অংশীদার আইন ১৯৩২এর কোন ধারায় “অংশীদার” সঙ্গায়িত করা হয়েছে ?
ব্যবসায় ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন অংশীদারি ব্যবসায় সংগঠন দেখি। তেমনি অবস্থা, ভূমিকা, কর্তব্য, দায়- দায়িত্ব, ক্ষমতা প্রভৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন অংশীদার দেখি।
১. সাধারণ বা সক্রিয় অংশীদার (Active partner): যে ব্যক্তি চুক্তির বলে অংশীদার হয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে নিযুক্ত থাকে তাকে সক্রিয় অংশীদার বলে। ঐ ব্যক্তিকে অন্যান্য অংশীদারগণের প্রতিনিধি বলা হয়ে থাকে। এরূপ অংশীদারের দায়িত্ব হলো—
ক. ব্যবসায়ে প্রয়োজনীয় মূলধন সরবরাহ করা;
খ. দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনায় অংশগ্রহণ করা;
গ. ব্যবসায় পরিচালনায় সৃষ্ট দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণ বহন করা ইত্যাদি ।
২. নিষ্ক্রিয় বা ঘুমন্ত অংশীদার (Sleeping or Inactive partner): যে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান হতে লাভ ও ক্ষতির অংশ গ্রহণ করে, অথচ নিজে ব্যবসায় পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে না, তাকে নিষ্ক্রিয় অংশীদার বলে । নিষ্ক্রিয় অংশীদারকে কারবার হতে অবসর গ্রহণের জন্য বিজ্ঞপ্তি (Public notice) দেবার কোনো বাধ্যবাধ্যকতা নেই। বিজ্ঞপ্তি না দিলেও অবসর গ্রহণের পরবর্তী সময়ে সম্পাদিত কার্যের জন্য সে দায়বদ্ধ হবে না ।
এরূপ অংশীদারের বৈশিষ্ট্য হলো—
ক. ব্যবসায়ে মূলধন সরবরাহ করে;
খ. ব্যবসায় হতে মুনাফা গ্রহণ করে;
গ. লোকসান ও দায় বহন করে;
ঘ. ব্যবসায় পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে;
ঙ. তারা অন্য অংশীদারের উপর নির্ভর করে;
চ. অন্য অংশীদারের উপর আস্থা রেখে ব্যবসায় পরিচালনায় নিষ্ক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে ইত্যাদি ।
৩. নামমাত্র অংশীদার (Nominal partner): এরূপ অংশীদারের অংশীদারি ব্যবসায়ে কোনো স্বার্থ থাকে না। কেবলমাত্র নিজের সুনাম অংশীদার হিসেবে ব্যবহার করতে দেয়া হয়। কিন্তু বাহিরের পাওনাদারগণের নিকট ঋণের জন্য তিনি দায়ী থাকে। এরা ব্যবসায়ে মূলধন বিনিয়োগ করে না, পরিচালনায়ও অংশ নেয় না, তবে চুক্তি অনুযায়ী লাভের অংশ অথবা নির্দিষ্ট বেতন বা অর্থ নেয়। নামমাত্র অংশীদারের বৈশিষ্ট্য হলো—
ক. এরূপ অংশীদার ব্যবসায়ে মূলধন বিনিয়োগ করে না;
খ. এ অংশীদারের সুনাম ও যশ ব্যবসায়ে ব্যবহৃত হয়;
গ. কেউ সরল বিশ্বাসে ঐ অংশীদারের উপস্থিতির কারণে ব্যবসায়ে ঋণদান করলে তার জন্য নামমাত্র অংশীদার দায়বদ্ধ হন ইত্যাদি ।
৪. আপাতঃদৃষ্টিতে অংশীদার (Quasi-partner): কোনো অংশীদার কারবার হতে অবসর গ্রহণের পর তাঁর প্রদত্ত মূলধন তুলে না নিয়ে ঋণ হিসেবে ব্যবসায় রেখে দিলে তাঁকে আপাতঃদৃষ্টিতে অংশীদার বলে । মূলধনের উপর তিনি । সুদ পেয়ে থাকেন। কার্যত এরুপ ব্যক্তি ব্যবসায়ের পাওনাদার; অংশীদার নয়। তবে কোনো সক্রিয় অংশীদারগণ বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে ব্যবসায়ে থেকে চলে গেলে তার দ্বারা তৃতীয় পক্ষের সৃষ্ট দায় তাকেই বহন করতে হবে ।
৫. নাবালক অংশীদার (Minor admitted as a partner): অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি (অর্থাৎ ১৮ বছরের নিচে) অংশীদারি কারবারে অংশগ্রহণ করলে তাকে নাবালক অংশীদার বলে। ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইনের ৩০(১) ধারায় বলা হয়েছে যে, সকল অংশীদারগণের অনুমোদনক্রমে কোনো বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানে নাবালককে অংশীদারি সুযোগ-সুবিধাগুলো ভোগ করতে দেয়া হয়। কিন্তু সে প্রতিষ্ঠানের কোনো দায়-দায়িত্ব বহন করে না বলে অংশীদাররূপে স্বীকৃতি পায় না।
