ভাইরাস একটি ল্যাটিন শব্দ, যার অর্থ বিষ (poison)।ভাইরাস হলো নিউক্লিক এসিড ও প্রোটিন সমন্বয়ে গঠিত এক প্রকার অতি-আণুবীক্ষণিক অকোষীয় সত্য যা কেবল উপযুক্ত জীবকোষের অভ্যন্তরে বংশবৃদ্ধি করতে পারে এবং বিশেষ বিশেষ রোগ সৃষ্টি করতে পারে কিন্তু জীবকোষের বাইরে জড় বস্তুর মত অবস্থান করে।
আবিষ্কারঃ ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে জার্মান বিজ্ঞানী চার্লস এনকুজ (Charles Encluse) সর্বপ্রথম ভাইরাসের অস্তিত্ব অনুধাবন করেন বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড জেনার (Edward Jenner) ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ভাইরাসঘটিত রোগের কথা উল্লেখ করেন। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম ভাইরাস সৃষ্ট মোজাইক রোগের বর্ণনা দেন বিজ্ঞানী অ্যাডোলফ মায়ার (Air Mayer)। তিনি তামাক গাছের পাতায় ভাইরাসজনিত রোগ পর্যবেক্ষণ করেন এবং নাম দেন তামাকের মোজাইক রোগ । ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে রুশ জীবাণুবিদ দিমিত্রি আইভানোভসকি (Dmitri Iwanowsky) তামাক গাছের মোজাইক রোগের কারণ হিসেবে ভাইরাসের উপস্থিতি প্রমাণ করেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান বিজ্ঞানী স্ট্যানলি (Stanley) তামাকের মোজাইক ভাইরাস (TMV)-কে রোগাক্রান্ত তামাক পাতা থেকে পৃথক করে কেলাসিত করতে সক্ষম হন। এজন্য তিনি ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে পিরি (Piric) এবং বদেন (Bawden) ভাইরাসের দেহ প্রোটিন ও নিউক্লিক এসিডে গঠিত তা প্রমাণ করেন। ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্র আবিষ্কারের পরবর্তী সময়ে (১৯৪০-১৯৯৬) ভাইরাসের এবং মরিস (Morris) ভৌত গঠন সম্বন্ধে নতুন নতুন ধারণা পাওয়া যায় (১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে শেফারম্যান (Shafferman M, মানুষের মরণব্যাধি সায়ানোব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী সায়ানোফাজ আবিষ্কার করেন। গ্যালো ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে এইডস রোগের ভাইরাস আবিষ্কার করেন। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে মানুষের নীরব ঘাতক হেপাটাইটিস সি ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়।
ভাইরাসের আবাস (Habitat of Virus) : ভাইরাস জীব ও জড় উভয় পরিবেশেই বাস করে, তবে সজীব দেে ভাইরাস সক্রিয় থাকে । উদ্ভিদ, প্রাণী, ব্যাকটেরিয়া, সায়ানোব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক প্রভৃতি জীবদেহের সজীব কোষে ভাইরা সক্রিয় অবস্থান করতে পারে। আবার মাটি, পানি, বায়ু ইত্যাদি সর্বত্রই ভাইরাস বিরাজ করে । বিভিন্ন উষ্ণ প্রস্রবণ থেকে শুরু করে প্রচন্ড ঠান্ডা পানি এবং ভাইরাস আক্রান্ত জীবের যে কোনো দেহরসে ভাইরাস বাস করতে পারে ।
