তৃতীয় অধ্যায়
কৃষি উপকরণ
আমরা পূর্ববর্তী শ্রেণিতে বিভিন্ন ধরনের কৃষি উপকরণ নিয়ে আলোচনা করেছি। এ অধ্যায়ে বীজ বপনের উপযুক্ত মাটি প্রনত করা, আদর্শ বীজতলা তৈরি ও তার রক্ষণাবেক্ষণ এবং সাশ্রয়ীরূপে সার ব্যবহার করা ইত্যাদি বিষয় বর্ণনা করা হবে। বীজতলার মাটি যদি উপযুক্তভাবে তৈরি করা না যায় তবে সব বীজ গজাবে না। যথাযথভাবে বীজতলা তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ করা না হে উপযুক্ত মাটি থাকা সত্ত্বেও চারা ভালো হবে না। আর একটি বিষয় হলো, জমিতে সার প্রয়োগ করতে অধিকাংশ কৃষক নিয়ম অনুসরণ করেন না। এতে সারের অপচয় হয় এবং অর্থনৈতিকভাবে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাজেই এখানে এই বিষয়গুলো আলোচনা করা যুক্তিযুক্ত।
১০ মিটার
চিত্র : কাদা মাটির জন্য বীজতলা
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
• বীজ বপনের জন্য উপযুক্ত মাটি প্রস্তুত প্রণালী বর্ণনা করতে পারব।
একটি আদর্শ বীজতলা তৈরির কৌশল ব্যাখ্যা করতে পারব
একটি আদর্শ বীজতলার রক্ষণাবেক্ষণ ব্যাখ্যা করতে পারব:
জমিতে সাশ্রয়ীরূপে সার ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করতে পারব;
জমিতে সাশ্রয়ীরূপে সেচ ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করতে পারব, উচ্চ ফলনের সাথে ভালো বীজ নির্বাচন ও সংরক্ষণের সম্পর্ক স্থাপন করতে পাৱৰ
১. মিটার
কৃষি উপকরণ
৩৫
পাঠ-১ নার্সারিতে বীজ বপনে উপযুক্ত মাটি প্রস্তুত।
আমরা জানি বীজতলায় বীজ বপন করে চারা উৎপাদন করা হয়। বীজ তলার মাটি ভালোভাবে প্রস্তুত না করে বীজ বপন করলে ভালো চারা উৎপন্ন হয় না। বীজতলার মাটি প্রস্তুত করার জন্য যে যে উপকরণ লাগবে তা হলো- জমি, খুঁটি, জায়গা মাপার
ফিতা, কোদাল, মই, জৈব ও অজৈব সার ইত্যাদি আমাদের দেশে দুই ধরনের বীজতলা তৈরি করা
হয়। যথা- (ক) শুকনো (খ) ভেজা।
শুকনো বীজতলায় সরাসরি বীজ বপন করা যাবে। তবে ভেজা বীজতলার ক্ষেত্রে মাটি পানি দ্বারা ভিজিয়ে কাদা করে সমান করতে হবে। অতঃপর বীজ বপন করতে হবে। শুকনা বীজতলায় অঙ্কুরিত বীজ বপন করা হয় না। কিন্তু ভেজা বীজতলায় অঙ্কুরিত বীজ (বিশেষ করে ধান বীজ বপন করা হয়। বীজতলার মাটি প্রস্তুতির নিয়মগুলো হলো-
১. বীজতলার চারপাশে ৩০ সে.মি. চওড়া ও ১৫ সে:মি: গভীর নালা তৈরি করতে হবে:
২. বীজতলার মাটি ২০-২৫ সে.মি. উঁচু রাখতে হবে;
৩. ১৫-২০ সে.মি. গভীর করে বীজতলার মাটি চাষ করতে হবে; ৪. এ অবস্থায় মাটি ২-৪ দিন রেখে দিলে মাটিতে রোদ লাগবে, পোকা বের হলে পাখি খেয়ে ফেলবে
৫. এরপর ঘাস, শিকড়, পাথর ইত্যাদি বেছে ফেলে দিতে হবে;
৬. মাটি এঁটেল হলে অন্য জায়গা থেকে দোআঁশ মাটি এনে বীজতলায় মেশাতে হবে, কিন্তু মাটি বেলে হলে জৈব পদার্থ ও দোআঁশ বা এঁটেল মাটি মিশাতে হবে:
৭. বৃষ্টির পানি বা বাতাসে মাটি সরে যেতে পারে সেজন্য চারপাশে ছিদ্র করা ইট বা অন্য কিছু দিয়ে ঘিরে দিলে ভালো হয়;
৮. বীজতলার দলা বা ঢেলা ভেঙে ঝুরঝুরা করে মাটি সমান করতে হবে;
৯. বীজ বপনের ১০-১২ দিন আগে বীজতলায় টিএসপি, এমওপি ও পচা শুকানো গোবর বা আবর্জনা সার মিশিয়ে দিতে হবে;
১০. নার্সারির আকার অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে;
১১. বীজতলার মাটিতে পোকা বা রোগ জীবাণু থাকতে পারে। তাই কিছু খড় বিছিয়ে দিয়ে তাতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলে মাটি কিছুটা জীবাণুমুক্ত হবে; ১২. মাটি শোধনের জন্য গ্যামাক্সিন বা ফরমালডিহাইড জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করা
যেতে পারে।
পলিব্যাগে ভরার জন্য মাটি উপরোক্ত নিয়মে প্রস্তুতকৃত মাটি চালনি দ্বারা চেলে ঢেলামুক্ত করতে হবে। তারপর নির্ধারিত মাপের পলিব্যাগে মাটি ভরাট করতে হবে ।
কৃষিশিক্ষা
হাতে কলমে কাজ
শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কয়েকটি দলে বিভক্ত করে বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট জায়গায় বীজ বপনের জন্য মাটি প্রন্তুত করতে বলবেন। শিক্ষার্থীরা দলগতভাবে মাটি তৈরির নিয়মগুলো ধারাবাহিকভাবে নোট খাতায় লিপিবদ্ধ করবে এবং শ্রেণিতে উপস্থাপন করবে। এ কাজটি সম্পাদন করার জন্য শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সাথে থেকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেবেন
পাঠ-২ : আদর্শ বীজতলা তৈরি
বীজতলা বিভিন্ন আকারের হতে পারে। এখন আমরা একটি আদর্শ বীজতলা সম্পর্কে জানব। এ ধরনের বীজতলার আকার-আকৃতি, সার প্রয়োগ, মাটি প্রস্তত ও রক্ষণাবেক্ষণ সঠিক নিয়মে হয়ে থাকে। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে আদর্শ বীজতলার একটি মডেল চিত্র দেখাবেন। মডেল চিত্র দেখে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তা আঁকতে বলবেন। এরপর শিক্ষক আদর্শ বীজতলার নিয়মাবলি উল্লেখ করবেন ।
(ক) ধান ফসলের বীজতলা বীজতলায় বীজ বপন করে চারা উৎপাদন করা হয় এবং রোপণের আগ পর্যন্ত চারার যত্ন নেওয়া হয়। তাই খানের আদর্শ বীজতলা তৈরির জন্য জমি চাষ ও মই দিতে হয়। সাধারণত বীজতলা দুইভাবে তৈরি করা হয়। যথা- ভেজা কাদাময় বীজতলা ও শুকানো বীজতলা। শুকানো বীজতলা উঁচু বেলে দোআঁশ মাটিতে এবং ভেজা কালামর বীজতলা এঁটেল মাটিতে তৈরি করা হয় । গাছের ছায়া পড়ে না ও বর্ষার পানিতে ডুবে যায় না, এমন জমি বীজতলার জন্য নির্বাচন করা হয় ।
আদর্শ বীজতলার গঠন (ধান)
(১) প্রতিটি বীজতলার আকার হবে ৯.৫ মিটার x ১.৫ মিটার এবং ছুটি দিয়ে তা চিহ্নিত করতে হবে; (২) দুইটি বীজতলার মাঝে ৫০ সে.মি ও বীজতলার চারপাশে ২৫ সে.মি পরিমাণ জায়গা নালা তৈরি করার জন্য রাখতে হবে। (৩) দুইটি বীজতলার মাঝের ও চারপাশের জায়গা থেকে মাটি তুলে বীজতলা ৭-১০ সে.মি. উঁচু করতে হবে; (৪) বীজতলার প্রতি বর্গমিটারে ২ কেজি হারে গোবর বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করে বীজতলার মাটির সাথে মেশাতে হবে;
কৃষি উপকরণ
109
(খ) উদ্যান ফসলের বীজতলা নার্সারিতে উদ্যান ফসলের বীজ/চারা/স্টাম্প বপন বা রোপণ করে মূল জমিতে রোপণের উপযোগী করে তোলা হয়। এর ফলে চারার স্বাভাবিক বৃদ্ধি নিশ্চিত হয় এবং অল্প জায়গায় সুষম পরিচর্যার মাধ্যমে বেশি চারা উৎপাদন করা হয় ।
আদর্শ বীজতলার গঠন (ক)
(১) নার্সারির বেড তৈরির জন্য সুনিষ্কাশিত উঁচু, আলো-বাতাসযুক্ত উর্বর জমি নির্বাচন করতে হবে,
প্রতিটি বেডের আকার হবে ৩ মিটার x ১ মিটার এবং খুঁটি দিয়ে তা চিহ্নিত করতে হবে; কোদাল দিয়ে ভালোভাবে কুপিয়ে বেড তৈরি করতে হবে:
(৪) প্রতিটি বেডে ২৫ কেজি গোবর বা কম্পোস্ট সার দিয়ে মাটির সাথে উত্তমরূপে মেশাতে হবে, (৫) পাশাপাশি দুইটি বেডের সাথে ৫০ সে.মি. নালা তৈরি করতে হবে;
(৬) নালার মাটি পাশাপাশি দুইটি বেডে ভাগ করে দিতে হবে যেন বেডের উচ্চতা ভূমি থেকে ১০ সে.মি. উঁচু হয়: ি
(৭) এরপর প্রতি ও বর্গমিটার বেডের জন্য ১৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম এমওপি সার ছিটিয়ে মাটির সাথে মেশাতে হবে:
(৮) মাটি অধিক অম্লীয় হলে বেড প্রতি ১৫০ গ্রাম চুন প্রয়োগ করতে হবে:
(৯) রশি, খুঁটি সরিয়ে বেডের উপরের মাটি
সমান করে বীজ বপন করতে হবে:
৩ মিটার
চিত্র: আদর্শ উদ্যান বী
শাকসবজির বীজ বপনের হার নিম্নের ছক অনুসারে হতে হবে-
৩ বর্গমিটার বীজতলার বীজ বপনের হার
সবজির নাম
ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রোকলি
ওলকপি
বীজ বপনের হার (গ্রাম)
১৫-২০
শালগম
12-18
টমেটো
বেগুন
মরিচ
১৮-২৪
লেটুস
পেঁয়াজ
১৮-২৪
কৃষিশিক্ষা
পাঠ-৩: বীজতলা রক্ষণাবেক্ষণ
