চিংড়ি মানুষের কাছে একটি আকর্ষণীয় খাদ্য। কিন্তু আহরণের পর খুব সহজেই এর খাদ্যমান নষ্ট হয়ে যায়। আর এ জন্য আহরণের পরপরই পচন রোধের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। সাধারণভাবে চিংড়ির পচন দুইটি কারণে ত্বরান্বিত হয়, যথা- সময় ও তাপমাত্রা। চিংড়ি আহরণের পর থেকে বাজারজাত বা প্রক্রিয়াজাতকরণের মধ্যবর্তী সময় যত বেশি হবে চিংড়ির পচন তত বেশি হবে। সে কারণে চিংড়ি আহরণের পরে পরিবহন ও বাজারজাতকরণে যত কম সময় ব্যয় হয় ততই চিংড়ি বেশি টাটকা বা তাজা থাকবে। সুতরাং চিংড়ি সংরক্ষণের মূলনীতি হলো এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা যার দ্বারা পচন সহায়ক কারণসমূহকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। চিংড়ির পচন রোধে নিম্নবর্ণিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা হয়।
ক) পরিচ্ছন্নতা: পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করার উদ্দেশ্য হলো আহরিত চিংড়ি যেন পচনশীল অন্য কোনো বস্তুর সংস্পর্শে এসে দুষিত না হয় এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ যেন চিংড়িকে কলুষিত করতে না পারে। আহরিত চিংড়ি অবতরণ কেন্দ্রে আনার সময় এদের খাদ্যনালী, দেহ গহবরে ও ফুলকায় প্রচুর ব্যাকটেরিয়া থাকে। এছাড়া শরীরের বাহিরাংশে শ্লেষ্মায়ও প্রচুর ব্যাকটেরিয়া থাকে। নড়াচড়া বা পরিচর্যাকালে ধুলাবালি, কাদা- ময়লা ও অপরিষ্কার পানি বা বরফ ইত্যাদির দ্বারা চিংড়ি কলুষিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, অর্থাৎ ত্রুটিপূর্ণ পরিচর্যা চিংড়ির পচনকে ত্বরান্বিত করে। সুতরাং চিংড়িকে উত্তমরূপে ধৌতকরণে এবং ফুলকা ও অগ্ন অপসারণের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ অনেকটা হ্রাস করা সম্ভব। সুতরাং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার মাধ্যমে মাছ বা চিংড়ির পচনকে অনেকটা কমানো যায়।
খ) ব্যাকটেরিয়ার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও কার্যকলাপ রহিতকরণ: এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন কৌশলে চিংড়ির দেহের বিদ্যমান ব্যাকটেরিয়ার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও কার্যকলাপকে থামিয়ে দিয়ে চিংড়িকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়। এই পদ্ধতিতে কৌশলসমূহ নিম্নরূপ-
পচন রোধে নিম্ন তাপের ব্যবহারঃ বরফ দিয়ে বা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চিংড়ির দেহের তাপমাত্রা হ্রাসের মাধ্যমে এনজাইম ও ব্যাকটেরিয়ার কার্যকারিতা ব্যাহত করা হয়। যেমন- শীতলীকরণ ও হিমায়িতকরণ।
আর্দ্রতা অপসারণের মাধ্যমে পচন রোধঃ এটি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে মাছের দেহের পানি অপসারণ বা কমিয়ে ফেলা হয়। এটা প্রাকৃতিকভাবে যেমন- সূর্যালাকে বা কৃত্রিম উপায়ে বা রাসায়নিক পদ্ধতিতে করা হয়। চিংড়ির শরীরের আর্দ্রতা এমন এক মাত্রায় কমানো হয় যেখানে ব্যাকটেরিয়া ও এনজাইমের কার্যকারিতা নিষ্ক্রিয় হয়। যেমন- লবণায়ন, শুষ্ককরণ বা শুটকিকরণ, ধূমায়িতকরণ ও নিরুদিকরণ প্রভৃতি পদ্ধতির মাধ্যমে চিংড়ির পচন রোধ করা যায়।
সংরক্ষক দ্রব্য প্রয়োগের মাধ্যমে পচন রোধঃ বিভিন্ন সংরক্ষক দ্রব্য প্রয়োগের মাধ্যমে চিংড়িকে পচনের হাত থেকে রক্ষা করা যায় বা সংরক্ষিত চিংড়ির সংরক্ষণ সময় দীর্ঘায়িত করা যায়। চিংড়ির সংরক্ষক হিসেবে ভিনেগার ও লবণ ব্যবহার করা হয়। তাজা বা হিমায়িত চিংড়ি সাধারণ তাপমাত্রায় এনে জীবাণুমুক্ত অবস্থায় সংরক্ষণ করা হয়। এ চিংড়িকে ৫-১০% অ্যাসিটিক অ্যাসিড ও ১০-১৫% লবণের দ্রবণে এক সপ্তাহ বা বেশি সময় ডুবিয়ে রাখা হয়। এ অবস্থায় চিংড়ির আমিষ জমাট বেঁধে যায়। এসব চিংড়ি তখন ১-২% অ্যাসিটিক অ্যাসিড ও ২-৪% লবণ দ্রবণে চূড়ান্তভাবে বোতলজাত করা হয়। এভাবে বোতলজাত চিংড়িকে ০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় কমপক্ষে ৩ মাস ভালো অবস্থায় সংরক্ষণ করা যায়।
গ) ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকরণের মাধ্যমে সংরক্ষণ: এই পদ্ধতিতে আহরিত মাছ বা চিংড়িকে পরবর্তীকালে ব্যবহারের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে গুণগতমান সম্পন্ন রাখার জন্য উচ্চ তাপমাত্রায় বায়ুরোধক পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়। এই পদ্ধতিকে টিনজাতকরণ পদ্ধতি বলা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট, মোল্ড সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয় এবং বায়ুরোধক পাত্রে রাখার কারণে নতুন করে কোনো প্রকার ব্যাকটেরিয়া প্রবেশের সুযোগ পায় না। এই প্রক্রিয়ায় সংরক্ষিত মাছ বা চিংড়ির স্বাভাবিক মৌলিক স্বাদের কিছুটা পরিবর্তন হলেও গুণাগুণের কোনো পরিবর্তন ঘটে না।
আরও দেখুন...