১। সরকারি সহায়তা (Government Assistance): ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্প স্থাপনে সরকারিভাবে যে সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়ে থাকে তাকে সরকারি সাহায্য-সহায়তা বলে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে সরকারি উৎসসমূহ শিল্পোদ্যোগ সহায়তার মূল উৎস হিসেবে পরিগণিত। কারণ দ্রুত শিল্পায়ন সরকারের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসূচির একটি অন্যতম ক্ষেত্র । সরকার দ্রুত শিল্পায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন যেমন- শিল্প ও বিনিয়োগ নীতি, রাজস্ব নীতি, রপ্তানি নীতি, বিভিন্ন অবকাঠামোগত সুবিধাদানের নীতি ইত্যাদি । নিম্নে সরকারি সহায়তার উল্লেখযোগ্য দিকগুলো সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো:
(ক) শিল্পনীতি: সরকার দ্রুত শিল্প স্থাপনের লক্ষ্যে নতুন নতুন উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার জন্য শিল্প ও বিনিয়োগ নীতি ঘোষণার মাধ্যমে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার দিক নির্দেশ করে থাকে। শিল্পায়নের গতিধারাকে অব্যাহত রাখার জন্য অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সময় সময় শিল্পনীতির সংশোধন ও পরিবর্তন করে যুগোপযোগী করা হয় । একটি সুষ্ঠু শিল্পনীতি উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট ও উদ্বুদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে ।
(খ) রাজস্ব সুবিধা: ব্যবসায়-বাণিজ্যে সহায়তার জন্য সরকার বিভিন্ন রাজস্ব সুবিধা দিয়ে থাকে । এগুলো সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো
(i) কর অবকাশ: উন্নত, স্বল্পোন্নত এবং অনুন্নত এলাকায় শিল্প স্থাপন করা হলে যথাক্রমে পাঁচ বছর, সাত বছর এবং নয় বছরের কর অবকাশ থাকে । এরূপ অবকাশ উৎপাদন শুরুর মাস থেকে গণনা করা হয় । এছাড়া মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি পশুর খামারে দশ বছরের কর অবকাশ দেওয়া হয় ।
(ii) বর্ধিত হারে অবচয় ধার্যের সুযোগ: নতুন মেশিনারি ও প্ল্যান্টের বেলায় প্রথম বছর শতকরা ৮০ ভাগ দ্বিতীয় বছর শতকরা ২০ ভাগ অবচয় ধার্য করার সুযোগ রয়েছে ।
(iii) বিনিয়োগ ভাতাঃ কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানের মেশিনারী ও প্ল্যান্টের প্রকৃত মূল্যের শতকরা ২০-২৫ ভাগ বিনিয়োগ ভাতা দেওয়া হয় ।
(গ) শিল্পের অর্থসংস্থান: সরকার দেশীয় উদ্যোক্তাদের শিল্পায়নে আকৃষ্ট করার জন্য প্রতিষ্ঠানগত ব্যবস্থা ও বিভিন্ন ঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে দেশীয় ও বৈদেশিক মুদ্রার পুঁজি সংগ্রহের ব্যবস্থা নিয়েছে।
(ঘ) শিল্পায়নে সাহায্যকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ: কোনো একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন সাফল্যজনকভাবে পরিচালনার জন্য শিল্পোদ্যোক্তাদের নানাবিধ সাহায্যের প্রয়োজন হয়। শিল্পোদ্যোক্তাদের সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান শিল্পোদ্যোক্তাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহায়তা প্রদান করে আসছে। নিম্নে শিল্পায়নে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যাবলি অতি সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
১। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (BSCIC): বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্পকে উন্নত ও সাহায্য করার জন্য ১৯৫৭ সালে সরকারি উদ্যোগে এ সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক) দেশে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উন্নয়ন ও বিকাশে নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠান। এ সংস্থার প্রধান কাজ হলো এ শিল্প খাতের উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগের পূর্বে পরামর্শ দান । এ সংস্থার অন্য কার্যগুলো নিম্নরূপ :
(i) শিল্পসংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ
(ii) উদ্যোক্তা শনাক্তকরণ
(iii) সাহায্যমূলক সেবা
(iv) শিল্পোদ্যোগ উন্নয়ন,
(v) প্রকল্প নির্বাচন,
(vi) প্রকল্প মূল্যায়ন
(vii) সম্ভাব্যতা পরীক্ষা
(viii) ঋণ ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধান
(ix) অবকাঠামোগত উন্নয়ন
(x) ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতা উন্নয়ন
(xi) পণ্য ডিজাইন
(xii) কাঁচামাল সরবরাহে সাহায্য