বীজতলায় বীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারা উৎপন্ন হয়। কাজেই বীজতলা সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা দরকার। নিম্নে সংক্ষেপে বীজতলার রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে উল্লেখ করা হলো-
• বীজতলার মাটি সমান রাখতে হবে।
• বীজতলার আগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে;
• বীজতলার পোকা ও রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে দমনের ব্যবস্থা করতে হবে;
• দুইটি বেডের মাঝে নালায় সবসময় পানি রাখার জন্য সেচের ব্যবস্থা করতে হবে;
• চারা হলদে দেখালে প্রতি শতক বীজতলার জন্য ২৮০ গ্রাম ইউরিয়া বীজতলায় ছিটাতে হবে;
• বীজতলায় কখনো কাঁচা গোবর প্রয়োগ করা যাবে না: ছাগল, ভেড়া ও গরু-বাছুরের আক্রমন থেকে রক্ষার জন্য চারদিকে বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে;
বীজতলা যাতে বেশি শুকিয়ে না যায় সেদিক লক্ষ্য রেখে ছায়া প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে;
কাজ : পাঠ মূল্যায়নের জন্য শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নিচের প্রশ্নগুলো দলীয়ভাবে সমাধান করতে দলীয় কাজ দেবেন এবং কাজ শেষে দলনেতার মাধ্যমে উপস্থাপন করাবেন ।
(১) কোন ধরনের মাটি বীজতলার জন্য উত্তম? (২) বীজতলার স্থান নির্বাচন করতে হলে
কোন বিষয়গুলোর প্রতি বেশি দৃষ্টি দেবে? (৩) চারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে জায়গার পরিমাণ
কীভাবে নির্ধারণ করবে? (৪) বীজতলায় বেড়া দেওয়ার প্রয়োজন কেন? (৫) বীজতলা
স্থাপনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কী?
পাঠ-৪: জমিতে সার প্রয়োগ
আমরা আগেই সার সম্পর্কে জেনেছি। এখন সার প্রয়োগে নিয়মনীতি অনুসরণ করার সুফল ও অনুসরণ না করার কুফল সম্পর্কে জানব ।
ফসল উৎপাদনে সারের বিকল্প নেই। কেননা উদ্ভিদের খাদ্যই হচ্ছে সার। পঞ্চাশের দশকে এদেশের ফসলে রাসায়নিক সার ব্যবহার শুরু হয় আর তখন সার ব্যবহারের কথা বলা হলে চাষিরা চমকে উঠতেন। কৃষি বিভাগের তৎপরতার কারণে এ ভীতি কমে এসেছে। কিন্তু আজও দেখা যায় চাষিরা ফসলের জমিতে সার ব্যবহারের নিয়মনীতি না মেনে অনেকেই পরিমাণের চেয়ে বেশি বা কম সার প্রয়োগ করে থাকেন। কাজেই গাছের বৃদ্ধি, ফুল-ফল ধারণ ও মাটিকে উর্বর রাখতে হলে মাটি পরীক্ষা করে সুষম সার ব্যবহার করতে হবে। কারণ মাটি পরীক্ষা না করে সার ব্যবহার করলে-
(১) একদিকে যেমন উৎপাদন কম হয় অন্যদিকে খরচ বাড়ে (২) এছাড়া মাটির উর্বরতা ও পরিবেশ নষ্ট হয়। আবার, সুষম সার প্রয়োগে-
(১) মাটিতে পুষ্টি উপাদান যোগ হয় (২) মাটি উর্বর হয়
কৃষি উপকরণ
মাটিতে সার ব্যবহারের আগে করণীয়
আমরা এতক্ষণ সারের ব্যবহার সম্পর্কে জানলাম। এসো এবার সার ব্যবহারের আগে করণীয় সম্পর্কে জেনে নেই । বছরের যেকোনো সময় ফসল চাষ করতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো আগে
থেকেই জেনে নিতে হবে- মাটি পরীক্ষা করে মাটির গুণাগুণ সম্পর্কে জানতে হবে। অর্থাৎ মাটিতে কোন পুষ্টি উপাদান
কী পরিমাণে আছে তা জানতে হবে
পরীক্ষিত মাটিতে কোন ফসল চাষ করা যাবে তা জানতে হবে।
ফসলভিত্তিক সারের চাহিদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার নির্দেশনা থেকে জেনে নিতে হবে ।
ঐ জমিতে পূর্ববর্তী কী ফসল চাষ করা হয়েছে এবং তাতে কী কী সার ব্যবহার করা হয়েছে তা জানতে হবে।
কাজ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পরিমিত সার ব্যবহারের সুফল ও কুফল সম্পর্কে দলীয়ভাবে
প্রতিবেদন লিখতে বলবেন। শিক্ষক প্রতিবেদনগুলো সংগ্রহ ও মূল্যায়ন করবেন।
পাঠ-৫: সার ব্যবহারে সাশ্রয়
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অল্প জমিতে বেশি ফলন পেতে হলে রাসায়নিক সার ব্যবহারের বিকল্প নেই । এখন প্রশ্ন হচ্ছে- কীভাবে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমানো যায় এবং পাশাপাশি ফলন বেশি পাওয়া যায়।
