জীবিকা অর্জন ও মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে যে কোনো ব্যবসায় করার অধিকার সকলের রয়েছে। তবে সকল ব্যবসায় দেশের প্রচলিত আইন দ্বারা স্বীকৃত ও বৈধ হতে হয়। এ অধ্যায়ে ব্যবসায়ের বিভিন্ন আইনগত দিক যেমন লাইসেন্স, ট্রেড মার্কস, ফ্রানসাইজ ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারব।
এ অধ্যায় শেষে আমরা-
ক. উৎপাদন
খ. বাজারজাতকরণ
গ. মুনাফা অর্জন
ঘ. চুক্তি
১৯৯৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে ব্যবসায় উদ্যোগ কোর্সটি মাধ্যমিক পর্যায়ে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় উদ্যোগ বিষয়ের একজন শিক্ষকের উদ্যোগে পাঠ্যপুস্তকটি রচিত হয় এবং তিনি এটি বাজারজাত করেন। এই বিষয়ের শিক্ষার্থীরা বইটি হাতে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। ফলে ৩য় সংস্করণে ছাপানো বইটি ৮০০০ কপি অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। ৪র্থ সংস্করণে লেখক ৪০০০ কপি বই ছাপিয়ে বাজারে ছাড়েন কিন্তু বইটির বিক্রয় আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, বাজারে নকল বই এসে গেছে যার দাম অপেক্ষাকৃত কম। বইটির লেখক উপায়ান্তর না দেখে নিকটবর্তী থানায় গেলেন। থানা কর্তৃপক্ষ বইটির কপিরাইট নিবন্ধিত আছে কিনা জানতে চাইলেন । যদিও নিবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে লেখক অবগত ছিলেন, কিন্তু এ বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে কপিরাইট করা থেকে বিরত ছিলেন। থানা কর্তৃপক্ষ এ কথা জেনে কোনো সাহায্য করতে অপারগ বলে দুঃখ প্রকাশ করে। পরিণামে লেখক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেন এবং পরবর্তীতে বইটি পুনঃপ্রকাশের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
উপরোউক্ত গল্পটি পাঠ করে তোমরা কী বুঝলে?
লেখক যদি কপিরাইট সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বইটির কপিরাইট নিবন্ধন করে রাখতেন তাহলে তিনি কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হতেন না। ব্যবসায় উদ্যোক্তাদের কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ থাকে যেমন কপিরাইট, পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক ইত্যাদি। এগুলো ব্যবসায় উদ্যোগের গবেষণার ফসল এবং ব্যবসায়ের অতিমূল্যবান সম্পদ। এসব সম্পদ সংরক্ষণের জন্য সব দেশেই আইনগত বিধি বিধান রয়েছে। এগুলো সম্পর্কে ব্যবসায় উদ্যোক্তাদের প্রাথমিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। আইন কানুন সম্পর্কে ধারণা ব্যবসায়ের আইনগত সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে।
যে কোনো ব্যবসায় শুরু করার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয় বা নিবন্ধন করতে হয়। অনুমোদন বা নিবন্ধন করার পদ্ধতি বিভিন্ন রকমের। একক মালিকানা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে যদি এর অবস্থান পৌর এলাকার ভিতরে হয় তাহলে পৌর কর্তৃপক্ষের এবং পৌর এলাকার বাইরে হলে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ট্রেউ লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হবে। বাংলাদেশে অংশীদারি ব্যবসায় নিবন্ধন বাধ্যতামূলক নয়। তবে অংশীদারগণ ইচ্ছা করলে অংশীদারি আইনে উল্লিখিত নিয়মানুসারে নিবন্ধন ফরম পূরণ করে নিবন্ধনের জন্যে স্থানীয় নিবন্ধকের কাছে অবেদন করতে পারে। আবেদন ফরমের সাথে নির্দিষ্ট হারে নিবন্ধন ফি জমা দিতে হয়।
