৩.২ রক্তের গ্রুপ

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান - হৃদযন্ত্রের যত কথা | NCTB BOOK

৩.২.১ অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডি

একজনের রক্তের সাথে আরেকজনের রক্ত মেশানো হলে কেন সেটি কখনো কখনো স্বাভাবিকভাবে মিশে যায় আবার কেন কখনো কখনো গুচ্ছবদ্ধ হয়ে যায় সেটি বুঝতে হলে প্রথমে আমাদের দুটি বিষয় বুঝতে হবে, একটি হচ্ছে অ্যান্টিজেন, অন্যটি হচ্ছে অ্যান্টিবডি। অ্যান্টিজেন হচ্ছে বহিরাগত কোনো বস্তু বা প্রোটিন, যেটি আমাদের রক্তে প্রবেশ করলে আমাদের শরীরের নিরাপত্তাব্যবস্থা (Immune System ) সেটাকে শরীরের জন্য ক্ষতিকর মনে করে তাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। অ্যান্টিজেনকে প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের রক্ত যে পদার্থ তৈরি করে, সেটাই হচ্ছে অ্যান্টিবডি। অ্যান্টিজেন এবং তাকে প্রতিরোধ করার জন্য সৃষ্ট অ্যান্টিবডি যখন একই দ্রবণে থাকে, তখন একটি বিশেষ ধরনের বিক্রিয়া ঘটে। অ্যান্টিজেনকে আক্রমণ করার এই বিক্রিয়াকে অ্যান্টিবডি-অ্যান্টিজেন বিক্রিয়া বলা যায় এবং রক্তের মাঝে এই বিক্রিয়ার কারণে রক্ত কণিকাগুলো গুচ্ছবদ্ধ হয়ে যায়।

১৯০০ সালে ড. কার্ল ল্যান্টস্টেইনার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আবিষ্কার করলেন, বিভিন্ন মানুষের রক্তের লোহিত কণিকায় দুই ধরনের অ্যান্টিজেন পাওয়া যায়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই এই দুইটি অ্যান্টিজেনকে প্রতিরোধ করার জন্য বিভিন্ন মানুষের সিরামে (যে তরলে লোহিত কণিকা ভাসমান থাকে) দুটি অ্যান্টিবডি পাওয়া যায়। লোহিত কণিকায় থাকা এই দুটি অ্যান্টিজেনকে A এবং B নাম দেওয়া হয়েছে। তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ একজন মানুষের রক্তের লোহিত কণিকায় যদি A অ্যান্টিজেন থাকে তাহলে কোনোভাবেই তার রক্তে A অ্যান্টিজেনের অ্যান্টিবডি থাকতে পারবে না- যদি থাকে তাহলে এই অ্যান্টিবডি নিজেই নিজের রক্তের লোহিত কণিকাকে আক্রমণ করে মৃত্যুর কারণ হয়ে যাবে। A অ্যান্টিজেনের অ্যান্টিবডি না থাকলেও, B অ্যান্টিজেনের অ্যান্টিবডি থাকে। একইভাবে যে রক্তের লোহিত কণিকায় B অ্যান্টিজেন আছে সেখানে A অ্যান্টিজেনের অ্যান্টিবডি আছে।অ্যান্টিজেন এবং তার অ্যান্টিবডির বিষয়টি বুঝে থাকলে আমরা মানুষের রক্ত কীভাবে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে সেটি বুঝতে পারব।

যদি লোহিত রক্ত কণিকায় A এবং B এই দুটি অ্যান্টিজেন থাকা সম্ভব হয় তাহলে আমরা রক্তকে নিচের

চারভাগে ভাগ করতে পারি: 

গ্রুপ A

রক্তে অ্যান্টিজেন A

গ্রুপ B

রক্তে অ্যান্টিজেন B

গ্রুপ AB

রক্তে অ্যান্টিজেন A এবং B দুটোই আছে।

সিরামে A অ্যান্টিজেনের অ্যান্টিবডি নেই। B অ্যান্টিজেনের অ্যান্টিবডি আছে।

সিরামে B অ্যান্টিজেনের অ্যান্টিবডি নেই, শুধু A অ্যান্টিজেনের অ্যান্টিবডি আছে।

সিরামে A কিংবা B কারো অ্যান্টিবডি নেই থাকা সম্ভব নয় ।

গ্রুপ 0

রক্তে A কিংবা B কোনো সিরামে A এবং B দুটো অ্যান্টিজেনেরই

অ্যান্টিজেন নেই।

অ্যান্টিবডি আছে।

এখন তোমরা নিজেরাই বলতে পারবে কোন মানুষের কোন গ্রুপের রক্ত দেওয়া সম্ভব।

O গ্রুপের রক্তের লোহিত কণিকায় যেহেতু কোনো অ্যান্টিজেনই নেই তাকে যেকোনো গ্রুপেই দেওয়া সম্ভব। সেই গ্রুপে যে অ্যান্টিবডিই থাকুক, কোনো ক্ষতি করা সম্ভব নয়। এজন্য O গ্রুপকে বলা হয় 