ভাইরাসের আয়তন (Size of Virus) : ভাইরাস অতিক্ষুদ্র জীবসত্তা, ইলেক্ট্রণ অণুবীক্ষণযন্ত্র ছাড়া এগুলো দেখা যায় না। ভাইরাসের গড় ব্যাস ৮-৩০০ ন্যানোমিটার (nm)। তবে কিছু ভাইরাস এর চেয়ে বড় হতে পারে। গবাদি পশুর ফুট অ্যান্ড মাউথ রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস সবচেয়ে ক্ষুদ্র ৮-১২ ন্যানোমিটার। ভ্যাকসিনিয়া ও ভিরিওলা ভাইরাসগুলো বেশ বড়, ২৮০-৩০০ ন্যানোমিটার পর্যন্ত হয়।)
১। আকৃতি অনুযায়ী (According to shape)
(i) দণ্ডাকার : এদের আকার অনেকটা দণ্ডের মতো।
উদাহরণ- টোবাকো মোজাইক ভাইরাস (TMV), আলফা-আলফা মোজাইক ভাইরাস, মাম্পস ভাইরাস।
(ii) গোলাকার : এদের আকার অনেকটা গোলাকার।
উদাহরণ-পোলিও ভাইরাস, TIV, HIV, ডেঙ্গু ভাইরাস।
(iii) ঘনক্ষেত্রাকার/বহুভুজাকার : এসব ভাইরাস দেখতে অনেকটা পাউরুটির মতো। যেমন- হার্পিস, ভ্যাকসিনিয়া ভাইরাস।
(iv) ব্যাঙ্গাচি আকার : এরা মাথা ও লেজ- এ দুই অংশে বিভক্ত।
উদাহরণ- T2 , T4, T6 ইত্যাদি।
(v) সিলিন্ড্রিক্যাল/সূত্রাকার : এদের আকার লম্বা সিলিন্ডারের মতো। যেমন- Ebola virus ও মটরের স্ট্রিক ভাইরাস।
(vi) ডিম্বাকার : এরা অনেকটা ডিম্বাকার। উদাহরণ- ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস।
২। নিউক্লিক অ্যাসিডের ধরন অনুযায়ী (According to the types of nucleic acid)
(i) DNA ভাইরাস : যে ভাইরাসে নিউক্লিক অ্যাসিড হিসেবে DNA থাকে তাদেরকে DNA ভাইরাস বলা হয়।
উদাহরণ- T 2 ভাইরাস, ভ্যাকসিনিয়া, ভ্যারিওলা, TIV (Tipula Iridiscent Virus), এডিনোহার্পিস সিমপ্লেক্স ইত্যাদি ভাইরাস।
(ii) RNA ভাইরাস : যে ভাইরাসে নিউক্লিক অ্যাসিড হিসেবে RNA থাকে তাদেরকে RNA ভাইরাস বলা হয়।
উদাহরণ- TMV, HIV, ডেঙ্গু, পোলিও, মাম্পস, র্যাবিস ইত্যাদি ভাইরাস।
৩। বহিস্থ আবরণ অনুযায়ী (According to the external covering)
(i) বহিস্থ আবরণহীন ভাইরাস;
যেমন- TMV, T 2 ভাইরাস।
(ii) বহিস্থ আবরণী ভাইরাস;
যেমন- ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, হার্পিস, HIV ভাইরাস।
৪। পোষকদেহ অনুসারে (According to the host body)
(i) উদ্ভিদ ভাইরাস : উদ্ভিদদেহে রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসকে উদ্ভিদ ভাইরাস বলে। যেমন- TMV, Bean Yellow Virus (BYV)। ব্যতিক্রম ফুলকপির মোজাইক ভাইরাস (DNA)।
(ii) প্রাণী ভাইরাস : প্রাণিদেহে রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসকে প্রাণী ভাইরাস বলে। যেমন—HIV, ভ্যাকসিনিয়া ভাইরাস।
