এই অধ্যায় শেষে শিক্ষার্থীরা নিচের বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে পারবে—
তুমি নিশ্চয়ই ক্ষুধা পেলে খাবার খাও। অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকলে দুর্বল বোধ করো। চারপাশে তাকালে দেখবে অন্য সব প্রাণীই খাবার খাচ্ছে। কখনো কি ভেবেছ উদ্ভিদের কথা? উদ্ভিদেরও কি খাবার দরকার হয়? তারা কীভাবে খাবার জোগাড় করে?
কেবল উদ্ভিদ বা প্রাণীই নয় প্রকৃতির সকল জীবের জীবন ধারণ এবং টিকে থাকার জন্য খাবার প্রয়োজন হয়। জীব এসব খাবার ভেঙে পুষ্টি উপাদান তার কোষের ব্যবহার উপযোগী করে তোলে।যেকোনো জীবের বেঁচে থাকা এবং বৃদ্ধির জন্য পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন। সরল জীব, যেমন—এককোষী। ব্যাকটেরিয়া, ঈস্ট, কিংবা ছত্রাক পরিবেশ থেকে প্রায় সরাসরি পুষ্টির উপাদান গ্রহণ করে। অপর দিকে জটিল জীব, যেমন—বড় উদ্ভিদ কিংবা মানুষ বিশদ পদ্ধতিতে পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ ও ব্যবহার করে।
তবে সবার ক্ষেত্রেই একটি কথা প্রযোজ্য সকল জীবই তার পুষ্টির প্রয়োজন মেটানোর জন্য তার পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। এই বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে জীবকে মূলত দুটো ভাগে ভাগ করা যায়—স্বভোজী (অটোট্রফিক, Autotrophic) এবং পরভোজী (হেটারোট্রফিক Heterotrophic) জীব। যেসব জীব পরিবেশ থেকে কার্বন, পানি ইত্যাদি সংগ্রহ করে তাদের খাবার তৈরি করে নিতে পারে তাদেরকে বলা হয় স্বভোজী জীব। যেমন- বিভিন্ন অণুজীব, সবুজ শৈবাল, উদ্ভিদ ইত্যাদি।
অপরদিকে যেসব জীব পরিবেশের অন্যান্য জীব থেকে খাবার (অর্থাৎ বিভিন্ন জৈব উপাদান, যেমন— আমিষ বা প্রোটিন, লিপিড বা স্নেহ, কার্বহাইড্রেট বা শর্করা) সংগ্রহ করে তাদেরকে পরভোজী জীব বলা হয়। যেমন বিভিন্ন প্রাণী মানুষ, বাঘ, মুরগি ইত্যাদি। এ তো গেল কীভাবে কার্বনসমৃদ্ধ জৈব উপাদান তৈরি করছে সেই বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে জীবের শ্রেণিবিভাগ। কিন্তু আবার যদি আমরা দেখি, জীব কিভাবে পরিবেশ থেকে শক্তি (Energy) সংগ্রহ করে তবে সেই বিবেচনায়ও জীবকে মূলত দুই ভাগে শ্রেণিবিভাগ করা যায়। এবার আমরা সেই সম্বন্ধে ान। পৃথিবীর সকল শক্তির উৎস হচ্ছে সূর্য যা আমাদের আলোকশক্তি প্রদান করে। এই আলোকশক্তিই আবার নানান প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানে সঞ্চিত হয়।
শক্তির প্রাথমিক উৎস হিসেবে কিছু জীব সূর্যের আলোকে সরাসরি ব্যবহার করে এবং জটিল জৈব অণু (শর্করা) তৈরি করে। এদেরকে বলা হয় ফটোট্রপিক বা সালোকপোষিত জীব। যেমন- সবুজ উদ্ভিদ ও সবুজ শৈবাল, সায়ানোব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি। এরা সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে সালোকসংশ্লেষণ বা ফটোসিনথেসিস প্রক্রিয়ায় শর্করা তৈরি করে।
অপরদিকে কিছু জীব রাসায়নিক পদার্থকে শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করে। এদেরকে বলা হয় কেমোট্রপিক বা রাসায়নিকপোষিত জীব। বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক এই ধরনের জীবনের অন্তর্ভুক্ত। আমরা মানুষও কিন্তু কেমোট্রপিক জীব। কারণ, আমরাও সূর্যের আলো কাজে লাগিয়ে সরাসরি খাবার উৎপাদন করতে পারি না। আমরা উদ্ভিদ কিংবা অন্য জীব থেকে পাওয়া উপাদান খেয়ে আমাদের শক্তির চাহিদা মেটাই।