ইউনিভার্সাল ডোনার।

আবার অন্যদিকে AB গ্রুপের রন্তু, নিজের গ্রুপ ছাড়া অন্য কোনো গ্রুপকে দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ অন্য সব গ্রুপেই কোনো না কোনো অ্যান্টিবডি আছে এবং AB গ্রুপ দুটো অ্যান্টিজেনই থাকার কারণে যে কোনো একটি বা দুটি অ্যান্টিটিই লোহিত কণিকাকে আক্রান্ত করে পুচ্ছবদ্ধ করে দেয়।

A গ্রুপ এবং B গ্রুপের রক্ত নিজের গ্রুপ ছাড়া শুধু AB গ্রুপকে দেওয়া যেতে পারে, কারণ AB গ্রুপে কোনো অ্যান্টিডি নেই, তাই A কিংবা B অ্যান্টিজেনকে আক্রান্ত করতে পারবে না।

আবার আমরা যদি গ্রহীতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি তাহলে উল্টোটা দেখতে পাব। O গ্রুপ কারো রাই নিতে পারবে না, কারণ অন্য কোনো গ্রুপের সিরামে দুই ধরনের অ্যান্টিবডিই আছে। অন্যদিকে AB গ্রুপ সবার রক্তই নিতে পারবে কারণ তার সিরামে কোনো ধরনের অ্যান্টিবডিই নেই। এজন্য AB কে বলা হয় Universal Acceptor.

 

৩.২.২ Rh ফ্যাক্টর

এতক্ষণ পর্যন্ত যে বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়েছে, সেটি কিন্তু সম্পূর্ণ হয়নি, কারণ এখন পর্যন্ত রক্তের গ্রুপের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাজনের কথা বলা হয়নি। তোমরা যারা রক্ত গ্রুপের সাথে পরিচিত, তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছ যে, রক্তের গ্রুপ বোঝানোর সময় শুধু A, B, AB কিংবা O বলা হয় না, সবসময়েই এর পর একটি প্লাস বা মাইনাস যুক্ত করা হয় (যেমন A+, O- ইত্যাদি)। এই প্লাস বা মাইনাস চিহ্নটি কোথা থেকে আসে? রেসাস নামের বানরের লোহিত রক্তকণিকায় এক ধরনের অ্যান্টিজেন রয়েছে যেটি অনেক মানুষের রক্তের লোহিত কণিকায় পাওয়া যায়। এই বানরের নাম অনুসারে এটাকে Rhesus Factor বা সংক্ষেপে Rh ফ্যাক্টর বলে। যাদের শরীরে এই অ্যান্টিজেন পাওয়া যায়, তাদের রক্তকে Rh+ এবং যাদের শরীরে এটি নেই, তাদের রক্তকে Rh- বলা হয়। রক্তের গ্রুপের পিছনে যে প্লাস এবং মাইনাস চিহ্নটি থাকে, সেটি এই Rh ফ্যাক্টর ছাড়া অন্য কিছু নয়।

তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ Rh- রক্ত সবসময়ই Rh+ বিশিষ্ট রক্তের মানুষকে দেওয়া সম্ভব (চিত্র ৩.০৬) কিন্তু উল্টোটা এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করে । Rh- রক্তবিশিষ্ট মানুষকে Rh+ বিশিষ্ট রক্ত দিয়ে প্রথমবার গ্রহীতার কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না কিন্তু ধীরে ধীরে গ্রহীতার রক্ত রসে Rh+ অ্যান্টিজেনের বিপরীত অ্যান্টিবডি তৈরি হবে। কাজেই দ্বিতীয়বার Rh+ বিশিষ্ট রক্ত দেওয়া হলে এই অ্যান্টিবডি Rh+ রক্তের লোহিত কণিকার সাথে বিক্রিয়া করে রক্তকে জমাট বাঁধিয়ে দেবে। তবে একবার Rh+ বিশিষ্ট রক্ত গ্রহণ করার পর যদি গ্রহীতা আর ঐ রক্ত গ্রহণ না করে তাহলে ধীরে ধীরে তার শরীরের Rh+ এর অ্যান্টিবডি নষ্ট হয়ে যায় এবং গ্রহীতা তার স্বাভাবিক রক্ত ফিরে পায়।

