সমাণুতা

সমাণুতা হলো জৈব যৌগের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। যে সকল জৈব যৌগের আণবিক সংকেত এক কিন্তু গাঠনিক সংকেত ভিন্ন তাদেরকে পরস্পরের সমাণু বলা হয়। গাঠনিক সংকেতের এই ভিন্নতার কারণে এদের ভৌত ও রাসয়নিক ধর্মেও দুই-একটি পার্থক্য দেখা যায়। জৈব যৌগের এরূপ ধর্মকে বলা হয় সমাণুতা।

সমাণুতার শ্রেণিবিভাগ

সমাণুতাকে প্রধাণত দুইটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। যেমন,

► গাঠনিক সমাণুতা
► স্টেরিও বা ত্রিমাত্রিক সমাণুতা

গাঠনিক সমাণুতা

একটি যৌগের অণুতে বিদ্যমান পরমাণুসমূহের অবস্থানের ভিন্নতার কারণে যে সমাণুতার সৃষ্টি হয় তাকে গাঠনিক সমাণুতা বলে। গাঠনিক সমাণুতা ৫ প্রকার। যেমন,

⇒ শিকল বা চেইন সমাণুতা
⇒ কার্যকরী মূলক সমাণুতা
⇒ অবস্থান সমাণুতা
⇒ টটোমারিজম
⇒ মেটামারিজম

স্টেরিও বা ত্রিমাত্রিক সমাণুতা

সাধারণত একটি অণুর মধ্যে অবস্থিত পরমাণু বা গ্রুপ সমূহের একটি নিদৃষ্ট ত্রিমাত্রিক বিন্যাসকে কনফিগারেশন বলে। এই কনফিগারেশনের ভিন্নতার কারণে ত্রিমাত্রিক বা স্টেরিও সমাণুতার সৃষ্টি হয়। গ্রিক স্টেরিও শব্দের অর্থ হলো ‘ত্রিমাত্রিক স্থান’। স্টেরিও সমাণুতা দুই প্রকার,

⇒ জ্যামিতিক বা সিস-ট্রান্স সমাণুতা
⇒ আলোক সমাণুতা বা প্রতিবিম্ব সমাণুতা

নিজেকে যাচাই করার জন্য উত্তর দিয়ে দাও নিচের প্রশ্নগুলোর-
 

(1) সমাণুতাকে প্রধাণত কয়টি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়?

(2) গাঠনিক সমাণুতাকে  কয় ভাগে ভাগ  করা যায়?

(3) স্টেরিও সমাণুতার অপর নাম কী?

(4) একটি অণুর মধ্যে অবস্থিত পরমাণু বা গ্রুপ সমূহের একটি নির্দিষ্ট ত্রিমাত্রিক বিন্যাসকে কী বলে?

5)  গ্রিক স্টেরিও শব্দের অর্থ কী?

উত্তরঃ (1)দুইটি; (2)পাঁচ; (3)ত্রিমাত্রিক সমাণুতা; (4)কনফিগারেশন; (5)ত্রিমাত্রিক স্থান

শিকল বা চেইন সমাণুতা

এই সমাণুগুলো একই আণবিক সংকেতযুক্ত এবং একই সমগোত্রীয় শ্রেণির হয়ে থাকে। এদের সমাণুর কার্বন কাঠামো শাখাবিহীন এবং শাখাযুক্ত হয় এবং এর ফলে এদের ধর্মেও পার্থক্য দেখা যায়। যেমন, বিউটেন এবং 2-মিথাইল প্রোপেন উভয়েরই আণবিক সংকেত হলো C₄H₁₀ কিন্তু এদের কার্বন শিকলের গঠন ভিন্ন।

