শূন্যস্থানে X-অক্ষ বরাবর আলো সঞ্চালনের সময় তড়িৎক্ষেত্রের জন্য যে তরঙ্গ সমীকরণ লেখা যেতে পারে তা হলো
… (7.1)
এখানে E হলো t সময়ে x অবস্থানে সাইনসদৃশভাবে পরিবর্তনশীল তড়িৎক্ষেত্র, c শূন্যস্থানে আলোর দ্রুতি এবং হলো তরঙ্গদৈর্ঘ্য । তড়িৎক্ষেত্র E রয়েছে Y Z তলে [চিত্র ৭.১]। সুতরাং আলো সঞ্চালন অভিমুখের সাথে লম্ব এবং Eo হলো তড়িৎক্ষেত্রের বিস্তার বা শীর্ষ মান। আলো সঞ্চালনের সময় তড়িৎক্ষেত্রের সাথে থাকে সাইনসদৃশভাবে পরিবর্তনশীল চৌম্বকক্ষেত্র B। চৌম্বকক্ষেত্র এর সঞ্চালনের অভিমুখ তড়িৎক্ষেত্র এর অভিমুখের সাথে লম্ব। চৌম্বকক্ষেত্র B এর জন্য তরঙ্গ সমীকরণটি হলো :
….(7.2)
এখানে Bo হলো চৌম্বকক্ষেত্রের বিস্তার বা শীর্ষ মান ।
তড়িৎ ও চৌম্বকক্ষেত্রের এরকম পরস্পর লম্ব সমবায়কে বলা হয় শূন্যস্থানে তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গ। তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গ তড়িৎ আধানের ত্বরণ থেকে উৎপন্ন হয়। বিকীর্ণ তরঙ্গ গঠিত হয় তড়িৎ ও চৌম্বকক্ষেত্রের পর্যায়ক্রমিক হ্রাস বৃদ্ধির মাধ্যমে। তড়িৎ ও চৌম্বকক্ষেত্র সর্বদাই পরস্পর সমকোণে থাকে। এছাড়া এগুলো সঞ্চালনের অভিমুখের সাথেও সমকোণে থাকে। সুতরাং ভাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গ হলো আড় বা অনুগ্রস্থ তরঙ্গ।
ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব থেকে জানা যায় যে, তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গে তড়িৎ ও চৌম্বকক্ষেত্রের বিস্তার যথাক্রমে Eo ও Bo নিচের সম্পর্ক দ্বারা সম্পর্কিত।
বা,
যেখানে c আলোর দ্রুতি । এ সমীকরণকে c = হিসেবেও লেখা যায়। B এ ছাড়া ম্যাক্সওয়েল শূন্যস্থানে তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গের বেগকে নিচের সমীকরণ দ্বারা প্রকাশ করেন।
এখানে হচ্ছে শূন্যস্থানের চৌম্বক প্রবেশ্যতা (permeability) এবং হচ্ছে শূন্যস্থানের তড়িৎ ভেদনযোগ্যতা (permitivity) ।
আমরা জানি যে, পরিবর্তনশীল চৌম্বক ফ্লাক্স তড়িৎক্ষেত্র উৎপন্ন করে এবং পরিবর্তনশীল তড়িৎ ফ্লাক্স চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি করে। এ থেকে বোঝা যায় যে, কোনো অঞ্চলে যদি তড়িৎ বা চৌম্বক ফ্লাক্সের পরিবর্তন ঘটে, তাহলে সে অঞ্চলের বাইরে পারিপার্শ্বিক স্থানে আলোর দ্রুতিতে তাড়িতচৌম্বকীয় ক্ষেত্র সঞ্চালিত হবে। এরকম চলাচলকারী তড়িৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্রকে বলা হয় তাড়িতচৌম্বকীয় বিকিরণ বা তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গ। সুতরাং তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গ হলো কোনো স্থান দিয়ে আলোর দ্রুতিতে গতিশীল তড়িৎ ও চৌম্বক আলোড়ন। এ তরঙ্গে তড়িৎ ও চৌম্বকক্ষেত্র সর্বদা সমকোণে থাকে। উভয়ক্ষেত্র সঞ্চারণের অভিমুখের সাথে সমকোণে থাকে। এ তরঙ্গ তাই আড় তরঙ্গ। কয়েকটি তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গের নাম হলো বেতার তরঙ্গ (radio wave), মাইক্রো তরঙ্গ (microwave), অবলোহিত তরঙ্গ (infrared wave), দৃশ্যমান আলো (visible light), অতি বেগুনি বিকিরণ (ultraviolet radiation), এক্সরে (x-ray) ও গামারশ্মি (gamma ray)।
এর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পাল্লা 7.80 x 10-7m থেকে 3.80 x 10-7m। এটি বিকিরণের একটি ক্ষুদ্র পটি বা ব্যান্ড (band) যার মধ্যে রয়েছে লাল থেকে বেগুনি আলো। দৃশ্যমান আলো কোনো অগ্নিশিখা বা ভাস্বর বস্তু থেকে উৎপন্ন হয় এবং মানব চক্ষু, ফটোগ্রাফিক ফিল্ম ও ফটোইলেকট্রিক সেল দ্বারা উদ্ঘাটিত হয়।
এই বিকিরণ 10-6m থেকে 10-8m তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পাল্লায় একটি বিকিরণ ব্যান্ড। এ ধরনের বিকিরণ উত্তপ্ত বস্তু যেমন সূর্য, তড়িৎশিখা ও তড়িৎচুল্লি থেকে উৎপন্ন হয়। এ বিকিরণকে থার্মোপাইন (thermopine), ফটোট্রানজিস্টর ইত্যাদি দ্বারা উদ্ঘাটন করা যায়। এই বিকিরণ প্রতিফলন ও প্রতিসরণের সূত্র মেনে চলে। এর ব্যতিচার ও সমবর্তন (polarization) ঘটে। কোনো বস্তুতে পতিত হলে বস্তুর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এর বেগ আলোর বেগের সমান। এ বিকিরণ সৌরচুল্লি ও সৌর হিটারে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে, কুয়াশার মধ্যে ছবি তুলতে, ফলকে শুষ্ক করতে, মাংসপেশির ব্যথা বা টান এর চিকিৎসায় এ রশ্মি ব্যবহৃত হয়।
