কোনো বস্তুকে উপর থেকে ছেড়ে দিলে অভিকর্ষের প্রভাবে ভূমিতে পৌঁছায়। একই উচ্চতা থেকে একই সময় একটি ভারী ও একটি হাল্কা বস্তু ছেড়ে দিলে এগুলো একই সময়ে ভূ-পৃষ্ঠে পৌঁছাবে কি? সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত সকলের ধারণা ছিল ভারী বস্তু হাল্কা বস্তুর চেয়ে আগেই মাটিতে পৌঁছাবে। কথিত আছে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও পিসার হেলানো মিনারের ছাদ থেকে বিভিন্ন ওজনের বস্তুকে একই সময়ে পড়তে দিয়ে দেখান যে এগুলো প্রায় একই সময় ভূ- পৃষ্ঠে পৌঁছায়।
নিজে কর : এক হাতে একটি কলম এবং অপর হাতে এক টুকরা কাগজ নাও। হাত দুটি উঁচু করে একই উচ্চতা থেকে একই সময়ে কলম ও কাগজ ছেড়ে দাও। |
কী দেখলে ? কলম ও কাগজ দুটিই ঘরের মেঝেতে পৌঁছেছে-কিছু এক সাথে নয়। কলমটি কাগজের আগেই মাটিতে পৌঁছায়। বাতাসের বাধার জন্যই এরূপ হয়। বাতাসের মধ্যে বস্তুদ্বয় থাকার জন্য এদের ওজনের বিপরীত দিকে বাতাসের প্লবতা কাজ করে। কলমের চেয়ে কাগজের উপর প্রবতা বা ঊর্ধ্বমুখী বল বেশি হওয়ায় কাগজ দেরীতে মাটিতে পৌঁছায়। বাতাসের বাধা না থাকলে এগুলো অবশ্যই একই সময়ে মাটিতে পৌঁছাতো। যেহেতু বস্তুর উপর ক্রিয়াশীল অভিকর্ষজ ত্বরণ বস্তুর ভরের উপর নির্ভর করে না, তাই কাগজ ও কলমের উপর ক্রিয়াশীল অভিকর্ষজ ত্বরণ একই ।
পড়ন্ত বস্তু সম্পর্কে গ্যালিলিও তিনটি সূত্র বের করেন। এগুলোকে পড়ন্ত বস্তুর সূত্র বলে। এ সূত্রগুলো একমাত্র স্থির অবস্থান থেকে বিনা বাধায় মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
পড়ন্ত বস্তুর সূত্রগুলো স্থির অবস্থান থেকে বিনা বাধায় পড়ন্ত বস্তুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অর্থাৎ বস্তু পড়ার সময় স্থির অবস্থান থেকে পড়বে—এর কোনো আদি বেগ থাকবে না। বস্তু বিনা বাধায় মুক্তভাবে পড়বে অর্থাৎ এর উপর অভিকর্ষজ বল ছাড়া অন্য কোনো বল ক্রিয়া করবে না। যেমন- বাতাসের বাধা এর উপর কাজ করবে না। সূত্রগুলো এরূপ :
এ সূত্রানুসারে স্থির অবস্থান থেকে কোনো বস্তু ছেড়ে দিলে তা যদি বিনা বাধায় মাটিতে পড়ে তাহলে মাটিতে পড়তে যে সময় লাগে তা বস্তুর ভর, আকৃতি বা আয়তনের উপর নির্ভর করে না। বিভিন্ন ভরের, আকারের ও আয়তনের বস্তুকে যদি একই উচ্চতা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং এগুলো যদি বিনা বাধায় মুক্তভাবে পড়তে থাকে তাহলে সবগুলোই একই সময়ে মাটিতে পৌঁছাবে।
অর্থাৎ অর্জিত বেগ পতনকাল । বা,
কোনো বস্তুকে যদি স্থির অবস্থান থেকে বিনা বাধায় পড়তে দেওয়া হয় তবে প্রথম সেকেন্ড পরে যদি এটি। বেগ অর্জন করে তবে দ্বিতীয় সেকেন্ড পরে এটি 2v বেগ অর্জন করবে। সুতরাং t1,t2,t3…..সেকেন্ড পরে যদি বস্তুর বেগ যথাক্রমে V1,V2, V3…. ইত্যাদি হয় তবে এ সূত্রানুসারে,
…... = ধ্রুবক।
অর্থাৎ অতিক্রান্ত দূরত্ব ( পতনকাল)2। বা, h t2
কোনো বস্তুকে যদি স্থির অবস্থান থেকে বিনা বাধায় পড়তে দেওয়া হয় তবে এক সেকেন্ডে যদি এটি h দূরত্ব অতিক্রম করে তবে দুই সেকেন্ডে এটি h x 22 বা 4h দূরত্ব, তিন সেকেন্ডে এটি h x 32 বা 9h দূরত্ব অতিক্রম করবে।