যৌথ মূলধনী কোম্পানি নিবন্ধন
কোম্পানি আইন অনুসারে বাংলাদেশে যৌথ মূলধনী ব্যবসায়ের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। এ ক্ষেত্রে কোম্পানির নিবন্ধকের ভূমিকা পালন করেন রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি। প্রবর্তকগণ কোম্পানি আইন অনুসারে প্রয়োজনীয় দলিলসহ ফি প্রদান করে নিবন্ধকের নিকট আবেদন করেন। দলিলাদি ও প্রমাণপত্র পরীক্ষা- নিরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলে নিবন্ধক নিবন্ধনপত্র ইস্যু করেন। নিবন্ধনপত্র পাওয়ার সাথে সাথে কোম্পানি জন্ম লাভ করে। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে ন্যূনতম দুইজন প্রবর্তককে এবং পাবলিক কোম্পানির বেলায় সাতজন প্রবর্তককে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হয়। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি নিবন্ধনপত্র পাওয়ার সাথে সাথে ব্যবসায় শুরু করতে পারে, কিন্তু পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিকে ব্যবসা শুরু করার জন্য কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হয়।
ফ্রানসাইজিং (Franchising)
বর্তমানে ফ্রানসাইজিং পদ্ধতিতে ব্যবসায় স্থাপন ও পরিচালন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কোনো খ্যাতনামা কোম্পানির নাম ব্যবহার এবং এর পণ্য তৈরি, বিক্রি বা বিতরণ করার অধিকারকে ফ্রানসাইজিং বলে। এ ধরনের ব্যবসার উদাহরণ হলো ব্যান্ড বক্স কোম্পানি, পিজ্জাহাট, কেএফসি উইম্পি, কেনটাকি ইত্যাদি। ফ্রানসাইজিং ব্যবসায় দুটি পক্ষ থাকে, ফ্রানসাইজর ও ফ্রানসাইজি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমেরিকার কেএফসি হচ্ছে ফ্রানসাইজর এবং বাংলাদেশের স্ট্রান্সকম লিঃ হচ্ছে ফ্রানসাইজি। ফ্রানসাইজিং ব্যবসায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো :
১) ফ্রানসাইজর ও ফ্রানসাইজি-এর মধ্যে চুক্তিপত্র।
২) ব্র্যান্ডেড পণ্য বা সেবা
৩) পণ্য বা সেবা স্বীকৃত মান ও প্রক্রিয়া অনুযায়ী হচ্ছে কিনা তা যাচাইয়ের জন্য ফ্রানসাইজার কর্তৃক মনিটরিং।
ফ্রানসাইজ চুক্তি
ফ্রানসাইজিং ব্যবসায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ফ্রানসাইজিং চুক্তি যা ফ্রানসাইজি ও ফ্রানসাইজারের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। পুঁজির পরিমাণ, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ব্যবস্থাপনায় সাহায্য, ফ্রানসাইজ এলাকা ইত্যাদি ভেদে চুক্তির ধারাগুলো বিভিন্ন রকম হতে পারে। তবে সকল ফ্রানসাইজিং চুক্তির মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে :
চুক্তিপত্রের শর্তাবলি যদি উভয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় তাহলে চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হবে। ফ্রানসাইজিং প্রতিষ্ঠানের আইনগত ধারণা অনুযায়ী বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়ম অনুযায়ী নিবন্ধন করে ব্যবসা শুরু করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যদি প্রতিষ্ঠানটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হয় তাহলে রেজিষ্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানির কাছ থেকে নিবন্ধন করে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করতে পারবে। ফ্রানসাইজিং-এর মাধ্যমে ব্যবসায় শুরু করার অনেকগুলো সুবিধা আছে। এগুলোর মধ্যে ব্র্যান্ডের পণ্য বাজারজাতকরণ সুবিধা, কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ফ্রানসাইজরের