সন্তানসম্ভবা মায়েদের জন্য এই Rh ফ্যাক্টরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি মায়ের রক্ত Rh- এবং বাবার রক্ত Rh+ হয় তাহলে তাদের সন্তান হবে Rh+ বিশিষ্ট, কারণ Rh+ একটি ‘প্রকট' বৈশিষ্ট্য (অর্থাৎ এটি Dominate করে)। মাতৃগর্ভে ভ্রূণ প্ল্যাসেন্টা বা ‘অমরা'-এর মাধ্যমে মায়ের জরায়ুর সাথে যুক্ত থাকে। সন্তানের Rh+ রক্ত প্ল্যাসেন্টার মাধ্যমে মায়ের রক্তে পৌঁছাবে এবং মায়ের রক্তরসে Rh+ এর বিপরীত অ্যান্টিবডি তৈরি হবে। যেহেতু এই অ্যান্টিবডি খুব ধীরে ধীরে তৈরি হয়, তাই প্রথম সন্তানের বেলায় মায়ের রক্তের Rh+ এর অ্যান্টিবডি সন্তানের দেহে পৌঁছে তার রক্তের কোনো ক্ষতি করতে পারে না এবং একজন সুস্থ সন্তান জন্ম নেয় (চিত্র ৩.০৭)।তবে দ্বিতীয় সন্তান গর্ভধারণ করার পর মায়ের শরীরের Rh+ এর অ্যান্টিবডি সন্তানের রক্তে প্রবেশ করতে থাকে এবং ভ্রুণের লোহিত কণিকা ধ্বংস করে, ভ্রূণ বিনষ্ট হয়, অনেক সময় গর্ভপাত হয়। সন্তান জীবিত জন্ম নিলেও তার প্রচন্ড রক্তস্বল্পতা থাকে এবং জন্মের পর জন্ডিস রোগ দেখা দেয়।এজন্য বিয়ের আগেই হবু বর-কনের রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত এবং প্রয়োজনে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।

৩.২.৩ রক্তের শ্রেণিবিভাগের গুরুত্ব

১. কোনো দাতার রক্ত গ্রহীতার দেহে দেওয়ার আগে সবসময়েই দুজনের রক্তের গ্রুপ জানার জন্য পরীক্ষা করে নেওয়া খুব জরুরি। ভুল গ্রুপের রক্ত দেওয়া হলে গ্রহীতার রক্তকে জমাট বাঁধিয়ে প্রাণহানির কারণ হতে পারে। খুবই জরুরি অবস্থায় যদি গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ জানা সম্ভব না হয়, তাহলে O এবং Rh নেগেটিভ রক্ত দেয়াই সবচেয়ে নিরাপদ ।

২. কোনো শিশুর পিতৃত্ব নির্ণয়ে জটিলতা দেখা দিলে রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করে অনেক সময় তার সমাধান করা যায়।

৩. রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের মাধ্যমে বিশেষ প্রক্রিয়ায় অপরাধীদের শণাক্তকরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

রন্তু নীতি

মানুষের অসুস্থতা কিংবা দুর্ঘটনার জন্য পর্যাপ্ত রক্তের ঘাটতি দেখা দিলে অন্য মানুষের শরীর থেকে রক্ত দেওয়ার বা রক্ত সঞ্চারণের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই জীবাণুমুক্ত এবং সঠিক গ্রুপের রক্ত নিশ্চিত করে নিতে হয়। রক্ত সঞ্চারণের আগে রক্তে এইডস, জন্ডিস— এধরনের জটিল রোগের জীবাণু আছে কি না তাও পরীক্ষা করে নিতে হয়। ডাক্তার অবশ্য রোগী ও দাতার রক্তে A, B, O ও Rh ব্লাড গ্রুপ পরীক্ষা করে গ্রুপ ম্যাচ করার মাধ্যমে একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে রক্ত সঞ্চারনের উদ্যোগ নেন। সঠিকভাবে গ্রুপ ম্যাচ না করে রক্ত সঞ্চারণ করা হলে মানুষের শরীরে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে।

Content added || updated By
কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার
উলিয়াম হার্ভে
আলেকজান্ডার ফ্লেমিং
লুই পাস্তুর

আরও দেখুন...

Promotion