তাড়িতচৌম্বকীয় বিকিরণের মধ্যে যাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পাল্লা 10 -2m থেকে 5 x 104 m তাদের বলা হয় বেতার তরঙ্গ। বেতার তরঙ্গকে আবার কয়েকটি উপবিভাগে ভাগ করা যায়। এরা হলো মাইক্রোওয়েভ বা মাইক্রোতরঙ্গ; রাডার তরঙ্গ ও টেলিভিশন তরঙ্গ।
বেতার তরঙ্গ উৎপাদিত হয় তড়িৎ স্পন্দনের মাধ্যমে। সাধারণ কোনো অ্যারিয়েল বা অ্যানটেনা দ্বারা ইলেকট্রনকে স্পন্দিত করে বেতার তরঙ্গ উৎপাদন করা হয়। দূরবর্তী স্থানে শব্দ বা ছবি প্রেরণের জন্য এ বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়।
এ তরঙ্গের শক্তি তড়িৎ ও চৌম্বক এ দুই ক্ষেত্রের মধ্যে সমানভাবে বণ্টিত থাকে। মধ্যম ও দীর্ঘ তরঙ্গের পথে বাধা থাকলেও অপবর্তনের মাধ্যমে তাদের পথের বাধা (পাহাড়-পর্বত) পেরিয়ে যেতে পারে। ফলে ট্রানজিস্টর ও রেডিও সিগন্যাল প্রেরক অ্যানটেনা থেকে গ্রাহক যন্ত্রে পৌঁছায়। এছাড়া পৃথিবীর ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলের আধানযুক্ত কণিকার স্তর দ্বারা মধ্যম ও দীর্ঘ বেতার তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়। ভূ-পৃষ্ঠের বাঁক থাকা সত্ত্বেও দূরবর্তী স্থানে এ ধরনের তরঙ্গ সঞ্চালিত হতে পারে। টেলিভিশন (VHF ও UHF) তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ক্ষুদ্রতর। এরা ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলের স্তর থেকে প্রতিফলিত হয় না। এবং কোনো উঁচু বাধা (যেমন পাহাড়-পর্বত) দ্বারা খুব সামান্যই পরিবর্তিত হয়। গ্রাহকযন্ত্রে উত্তম সিগন্যাল পেতে হলে এই ধরনের তরঙ্গের জন্য প্রেরক অ্যানটেনা থেকে গ্রাহক (টিভি) অ্যারিয়েল পর্যন্ত ভ্রমণ-পথ সরলরেখা হওয়া উচিত
এ জন্য দূরবর্তী স্থানে টেলিভিশন তরঙ্গ কৃত্রিম উপগ্রহ বা (স্যাটেলাইট)-এর মাধ্যমে রিলে (relay) করা হয় ।
নাম থেকেই বোঝা যায় যে, তাড়িতচৌম্বকীয় বর্ণালির দৃশ্যমান আলোর বেগুনি প্রান্ত ছাড়িয়ে এ বিকিরণের অবস্থান। এর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পাল্লা 5 x 10-7m থেকে 5 x 10-9m। কার্বন-আর্ক-ল্যাম্প, উত্তরে বস্তু ও সূর্য থেকে এই বিকিরণের উৎপত্তি হয়। এই বিকিরণকে ফটোগ্রাফিক প্লেট ও প্রতিপ্রভা দ্বারা উদ্ঘাটন করা যায়। এই বিকিরণ প্রতিফলন ও প্রতিসরণের সূত্র মেনে চলে। এর ব্যতিচার ও সমবর্তন ঘটে। কোনো বস্তুতে পতিত হলে তা থেকে ফটোইলেক্ট্রন নির্গত হয়। কোনো পদার্থে প্রতিপ্রভার সৃষ্টি করে ।
চুরি নিরোধক অ্যালার্ম, স্বয়ংক্রিয়ভাবে দরজা খোলার যন্ত্র ও কাউন্টারে এ বিকিরণ ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া আসল হীরা ও নকল ব্যাংক নোট উদ্ঘাটনে অতি বেগুনি বিকিরণ ব্যবহৃত হয়। শল্য চিকিৎসায় যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করতে এ বিকিরণ ব্যবহৃত হয় ।
এক্স-রে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পাল্লা 5x10-8 m থেকে 5 x 10-15 m-এর মধ্যে। সুতরাং এর এক প্রাপ্ত অতি বেগুনি বিকিরণ ও অপর প্রাপ্ত গামা রশ্মির পাল্লার ওপর উপরিলেপিত হয়। অত্যন্ত দ্রুতগতিসম্পন্ন ইলেকট্রনকে কোনো ভারী ধাতব বস্তু দ্বারা থামিয়ে দিলে এক্স-রে উৎপন্ন হয়। একে ফটোগ্রাফিক প্লেট বা ফিল্ম দ্বারা উদ্ঘাটন করা যায় । এছাড়া ধাতুতে তাড়িতচৌম্বকীয় প্রভাব তৈরি করে এবং গ্যাসে আয়নায়ন সৃষ্টি করে এক্স-রে উদ্ঘাটন করা যায়। ভাঙা হাড় ও দেহের অভ্যন্তরস্থ কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ছবি তুলতে এক্স-রে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া দেহের ক্ষতিকারক সেল টিউমার ধ্বংস করতে ব্যবহৃত হয়। কোনো ধাতব যন্ত্রের কোথাও কোনো ফাটল আছে কিনা তা শনাক্ত করতেও এক্স-রে ব্যবহৃত হয়।