কাছ থেকে ব্যবসায় সংক্রান্ত পরামর্শ নেওয়া এবং যে কোনো সময় অর্থায়নের ব্যবস্থা অন্যতম। অসুবিধাগুলোর মধ্যে কড়া মনিটরিং, চুক্তিপত্রের উল্লিখিত শর্ত ভঙ্গের জন্য চুক্তি বাতিলের সম্ভাবনা এবং বেশি পরিমাণ বিনিয়োগ অন্যতম। এসত্ত্বেও ফ্রানসাইজিং ব্যবস্থা নতুন নতুন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সহায়তা করছে। বিদেশে এ জাতীয় ব্যবসায় জনপ্রিয়তা লাভ করলেও বাংলাদেশে এখনও তেমন জনপ্রিয়তা ও পরিচিতি লাভ করেনি। বড় বড় শহরের পাশাপাশি জেলা শহরগুলোতে এগুলোর শাখা বৃদ্ধি করলে ধীরে ধীরে এর প্রসার বাড়বে।
মনন ও মেধা দ্বারা সৃষ্ট কাজই মেধাসম্পদ। ব্যবসায়, শিল্পে বা বাণিজ্যে প্রয়োগ উপযোগী আবিষ্কার, সাহিত্য ও শিল্পকর্ম, নকশা, প্রতীক, নাম ইত্যাদি মেধাসম্পদের অন্তর্ভুক্ত। শিল্প বা ব্যবসায় উদ্যোক্তার মেধাসম্পদ বলতে ঐসব মূল্যবান সম্পদকে বোঝায় যা সে দীর্ঘদিন প্রচেষ্টা চালিয়ে উদ্ভাবন করেছে। সব উদ্ভাবন ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মূলে রয়েছে মেধাসম্পদ। মেধাসম্পদকে কাজে লাগিয়ে মানুষ জয় করেছে সৃষ্টির অনেক অজানা রহস্য। সম্ভব করে তুলেছে অনেক অসম্ভবকে। এসব সম্পদের মধ্যে পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক এবং কপিরাইট অন্যতম। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ২৬ এপ্রিল বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস পালিত হয়।
পেটেন্ট হলো এক ধরনের মেধাসম্পদ। পেটেন্টের মাধ্যমে এরূপ আবিষ্কারের জন্য আবিষ্কারককে তার স্বীকৃতিস্বরূপ একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একচেটিয়া মালিকানা প্রদান করা হয়। এক্ষেত্রে পণ্য বা সেবার উদ্ভাবক বা আবিষ্কারক ও সরকারের মধ্যে চুক্তি হয়। আবিষ্কারককে পেটেন্টটি প্রদানের অর্থ হলো এই নির্দিষ্ট সময়ে অন্য কেউ এটি তৈরি, ব্যবহার এবং বিক্রয় করতে পারবে না। অনেক সময় কোন অসাধু ব্যবসায়ী বা প্রতিযোগী বিধি লঙ্ঘন করে নকল পণ্য বাজারে বিক্রয় করে উদ্ভাবনকারীকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পেটেন্ট করার প্রধান উদ্দেশ্য হলো শিল্পোদ্যোক্তার পরিশ্রমলব্ধ উদ্ভাবন নকল বা অন্য কোনো উপায়ে তৈরি বা বিক্রি করে যাতে আর্থিক সুবিধা অর্জন না করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। ব্যবসায় জগতে প্রকৃত উদ্ভাবক এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে পেটেন্ট ধারণার উৎপত্তি হয়েছে। বস্তুত এ বিষয়ে শিল্পোদ্যোক্তার সচেতনতার অভাব বা অবহেলার কারণে অনেক সময় প্রতারিত হয়েছে। বাংলাদেশে ১৯১১ সালের পেটেন্ট ও ডিজাইন আইন চালু আছে।
ব্যবসার ক্ষেত্রে কোনো পণ্যকে অন্যের অনুরূপ বা অভিন্ন পণ্য হতে স্বতন্ত্র করার লক্ষ্যে ব্যবহৃত প্রতীককে ট্রেডমার্ক বলে। ঠিক একই উদ্দেশ্যে সেবার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্রতীককে সার্ভিস মার্ক বলে। স্বাতন্ত্র্যতাই মার্ক বা প্রতীকের মূল বিষয়। ডিভাইস (device), ব্রান্ড (brand), শিরোনাম (Heading), লেবেল (label), টিকেট, নাম, স্বাক্ষর, শব্দ, অক্ষর, প্রতীক, সংখ্যা যুক্ত উপাদান, রঙের সমন্বয় বা এগুলোর যে কোনো রূপ সমন্বয় প্রতীকের অন্তর্ভুক্ত হবে। মোড়ক প্রতীকের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয়।
ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশনের প্রয়োজনীয়তা (Necessity of Trademark Registration ):