(xiii) উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রীর বিপণনে সহায়তা
(xiv) গবেষণা ও উন্নয়ন
(xv) পণ্যের বাজার সমীক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রবিশেষে এ সংস্থা বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের সাথে যৌথ উদ্যোগে প্রয়োজনীয় ঋণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। শিল্পোদ্যোক্তাদের কাছে সংস্থার সাহায্যসমূহ পৌঁছে দেওয়ার জন্য সংস্থা দেশের বিভিন্ন স্থানে শাখা স্থাপন করেছে ।
২। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (BSB ): ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির নির্দেশে এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় । এর অনুমোদিত মূলধন ২০০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ১৩২ কোটি টাকা । বাংলাদেশকে দ্রুত শিল্পায়িত করার উদ্দেশ্যে নতুন শিল্প প্রকল্প স্থাপন এবং চালু শিল্প প্রকল্পগুলোর সুষমকরণ, আধুনিকীকরণ, যন্ত্রপাতি পরিবর্তন এবং সম্প্রসারণের জন্য শিল্প উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদান ও পরামর্শ দেওয়া শিল্প ব্যাংকের প্রধান কাজ ।
বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক দেশীয় ও বৈদেশিক মুদ্রায় দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করে এবং ব্যাংকের সাহায্যপ্রাপ্ত শিল্পসমূহের উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য সীমিত পরিমাণে স্বল্পমেয়াদি চলতি মূলধন সরবরাহ করে । এছাড়া সীমিত পরিমাণে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিসমূহের শেয়ার সরাসরি ক্রয়ের মাধ্যমে ইকুইটি সমর্থন দান, পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিগুলোর শেয়ার জনসাধারণের কাছে বিক্রয়ের জন্য অবলিখন (Underwriting) এবং এ ধরনের কোম্পানিগুলোর জন্য স্বল্পমেয়াদি সম্পূরক অর্থ জোগানের ব্যবস্থা করে । ব্যাংক বিনিয়োগকারীগণ কর্তৃক অন্যান্য সূত্র থেকে সংগৃহীত ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তা প্রদান করে এবং প্রকল্প নির্বাচনে, বাস্তবায়নে ও পরিচালনায় বিনিয়োগকারীকে বিনামূল্যে কারিগরি পরামর্শ ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করে।
৩। বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা (BSRS) : শিল্পক্ষেত্রে ঋণদানের সুযোগ সৃষ্টি, শিল্প সম্পর্কিত সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির আদেশে বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থার কাজ হচ্ছে ঋণ আদায়ের সামগ্রিক অবস্থা তথা ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধ কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে সংস্থার প্রয়োজনীয় সামর্থ্য ও যোগ্যতা বৃদ্ধিকল্পে বিশেষজ্ঞমূলক ভূমিকার উন্নয়ন। সংস্থার নিজস্ব পোর্টফলিওভুক্ত শিল্প প্রকল্পগুলোর সুষমকরণ ও আধুনিকীকরণ, প্রতিস্থাপন ও সম্প্রসারণের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান । বিনিয়োগে উৎসাহিতকরণ, অনুন্নত এলাকায় শিল্প স্থাপনে উৎসাহিত করা। শিল্পায়ন, গবেষণা ও শিল্প সম্পর্কিত পরামর্শ দান ।
৪ । ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (ICB): এটি বাংলাদেশের একমাত্র বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান । ১৯৭৬ সালের পহেলো অক্টোবর বিনিয়োগ ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদান, বিনিয়োগের সম্প্রসারণ, পুঁজিবাজার উন্নয়নে সাহায্য প্রদান, সঞ্চয়কে অর্থকরী কাজে লাগানো ইত্যাদি উদ্দেশ্য নিয়ে এ কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয় ।
প্রতিষ্ঠার সময় হতেই আইসিবি সাধারণ সীমিত কোম্পানির বৈশিষ্ট্য অধিকারী প্রকল্পসমূহে অর্থনৈতিক সাহায্য প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রকল্পের যৌক্তিকতা যাচাই ও বিনিয়োগের বিভিন্ন দিক নির্ধারণের প্রেক্ষিতে অবলিখন ও ঋণপত্র (Debenture) ঋণের যাচাইয়ে সহায়তা করে আসছে। আইসিবি-এর কার্যাবলি সম্পাদনের সময় বাণিজ্যিক দিক ছাড়াও পুঁজিবাজার, বিনিয়োগকারী ও জনসাধারণের দিক বিবেচনা করে থাকে । বিনিয়োগ ঝুঁকি দূর করার জন্য আইসিবির নেতৃত্বে সাধারণ বিমা কর্পোরেশন, বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা, বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহের সমন্বয়ে একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করা হয়েছে ।