এর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পাল্লা 5 x 10-11 m থেকে 5 x 10-15 m বা এর চেয়েও কম। তরঙ্গদৈর্ঘ্যের দিক দিয়ে এটি এক্স-রের অঞ্চলে উপরিলেপিত হয়। তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে এ রশ্মি নির্গত হয়। ফটোগ্রাফিক প্লেট ও গাইগার মূলার কাউন্টার দিয়ে এ রশ্মি উদ্ঘাটন করা যায়। মানবদেহে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষকে ধ্বংস করতে এই রশ্মি ব্যবহৃত হয়।
সূর্যের সাদা আলোর বর্ণালিতে রয়েছে বেগুনি, নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল রঙের সাতটি আলো। রংগুলোর নাম ও ক্রম সহজে মনে রাখার জন্য এদের নামের আদ্যাক্ষরগুলো নিয়ে ইংরেজিতে VIBGYOR ও বাংলা বেনীআসহকলা শব্দ গঠন করা হয়। এই রংগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পাল্লা নিচে দেয়া হলো :
বেগুনি : 3.80 x 10-7m থেকে 4.25 x 10-7m
নীল : 4.25 x 10-7m থেকে 4.45 x 10-7m
আসমানী : 5.00 x 10-7m থেকে 5.75 x 10-7m
সবুজ : 5.75 x 10-7m থেকে 5.85 x 10-7m
হলুদ : 5.85 x 10-7m থেকে 6.20 x 10-7m
কমলা : 6.20 x 10-7m থেকে 7.80 x 10-7m
লাল : 4.45 x 10-7m থেকে 5.00 x 10-7m
কোনো তরঙ্গের বেগ v হলে t সময়ে তরঙ্গ vt দূরত্ব অতিক্রম করে। কোনো বিন্দু উৎসকে কেন্দ্র করে vt ব্যাসার্ধের একটি গোলক কল্পনা করলে এই গোলক পৃষ্ঠ t সময়ের তরঙ্গমুখ নির্দেশ করে। এ t সময়ে গোলকের পৃষ্ঠের প্রতিটি কম্পমান কণা একই দশায় থাকে। সুতরাং যে কোনো সময় তরঙ্গমুখ সেই তল নির্দেশ করে যে তলে কণাসমূহ একই দশায় কম্পমান থাকে। সময়ের সাথে সাথে তরঙ্গমুখসমূহ সমান্তরালভাবে অগ্রসর হয় (চিত্র ৭.৩-এ A, B, C, D, E )।
তরঙ্গমুখের সাথে সমকোণে অঙ্কিত সরলরেখা ঐ তরঙ্গ যে শক্তি সঞ্চারণ করে সেই শক্তি সঞ্চারণের দিক নির্দেশ করে। ৭.৩ চিত্রে আলোক উৎস O থেকে A, B, C বা D তরঙ্গমুখের সমকোণে অঙ্কিত OP, OQ, OR প্রভৃতি রেখা বিভিন্ন দিকে আলোক সঞ্চারণের দিক নির্দেশ করে। এদের আলোক রশ্মি বলে। আলোক রশ্মি তরঙ্গমুখের সাথে সমকোণে থাকে। তরঙ্গমুখ যে সর্বদা গোলীয় হবে এমন কোনো কথা নেই। কোনো বিন্দু উৎস থেকে সমসত্ত্ব মাধ্যমে অল্প দূরত্বে তরঙ্গমুখ গোলীয় হবে। বহু দূরবর্তী কোনো উৎস থেকে আগত তরঙ্গমুখের বক্রতা এত সামান্য যে এর অংশবিশেষকে সমতল ধরা যায়। যে কারণে সূর্যের আলোর তরঙ্গমুখকে সমতল বিবেচনা করা যায় ।
সুতরাং একগুচ্ছ অভিসারী বা অপসারী আলোক রশ্মির তরঙ্গমুখ গোলীয় এবং সমান্তরাল আলোক রশ্মির তরঙ্গমুখ সমতল হবে।
সাধারণভাবে দুটি আলাদা আলোক উৎসকে সুসঙ্গত উৎস হিসেবে গণ্য করা যায় না, কেননা যে কোনো একটি উৎসের পরমাণু কর্তৃক নিঃসৃত আলোক তরঙ্গ অন্য উৎসের ওপর কোনোভাবেই নির্ভর করে না। তাই দুটি ভিন্ন উৎস থেকে নির্গত দুটি আলাদা আলোক তরঙ্গ একটি নির্দিষ্ট দশা সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে না। আলোর ব্যতিচার সংক্রান্ত পরীক্ষা নিরীক্ষায় সাধারণত একটি উৎস থেকে নির্গত আলোকে দুটি অংশে এমনভাবে বিভক্ত করা হয় যেন প্রতিটি বিভক্ত অংশকেই একটি স্বতন্ত্র উৎস হিসেবে গণ্য করা যায়। ফলে এই দুটি বিভক্ত অংশকে দুটি সুসঙ্গত উৎস হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আলোক তরঙ্গকে দুটি সরু পথে বা চিরের (slit) মধ্য দিয়ে যেতে দিয়ে একটি উৎস থেকে দুটি সুসঙ্গত উৎস তৈরি করা যায়।
কোনো স্থানে দুই বা ততোধিক আলোক তরঙ্গের উপরিপাতনের ফলে আলোর তীব্রতা তথা আলোক শক্তির পরিবর্তনের ঘটনাকে আলোর ব্যতিচার বলা হয়। দুটি উৎস থেকে নির্গত অভিন্ন দুটি তরঙ্গ (অর্থাৎ একই তরঙ্গদৈর্ঘ্য তথা কম্পাঙ্ক ও বিস্তারবিশিষ্ট দুটি তরঙ্গ) কোনো বিন্দুতে একে অপরের ওপর আপতিত হলে ঐ বিন্দুতে লব্ধি তীব্রতা যে কোনো একটি তরঙ্গের তীব্রতার চেয়ে বেশি বা কম হতে পারে। এই ঘটনাই তরঙ্গের ব্যতিচার । যখন লব্ধি তীব্রতা আলাদা আলাদা তরঙ্গের তীব্রতার চেয়ে বেশি হয় তখন তাকে গঠনমূলক ব্যতিচার আর যদি লব্ধি তীব্রতা আলাদা আলাদা তীব্রতার চেয়ে কম হয় তাকে ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার বলে ।