প্রয়োগের সময় ও পদ্ধতির উপরই প্রয়োগকৃত সারের কার্যকারিতা বাড়ে। এটি নাইট্রোজেন সারের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা পানিতে সহজে দ্রবণীয় বলে কোনো কোনো পরিস্থিতিতে প্রয়োগকৃত নাইট্রোজেনের প্রায় ৭০% নানাভাবে মাটি থেকে ধুয়ে ফসলের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে এবং পরিবেশকেও দূষিত করে। যেমন -
১. ইউরিয়া সার মাটিতে অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী এবং মৌসুম শেষে মাটিতে তা একেবারেই অবশিষ্ট থাকে না। কাজেই ইউরিয়া সার ফসলের চাহিদামাফিক গাছের আংশিক বৃদ্ধির ধাপে ধাপে কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হয়।
80
কৃষিশিক্ষা
২. জমিতে সবুজ সার তৈরির পর ধানের জমিতে নাইট্রোজেন সারের মাত্রা ১৫-২০ কেজি/ হেক্টর কমানো যায়।
৩. শুঁটি জাতীয় দানা ফসল চাষের পর (ফসলের পরিত্যক্ত অংশ মাটিতে মিশিয়ে দিলে) নাইট্রোজেন সারের প্রয়োগ মাত্রা ৮-১০ কেজি / হেক্টর কমানো যায়।
৪. এলসিসি LCC (Leaf Color Chart) ব্যবহারের মাধ্যমে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে ধানের ফলন ঠিক থাকে এবং হিসেব করে দেখা গেছে রোপা আমন ধানে শতকরা ২৫ ভাগ এবং বোরো ধানে শতকরা ২৩ ভাগ ইউরিয়া সার কম লাগে।
৫. ইউরিয়া সার গুটি আকারে ফসলের জমিতে প্রয়োগ করলে ২৫% ইউরিয়া সাশ্রয় হয় ।
সাশ্রয়ীরূপে সার প্রয়োগের পদ্ধতি
এতক্ষণ আমরা সারের ব্যবহার কমানোর উপায়গুলো অর্থাৎ সাশ্রয় সম্পর্কে আলোচনা করলাম । এবার এসো সাশ্রয়ীরূপে প্রয়োগের নিয়মগুলো জেনে নিই-
১. রাসায়নিক সার কোনো বীজ, গাছের কাণ্ডের খুব কাছাকাছি বা কোনো ভেজা কচিপাতার উপর ব্যবহার করা যাবে না।
২. ধানের কাদাময় জমিতে ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে। তবে শুকনো জমিতে প্রয়োগের পর নিড়ানি বা আঁচড়া দিয়ে মাটির সাথে মেশাতে হবে।
৩. জৈব সার, টিএসপি ও এমওপি সার বীজ বপন বা চারা রোপণের ৭ দিন আগে প্রয়োগ করতে হবে।
৪. বেলে মাটিতে এমওপি ও ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে মাটির কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়
৫. ধানের চারার প্রথম কুশি (Tiller) বের হওয়ার সময়, কচি থোড় জন্মের কয়েকদিন আগে এবং গমে মুকুট শিকড় বের হলে, ভুট্টার চারা যখন হাঁটু সমান উঁচু হয় এবং স্ত্রী ফুল বের হওয়ার এক সপ্তাহ আগে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা দরকার।
কৃষি উপকরণ
83
৬. ২য় অধ্যায়ে বর্ণিত ধানচাষে গুটি ইউরিয়া প্রয়োগের নিয়মাবলী অনুযায়ী গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে।
৭. জমি তৈরির শেষ চাষে পটাশ, গন্ধক ও দস্তা জাতীয় সারগুলো প্রাথমিকভাবে একবারে প্রয়োগ করা যায়।
কাজ : শিক্ষক শিক্ষার্থীদের দিয়ে একটি বিতর্কের ব্যবস্থা করবেন। বিতর্কের বিষয়: একমাত্র রাসায়নিক সারের পরিমিত ব্যবহারই ফসলের ভালো ফলন নিশ্চিত করতে পারে।
পাঠ ৬ জমিতে সাশ্রয়ীরূপে সেচের ব্যবহার
ফসল উৎপাদনে পানির চাহিদা পূরণে কৃত্রিম উপায়ে পানি প্রয়োগকে পানি সেচ বলে । সেচের পানির মূল উৎস বৃষ্টিপাত । বৃষ্টিপাতের পানি নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর, হ্রদ, পুকুর ইত্যাদিতে জমা হয় বা চলাচল করে । এ সব পানির অংশবিশেষ ভূ-গর্ভে জমা হয়। সেচের জন্য অবস্থান অনুসারে পানির উৎস দুই প্রকার; ক) ভূ-উপরিস্থ পানি; যেমন- নদ-নদী, খাল-বিল ইত্যাদির পানি ও খ) ভূ-গর্ভস্থ পানি। বিভিন্ন ধরনের সেচ প্রযুক্তি যেমন- গভীর নলকূপ, অগভীর নলকূপ, শক্তিচালিত পাম্প, ভাসমান পাম্প ইত্যাদি ব্যবহার করে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে সেচ দেওয়া হয়। পানি উত্তোলনের পর কাঁচা বা পাকা সেচ নালার মাধ্যমে জমিতে দেওয়া হয়। দেশের মোট কৃষি জমির ৫২ শতাংশ সেচের আওতাভুক্ত। ১৪.