(iii) ব্যাকটেরিওফাজ বা ফাজ ভাইরাস : ভাইরাস যখন ব্যাকটেরিয়ার উপর পরজীবী হয় এবং ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে তখন তাকে ব্যাকটেরিওফায বলে। যেমন: T 2 ,T4,T6 ব্যাকটেরিওফায।
(iv) সায়ানোফাজ : সায়ানোব্যাকটেরিয়া (নীলাভ সবুজ শৈবাল) ধ্বংসকারী ভাইরাসকে সায়ানোফায বলে। যেমন-P1LPP 1 P2LPP2 , (Lyngbya, Plectonema ও Phormidium নামক সায়ানোব্যাকটেরিয়ার প্রথম অক্ষর দিয়ে নামকরণ করা হয়েছে।)
৫। পোষক দেহে সংক্রমণ ও বংশবৃদ্ধির উপর ভিত্তি করে (Based on infection and reproduction in the host body) সাধারণ ভাইরাস ও রিট্রোভাইরাস।এখানে ভাইরাল RNA থেকে DNA তৈরি হয়।
৬। অন্যান্য ধরন (Other types)
যে সব ভাইরাস ছত্রাককে আক্রমণ করে থাকে তাদের মাইকোফাজ (Mycophage) বলে।
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে Holmes ব্যাকটেরিয়া আক্রমণকারী ভাইরাসকে Phaginae, উদ্ভিদ আক্রমণকারী ভাইরাসকে Phytophaginae এবং প্রাণী আক্রমণকারী ভাইরাসকে Zoophaginae নামকরণ করেন।
পরজীবীতাঃ পরজীবী হিসেবে বেঁচে থাকার চরিত্রকে পরজীবিতা বলে। ভাইরাস বাধ্যতামূলক পরজীবী (obligate parasite)। এটি একটি আদি বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ ভাইরাস তার বংশবৃদ্ধি তথা জীবনের লক্ষণ প্রকাশ করার জন্য সম্পূর্ণভাবে অন্য জীবের সজীব কোষের ওপর নির্ভরশীল। অন্য কোনো জীবের (মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদ, ব্যাকটেরিয়া, শৈবাল ইত্যাদি) সজীব কোষ ছাড়া কোনো ভাইরাসই জীবের লক্ষণ প্রকাশ করতে পারে না, বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। কোনো আবাদ মাধ্যমে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি করা বিজ্ঞানীদের পক্ষেও আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
ভাইরাসের পরজীবিতা সাধারণত সুনির্দিষ্ট অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট প্রকারের ভাইরাস কোনো সুনির্দিষ্ট জীবদেহে পরজীবী হয় । যে সব ভাইরাস আদি কোষকে আক্রমণ করে, আর যে সব ভাইরাস প্রকৃত কোষকে আক্রমণ করে তারা ভিন্ন প্রকৃতির। প্রকৃতপক্ষে কোনো ভাইরাসের প্রোটিন আবরণটিই নির্ণয় করে তার আক্রমণের সুনির্দিষ্টতা (specificity)। পোষক কোষে কোনো ভাইরাস- প্রোটিনের জন্য রিসেপ্টর সাইট (receptor site) থাকলে তবেই ঐ ভাইরাস ঐ পোষক কোষকে আক্রমণ করতে পারবে। এ জন্যই ঠাণ্ডা লাগার ভাইরাস (cold virus) শ্বাসতন্ত্রের মিউকাস মেমব্রেন কোষকে আক্রমণ করতে পারে, চিকেন পক্স ভাইরাস ত্বক কোষকে আক্রমণ করতে পারে, পোলিও ভাইরাস ঊর্ধ্বতন শ্বাসনালী ও অন্ত্রের আবরণ কোষ, কখনো স্নায়ু কোষকে আক্রমণ করতে পারে। চিকেন পক্স ভাইরাস শ্বাসনালীকে আক্রমণ করতে পারবে না। কারণ শ্বাসনালী কোষে এর জন্য কোনো রিসেপ্টর সাইট নেই, ঠাণ্ডা লাগার ভাইরাস ত্বক কোষকে আক্রমণ করতে পারবে না, কারণ ত্বক কোষে এই ভাইরাসের জন্য কোনো রিসেপ্টর সাইট নেই।