ধরা যাক, একই বিস্তার ও তরঙ্গদৈর্ঘ্য তথা কম্পাঙ্কবিশিষ্ট দুটি আলোক তরঙ্গ একই রেখা বরাবর কোনো স্থানে অগ্রসর হচ্ছে। কোনো বিন্দুতে তরঙ্গদ্বয় একই দশায় পৌঁছালে (অর্থাৎ ঐ বিন্দুতে উভয় তরঙ্গের তরঙ্গ চূড়া বা তরঙ্গ খাঁজ আপতিত হলে) ঐ বিন্দুতে লব্ধি বিস্তার তরঙ্গদ্বয়ের বিস্তারের সমষ্টির সমান হবে। অপরপক্ষে, কোনো বিন্দুতে তরঙ্গদ্বয় যদি বিপরীত দশায় মিলিত হয় (অর্থাৎ ঐ বিন্দুতে একটি তরঙ্গের তরঙ্গ চূড়া অপর তরঙ্গের তরঙ্গ খাঁজের সাথে মিলিত হয়) তবে ঐ বিন্দুর লব্ধি বিস্তার শূন্য হবে। যেহেতু আলোর তীব্রতা বিস্তারের বর্গের সমানুপাতিক সেহেতু প্রথমোক্ত বিন্দুতে তীব্রতার মান বেড়ে যাবে এবং শেষোক্ত বিন্দুতে এই মান শূন্য হবে। এর ফলে ঐ স্থানের কোনো তলে পরপর আলোকোজ্জ্বল ও অন্ধকার অবস্থার সৃষ্টি হয় অর্থাৎ ব্যতিচার হয়।
১। আলোর উৎস দুটি সুসঙ্গত হতে হবে।
২। যে দুটি তরঙ্গ ব্যতিচার ঘটাবে তাদের বিস্তার সমান বা প্রায় সমান হতে হবে।
৩। উৎসগুলো খুব কাছাকাছি অবস্থিত হতে হবে।
৪। উৎসগুলো খুব সূক্ষ্ম হতে হবে।
কোনো তলের বা পর্দার ওপর আলোর ব্যতিচার ঘটানো হলে সেখানে অনেকগুলো পরপর সমান্তরাল উজ্জ্বল আলোক রেখা বা পট্টি (band) এবং অন্ধকার রেখা বা পট্টি পাওয়া যায় । এই আলোকিত ও অন্ধকার ডোরাগুলোকে (fringe) ব্যতিচার ঝালর বলে ।
৭.৭ চিত্রে ইয়ং-এর পরীক্ষার ব্যবস্থাটি দেখানো হয়েছে। এই পরীক্ষায় তিনি সাদা আলোর উৎস ব্যবহার করেন।
পরীক্ষা : একটি চির S কাগজের তলের অভিলম্বভাবে রাখা আছে। অপর দুটি চির S1 ও S2 পরস্পরের খুব কাছাকাছি এবং প্রথম চির S এর সমান্তরালে রাখা আছে। S এর ভেতর দিয়ে সাদা সূর্য রশ্মি যেতে দিয়ে PR অবস্থানে একটি পর্দা রেখে তিনি পর্দার ওপর রঙিন ব্যতিচার পট্টি দেখতে পান ।
সাদা আলোর পরিবর্তে একবর্ণী (monoch- romatic) আলো নিলে পর্যায়ক্রমিকভাবে উজ্জ্বল ও অন্ধকার ডোরা দেখা যায়। S1 ও S2 চিরের যে কোনো একটি বন্ধ করে দিলে আর ব্যতিচার ডোরা দেখা যায় না। এভাবে ইয়ং সর্বপ্রথম পরীক্ষার মাধ্যমে আলোর ব্যতিচার প্রদর্শন করেন এবং আলোর তরঙ্গ প্রকৃতি প্রমাণ করেন।
নিজে কর : একটি অন্ধকার ঘরে ইয়ং-এর পরীক্ষাটি সম্পন্ন কর। সূর্যের আলোর পরিবর্তে সোডিয়াম আলো ব্যবহার করো। একটি সলতেকে লবণগোলা পানিতে ভিজিয়ে শুকিয়ে নাও। এখন এই সলতেটি জ্বালালে একবর্ণী আলো বিকিরণ করবে। |
---|
ব্যাখ্যা : হাইগেন্সের নীতি ব্যবহার করে ইয়ং-এর দ্বি চির পরীক্ষায় প্রদর্শিত আলোর ব্যতিচার ব্যাখ্যা করা যায়। চিড় S গোলীয় তরঙ্গমুখ প্রেরণ করে। যেহেতু S1 ও S2 চিরের দূরত্ব S থেকে সমান, কাজেই একই তরঙ্গমুখ S1 ও S2-তে এসে পৌঁছায়। এই তরঙ্গমুখের ওপর অবস্থিত S1, ও S2 বিন্দু এখন গৌণ তরঙ্গ নিঃসৃত করে যেগুলো পরস্পরের সাথে একই দশায় থাকে। সুতরাং S1 ও S2 চির থেকে নিঃসৃত গৌণ তরঙ্গসমূহ সুসঙ্গত, কেননা তাদের কম্পাঙ্ক ও বিস্তার একই । এখন S1, ও S2 থেকে নিঃসৃত তরঙ্গ দুটি উপরিপাতিত হয়ে ব্যতিচার ঘটায়। ৭.৭ চিত্রে অভগ্ন রেখাগুলো বরাবর গঠনমূলক ব্যতিচার ঘটে এবং পর্দার ওপর P, O, R প্রভৃতি স্থানে উজ্জ্বল ডোরা দেখা যায়।
অপরপক্ষে ভগ্ন রেখাগুলো বরাবর ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার ঘটে এবং T ও Q বিন্দুতে অন্ধকার ডোরা দেখা যায় ।
ধরা যাক, তরঙ্গদৈর্ঘ্যের একরঙা আলোর দুটি উৎস S1 এবং S2 (চিত্র ৭.৭ ) হতে একই সঙ্গে নির্গত আলোক তরঙ্গ প্রায় একই দিকে c বেগে সঞ্চালিত হয়ে P বিন্দুতে উপরিপাতিত হয়। P বিন্দুতে আলোর তীব্রতা সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন হওয়ার শর্ত নির্ণয় করা যাক।
ধরা যাক, যে কোন t সময়ে P বিন্দুতে আলোক তরঙ্গের সরণ S1 থেকে আগত তরঙ্গের জন্য y1 এবং S2 থেকে আগত তরঙ্গের জন্য y2 হলে,
এবং
এখানে a তরঙ্গের বিস্তার এবং S1 p = x1 S2 P = x2
P বিন্দুতে S1, ও S2 থেকে আগত তরঙ্গের দশাকোণ যথাক্রমে এবং বিন্দুতে তরঙ্গদ্বয়ের
দশা পার্থক্য,
অতএব, দশা পার্থক্য = পথ পার্থক্য
দুটি তরঙ্গ যখন একই দশায় মিলিত হয় তখন লব্ধি তরঙ্গের বিস্তার তথা প্রাবল্য সর্বাধিক হয় ফলে উজ্জ্বল ডোরার সৃষ্টি হয় বা গঠনমূলক ব্যতিচার ঘটে। অর্থাৎ গঠনমূলক ব্যতিচার সৃষ্টি হবে যখন,
দশা পার্থক্য, = 0, 2, 4, 6n....... ইত্যাদি π -এর যুগ্ম গুণিতক।
=2πn, যেখানে n= 0,1,2,3,4,…..