৩৫ লক্ষ হেক্টর জমিতে ভূ-উপরিস্থ সেচ এবং ৩৩.৭৩ লক্ষ হেক্টর জমি ভূ-গর্ভস্থ সেচের আওতাভুক্ত। আন্তর্জাতিক পানি ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউট (IWMI International Water Management Institute) -এর এক জরিপে দেখা যায় আমাদের দেশে সেচ দক্ষতা ৩০-৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ সেচের জন্য দেওয়া পানির ৬৫-৭০ ভাগই অপচয় হয়। সেচ পাম্প ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ, সেচ নালা নির্মাণ ও মেরামত এবং সেচ পাম্প পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত বিদ্যুৎ, ডিজেল, পেট্রোলের জন্য প্রতি বছর অনেক টাকা খরচ হয়। বোরো ধানের মোট উৎপাদন খরচের ২৮-৩০ শতাংশ সেচের জন্য খরচ হয়। আবার অতিমাত্রায় ভূ-গর্ভস্থ সেচ পানি ব্যবহারের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে যা পরিবেশগত দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং মূল্যবান সেচের পানির অপচয় হ্রাস করে জমিতে সাশ্রয়ীরূপে সেচের ব্যবহার বাড়াতে হবে।
ফসলের চাহিদা অনুসারে জমি থেকে পানি প্রাপ্তি ভালো ফলনের পূর্বশর্ত। জমিতে পানির ঘাটতি দেখা দিলে সেচের মাধ্যমে ফসলের চাহিদা অনুসারে পানি সরবরাহ করতে হয়। প্রয়োজনের বেশি বা কম পানি উভয়ই ফসলের ফলন বৃদ্ধির অন্তরায়। বেশি পানি দিলে অনেক ফসল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সুতরাং ফসল সেচ প্রয়োগের আগে সেচের সঠিক সময় ও প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণ
কৃষিশিক্ষা
সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। বিভিন্ন ফসলের পানির চাহিদা বিভিন্ন ফসলের বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়েও পানির চাহিদার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। শস্যে কখন সেচ দিতে হবে তা নানাভাবে নির্ধারণ করা যায়। সব পদ্ধতিই আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। জমিতে সাশ্রয়ীরূপে সেচের ব্যবহারের জন্য নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে-
ক) সেচ নালার ধরন : সেচ নালার বা ক্যানালের মাধ্যমে জমিতে সেচের পানি সরবরাহ করা হয়। মাটির সেচ নালায় পানি পরিবহনে বেশি অপচয় হয়। আবার যদি মাটির সেচ নালা সঠিকভাবে তৈরি করা না হয় তাহলে অপচয় আরও বেশি হয়। জমি থেকে উঁচু করে সেচ নালা তৈরি, নালার দুই পাশ ও ভলা পিটিয়ে মজবুত করলে সরবরাহের সময় সেচের পানির অপচয় হ্রাস পায়।
খ) সেচ পদ্ধতি : ফসলের প্রকার, ভূমির বন্ধুরতা, মাটির প্রকৃতির উপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধরনের সেচ পদ্ধতি রয়েছে । নিচে পানি সাশ্রয়ী কয়েকটি সেচ পদ্ধতি সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো : ১. চেক বেসিন পদ্ধতি : প্লাবন সেচ পদ্ধতিতে জমিতে পানি নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ থাকে না ।
ফলে পানির অপচয় বেশি হয়। এ অসুবিধা দূর করার জন্য চেক বেসিন পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়।
চেক বেসিন বা আইল সেচ পদ্ধতিতে সমস্ত জমিকে ঢাল অনুসারে কয়েকটি খণ্ডে উঁচু আইল দ্বারা
বিভক্ত করে পানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সেচ দেওয়া যায়।
২. রিং বেসিন পদ্ধতি : ফল বাগানে রিং বেসিন বা বৃত্তাকার পদ্ধতিতে সেচ দিলে পানির অপচয় কম হয়। এ পদ্ধতিতে প্রত্যেকটি ফল গাছের গোড়ায় বৃত্তাকার নালা তৈরি করে প্রধান সেচ নালার সাথে সংযোগ দেওয়া হয়।