৫। বাণিজ্যিক ব্যাংক (Commercial Bank) শিল্প ও ব্যবসায়ে উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা করার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশের ৪টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক যথা- সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক দেশব্যাপী শাখা বিস্তারের মাধ্যমে সর্বস্তরের শিল্পোদ্যোক্তাদের ব্যাংকিং সেবা প্রদান করে আসছে। তাছাড়া ব্যাংকিং সেবাকে আরও ব্যাপকতর করার লক্ষ্যে বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব ব্যাংক শিল্পোদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি পুঁজিও সরবরাহ করছে। একজন শিল্পোদ্যোক্তা মূলধন ছাড়াও ব্যাংক থেকে শিল্প স্থাপন সংক্রান্ত বিনিয়োগ-পূর্ব পরামর্শ, পণ্য নির্বাচন এবং বাজারজাতকরণ প্রভৃতি বিষয়ে পরামর্শ পেতে পারে ।
৬। আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রক (CIE): শিল্প স্থাপন ও পরিচালনা করতে একজন উদ্যোক্তাকে মেশিনারী, কাঁচামাল এবং খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হয়। রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোকে উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করার পূর্বে সরকারি অনুমোদন নিতে হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রক বিদেশ থেকে দ্রব্যসামগ্রী আমদানি করার লাইসেন্স এবং রপ্তানিকারককে রপ্তানি নিবন্ধন সার্টিফিকেট ইস্যু করে থাকে ।
৭। বাংলাদেশ হস্তচালিত তাঁতশিল্প দ্রব্য রপ্তানি কর্পোরেশন (BHPECO): এ কর্পোরেশনের প্রধান লক্ষ্য হস্তচালিত তাঁতশিল্প দ্রব্যসমূহের রপ্তানি বৃদ্ধি করা। বাংলাদেশের তাঁত ও কুটির শিল্পের পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বৃদ্ধির জন্য এ কর্পোরেশন আন্তর্জাতিক মেলা ও প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে থাকে । সংস্থা নিজস্ব উদ্যোগে তাঁত শিল্প দ্রব্য রপ্তানি করে থাকে ।
৮। বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সাহায্য সংস্থা (BITAC): দেশের শিল্পায়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ কেন্দ্রের প্রধান কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে কারিগরি ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান, নতুন ডিজাইন ও যন্ত্রপাতির সাথে পরিচিত করা, যন্ত্রপাতি স্থাপনে উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে উপদেশ প্রদান, বিভিন্ন প্রকাশনা, সেমিনার, গ্রুপ আলোচনা, প্রদর্শনী, চলচ্চিত্র ইত্যাদির মাধ্যমে আধুনিক কারিগরি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান দান ইত্যাদি ।
৯। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (BCSIR) : এ পরিষদ শিল্প ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের আবিষ্কার ও উদ্ভাবন, বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণার দিক নির্দেশ, নতুন পণ্য ও প্রক্রিয়া উদ্ভাবন ও পরিষদের বিভিন্ন আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের বাস্তব প্রয়োগের ব্যবস্থা করে থাকে। এছাড়া এটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের গবেষণা সেল স্থাপনে উৎসাহিত করে। দেশীয় প্রযুক্তি বা প্রক্রিয়া উন্নয়ন এবং শিল্প ক্ষেত্রে তার প্রয়োগের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করাও পরিষদের অন্যতম কাজ। একজন শিল্পোদ্যোক্তা এ পরিষদের আবিষ্কৃত পণ্য বা প্রক্রিয়া বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যবহার করে উৎপাদন ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে ।
১০। ইন্ডাট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট লিজিং কোম্পানি অব বাংলাদেশ লি: (আইডিএলসি): দেশের শিল্প ও ব্যবসায়ের উন্নয়নের জন্য লিজিং কোম্পানির ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ । আইডিএলসি ইজারা চুক্তির ভিত্তিতে মেশিনারি ও অফিস ইকুইপমেন্ট প্রভৃতি সরবরাহের মাধ্যমে শিল্পোন্নয়নে সাহায্য করছে ।
১১। শিল্প ও বণিক সমিতি: শিল্প, ব্যবসায়, বাণিজ্যের উন্নয়নে ও প্রসারের ক্ষেত্রে ব্যবসায় শিল্প ও বণিক সমিতির ভূমিকা অপরিসীম। বিভিন্ন সমিতি তাদের ব্যবসায় সংক্রান্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের ব্যবস্থা করে । ব্যবসায় সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, ফ্যাসিলিটিজ সেন্টার স্থাপন, সদস্যদের স্বার্থ সংরক্ষণ প্রভৃতি এ সমিতির কাজ। এসব সমিতির মধ্যে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই), মেট্রোপলিটন চেম্বারস অব কমার্স (এমসিসি), ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিসিসিআই) ন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব স্মল অ্যান্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশ (নাসিব) প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।