সুতরাং t1, t2, t3 ... সেকেন্ডে যদি বস্তুর অতিক্রান্ত দূরত্ব যথাক্রমে, h1, h2, h3 .... .... ইত্যাদি হয় তবে
= ধ্রুবক ।
পড়ন্ত বস্তুর সাথে আমরা সবাই পরিচিত। উদাহরণস্বরূপ, টেবিল থেকে হঠাৎ কোনো কলম নিচে পড়ে গেল। এ কলমের গতি বর্ণনায় আমরা বাতাসের বাধা উপেক্ষা করি। যদি বস্তুর উপর বাতাসের বাধা নগণ্য হয় তাহলে বস্তুর যে ত্বরণ হয়, তা পুরোপুরি পৃথিবীর আকর্ষণের অর্থাৎ অভিকর্ষের ফলেই হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আমরা বস্তুটিকে বলি মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তু। অভিকর্ষের ফলে বস্তুর যে ত্বরণ হয় তাকে অভিকর্ষজ ত্বরণ বলে । পদার্থবিজ্ঞানে এ অভিকর্ষজ ত্বরণ এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে যে, এর মানের জন্য আলাদা প্রতীক g ব্যবহার করা হয়। মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর জন্য নির্দিষ্ট স্থানে ভূ- পৃষ্ঠের কাছাকাছি অঞ্চলে এ ত্বরণের মান মোটামুটি ধ্রুব থাকে। যদিও ভূপৃষ্ঠে বিভিন্ন স্থানে এর মানের সামান্য পরিবর্তন হয়, তবুও আমাদের হিসাব নিকাশের সময় g = 9.8ms -2 মান যথেষ্ট সঠিক g সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা মহাকর্ষ অধ্যায়ে করা হয়েছে।
সাধারণত খাড়া উপরের দিকে Y অক্ষ ধনাত্মক ধরা হয়। সুতরাং ঊর্ধ্বমুখী সরণ, ঊর্ধ্বমুখী বেগ এবং ঊর্ধ্বমুখী ত্বরণ ধনাত্মক এবং নিম্নমুখী সরণ, নিম্নমুখী বেগ এবং নিম্নমুখী ত্বরণ ঋণাত্মক ধরা হয়।
তাহলে মুক্তভাবে পড়ন্ত কোনো বস্তুর ত্বরণ হয়,
a= -g
এখানে ঋণাত্মক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে, কারণ এক্ষেত্রে ত্বরণের অভিমুখ নিচের দিকে এবং g একটি ধনাত্মক সংখ্যা।
যেহেতু মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর গতি একটি সুষম গতি, তাই আমরা এর গতি বর্ণনায় (3.12 ), ( 3.14), (3.16) এবং (3.18) সমীকরণগুলো ব্যবহার করতে পারি। এ ক্ষেত্রে আমরা ত্বরণ a= - g এবং সরণ s = উচ্চতা h বসাই। তাহলে মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর ক্ষেত্রে গতির সমীকরণগুলোর রূপ হয়।
Y- অক্ষ বরাবর গতি বোঝার সুবিধার্থে যদি আমরা রাশিগুলোর সংকেতে y পাদাঙ্ক ব্যবহার করি, অর্থাৎ অবস্থান বা সরণ h এর পরিবর্তে y, আদি বেগ vo এর পরিবর্তে vyo, শেষ বেগ v এর পরিবর্তে vy লিখি, তাহলে উপরিউক্ত সমীকরণগুলোর রুপ হবে,
কোনো বস্তুকে খাড়া উপরের দিকে নিক্ষেপ করলে অভিকর্ষের প্রভাবে এক সময় সেটি নিচে নামতে শুরু করে। উপরে ওঠার সময় এর বেগ হ্রাস পেতে থাকে, এক সময় বেগ শূন্য হয়, তারপর নিচে নামার সময় আবার বেগ বাড়তে থাকে। সর্বাধিক উচ্চতায় বস্তুর বেগ তথা শেষ বেগ v = 0 হয়। উপরিউক্ত সমীকরণগুলোতে v =0 বসিয়ে আমরা সর্বাধিক উচ্চতা, সর্বাধিক উচ্চতায় পৌঁছাতে অতিবাহিত সময়, বস্তুটির উড্ডয়নকাল ইত্যাদি নির্ণয় করতে পারি।