বা, পথ পার্থক্য, PS2- PS1 = =2n …(7.8)
যেখানে, n = 0, 1, 2, 3 ইত্যাদি।
সুতরাং এই ক্ষেত্রে গঠনমূলক ব্যতিচারের জন্য আমরা পাই,
আলোকীয় পথ পার্থক্য =
PS2- PS1 =…(7.9)
সুতরাং O বিন্দুতে একটি উজ্জ্বল ডোরা সৃষ্টি হয়। এটিকে অনেক সময় কেন্দ্রীয় চরম (Central maximum ) বলা হয়।
O থেকে প্রথম উজ্জ্বল ডোরাটি পাওয়া যাবে P তে যেখানে n = 1 এবং পথ পার্থক্য = PS2 - PS1 =
সুতরাং (7.9) সমীকরণের অখণ্ড পূর্ণ সংখ্যা n আসলে কেন্দ্র বা মধ্যস্থল থেকে n তম উজ্জ্বল ডোরা নির্দেশ করে।
সুতরাং দেখা যায় যে, পর্দার ওপর যে বিন্দুতে উভয় চির থেকে আগত তরঙ্গ দুটির পথপার্থক্য 1 টি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (.) সমান হয়, সে বিন্দুতে একটি উজ্জ্বল ডোরা পাওয়া যায় এবং মধ্যস্থল থেকে গণনা করলে সেটি হবে ১ম উজ্জ্বল ডোরা। অনুরূপভাবে যে বিন্দুতে পথপার্থক্য ২টি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সমান হয় সেই বিন্দুতে আরেকটি উজ্জ্বল ডোরা পাওয়া যায় এবং মধ্যস্থল থেকে গণনা করলে সেটি হবে ২য় উজ্জ্বল ডোরা।
যখন ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার ঘটে, তখন অন্ধকার ডোরা পাওয়া যায় এবং সাধারণভাবে সেটা ঘটে যখন তরঙ্গ দুটি বিপরীত দশায় মিলিত হয় অর্থাৎ যখন দশা পার্থক্য = π, 3π, 5π, 7π ....... ইত্যাদি π-এর অযুগ্ম গুণিতক = ( 2n + 1), যেখানে n = 0, 1, 2, 3 ইত্যাদি।
(Separation between two Consecutive fringes and fringe width)
দেখা গেছে, দুটি ডোরার মধ্যবর্তী দূরত্ব নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর ওপর নির্ভর করে-
(১) ব্যবহৃত তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য, (.;
(২) দ্বি-চির থেকে পর্দার দূরত্ব D
(৩) চির দুটির মধ্যবর্তী দূরত্ব, al
আমরা এখন ডোরার মধ্যবর্তী ব্যবধানের সাথে এদের সম্পর্ক স্থাপন করব।
ধরা যাক ৭.৮ চিত্রে O থেকে তথা কেন্দ্রীয় চরম থেকে n তম উজ্জ্বল ডোরাটির অবস্থান হচ্ছে P 10 থেকে P তথা n তম উজ্জ্বল ডোরার দূরত্ব xn। যেহেতু এই সকল দূরত্ব খুবই ক্ষুদ্র, তাই
B হচ্ছে S2P এর ওপর একটি বিন্দু যেখানে S1P = BP হয়।
যেহেতু D এর তুলনায় a এবং x খুবই ক্ষুদ্র, তাই PSB সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের সমান কোণ দুটিকে প্রায় 90° ধরা যায় । সুতরাং 2 প্রায় 90° । এ ছাড়াও
পথ পার্থক্য = PS2 - PS1
= PS2 - PB (PB = PS 1 ) = S2 B
এখন S, BS, ত্রিভুজে
১। দ্বি-চির পরীক্ষা থেকে দেখা যায় আলোর ব্যতিচার ঘটে।
২। যেহেতু ব্যতিচার ঘটে তরঙ্গের, কাজেই আলো এক প্রকার তরঙ্গ। অর্থাৎ ইয়ং এর দ্বি চির পরীক্ষা আলোর তরঙ্গ তত্ত্বকে সমর্থন করে।
আমরা জানি, আলো সরল পথে চলে। আলোক রশ্মির পথে কোনো অস্বচ্ছ বস্তু স্থাপন করলে ঐ বস্তুর ছায়া সৃষ্টি হয়। এটি আলোর সরলরেখ গতির একটি প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আলোক রশ্মির পথে কোনো তীক্ষ্ণ ধার বিশিষ্ট কোনো অস্বচ্ছ বস্তু স্থাপন করলে বস্তুর যে ছায়া সৃষ্টি হয় তা ভালোভাবে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, আলোর সরলরেখ গতির নিয়মানুযায়ী যে রূপ ছায়া হওয়া উচিত, ঠিক সে রূপ ছায়া হচ্ছে না। দেখা যায় যে, ছায়ার সীমারেখার মধ্যেও কিছুটা আলোক তীব্রতা থাকে যা দ্রুত হ্রাস পেয়ে শূন্য হয়। অর্থাৎ কিছু আলো এমন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে যে অঞ্চলে আলো শুধু সরলরেখায় গমন করলে অন্ধকার থাকার কথা। এ থেকে বোঝা যায় যে, কোনো প্রতিবন্ধকের ধার ঘেঁষে আলো সরল পথে না চলে কিছুটা বেঁকে যায় এবং আলো জ্যামিতিক ছায়া অঞ্চলের সামান্য ভেতর পর্যন্ত প্রবেশ করে । আলোর অপবর্তনের জন্য এরূপ ঘটে।
তীক্ষ্ণধার প্রতিবন্ধক, কোনো ছিদ্র বা চিরের আকার যদি আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সাথে তুলনীয় বা প্রায় সমান হয় তাহলে অপবর্তনের ঘটনা লক্ষণীয় হয়। সকল প্রকার তরঙ্গ অপবর্তন প্রদর্শন করে।