১২। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব): এ দুটি ব্যাংক কৃষির সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য ঋণ প্রদান ছাড়াও কৃষিভিত্তিক ও কুটির শিল্পসমূহকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে । সারা দেশে এদের অনেক শাখা রয়েছে ।
১৩। এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো (ইপিবি): বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ইপিবি শিল্পোদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানির জন্য বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করে। এসব সাহায্যের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশি পণ্যের প্রচার, বিদেশি আমদানিকারকের সাথে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকের যোগাযোগ স্থাপন, রপ্তানি লাইসেন্স প্রদান, অল্প সুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা, রপ্তানিকারকের বিদেশ সফরের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা প্রদান এবং এক্সপোর্ট গ্যারান্টি প্রদান ।
১৪ । ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি): এ করপোরেশন শিল্পোদ্যোক্তাদের কাঁচামাল সংগ্রহ ও উৎপাদিত পণ্য রপ্তানিতে সাহায্য করে । এছাড়া কাঁচামালের নতুন উৎসের সন্ধান ও উৎপাদিত পণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে ।
১৫। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (BSTI): এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য শিল্প প্রতিষ্ঠানে উন্নতমানের দ্রব্য উৎপাদনে সহায়তা করা যাতে দেশি ও বিদেশি বাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে । বাংলাদেশের উৎপাদিত দ্রব্য দেশি ও বিদেশি বাজারে প্রতিযোগিতার সামর্থ্য অর্জনের জন্য উৎপাদিত দ্রব্যের মাননিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কঠোরভাবে মেনে চলার জন্য এ সংস্থা ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে ।
১৬। বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি) ও রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন বোর্ড (আরইবি):
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত ।
১৭। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (বিআইএম): শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দক্ষ ব্যবস্থাপক সরবরাহের জন্য এ সংস্থা প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করে । এসব কোর্সে শিল্পোদ্যোক্তা নিজে বা তার ফার্মের ব্যবস্থাপকগণ অংশগ্রহণ করে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে পারে ।
অধিকন্তু শিল্প ও বাণিজ্য খাতের দক্ষ ব্যবস্থাপক ও কারিগরি জ্ঞানে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সরবরাহ করার লক্ষ্যে দেশের শিল্প ব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ, ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউট, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট, টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার, কমার্শিয়াল ইন্সটিটিউট সরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
২। বেসরকারি সহায়তা (Non Government Assistance): কোনো শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উৎসাহ বা সহায়তা বেসরকারি উৎস থেকেও পাওয়া যায় । বর্তমান শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তার চেয়ে বেসরকারি সাহায্য সংস্থা (এনজিও) উপদেষ্টা ফার্ম, ব্যবসায় বা বণিক সমিতি থেকে শিল্প সংক্রান্ত বিভিন্ন পরামর্শ ও অনুপ্রেরণা নিতে পারে। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অর্থসংস্থানের ক্ষেত্রে বেসরকারি উৎস উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। বেসরকারি সহায়তার উৎসকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে । যথা-
(ক) বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ঋণ: ব্যবসায়ের অর্থসংস্থানের একটি স্বীকৃত উপায় বা উৎস হিসেবে আমাদের সমাজে পূর্বকাল থেকেই বিবেচিত হয়ে আসছে, আত্মীয়স্বজনও বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করা।