৩. নালা পদ্ধতি : নালা সেচ পদ্ধতিতে জমির আয়তন অনুসারে পর্যাপ্ত সংখ্যক নালা তৈরি করে প্রধান সেচ নালার সাথে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। সারি ফসলে এ পদ্ধতি বেশি উপযোগী। এ পদ্ধতিতে পানি নিয়ন্ত্রণ সহজ বলে অপচয় কম হয়।
৪. বর্ষণ সেচ পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে নজালের মাধ্যমে পানি পাছের উপর বৃষ্টির মতো ছিটিয়ে দেওয়া হয়। পানি সাশ্রয়ী এ পদ্ধতিতে প্রাথমিক খরচ বেশি। চা বাগানে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়
৫. ড্রিপ সেচ পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে পানি পাইপের মাধ্যমে গাছের মূলাঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া হয় এটা সবচেয়ে পানি সাশ্রয়ী পদ্ধতি। যেখানে সেচের পানির খুব অভাব সেখানে এ পদ্ধতি বেশি কার্যকর।
কৃষি উপকরণ
৪৩
কাজ : শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে অতিরিক্ত সেচের কুফল সম্পর্কে আলোচনা করবে। আলোচনা শেষে শ্রেণিতে উপস্থাপন করবে ।
গ) সেচের পানির পরিমাণ গাছ মূলাঞ্চল হতে পানি গ্রহণ করে। গাছের বৃদ্ধির সাথে মূল বৃদ্ধি পায় ও মাটির গভীরে প্রবেশ করে। তাই সেচের মাধ্যমে গাছের মূলাঞ্চল ভিজাতে হয়। বেশির ভাগ ফসলের ৮০-৯০ শতাংশ মূল উপরের প্রথম এক থেকে দেড় ফুট মাটির গভীরে থাকে। গাছের মোট পানির ৭০ শতাংশ মূলাঞ্চলের প্রথমার্ধ থেকে গ্রহণ করে। তাই মাটির প্রথম এক থেকে দেড় ফুট গভীরতা পর্যন্ত ভিজিয়ে পানি সেচ দিতে হবে
ঘ) সেচ দেওয়ার সময় : সেচের পানির সাশ্রয়ী ব্যবহারের জন্য সঠিক সময়ে সেচ দিতে হবে। সঠিক সময়ে সেচ দেওয়ার জন্য দুইটি বিষয় বিবেচনা করতে হয়-
১. মাটিতে রসের অবস্থা মাটিতে রসের অবস্থা বুঝে জমিতে সেচ দিতে হবে। জমিতে রসের পরিমাণ জানার বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। সহজ একটি পদ্ধতি হলো হাতের সাহায্যে অনুভব করে মাটির রসের অবস্থা বুঝে সেচ দেওয়া। যে জমিতে সেচ দিতে হবে ঐ জমির একটি স্থানে গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তের গভীরতা ফসলের শিকড়ের গভীরতার তিন ভাগের দুই ভাগের সমপরিমাণ হবে। এবার গর্ভের তলা থেকে মাটি তুলে হাতের মুঠোয় নিয়ে চাপ দিয়ে গোলাকার বল তৈরি করতে হবে। যদি মাটি শুকনা ও ধুলা হয়, বল তৈরির সময় আঙুলের ফাঁক দিয়ে গুঁড়ো হয়ে বের হয়ে যায় বা বল তৈরি হলেও তা ফেলে দিলে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়, তাহলে জমিতে অতি সত্বর সেচ দিতে হবে । মাটি হাতের মুঠোয় নিয়ে চাপ দিলে দলা হবে কিন্তু ফেলে দিলে দলা ভাঙবে না, এমন অবস্থায় ১-২ দিন পর জমিতে সেচ দিতে হবে। মাটি হাতের মুঠোয় নিয়ে চাপ দিলে ভিজা দলা তৈরি হবে, হাতের তালু ভিজে যাবে এবং দলা ফেলে দিলে ভাঙবে না, এ অবস্থায় ৩-৪ দিন পর পুনরায় মাটির রস পরীক্ষা করতে হবে। আর যদি মাটি কাদাময় হয়, হাতে চাপ দিলে কাদা মাটি আঙুলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে, তালু ভিজে যায় কিন্তু পানি বেরিয়ে আসে না, এমতাবস্থায় সেচ দিতে হবে না। ৭ দিন পর জমি আবার পরীক্ষা করতে হবে।
২. ফসলের বৃদ্ধি পর্যায় : ফসলের শারীরতাত্ত্বিক বৃদ্ধির সকল পর্যায়ে সমানভাবে পানির প্রয়োজন হয় না। যে সকল পর্যায়ে মাটিতে পানি স্বল্পতায় ফসলের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় তাকে সেচের প্রতি সংবেদনশীল পর্যায় বলে। আর যেসব পর্যায়ে পানির অভাবে ফসলের ফলন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায় তাকে সংকটময় পর্যায় বলে
কাজ : শিক্ষার্থীরা বিষয় শিক্ষকের সহায়তায় জমিতে সাশ্রয়ীরূপে সেচ ব্যবহারে বিবেচ্য বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে পোস্টার তৈরি করবে।
কৃষি উপকরণ
৪৫
পাঠ ৭ : ভালো উন্নত বীজ নির্বাচন