নিজে কর : দিনের বেলা ঘরের জানালার বা রাতের বেলা আলোক উৎসের বিপরীত পাশের দেয়ালের সামনে হাতের আঙ্গুল প্রসারিত করে ধরো। |
---|
ধরা যাক, S একটি আলোক উৎস এবং তার সামনে একটি অস্বচ্ছ প্রতিবন্ধক AB । প্রতিবন্ধকের পেছনে PQ একটি
পর্দা (চিত্র ৭.১১)। আলো সরলরেখায় গমন করে বলে পর্দার ওপর AB প্রতিবন্ধকের একটি ছায়া MN গঠিত হবে। কারণ, প্রতিবন্ধকের জন্য উৎস থেকে কোনো আলো MN অঞ্চলে এসে পৌঁছাতে পারে না। MN অংশ সম্পূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকবে। M বিন্দুর ওপরে এবং N বিন্দুর নিচে পর্দার সমস্ত অংশ সমভাবে আলোকিত হবে কারণ ঐ অঞ্চলে উৎস থেকে আলো পৌঁছাতে কোনো বাধা পায় না। কিন্তু খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, M বিন্দু এবং N বিন্দু থেকে হঠাৎ অন্ধকার শুরু হয় না। অর্থাৎ ছায়ার দুই প্রান্ত খুব তীক্ষ্ণ (Sharp) নয়। M বিন্দুর নিচে এবং N বিন্দুর ওপরেও কিছু অংশে অল্প অল্প আলোর অনুপ্রবেশ ঘটে। অর্থাৎ আলোর অপবর্তন হয়।
ধরা যাক, S উৎস থেকে কোনো এক সময় তরঙ্গমুখ AB প্রতিবন্ধকে উপস্থিত হলো। এখন হাইগেনসের নীতি অনুযায়ী অগ্রসরমান প্রতিটি তরঙ্গমুখের উপর অবস্থিত কণাগুলো গৌণ তরঙ্গসমূহের উৎসরূপে ক্রিয়া করে। হাইগেনসের নীতি অনুসরণ করে অণুতরঙ্গ অঙ্কন করলে দেখা যায় A ও B এর নিকটবর্তী অঞ্চল থেকে কিছু কিছু গৌণতরঙ্গ MN ছায়া অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করে M বিন্দুর নিচে এবং N বিন্দুর ওপরে কিছু অংশকে আলোকিত করে।
অপবর্তন দু শ্রেণির হয়ে থাকে; যথা-
(১) ফেন্সে শ্রেণির অপবর্তন (Fresnel diffraction)
(২) ফ্রনহফার শ্রেণির অপবর্তন (Fraunhoffer diffraction)
সুই, সরু তার বা সরু চিরের ওপর গোলীয় তরঙ্গমুখের আপতনে এ শ্রেণির অপবর্তন পাওয়া যায়।
একক বা দ্বি-চির, অপবর্তন গ্রেটিং প্রভৃতির সাহায্যে ফ্রনহফার শ্রেণির অপবর্তন পাওয়া যায় ।
Diffraction at a Single Slit
একটি সরু চির AB বিবেচনা করা যাক। এই চিরের প্রস্থ a চিরটি বই-এর তলের সাথে অভিলম্বভাবে অবস্থিত। এই চিরের সামনে একটি উত্তল লেন্স L1, স্থাপন করা আছে। এই লেন্সের প্রধান ফোকাসে স্থাপিত একটি সরু ছিদ্র S থেকে । তরঙ্গদৈর্ঘ্যের একবর্ণী আলো লেন্সে প্রতিসরিত হয়ে সমান্তরাল গুচ্ছে পরিণত হয় (চিত্র ৭.১২)। এই সমান্তরাল রশ্মিগুচ্ছ সমতল তরঙ্গমুখের আকারে AB চিরের ওপর পড়ে। AB থেকে নির্গত আলোক রশ্মিগুচ্ছকে অন্য একটি উত্তল লেন্স L2 এর সাহায্যে তার ফোকাস তলে স্থাপিত MN পর্দার ওপর কেন্দ্রীভূত করা হয় ।
AB চিরের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় আলোক রশ্মি A বিন্দুর ওপরে এবং B বিন্দুর নিচের দিকেও ছড়িয়ে পড়ে। কাজেই O বিন্দুতে চিরের একটি সুতীক্ষ্ণ বিম্ব না হয়ে এর উভয় পাশে পর্যায়ক্রমে উজ্জ্বল ও কালো বর্ণের অপবর্তন ঝালর গঠিত হয়। AB চিরে অবস্থিত সমতল তরঙ্গমুখের প্রতিটি কণা সমদশা সম্পন্ন। ফলে ঐ সকল কণা থেকে গৌণ তরঙ্গসমূহ চিরের অক্ষ CO এর সমান্তরালে এসে L2, উত্তল লেন্স দ্বারা প্রতিসরিত হয়ে O বিন্দুতে একত্রিত হয়। এভাবে এরা O বিন্দুতে সমদশায় পৌঁছে গঠনমূলক ব্যতিচার গঠন করে এবং ঐ বিন্দুর প্রাবল্য তথা উজ্জ্বলতা সর্বোচ্চ বা চরম হয় । O বিন্দুকে মুখ্য চরম বিন্দু (Principal maximum) বলে ।
এখন ধরা যাক, কিছু গৌণ তরঙ্গ CO এর সাথে কোণে অপবর্তিত হয়ে CO অভিমুখের সমান্তরালে গিয়ে L2, লেন্সে আপতিত হয়। এখন লেন্স দ্বারা প্রতিসরিত হয়ে এগুলো O1 বিন্দুতে একত্রিত হয়। এক্ষেত্রে তরঙ্গগুলো সমান পথ অতিক্রম করে না বলে O1 বিন্দুতে ঐ সকল তরঙ্গের দশা এক হবে না। O1, বিন্দুর প্রাবল্য সর্বোচ্চ বা চরম (maximum ) হবে নাকি সর্বনিম্ন বা অবম (minimum) হবে অর্থাৎ বিন্দুটি চরম বিন্দু হবে না অবম বিন্দু হবে তা নির্ভর করবে গৌণ তরঙ্গগুলোর পথ পার্থক্যের ওপর । ৭.১২ চিত্র থেকে দেখা যায় যে, AB চিরের দুই প্রান্তবিন্দু A ও B থেকে নির্গত দুটি গৌণ তরঙ্গের পথ পার্থক্য