কার্যকরী মূলক সমাণুতা

যে সকল যৌগের আণবিক সংকেত এক কিন্তু তাদের কার্যকরী মূলক ভিন্ন এবং এর ফলে এদের ভৌত ও রাসয়নিক ধর্মের পার্থক্য হয়ে থাকে, তাদেরকে কার্যকরী মূলক সমাণুতা বলে। যেমন, অ্যালকোহল ও ইথার পরস্পরের কার্যকরী মূলক সমাণু। ইথানল এবং ডাই মিথাইল ইথার উভয়েরই আণবিক সংকেত C₂H₆O কিন্তু ইথানলের কার্যকরী মূলক হচ্ছে -OH এবং ডাই মিথাইল ইথারের কার্যকরী মূলক হচ্ছে R-O-R। এখনে R হলো অ্যালকাইল মূলক।

অবস্থান সমাণুতা

একই আণবিক সংকেত বিশিষ্ট একাধিক যৌগের কার্বন শিকলে একই কার্যকরী মূলকের বিভিন্ন অবস্থানের কারণে অবস্থান সমাণুতার সৃষ্টি হয়। যেমন, C₃H₈O এই আণবিক সংকেত দিয়ে দুইটি অ্যালকোহল সম্ভব ⇒ প্রপানল-1 এবং প্রপানল-2

(কার্যকরী মূলক সমাণুতা এবং অবস্থান সমাণুতার মধ্যে একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে, তা হলো কার্যকরী মূলক সমাণুতে ভিন্ন কার্যকরী মূলক গঠিত হয়, কিন্তু অবস্থান সমাণুতায় একই কার্যকরী মূলকের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন যায়গায় হয়।)


টটোমারিজম

এই সমাণুতাটি একটু অন্যরকম। এক বিশেষ ধরণের গতিশীল কার্যকরী মূলক সমাণুতার নাম টটোমারিজম। এই প্রক্রিয়ায় সমাণুগুলোতে একটি কার্যকরী মূলক কাঠামো থেকে স্বতংস্ফূর্তভাবে ভিন্ন কার্যকরী মূলক কাঠামোতে রুপান্তরিত হয় এবং উভয় কাঠামোতে গতিশীল সাম্যবস্থা বিরাজ করে। যেমন,

প্রপানোন এর কার্যকরী মূলক হচ্ছে ‘কিটোনীয় মূলক’। প্রপানোন থেকে স্বতংস্ফূর্তভাবে প্রপিন -2-অল তৈরী হয়, অর্থাৎ কিটোন মূলক থেকে ইন ও অল মূলকে রুপান্তরিত হয়। তাই প্রপানোন এবং প্রপিন-2-অল পরস্পরের টটোমার এবং এই দুই কাঠামোর মধ্যে সাম্যবস্থা বজায় থাকে।

 

 

 

মেটামারিজম

উপরের উদহারণ দেখে সহজেই মেটামারিজম ব্যাপারটি বোঝা যাচ্ছে। পেন্টান – 2 – ওন এর বাম পাশে একটি এবং ডান পাশে তিনটি কার্বন রয়েছে।  অপরদিকে পেন্টান – 3 – ওন এর বাম পাশে দুইটি এবং ডান পাশে দুইটি কার্বন আছে।

সব কার্যকরী মূলকের ক্ষেত্রে মেটামারিজম হয় না। দ্বিযোজী কার্যকরী মূলক যেমন, ইথার, কিটোন, সেকেন্ডারী অ্যামিন এসবের ক্ষেত্রে মেটামারিজম ঘটে। একই সমগোত্রীয় শ্রেণির মধ্যে অবস্থিত দ্বিযোজী কার্যকরী মূলকের উভয় পার্শ্বে কার্বন পরমাণু সংখ্যার ভিন্নতার কারণে যে সমাণুতার সৃষ্টি হয় তাকে মেটামারিজম বলে। 