বীজ একটি মৌলিক কৃষি উপকরণ। বীজের মাধ্যমে উদ্ভিদের বংশ বিস্তার ঘটে। উদ্ভিদ বিজ্ঞান অনুযায়ী নিষিক্ত ও পরিপক্ক ডিম্বককে বীজ বলে। আমরা জানি উদ্ভিদের অন্যান্য অঙ্গ ব্যবহার করেও বংশ বিস্তার সম্ভব । কৃষিতত্ত্ব এগুলোকেও বীজ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কৃষিবিদগণ এগুলোকে কৃষিতাত্ত্বিক বীজ বলেন আর নিষিক্ত পরিপক্ক ডিম্বককে বলা হয় সত্যিকার বীজ (True Sced) বা উদ্ভিদতাত্ত্বিক বীজ (Sexual Seed)। বীজের মাধ্যমে উদ্ভিদের জাতের গুণাগুণ পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত হয়। অঙ্গজ প্রজননে মাতৃ উদ্ভিদের অর্থাৎ যে উদ্ভিদের অঙ্গ ব্যবহার করা হলো তার গুণাগুণ পরবর্তী বংশধরে প্রকাশ ঘটতে পারে। অপর দিকে যৌন বীজে মাতা ও পিতা উদ্ভিদ উভয়ের গুণের একটি যৌক্তিক মিশ্রণ নিয়মানুসারে ঘটে। এ ক্ষেত্রে অসুবিধা এই যে স্বপরাগায়ন (Self fertilized) না হলে, মা গাছের সকল গুণাগুণ পরবর্তী প্রজন্মে নাও পাওয়া যেতে পারে। তবে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে দুইটি আলাদা জাতের (একই ফসলের) মধ্যে সংকরায়ণ (Hybridization) ঘটিয়ে তৃতীয় জাত তৈরি করা যায় যাতে মাতার কিছু এবং পিতার কিছু ভালো গুণের সমাহার ঘটতে পারে। এইভাবে বীজের বংশগতিগত (Genetic) উন্নয়ন সম্ভব, যাকে বলা হয় সংকরায়ণ।
কৃষক চাষাবাদের জন্য উন্নত গুণাগুণসম্পন্ন উচ্চ ফলনশীল জাতের উন্নত বীজ ব্যবহার করে লাভবান হতে চায়। কৃষি গবেষণা সংস্থাগুলো বীজ উন্নয়নের কাজ করে, বীজ প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ উন্নতজাতের বীজের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় এবং Bangladesh Agricultural Development Corporation (BADC) এর মতো রাষ্ট্রীয় কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন বিভিন্ন স্বীকৃত প্রতিনিধির মাধ্যমে কৃষকদের উন্নত বীজ সরবরাহ করে।
চলতি কোনো ফসলের জাতের প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কিছু কাঙ্ক্ষিত গুণের ভিত্তিতে ক্রমাগত বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও বীজের উন্নতি বা জাতের উন্নতি ঘটানো যেতে পারে। এই পদ্ধতিতে উন্নয়নকে বলা হয় চয়ন-প্রজনন (Selection Breeding)। পর্যবেক্ষণ ও বাছাই এখানে মূল কৌশল । সংকরায়ণের পরও বেশ কয়েক প্রজন্ম (Generation) পর্যবেক্ষণ ও বাছাই করা হয়
চাষি পর্যায়ে উন্নত বীজ নির্বাচনের আগে আরও কিছু বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়। যেমন-
• চাষির কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের জন্য ফসলের কোন কোন জাত উপযুক্ত ।
• ঐ জাতগুলোর মধ্যে কোনটি সবচেয়ে কম সময়ে ফলন দেয়।
ঐ জাতগুলোর মধ্যে কোনটি সবচেয়ে কম খরচে সবচেয়ে বেশি ফলন দিতে পারে।
কোন জাতটির রোগ-বালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক বেশি।
• কোন জাতটির মাঠ পরিচর্যা সহজতর।
কৃষিশিক্ষা
যদিও উচ্চ ফলনশীলতা উন্নত জাতের একটি বিশেষ গুণ। কিন্তু উন্নত জাতের বীজ হলেই উচ্চ ফলন পাওয়া নিশ্চিত হয় না, চাবির প্রয়োজন উন্নত জাতের ভালো বীজ ভালো বীজের আরও কিছু ভালো গুণ থাকা প্রয়োজন যেমন-
• মিশ্রণহীন বীজ
• অন্তত ৮০% অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা সম্পন্ন
• চারার উচ্চমানের সতেজতা
• পরিচাতা
• সুস্থ বীজ (রোগজীবাণুর দূষণ ও সংক্রমণমুক্তা)
সহজাতের ও বিশ্বাসযোগ্য পরীক্ষার মাধ্যমে বীজের উল্লিখিত গুণগুলো আছে কি না তা নির্ধারণ করা যায়। এই গুণগুলোর ঘাটতি থাকলেও যে কোনো বীজও উচ্চ ফলন দিতে ব্যর্থ হয়। তাই উন্নত ভালো বীজ নির্বাচন উচ্চ ফলন পাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। বীজের অঙ্কুরোদগম এবং চারার সতেজতা পরীক্ষা