ফাজ ভাইরাস কেবল ব্যাকটেরিয়া কোষকেই আক্রমণ করে। ফাজ ভাইরাসের মধ্যে T2-ব্যাকটেরিওফাজ E. coli ব্যাকটেরিয়াকেই আক্রমণ করে। TMV ভাইরাস কেবল তামাক গাছকেই আক্রমণ করে। এমনই ভাবে সুনির্দিষ্ট ভাইরাস নির্দিষ্ট প্রকার পোষক কোষকেই আক্রমণ করে থাকে।
ইমার্জিং ভাইরাস (Emerging virus):
যেসব ভাইরাস প্রথমে এক ধরনের পোষকে রোগ সৃষ্টি করে, কিন্তু পরবর্তীতে নতুন পোষকে রোগ সৃষ্টি করার সক্ষমতা অর্জন করে এবং রোগ সৃষ্টি করে- তাদের ইমার্জিং ভাইরাস বলে।
যেমন- করোনা ভাইরাস (SARS-COV-2) এটা প্রথমে শুধু বানরেই রোগ সৃষ্টি করতো । পরবর্তীতে বিবর্তিত হয়ে মানুষে রোগ সৃষ্টি করছে।
ভিরিয়ন (Virion) :
নিউক্লিক অ্যাসিড ও একে ঘিরে অবস্থিত ক্যাপসিড সমন্বয়ে গঠিত এক একটি সংক্রমণ ক্ষমতাসম্পন্ন সম্পূর্ণ ভাইরাস কণাকে ভিরিয়ন বলে। সংক্রমণ ক্ষমতাবিহীন ভাইরাসকে বলা হয় নিউক্লিয়োক্যাপসিড। প্রতিটি ভিরিয়নে সর্বোচ্চ ২০০০ হতে ২১৩০টি ক্যাপসোমিয়ার থাকে।
ভিরয়েডস (Viroids):
ভিরয়েডস হলো সংক্রামক RNA। Theodore Diener (US এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্ট) এবং W.S. Rayner ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ভিরয়েডস আবিষ্কার করেন। ভিরয়েডস হলো এক সূত্ৰক বৃত্তাকার RNA অণু যা কয়েক শত নিউক্লিয়োটাইড নিয়ে গঠিত এবং ক্ষুদ্রতম ভাইরাস থেকেও বহুগুণে ক্ষুদ্র। কেবলমাত্র উদ্ভিদেই ভিরয়েডস পাওয়া যায়। এরা উদ্ভিদ থেকে উদ্ভিদে এবং মাতৃ উদ্ভিদ থেকে সন্তান সন্ততিতে স্থানান্তরিত হয়ে থাকে। উদ্ভিদ পোষকের এনজাইম ব্যবহার করে এরা সংখ্যাবৃদ্ধি করে। বিজ্ঞানীগণ এখন ধারণা করছেন হেপাটাইটিস-ডি এর কারণ ভিরয়েডস। ভিরয়েড নারিকেল গাছে ক্যাডাং রোগ তৈরি করে।
প্রিয়নস (Prions):
সংক্রামক প্রোটিন ফাইব্রিল হলো প্রিয়নস। এটি নিউক্লিক অ্যাসিডবিহীন প্রোটিন আবরণ মানুষের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের Kuru এবং Creutzfeldt রোগ; ভেড়া ও ছাগলের Scrapie রোগ প্রিয়নস দিয়ে হয়ে থাকে। বহুল আলোচিত ‘ম্যাড কাউ’ রোগ সৃষ্টির সাথে প্রিয়নস-এর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। ১৯৮২ সালে প্রথম Stanley B, Prusiner অতি ক্ষুদ্র প্রকৃতির প্রিয়নস এর অস্তিত্বের কথা বলেন এবং ভেড়ার স্ক্র্যাপি (Scrapie) রোগে প্রথম পর্যবেক্ষণ (study) করা হয়। এজন্য তাকে ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।