কোনো প্রতীক বা মার্কের রেজিস্ট্রেশন ঐ পণ্য বা সেবার ক্ষেত্রে প্রতীকটি ব্যবহারের বিষয়ে রেজিস্টার্ড মালিককে একচ্ছত্র স্বত্ত্ব বা অধিকার প্রদান করে। রেজিস্টার্ড মালিকের অনুমতি ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঐ প্রতীকটি ব্যবহার করতে পারবে না। রেজিস্টার্ড মার্কটি সুপরিচিত হলে অন্যান্য পণ্য বা সেবার ক্ষেত্রেও মালিকের এ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। আইন দ্বারা এ অধিকার সুরক্ষিত। এ অধিকার লঙ্ঘিত হলে আদালতে মামলা করে প্রতিকার পাওয়া যাবে।
ট্রেড মার্ক রেজিস্ট্রেশনের সময়সীমা (Time-limit of Trademark Registration)
রেজিস্টার্ড ট্রেড মার্কের মালিক মার্কটি ব্যবহারের একচ্ছত্র অধিকার সংরক্ষণ করেন। রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয় ৭ বছরের জন্য। মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগে আবেদন করলে ১০ বছরের জন্য নবায়ন করা যায়। অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত পুনঃ পুনঃ নবায়ন করা যেতে পারে। নবায়ন না করলে, শর্ত লঙ্ঘিত হলে বা কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হলে রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা হয়। উপমহাদেশে ১৯৪০ সালে ট্রেডমার্কস আইন প্রণয়ন করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ট্রেডমার্কস আইন ২০০৯ চালু আছে।
কপিরাইটও একটি গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ যা রক্ষা করার ব্যবস্থা না করলে এর স্বত্বাধিকারী বা মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কপিরাইটের মাধ্যমে সাহিত্য,শিল্পকর্ম ও অন্যান্য শিল্পকলা সৃষ্টিকারীকে তার সৃষ্ট মেধাসম্পদ ব্যবহারের একচ্ছত্র অধিকার প্রদান করা হয়। গল্প, নাটক, প্রবন্ধ, কবিতা জাতীয় সাহিত্যকর্ম, চিত্রকর্ম, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, যন্ত্র সংঙ্গীত, ভাস্কর্য, স্থাপত্যকলা কপিরাইট দ্বারা সংরক্ষিত হয়। বর্তমানে কম্পিউটার সফটওয়্যারও কপিরাইট দ্বারা সংরক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যখন কোনো পুস্তকের লেখক এবং প্রকাশকের মধ্যে বইটি মুদ্রণ ও বাজারজাতকরণের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের চুক্তি হয় একেই কপিরাইট চুক্তিপত্র বলা হয়। চুক্তিপত্রে সময়, রয়েলটির পরিমাণ প্রভৃতি উল্লেখ থাকে। চুক্তিপত্র রেজিষ্ট্রি করা থাকলে চুক্তি ভঙ্গের জন্য লেখক কোর্টে প্রতিকার চাইতে পারে। ব্র্যান্ডের পণ্য, খেলা, তারকাদের নাম প্রভৃতি কপিরাইট চুক্তির মাধ্যমে বিপণন করা যায়। প্রকৃত পক্ষে কপিরাইট চুক্তি পণ্য বাজারজাতকরণের একটি জনপ্রিয় উপায়। উপমহাদেশে ১৯১২ সালে প্রথম কপিরাইট আইন প্রণীত হয়। বাংলাদেশে কপিরাইট আইন ২০০০ প্রচলিত আছে যা সর্বশেষ ২০০৫ সালে সংশোধন করা হয়। মোট কথা মেধাসম্পদ সংরক্ষণের উপায়গুলো যথাযথভাবে ব্যবহার করলে ব্যবসায় উদ্যোক্তা অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা পাবে। কপিরাইট আইন ২০০৫ অনুযায়ী লেখক বা শিল্পীর জীবনকালীন ও মৃত্যুর পর ৬০ বছর পর্যন্ত কপিরাইট সংরক্ষিত থাকে।