চিত্র । ব্লাটার পরীক্ষা
চিন পেপার টাওয়েল
উপরের চিত্রের রটায় পরীক্ষা এবং পেপার টাওয়েল পরীক্ষার মাধ্যমে বীজের অঙ্কুরোদগম এবং চারার সতেজতা নির্ণয় করা যায়। রটার পরীক্ষায় একটি পেট্রিডিসের মধ্যে ব্লটিং পেপার বিছিয়ে পানি দিয়ে বীজ স্থাপন করে উপযুক্ত পরিবেশে রেখে বীজের অঙ্কুরোদগম পরীক্ষা করা হয়। একই ভাবে একটি ট্রের মধ্যে কয়েক স্তর নিউজ পেপার বিছিয়ে পানি দিয়ে ভিজিয়ে বীজ স্থাপন করে অঙ্কুরোদগম ঘটানো হয় । কয়েকদিন রেখে চারাগুলোর বৃদ্ধি পরীক্ষা করে বীজের তেজ বা চারার সতেজতা নির্ণয় করা যায়। অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা এবং চারার সতেজতা শতকরা হারে নির্ণয় করা
কৃষি উপকরণ
89
কাজ :শিক্ষার্থীরা উন্নত ও সুস্থ বীজ নির্বাচন, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ সম্পর্কে দলগতভাবে আলোচনা করে পোস্টার পেপারে লিখে উপস্থাপন করবে।
পাঠ-৮: বীজ সংরক্ষণ
উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে ভালো বীজও খারাপ হয়ে যেতে পারে। বাস্তবে সংরক্ষণ বিষয়টি সত্যিকারের বীজের ক্ষেত্রে বেশি প্রাসঙ্গিক। সঠিক কৌশলে বীজ সংরক্ষণ করলে ভালো বীজের যে গুণাগুণগুলো পূর্ববর্তী পাঠে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো অক্ষুণ্ণ রেখে কয়েক বছর ব্যবহার করা যায়।
উন্নত বীজ সংরক্ষণ কৌশল : বীজ ফসল (seed crop) নির্বাচন মাঠে থাকতেই শুরু করতে হয়। বীজ ফসল মাঠে থাকতেই সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে বীজ ফসলে রোগ সংক্রমণ না হয় এবং অন্য কোনো বালাই আক্রান্ত না হয়। পরিপক্ক হওয়া মাত্র এই বীজ সংগ্রহ করে ঝাড়া, বাছা ও শুকানো এমন যত্ন সহকারে করা উচিত যাতে আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। খোলা বাতাসে রৌদ্রে শুকানো যেতে পারে। প্রত্যেক ফসলের জন্য বীজ শুকানোর আলাদা মান থাকতে পারে। অর্থাৎ বীজের আর্দ্রতার নির্দিষ্ট নিরাপদ মাত্রা রয়েছে। ধান, গম বীজের জন্য এই আর্দ্রতার মাত্রা ১০-১২%, বীজ খুব বেশি শুকালে ভঙ্গুর হয়ে পড়তে পারে এবং বীজের ভ্রূণের ক্ষতি হতে পারে। আবার বীজ নিরাপদ আর্দ্রতার মাত্রার কম শুকালে সহজেই জীবাণু সংক্রমণ ঘটতে পারে এবং পোকার আক্রমণ ঘটতে পারে। তাছাড়া অতিরিক্ত আর্দ্রতার কারণে শ্বসন দ্রুত হওয়ায় দ্রুত বীজের সজীবতা (Viability) ও সতেজতা (Vigour) কমে যেতে পারে এবং গুদামে সংরক্ষণ অবস্থায় বীজ অঙ্কুরিত হয়ে যেতে পারে।
গুদামজাত বীজ কতটা এবং কত সময় ভালো থাকবে তার উপর আর্দ্রতা নিয়ামক প্রভাব রাখে। বীজের আর্দ্রতা ছাড়াও যে পাত্রে বীজ রাখা হবে তার অভ্যন্তরের এবং যে গুদামে বীজভরা পাত্রগুলো রাখা হবে তার অভ্যন্তরীণ আর্দ্রতাও প্রভাব রাখতে পারে। তবে যদি বীজ রাখার পাত্রটি এমন হয় যার ভিতরে বায়ু প্রবেশ করতে বা বের হতে না পারে তাহলে ভালো বীজ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে না ।
আর্দ্রতা ছাড়া যে সকল প্রভাবক বীজের ক্ষতি করতে পারে সেগুলো হলো উচ্চ তাপ, তীব্র রশ্মি ইত্যাদি। তবে বায়ুরোধক পাত্রে উপযুক্ত মাত্রায় শুকানো বীজ রাখলে এগুলোর প্রভাব তেমন পড়ে না তবু পাত্রে সংগৃহীত বীজ অন্ধকার শীতল জায়গায়, ইঁদুর, পোকামাকড়, এসবের উপদ্রব থেকে সুরক্ষিত স্থানে গুদামজাত করা উচিত। হিমাগারে বীজপাত্র রাখা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে কোল্ড স্টোরের ভিতর আলাদা এলাকা নির্দিষ্ট থাকা দরকার। সংরক্ষিত বীজের পরিমাণ কম হলে (যেমন- শাকসবজি, ফুলের বীজ) বীজের প্যাকেট বা কৌটার গায়ে পরিচয় লিখে রেফ্রিজারেটরে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়। সংরক্ষণের জন্য বীজ সংগ্রহের আগেই জেনে নিতে হবে। ঐ বীজ থেকে নতুন ফসল হবে কি না।
আরও দেখুন...