হচ্ছে AD = AB sin = a sine
গাণিতিক হিসাবের সাহায্যে O1 বিন্দুটির অবম বা চরম হওয়ার নিম্নোক্ত শর্ত পাওয়া যায় ।
a sin n =
a sin θn= (2n +1)
আলোর উৎসকে বিশ্লেষণের একটি অতি প্রয়োজনীয় কৌশল (device) হলো অপবর্তন গ্রেটিং। অনেকগুলো সমান ফাঁকবিশিষ্ট সমান্তরাল চির দিয়ে অপবর্তন যেটিং গঠিত।
একটি সূচালো অগ্রভাগ বিশিষ্ট হীরার টুকরা দিয়ে একটি স্বচ্ছ সমতল কাচ পাতে দাগ কেটে বা রেখা টেনে গ্রেটিং তৈরি করা হয়। এই দাগগুলো সমব্যবধানে অবস্থিত থাকে এবং এগুলো পরস্পর সমান্তরাল হয়। এই পাতের ওপর আলো আপতিত হলে আলো দুটি দাগের মধ্যবর্তী স্বচ্ছ অংশের মধ্য দিয়ে যেতে পারে। সুতরাং দুটি দাগের মধ্যবর্তী স্বচ্ছ অংশগুলো চিরের মতো কাজ করে এবং প্রতিটি দাগ অস্বচ্ছ ব্যবধানের কাজ করে। আমরা পরীক্ষাগারে যে সকল গ্রেটিং ব্যবহার করি তার প্রতি সেন্টিমিটারে প্রায় 10,000 পর্যন্ত দাগ কাটা থাকে। ফলে এক একটি চিরের প্রস্থ হয় প্রায় 10-4cm
ধরা যাক,
প্রতিটি চিরের প্রস্থ = a
প্রতিটি রেখার প্রস্থ = b
:: গ্রেটিং ধ্রুবক, d = a + b
সুতরাং গ্রেটিং এর d দৈর্ঘ্যে রেখার সংখ্যা দুটি। অতএব, একক দৈর্ঘ্যে রেখার সংখ্যা টি। এখন গ্রেটিং এর প্রতি একক দৈর্ঘ্যে রেখার সংখ্যা N হলে,
N =
গ্রেটিং এর (a + b) ব্যবধানে অবস্থিত দুটি বিন্দুকে অনুরূপ বিন্দু (Corresponding points) বলে।
আলোকীয় ঘটনা ব্যতিচার ও অপবর্তন ব্যাখ্যার জন্য আমরা আলোর তরঙ্গ প্রকৃতি ব্যবহার করেছি। এখন আমরা সমবর্তন আলোচনা করব এবং দেখাব যে, তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গ হলো আড় তরঙ্গ ।
আমরা জানি যে, তরঙ্গ দু'রকম হতে পারে-দীঘল তরঙ্গ ও আড় তরঙ্গ। এ দু ধরনের তরঙ্গকে এভাবে পৃথক করা যেতে পারে যে, আড় তরঙ্গকে সমবর্তিত বা পোলারায়িত করা যায় কিন্তু দীঘল তরঙ্গকে সমবর্তিত করা যায় না ।
তরঙ্গ সঞ্চালনের অভিমুখ যে তলে অবস্থিত আড় তরঙ্গের সকল কম্পন যদি সেই সমতলে থাকে তাহলে তাকে সমতল- সমবর্তিত (plane polarized) বা রৈখিক সমবর্তিত (linearly polarized) বলা হয়।
৭.১৩ নং চিত্রে দুটি তার দেখানো হয়েছে যাদের বরাবর আড় তরঙ্গ অগ্রসর হচ্ছে। তরঙ্গ A, XY-তলে সমতল সমবর্তিত এবং তরঙ্গ B. XZ তলে সমতল সমবর্তিত। প্রতিটি তরঙ্গ কোনো বাধা না পেয়ে এর আনুষঙ্গিক চির দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে (চিরগুলো যদি চিত্রের মতো দিকাভিমুখী থাকে)। কিন্তু চির A কে OX-অক্ষের চারদিকে 90° ঘুরানো হলে এটি OX-এর সমান্তরাল হয়ে যায় এবং তরঙ্গ A এর চির দিয়ে যেতে অক্ষম হয়ে যায়। দীঘল তরঙ্গের ক্ষেত্রে এরকম প্রভাব কখনো ঘটে না।
আলোক তরঙ্গ এক প্রকার তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গ। এর সাথে সংশ্লিষ্ট আছে তড়িৎ ক্ষেত্র এবং চৌম্বকক্ষেত্র । আলোক তরঙ্গের কম্পন হলো এবং এর পর্যায়বৃত্ত পরিবর্তন। এদের পর্যায়বৃত্ত কম্পনের কম্পাঙ্ক সমান। এবং পরস্পর লম্ব এবং উভয়ই সর্বদা আলোক তরঙ্গ সঞ্চালনের দিক তথা আলোর বেগের দিকের সাথে লম্ব। অর্থাৎ এবং এর দিক সর্বদা এমন হবে যাতে ভেক্টর গুণফল x এর অভিমুখ আলোর বেগের অভিমুখ নির্দেশ করে ।
৭.১৪ চিত্রে দেখা যাচ্ছে আলোক সঞ্চালনের অভিমুখ X - অক্ষ বরাবর। সুতরাং ভেক্টর XY সমতলে এবং B ভেক্টর -> -> XZ সমতলে কম্পনশীল। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, x অর্থাৎ এবং ভেক্টর গুণফলের দিক আলোর বেগের দিক নির্দেশ করলেও এবং এর ভেক্টর গুণফলের মান কিন্তু আলোর বেগের মান তথা আলোর দ্রুতি নির্দেশ করে না। বরং E ও B এর অনুপাত অর্থাৎ E/B-ই হচ্ছে আলোর দ্রুতির সমান ।
সুতরাং
