমতায় সম্বোধন করেছেন 'বীরাঙ্গনা' বলে। এর বাইরে বিশালসংখ্যক নারী মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দিয়ে, খাবার দিয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, অস্ত্র লুকিয়ে রেখে, সেবা দিয়ে, নানাভাবে সহায়তা করেছেন। এমনকি প্রত্যক্ষ যুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণের দৃষ্টান্তও কম নয় । মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ দুইজন নারী ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব অর্জন করেন । একজন তারামন বিবি, অন্যজন ডাক্তার সিতারা বেগম । সারা দেশে আরও অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাকিস্তানি বাহিনীর মোকাবেলা করেছেন ।

গণমাধ্যম:
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম । সংবাদপত্র ও স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে । ২৬শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতারের শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করেন । পরে এটি মুজিবনগর সরকারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় । স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র সংবাদ, দেশাত্মবোধক গান, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, রণাঙ্গনের নানা ঘটনা ইত্যাদি দেশ ও জাতির সামনে তুলে ধরে সাধারণ মানুষকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে অনুপ্রাণিত করে; মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়ে বিজয়ের পথ সুগম করে । এছাড়া মুজিবনগর সরকারের প্রচার সেলের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত পত্রিকা মুক্তিযুদ্ধে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে ।

প্রবাসী বাঙালি:
প্রবাসী বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন । বিভিন্ন দেশে তারা মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন । বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ে পার্লামেন্ট সদস্যদের নিকট ছুটে গিয়েছেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেছেন, পাকিস্তানকে অস্ত্র-গোলাবারুদ সরবরাহ না করতে আবেদন করেছেন । এক্ষেত্রে, ব্রিটেনের প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখ্য । মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে তাঁরা কাজ করেছেন ।

শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী:
মুক্তিযুদ্ধের মূল নিয়ামক শক্তি ছিল জনগণ । তথাপি, যুদ্ধে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে শিল্পী-সাহিত্যিক- বুদ্ধিজীবী, বিভিন্ন সংস্কৃতি কর্মীর অবদান ছিল প্রশংসনীয় । এমনকি নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছেন । পত্রপত্রিকায় লেখা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে খবর পাঠ, দেশাত্মবোধক গান, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গান, কবিতা পাঠ, নাটক, কথিকা, এম আর আকতার মুকুলের অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘চরমপত্র' এবং ‘জল্লাদের দরবার' ইত্যাদি অনুষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে । এসব অনুষ্ঠান রণক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিক ও নৈতিক বল ধরে রাখতে সহায়তা করেছে, সাহস জুগিয়েছে, জনগণকে শত্রুর বিরুদ্ধে দুর্দমনীয় করেছে। সুরকার আলতাফ মাহমুদ, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, সেলিনা পারভীন, চিকিৎসক ডা. ফজলে রাব্বী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গিয়াস উদ্দিন আহমদসহ অগণিত গুণিজনকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। তাঁদের অমূল্য জীবনের বিনিময়ে এদেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে, হয়েছে স্বাধীন ।

জনসাধারণ:
সাধারণ জনগণের সাহায্য-সহযোগিতা ও স্বাধীনতার প্রতি ঐকান্তিক আকাঙ্ক্ষার ফলেই মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কিছুসংখ্যক দোসর ব্যতীত সবাই কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে । সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, শত্রুর অবস্থান ও চলাচলের তথ্য দিয়েছে, খাবার ও ওষুধ সরবরাহ করেছে, সেবা দিয়েছে ও খবরাখবর সরবরাহ করেছে । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ জনগণের পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণও অংশগ্রহণ করে। অনেকে মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হন । আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহিদের মধ্যে সাধারণ মানুষের সংখ্যা ছিল অধিক । তাঁদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীন মানচিত্র, লাল-সবুজ পতাকা ।

Content added || updated By