(খ) বেসরকারি সাহায্য সংস্থা: বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সাহায্য সংস্থাগুলো উদ্যোক্তা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে । যেমন-গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, প্রশিকা, আশা প্রভৃতি সংস্থা আমাদের দেশে ক্ষুদ্র ব্যবসায় ও কুটির শিল্প স্থাপনে অর্থ ও পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে থাকে । এখানে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংস্থার কার্যক্রম বর্ণনা করা হলো :
১। গ্রামীণ ব্যাংক (Grameen Bank)
১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক নামকরণের মাধ্যমে একটি গবেষণা কাজ হাতে নেন । পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবে চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামে কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে তা বিরাট মহীরুহে পরিণত হয়েছে। ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পকে বিত্তহীনদের জন্য একটি বিশেষ ব্যাংকে রূপান্তরিত করা হয়। সাধারণত বিত্তহীনদের ৫ বা ১০ জনের একটি দলকে একত্র করে এ ব্যাংক কোনো বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে ঋণ দিয়ে থাকে । তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেবল একজনকে পৃথকভাবে ঋণ দেওয়া হয়ে থাকে । মাথাপিছু গড় ঋণ ২ থেকে ৩ হাজারের বেশি হয় না । ঋণের টাকা সদস্যগণ সম্মিলিতভাবে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে লাভজনক ব্যবসায় বা ক্ষুদ্র শিল্পে খাটাতে পারে । গ্রামীণ ব্যাংক ঋণ প্রদান ছাড়াও গ্রুপের সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদানেও উদ্বুদ্ধ করে ।
২। ব্র্যাক (Bangladesh Rural Advancement Committee)
ব্র্যাক সর্ববৃহৎ বেসরকারি সাহায্য সংস্থা। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কার্যক্রম হাতে নিয়ে সংস্থাটি স্থাপিত হয় । কিন্তু এরপর থেকে দারিদ্র দূরীকরণ ও দরিদ্র জনগণকে ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে এ সংস্থা বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে ।
উদ্যোক্তা উন্নয়নের লক্ষে ব্র্যাক যে কার্যক্রমগুলো হাতে নিয়েছে সেগুলো হচ্ছে-
ক্ষুদ্র শিল্প উন্নয়ন কার্যক্রম: এর মধ্যে রয়েছে কাপড় বুনন, হাঁস-মুরগি পালন, আসবাবপত্র, তৈল উৎপাদন, গুড়, দড়ি, বাঁশ ও বেতের সামগ্রী তৈরি, ধান ভানা প্রভৃতি ।
সহযোগী প্রতিষ্ঠান উন্নয়নঃ এ কর্মসূচির আওতায় ভূমিহীন লোকদের প্রকল্প প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, ব্যবস্থাপনা, বিপণন প্রভৃতি কার্যক্রমের মাধ্যমে সংগঠিত করা হয় । যথা— ইট তৈরি প্রকল্প ।
উৎপাদন কেন্দ্র উন্নয়ন: আধুনিক ডিজাইন ও প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রামীণ শিল্পজাত সামগ্রীর মান উন্নয়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয় । ঐতিহ্যগত কারুশিল্পের উন্নয়নের মধ্যে রয়েছে সিল্ক, জামদানি, নকশিকাঁথা প্রভৃতি ।
৩। বেসরকারি ব্যাংকসমূহ: দেশি-বিদেশি ব্যাংক মিলে বাংলাদেশে বর্তমানে বেসরকারি খাতে অনেক ব্যাংক সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। এসব ব্যাংকের মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক লি., ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লি., আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক, গ্রীভলেজ ব্যাংক, ইন্দোসুয়েজ ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি. এ বি ব্যাংক লি., ঢাকা ব্যাংক লি., সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লি. প্রভৃতি । শিল্প, ব্যবসায় ও বাণিজ্যে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান এসব ব্যাংকের অন্যতম কাজ। এসব ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংকিং কার্যও সম্পাদন করে ।
৪ । বিমা কোম্পানি: সাধারণ বিমা করপোরেশন ও জীবন বিমা করপোরেশন দুটি সরকারি বিমা কোম্পানির পাশাপাশি বেসরকরি খাতে বেশ কয়েকটি বিমা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে। এদের মধ্যে ইস্টার্ন ইনসিউরেন্স, ইস্টল্যান্ড ইনসিউরেন্স, গ্রীনল্যান্ড ইনসিউরেন্স ও প্রগতি ইনসিউরেন্স প্রধান । এছাড়াও কিছু সংখ্যক বিদেশি ইনসিউরেন্স কোম্পানিও বাংলাদেশে বিমা ব্যবসায়ে নিয়োজিত রয়েছে ।
আরও দেখুন...