ধরা যাক, S আলোক উৎস থেকে চারদিকে আলোক তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে [চিত্র ৭.৪ ]। কোনো এক সময় AB হচ্ছে তরঙ্গমুখের অবস্থান। এখন সময়ের সাথে সাথে তরঙ্গমুখ সামনের দিকে অগ্রসর হয়। t সময় পরে তরঙ্গমুখের অবস্থান কোথায় হবে তা হাইগেন্সের নীতির সাহায্যে নির্ণয় করা যায়। হাইগেনসের নীতি অনুযায়ী তরঙ্গমুখে অবস্থিত প্রত্যেকটি কণাকে গৌণ উৎস (secondary source) বলে ধরা হয় এবং ঐ কণাগুলো থেকে অণুতরঙ্গ বা গৌণতরঙ্গসমূহ (secondary waves) নির্গত হয়ে চারদিকে একই বেগে ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং সেকেন্ড পরে তরঙ্গমুখের অবস্থান বের করার জন্য AB তরঙ্গমুখের ওপর P1, P2, P3 ইত্যাদি কণা নেওয়া হয়। এখন আলোর বেগ c হলে প্রত্যেক কণাকে কেন্দ্র করে ct ব্যাসার্ধের ছোট ছোট গোলক কল্পনা করা হয়। ঐ গোলকগুলোই হবে P1, P2 প্রভৃতি গৌণ উৎস থেকে সৃষ্ট গৌণ তরঙ্গের অবস্থান। তখন ঐ ছোট গোলকগুলোকে স্পর্শ করে যে গোলীয় তল A1 B1, পাওয়া যায় তাই হচ্ছে। সেকেন্ড পরে অগ্রসরমান তরঙ্গমুখের অবস্থান।
ধরা যাক, AF একটি সমতল তরঙ্গমুখ XY প্রতিফলক তলের উপর তির্যকভাবে আপতিত হয় [চিত্র ৭.৫। AF- এর ওপর অঙ্কিত লম্বগুলো আলোকরশ্মি নির্দেশ করে। এখন হাইগেনসের নীতি অনুসারে AF-এর উপরস্থ প্রত্যেকটি বিন্দু পর্যায়ক্রমে XY তলে পৌঁছে সুতরাং এগুলো গৌণ উৎসের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। ধরা যাক, আলোক তরঙ্গকে C বেগে F থেকে E-তে পৌঁছতে সেকেন্ড সময় লাগে। সুতরাং যে সময়ে আলোক তরঙ্গ F থেকে E-তে পৌঁছে সেই একই সময়ে A বিন্দু থেকে তরঙ্গ একই মাধ্যমে AB (= ct) দূরত্ব অতিক্রম করে। এখন A-কে কেন্দ্র করে EF(=ct) এর সমান ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্তাংশ অঙ্কন করে E থেকে বৃত্তাংশের উপর EB স্পর্শক টানা হয়। তাহলে EB হবে AF-এর প্রতিফলিত তরঙ্গমুখ। AEB ও EFA সমকোণী ত্রিভুজদ্বয়ে AB =FE =ct এবং AE সাধারণ বাহু
:- ত্রিভুজদ্বর সর্বসম ।
সুতরাং এখন A বিন্দুতে XY তলের ওপর NA লম্ব টানা হয় । সুতরাং :- আবার, :. ( 7.4) সমীকরণ থেকে অর্থাৎ আপতন কোণ (i) = প্রতিফলন কোণ (r) ।... (7.5) আবার আপতিত রশ্মি CA অভিলম্ব AN এবং প্রতিফলিত রশ্মি AB একই সমতলে অবস্থিত। সুতরাং হাইগেন্সের নীতির সাহায্যে প্রতিফলনের সূত্র প্রতিপাদিত হলো। আবার যেহেতু আপতিত রশ্মি, অভিলম্ব ও প্রতিফলিত রশ্মি কাগজের তলে অর্থাৎ একই সমতলে অবস্থান করে, সুতরাং প্রতিফলনের প্রথম সূত্রটিও প্রতিষ্ঠিত হয়। ধরা যাক, XY হচ্ছে a ও b দুটি স্বচ্ছ মাধ্যমের বিভেদতল। ধরা যাক, AB একটি সমতল তরঙ্গমুখ a মাধ্যমে EA অভিমুখে c বেগে চলছে। তরঙ্গমুখটি যখন X Y বিভেদতলের A বিন্দুতে তির্যকভাবে পৌঁছে তখন সেখানকার ইথার কণাগুলো আন্দোলিত হয়। হাইগেন্সের নীতি অনুযায়ী সেগুলো গৌণ উৎস হিসেবে কাজ করে এবং তা থেকে উৎপন্ন গৌণ তরঙ্গ b মাধ্যমে প্রবেশ করে পরিবর্তিত বেগে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে [চিত্র ৭.৬)। এখন t সময়ে আলোক তরঙ্গ B থেকে একই মাধ্যমে a তে C বিন্দুতে পৌঁছে। সুতরাং BC = c1t । এই একই সময়ে A থেকে আলোক রশ্মি b মাধ্যমে D-তে পৌঁছলে AD = c2t হয়। এখানে C2 হলো b মাধ্যমে আলোর বেগ । এখন A কে কেন্দ্র করে c2t সমান ব্যাসার্ধের বৃত্তচাপ অঙ্কন করে C থেকে CD স্পর্শক টানলে তা প্রতিসরিত তরঙ্গমুখ নির্দেশ করে যা AG বরাবর অগ্রসর হয়। সুতরাং CD তরঙ্গমুখের ওপর লম্ব AG প্রতিসরিত রশ্মি এবং EA আপতিত রশ্মি নির্দেশ করে। এখন আপতিত তরঙ্গমুখ AB ও প্রতিসরিত তরঙ্গমুখ CD প্রতিসরণ তল XY-এর সাথে যথাক্রমে এখন EA, AB তলের উপর এবং NA, AC তলের ওপর লম্ব। সুতরাং .. :. .: AN' ও AD যথাক্রমে AC ও DC-এর ওপর লম্ব। এখন, …(7.6) এটি প্রতিসরণ সংক্রান্ত স্নেলের সূত্র বা প্রতিসরণের দ্বিতীয় সূত্র। আবার যেহেতু আপতিত রশ্মি, অভিলম্ব ও প্রতিসৃত রশ্মি কাগজের তলে অর্থাৎ একই সমতলে অবস্থান করে, সুতরাং প্রতিসরণের প্রথম সূত্রটিও প্রতিষ্ঠিত হয়।হাইগেন্সের নীতি ও আলোর প্রতিসরণ