কোনো বিশেষ পণ্য উৎপাদন ও বিপণন করতে চাইলে বা সেই বিশেষ পণ্যটিকে বাজারে প্রচলিত অনুরূপ অন্যান্য পণ্য থেকে আলাদা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে প্রয়োজনবোধে সেই পণ্যের প্রতীক রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধিকরণ করতে হয়। এর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন বা বিএসটিআই। এটি শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সংস্থা। নির্ধারিত ফরমে আবেদন করে এবং প্রয়োজনীয় ফি জমা দিয়ে পণ্য প্রতীক বা ট্রেড মার্ক নিবন্ধিকরণ করা যেতে পারে। তদুপরি কতিপয় নির্ধারিত পণ্যের মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নির্ধারিত মান অনুযায়ী সেই সকল পণ্য উৎপাদন করে বিএসটিআই থেকে বাধ্যতামূলকভাবে সনদপত্র বা সার্টিফিকেট নিতে হয়। বিএসটিআই বাধ্যতামূলকভাবে সার্টিফিকেটের আওতাধীন পণ্যের তালিকা সংরক্ষণ করে। নির্ধারিত মান অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন না করলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিএসটিআই কর্তৃক প্রদত্ত সার্টিফিকেশন বা লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। কোন কোন পণ্য বিএসটিআই এর বাধ্যতামূলক সার্টিফিকেশন মার্ক-এর আওতাধীন এবং সেই সকল পণ্যের নির্ধারিত মান কেমন তা বিএসটিআই থেকে জানা যায়। উৎপাদিত পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য বিএসটিআই প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করে থাকে।
কোনো না কোনো কারণে ব্যবসায় ক্ষতির সম্ভাবনাকে ব্যবসায় ঝুঁকি বলে। ঝুঁকি ছাড়া কোনো ব্যবসায় হয় না। প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে ঝড়, বন্যা, সাইক্লোন, অতিবৃষ্টিপাত অন্যতম। এছাড়া চুরি-ডাকাতি, অপহরণ, অগ্নি, নৌ, রেল ও মটর দুর্ঘটনার কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এসব ঝুঁকি পরিহার বা কমানোর ক্ষেত্রে বিমাকরণ একটি উত্তম উপায়। বিমা একটি ব্যবসায়ও বটে।
যে চুক্তির মাধ্যমে কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি কর্তৃক নির্দিষ্ট প্রিমিয়ামের বিনিময়ে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা বিষয় সম্পত্তি সম্পর্কিত কোনো ঘটনাজনিত ক্ষতির বা ঘটনার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হয়। তাকে বিমাচুক্তি বলে। উক্ত ক্ষতিপূরণের জন্য বা নির্দিষ্ট অর্থ প্রদানের জন্য যে পক্ষ স্বীকৃত হয় তাকে বিমাকারি এবং যার ক্ষতিপূরণের জন্য বা যাকে অর্থ প্রদানের জন্য উক্ত চুক্তি সম্পাদিত হয় তাকে বিমাগ্রহীতা বলে। চুক্তি অনুযায়ী বিমাগ্রহীতা এককালীন বা নিয়মিত কিস্তিতে যে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিমাকারীকে প্রদান করে তাকে প্রিমিয়াম বলা হয়। বিমাচুক্তি যে দলিল দ্বারা সম্পাদিত হয় তাকে বিমাপত্র বলা হয়। বিমাপত্রে বিমার যাবতীয় শর্ত লিখিত থাকে। বিমাকে ক্ষতিপূরণের চুক্তি বলা হয়। তবে জীবন বিমার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও বিমা ব্যবস্থা চালু আছে। ১৯৩৮ সালে উপমহাদেশে প্রবর্তিত বিমা আইন এতদিন বাংলাদেশে চালু ছিল। উক্ত আইনের পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংশোধন করে ২০১০ সালে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে যা বিমা আইন ২০১০ নামে পরিচিত।