জ্যামিতিক বা সিস-ট্রান্স সমাণুতা

কোন অণুর মাঝে উপস্থিত বন্ধন যদি মুক্তভাবে ঘুরতে না পারে সেক্ষেত্রে একই আণবিক সংকেত এবং একই গাঠনিক সংকেত বিশিষ্ট দুইটি কনফিগারেশন সৃষ্টি হয়। এদেরকে পরস্পরের জ্যামিতিক সমাণু এবং এই বিষয়কে জ্যামিতিক সমাণুতা বলা হয়।

জ্যামিতিক বা সিস-ট্রান্স সমাণুতা


উপরে একটি পেঁচা দেখা যাচ্ছে, যে নিজের ইচ্ছা মতো তার মুখ ঘুরাতে পারে। মুখটিকে একটি একক বন্ধন ধরলে আমরা বলতে পারি এখানে তা মুক্তভাবে ঘুরতে পারছে। এরজন্য আমরা মুখটির কোন নিদৃষ্ট দিক পাচ্ছি না। এখন মুখটিকে আমরা যদি একটি লাঠির (এখানে লাঠিটি আরেকটি বন্ধন হিসেবে কাজ করে) সাথে বেঁধে দেই তাহলে মুখটি আর মুক্তভাবে ঘুরতে পারবে না এবং সেটি স্থির হয়ে যাবে। এর ফলে আমরা পেঁচাটির দুইটি দিক পাব, একটি মুখের সামনের দিক এবং অন্যটি মুখের পেছনের দিক। অর্থাৎ এখানে মুখের দুইটি কনফিগারেশন তৈরী হয়েছে এবং এদেরকে পরস্পরের জ্যামিতিক সমাণু বলা হয়। সুতরাং এই পুরো ব্যাপারটি দেখে আমরা বলতে পারি যে, জ্যামিতিক সমাণুতা সবার জন্য অণুতে দ্বিবন্ধন থাকতে হবে।

জ্যামিতিক সমাণুতার ব্যাখ্যা

জ্যামিতিক সমাণুতা হতে হলে অণুতে দ্বিবন্ধন থাকতে হবে। আর আমরাজানি দ্বিবন্ধন মানে হলো কার্বন পরমাণুটি SP² সংকরিত। অর্থাৎ কার্বনের একটি অরবিটাল অসংকরিত অবস্থায় থাকবে। অ্যালকিন (কার্বন-কার্বন দ্বিবন্ধন যুক্ত অণু) অণুর গঠন ব্যাখ্যা করা যাক।

C=C দ্বিবন্ধনে আবদ্ধ উভয় কার্বন পরমাণুই SP² সংকরিত এবং এরা একই সমতলে 2s, 2px, 2py সংকর অরবিটাল গঠন করে। একটি কার্বন পরমাণু তিনটি SP² সংকরিত অরবিটাল গঠন করে।

প্রত্যেকে তাদের একটি করে SP² সংকরিত অরবিটাল অধিক্রমণের মাধ্যমে নিজেদের মাঝে একটি সিগমা বন্ধন তৈরি করে। প্রতিটি কার্বন পরমাণুর অপর দুইটি SP² সংকরিত অরবিটাল অন্য কোন মূলক (a, b, c, d) এর সাথে সিগমা বন্ধন তৈরি করে। এর সবাই একই সমতলে থাকে (চিত্রের নীল রঙের অংশটি)। দুইটি কার্বন পরমাণুর ক্ষেত্রেই একটি করে 2pz অরবিটাল অসংকরিত অবস্থায় থাকে। এই দুইটি অসংকরিত 2pz অরবিটাল ওই সমতলের উপর লম্বভাবে (লাল রঙের অংশটি) অবস্থান করে এবং নিজেদের মাঝে পাশাপাশি অধিক্রমণের মাধ্যমে পাই বন্ধন তৈরি করে যা সমতলটির উপরে এবং নিচে অবস্থান করে (কমলা রঙের অংশটি)। এর ফলে উভয় কার্বন পরমাণুই দ্বিবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং এরা নিজেদের অক্ষ বরাবর আর ঘুরতে পারে না। সহজভাবে বলতে গেলে লাঠিটি যেমন পেঁচাটির মুখকে স্থির করে ফেলেছিল এর ফলে সেটি আর তার মুখ নিজের ইচ্ছা মতো ঘুরাতে পারেনি। এই দিবন্ধনযুক্ত কার্বন পরমাণুদ্বয়ের সাথে বিভিন্ন মূলক যুক্ত হয়ে দুইটি কনফিগারেশন তৈরী করে। যেমন,