১৯৩২ সালের অংশীদারি আইনের ৩০ ধারা অনুযায়ী নাবালক কোন ব্যবসায়ের অংশীদার না হতে পারলেও সে অন্যান্য অংশীদারের সম্মতিক্রমে ব্যবসায়ে মূলধন বিনিয়োগ কওে মুনাফা ভোগ করতে পারে। কিন্তু কোন প্রকারেই তাকে ফার্মের দায়-দায়িত্বের জন্য দায়ী করা যাবে না। কেবল ফার্মে দেয় তার মূলধনের অংশ পরিমাণ দায়ের জন্যই তাকে দায়ী করা যায়, অতিরিক্ত কিছুর জন্য দায়ী করা যায় না। এমনকি তার ব্যক্তিগত সম্পত্তিও এ দায় হতে মুক্ত। কিন্তু সে যখন সাবালক হবে তখনই সে ফার্মেও সবকিছুর জন্য দায়ী হবে। অবশ্য সাবালক হওয়ার ৬ মাসের মধেই তাকে চুক্তিপত্রে দস্তখত দিতে হবে। এমনকি তখন নাবালক অবস্থায় যে দিন হতে সে ফার্মের অংশীদাররূপে গণ্য হয়েছিল, সে সময়কার দায় এবং কার্যকলাপের জন্য তাকে দায়ী করা যাবে। নাবালক অংশীদারকে সীমাবদ্ধ অংশীদার বলে ডাকা হয় ।
৬. আচরণে অনুমিত অংশীদার (Partner by holding out): যে ব্যক্তি প্রকৃত অংশীদার না হয়েও তার কথাবার্তা, আচরণ দ্বারা নিজেকে ব্যবসায়ের অংশীদার বলে পরিচয় দেন তাকে আচরণে অনুমিত অংশীদার বলে। যদি কেউ এতে প্রভাবিত হয়ে ব্যবসায়কে ঋণ দেয় বা চুক্তি করে তবে ঐ দায় আচরণে অনুমিত অংশীদারকে নিতে হবে ।
সংজ্ঞার আলোকে বলতে পারি আচরণে অনুমিত অংশীদার হলো -
ক. আচরণের মাধ্যমে পরিচয়দানকারি অংশীদার;
খ. এ অংশীদার ব্যবসায় পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে না;
গ. ব্যবসায়ে মূলধন সরবরাহ করে না;
ঘ. ব্যবসায় হতে মুনাফাও গ্রহণ করে না;
ঙ. কিন্তু আচরণ দ্বারা প্রভাবিত তৃতীয় পক্ষের দায়ের জন্য আচরণে অনুমিত অংশীদার দায়বদ্ধ হন;
চ. এরূপ অংশীদারের ভোটাধিকার থাকে না ইত্যাদি ।
৭. কর্মী অংশীদার (Working partner): যে অংশীদার ব্যবসায়ে কোনো মূলধন বিনিয়োগ করে না শুধুমাত্র নিজস্ব শ্রম ও দক্ষতা সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত রাখে তাকে কর্মী অংশীদার বলে। চুক্তি অনুযায়ী এরা অন্যান্য অংশীদারের ন্যায় ব্যবসায়ের লাভ-ক্ষতি অংশগ্রহণ করে এবং অসীম দায় বহনে বাধ্য থাকে। অবশ্য ব্যবসায় পরিচালনার জন্য এদেরকে নির্দিষ্ট হারে বেতন বা লাভের অংশ দেয়া হতে পারে।
৮. সীমিত বা সীমাবদ্ধ অংশীদার (Limited partner): চুক্তি অনুযায়ী ব্যবসায়ের কোনো অংশীদারের দায় সীমাবদ্ধ হলে বা আইনগতভাবে সকল অংশীদারের সম্মতিক্রমে কোনো নাবালককে সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করা হলে সেক্ষেত্রে অনুরূপ অংশীদারকে সীমিত অংশীদার বলে। এদের দায় সাধারণত ব্যবসায়ে নিয়োজিত উক্ত অংশীদারের মূলধন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ হয়। আইন অনুযায়ী এরূপ অংশীদার ব্যবসায় পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। কোনো সাবালক যোগ্য ব্যক্তিও চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এরূপ অংশীদার হতে পারে। কোনো অংশীদারি ব্যবসায়ে এক বা একধিক সীমিত অংশীদার থাকলেও তাকে সীমাবদ্ধ অংশীদারি ব্যবসায় (limited partnership) বলে।
৯. প্রতিবন্ধ অংশীদার (Patner by estoppel): যদি ব্যবসায়ের অংশীদারগণ কোনো ব্যক্তিকে ব্যবসায়ের অংশীদার হিসাবে পরিচয় দেয় এবং উক্ত ব্যক্তি তা জেনেও মৌনতা অবলম্বন করে তবে তাকে প্রতিবন্ধ অংশীদার বলে। এরূপ প্রচারণার ফলে সৃষ্ট দায়ের জন্য উক্ত ব্যক্তি তৃতীয় পক্ষের নিকট দায়বদ্ধ হয় । প্রতিষ্ঠান নিজের স্বার্থে কোন ব্যক্তি বা তৃতীয়পক্ষকে এধরনের প্রতিবন্ধ অংশীদার হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। এধরনের কাজের জন্য প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধ অংশীদারকে মাসিক হারে সম্মানী বা অন্যকোন সুবিধা দিতে পারে।
পরিশেষে বলা যায় যে, অংশীদারি ব্যবসায়ের অংশীদার হতে হলে কোনো ব্যক্তির অবশ্যই চুক্তি সম্পাদনের যোগ্যতা থাকতে হবে। অবশ্য নাবালক অন্য অংশীদারদের সম্মতিক্রমে সীমিত অংশীদার হতে পারে। তবে পাগল, দেউলিয়া সরকারি কর্মচারী, বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও বিদেশি শত্রু আইন অনুযায়ী অংশীদার হতে পারে না। কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংঘ অংশীদার হওয়ার যোগ্যতা রাখে না ।