ব্যবসায়ে বিমার প্রয়োজনীয়তা (Necessity of Insurance in Business) একজন ব্যবসায়ীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ঝুঁকি নিরূপণ। পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয়ে বহুবিধ ঝুঁকি বিদ্যমান। যেমন কোনো জিনিসের ভৌতিক ক্ষতি, চুরি, কর্মচারীদের পীড়া, আকস্মিক দুর্ঘটনা, আগুন, জাহাজ ডুবি ইত্যাদি ঘটনার কারণে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যে কোনো মুহূর্তে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। বিমাকারি প্রতিষ্ঠান বিমাকৃত ব্যক্তি বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিতে উল্লিখিত প্রদত্ত প্রিমিয়ামের বিনিময়ে এই জাতীয় ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে থাকে। ব্যবসার জন্য তাই বিমা অত্যন্ত সহায়ক। বিমাকারী প্রতিষ্ঠান না থাকলে ঝুঁকির আশঙ্কায় অনেক ব্যবসায়ীকেই প্রাথমিক পর্যায়েই তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হতো। তাই ব্যবসায়ের ঝুঁকিগত প্রতিবন্ধকতা ও বিরাজমান অনিশ্চয়তা দূর করে ব্যবসায়কে নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিচালনার জন্য বিমার প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি ।
বিমার প্রকারভেদ (Classification of Insurance)
বর্তমানে বিভিন্ন প্রকার বিমার প্রচলন হয়েছে। এর মধ্যে চার প্রকার বিমা সর্বাধিক প্রচলিত। ১. জীবন বিমা, ২. নৌ বিমা, ৩. অগ্নি বিমা এবং ৪. দুর্ঘটনা বিমা। বর্তমানকালে মানুষ ক্রমশই বিমার সুবিধা উপলব্ধি করায় উপরোক্ত চার প্রকার বিমা ছাড়াও আরো কয়েক শ্রেণির বিমার প্রচলন হয়েছে, যেমন চৌর্য বিমা, বিশ্বস্ততা বিমা, দাঙ্গা বিমা, দায় বিমা, মোটর গাড়ি বিমা, শস্য বিমা ইত্যাদি। নিচে কয়েকটি বিমার উপর আলোকপাত করা হলো-
জীবন বিমা (Life Insurance)
বিমা ব্যবসায়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে জীবন বিমা। যে বিমা চুক্তির মাধ্যমে বিমাকারী বিমা কিস্তির বিনিময়ে বিমা গ্রহণকারী ব্যক্তিকে বা তার নির্বাচিত ব্যক্তি বা উত্তরাধিকারীকে একটি বিশেষ সময়ের পরে বা বিমাগ্রহীতার মৃত্যুতে বিমাকৃত অর্থ প্রদান করে থাকে সেই বিমা চুক্তিকেই জীবন বিমা বলে। এ বিমার বিষয়বস্তু হচ্ছে মানুষের জীবন। যেহেতু মানুষের জীবনের ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না, , তাই জীবন বিমাকে ক্ষতিপূরণের চুক্তি বলা হয় না।
অগ্নি বিমা (Fire Insurance)
যে বিমা চুক্তির মাধ্যমে বিমা গ্রহীতা ব্যক্তিকে অগ্নিজনিত ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ দান করা হয় তাকে অগ্নি বিমা বলে। সাধারণত পণ্য, ঘরবাড়ি, গুদাম, কারখানা, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি আগুনে পুড়ে যাওয়া থেকে সুরক্ষার জন্য অগ্নি বিমা করা হয়।
নৌ বিমা (Marine Insurance)
যে বিমায় নদী ও সামুদ্রিক যাত্রা থেকে সৃষ্ট ঝুঁকির জন্য ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় তাকে নৌ বিমা বলা হয়। সারা পৃথিবীর ব্যবসায়-বাণিজ্যের অধিকাংশ পণ্যই নৌপথে পরিবাহিত হয়। তাই নৌপথে বিরাজমান ঝড়-ঝঞ্জা, ঢেউ, সুনামি, দস্যুতা, যুদ্ধ-বিগ্রহসহ সকল প্রকার ঝুঁকি এড়াতে নৌ বিমা করা হয়।
দুর্ঘটনা বিমা (Accident Insurance):
ব্যক্তির জীবন বা সম্পত্তি বিনাশের ঝুঁকি দুর্ঘটনা বিমার আওতাভুক্ত। এ জাতীয় বিমার শর্তানুসারে নির্দিষ্ট প্রিমিয়ামের পরিবর্তে আশঙ্কিত দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতি সংঘটিত হলে বিমাকারী বিমাগ্রহীতাকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করে।
উপরোক্ত ব্যবসা সংক্রান্ত আইনগত কার্যক্রম ছাড়া আরও বেশ কিছু আইন রয়েছে যা একজন ব্যবসায় উদ্যোক্তার জানা থাকলে ব্যবসা পরিচালনা সহজতর হয়। বিশেষ করে শ্রমিক নিয়োগসংক্রান্ত আইন, কারখানা আইন, ব্যবসায় ঝুঁকি মোকাবেলা আইন এবং ব্যাংকিং আইন সম্পর্কে জ্ঞান ব্যবসা পরিচালনার জন্য অনুকূল।
আরও দেখুন...