► সিস সমাণু
► ট্রান্স সমাণু

সিস সমাণু

কার্বন-কার্বন দ্বিবন্ধনের সাথে যুক্ত মূলকগুলোর মাঝে যদি দুইটি সদৃশ পরমাণু বা মূলক দ্বিবন্ধন যুক্ত কার্বনের একই দিকে অবস্থান করে তখন সেই সমাণুকে সিস সমাণু বলে।

ট্রান্স সমাণু

কার্বন-কার্বন দ্বিবন্ধনের সাথে যুক্ত মূলকগুলোর মাঝে যদি দুইটি সদৃশ পরমাণু বা মূলক দ্বিবন্ধন যুক্ত কার্বনের বিপরীত দিকে অবস্থান করে তখন সেই সমাণুকে ট্রান্স সমাণু বলে।

জ্যামিতিক সমাণুতার শর্ত

জ্যামিতিক সমাণুতার দুইটি শর্ত রয়েছে,

(১) জ্যামিতিক সমাণু হতে হলে অণুতে বন্ধনের মুক্তভাবে ঘূর্ণন বন্ধ করতে হবে। দেখা যায় যে, দুই ধরণের কাঠামোতে বন্ধনের মুক্ত ঘূর্ণন সম্ভব নয়, তা হলো-

► দ্বিবন্ধনযুক্ত যৌগ
► চাক্রিক যৌগ

উপরের চিত্রে যে যৌগটি রয়েছে তাতে বন্ধনের মুক্ত আবর্তন হচ্ছে। সুতরাং এইক্ষেত্রে জ্যামিতিক সমাণুতা সম্ভব নয়।

(২) দ্বিবন্ধনযুক্ত কার্বনের সাথে অন্য যে মূলকগুলো যুক্ত থাকে তারা পরস্পর থেকে ভিন্ন হতে হবে। অর্থাৎ a, b, c, d চারটি মূলকই এক হতে পারবে না।


দ্বিবন্ধনযুক্ত যৌগ

আসো কিছু উদহারণের মাধ্যমে দ্বিবন্ধনযুক্ত যৌগের জ্যামিতিক কাঠামো দেখে নিয়া যাক,

 

 

চাক্রিক যৌগ

সাধারণত একটি মুক্ত শিকলের দুই প্রান্ত যুক্ত হয়ে চাক্রিক যৌগ গঠন করে। চাক্রিক যৌগের ক্ষেত্রে বন্ধনের মুক্ত আবর্তন সম্ভব নয়, সুতরাং এটিও জ্যামিতিক সমাণুতা দেখাতে পারবে। চাক্রিক যৌগের ত্রিমাত্রিক কাঠামোতে যখন সদৃশ মূলকগুলো একই দিকে থাকে তখন তা হলো সিস সমাণু  এবং যখন বিপরীত দিকে থাকে তখন তা হলো ট্রান্স সমাণু।

এখানে তিনটি কার্বন বদ্ধ অবস্থায় আছে তাই এটা হবে সাইক্লোপ্রপেন। যেহেতু 1 নাম্বার এবং 2 নাম্বার কার্বনে দুইটি মিথাইল (-CH₃) মূলক আছে তাই ডাইমিথাইল হয়ছে। যখন মিথাইল দুইটি একই দিকে অবস্থিত তখন নামকরণে সিস হয়েছে এবং যখন মিথাইল মূলক দুইটি বিপরীত দিকে অবস্থিত তখন নামকরণে ট্রান্স হয়েছে।

Promotion