এতক্ষণ পর্যন্ত মূলত আমরা কার্বন, হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন এই তিনটি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত পুষ্টি উপাদান নিয়েই কথা বলেছি। তবে এগুলোর বাইরে আরও কিছু রাসায়নিক উপকরণ জীবের বৃদ্ধি ও বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন হয়। যেমন—নাইট্রোজেন, ফসফরাস, খনিজ লবণ (পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, আয়রন, জিঙ্ক, কপার, ম্যাঙ্গানিজ ইত্যাদি)।
অণুজীবে পুষ্টি উপাদান পরিশোষণ
এককোষী অণুজীবগুলো কর্তৃক তাদের পুষ্টি উপাদান পরিশোষণ সরল প্রকৃতির হয়। তাদের কোষটি সরাসরি পুষ্টি উপাদানের সান্নিধ্যে থাকে, যা তাদের পুষ্টিপ্রাপ্তিকে তুলনামূলকভাবে সহজ করে তোলে। অনেক সময় পুষ্টি উপাদান পরিবেশ থেকে সরাসরি কোষঝিরি ভেদ করে অণুজীবের কোষের ভেতরে প্রবেশ করে। আবার কখনো কখনো পুষ্টি উপাদানকে পরিবেশ থেকে কোষের ভেতরে নেওয়ার জন্য কোষঝিল্লির কিছু বাহুক সহযোগিতা করে।
এককোষী অণুজীবের উপরোক্ত পুষ্টি গ্রহণ প্রক্রিয়াগুলোই মূলনীতি হিসেবে বহুকোষী বড় উদ্ভিদ ও প্রাণীর ক্ষেত্রে কাজ করে।
আমরা সাধারণত উদ্ভিদ বলতেই স্বভোজী জীব বলে মনে করি। অর্থাৎ তারা নিজেদের খাবার নিজেরাই তৈরি করে। আসলে কিন্তু ব্যাপারটা পুরো সত্যি নয়। অনেক উদ্ভিদ আছে যারা তাদের পুষ্টি সংগ্রহের জন্য অপর উদ্ভিদের ওপর নির্ভর করে। যেমন—স্বর্ণলতা, এর কোনো ক্লোরোফিল নেই। ক্লোরোফিল হলো একধরনের সবুজ কণা যার মাধ্যমে উদ্ভিদ খাদ্য তৈরি করতে পারে। স্বর্ণলতায় ক্লোরোফিল থাকার ফলে তারা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় নিজেরা কোনো খাবার তৈরি করতে পারে না। তাদের পুষ্টি উপাদানের জন্য তারা অপর উদ্ভিদের ওপর নির্ভর করে। আবার কোনো উদ্ভিদ আছে যারা কীট- পতঙ্গ থেকেও পুষ্টি সংগ্রহ করে- এদেরকে পতঙ্গভুক উদ্ভিদ বলে। তবে তারা নিজেরাও নিজেদের খাদ্য। উৎপাদন করতে পারে।
উৎস স্থান থেকে উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশে পুষ্টির উপাদানাগুলো পরিবহণ করার জন্য উদ্ভিদের ক্ষেে নির্দিষ্ট কোষ এবং টিস্যু থাকে যারা পুষ্টি পরিবহণের এই কাজগুলোতে নিযুক্ত থাকে। এদেরকে বলা হয় জাইলেম ও ফ্লোয়েম টিস্যু। আমরা আগেও এগুলোর কথা জেনেছি । এই টিস্যুগুলোকে উদ্ভিদের দেহের ভেতরে থাকা কিছু সুনির্দিষ্ট পথের সঙ্গে তুলনা করা যায় যাদের মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট উপাদানগুলো চলাচল করে। মাটি থেকে মূলের মাধ্যমে পানি এবং পানিতে দ্রবীভূত খনিজ উপাদান শোষণ করে তা পরিবহণ করার কাজটি করে জাইলেম টিস্যু। অপরদিকে উদ্ভিদের সবুজ পাতায় তৈরি হওয়া পুষ্টি উপাদান (যেমন-শর্করা) উদ্ভিদের অন্যান্য অংশে পৌঁছে দেওয়ার পথটি হচ্ছে ফ্লোয়েম টিস্যু দিয়ে তৈরি।।
উদ্ভিদের পরিবহণে সহযোগিতার পাশাপাশি জাইলেম ও ফ্লোয়েম উদ্ভিদকে দৃঢ়তাও প্রদান করে। আণুবীক্ষণিকভাবে জাইলেম টিস্যুকে ঘিরে ফ্লোয়েম টিস্যুর অবস্থান দেখা যায়।
উদ্ভিদ ও প্রাণীর অন্যতম বড় পার্থক্য হচ্ছে তাদের খাদ্য ও পুষ্টি ব্যবস্থাপনায়। কোনো প্রাণীই নিজের কোষের ভেতর খাদ্য তৈরি করতে পারে না। ফলে খাদ্যের জন্য প্রাণীকে উদ্ভিদ বা অন্য কোনো জীব বা অণুজীবের ওপর নির্ভর করতে হয়। আমরা যখন শাকসবজি, ভাত, মাংস, মাছ ইত্যাদি খাই, তখন আমরা আসলে পুষ্টি উপাদান যেমন— শর্করা, আমিষ, স্নেহ ইত্যাদি গ্রহণ করি। এর বাইরে আমাদের খনিজ উপাদান যেমন-ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, ভিটামিন ইত্যাদিও প্রয়োজন হয়।
এসব উপাদানও আমরা আমাদের গ্রহণ করা বিভিন্ন খাবার থেকে পাই।
এর আগে আমরা দেখেছি উদ্ভিদের ক্ষেত্রে তার পুষ্টি উপাদান পরিশোষণ ও পরিবহণের জন্য বিশেষ টিস্যু রয়েছে। প্রাণীর ক্ষেত্রেও তার পুষ্টি গ্রহণ ও পরিশোষণের বিষয়টি নির্দিষ্ট কোষ, টিস্যু এবং অঙ্গের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। যেমন- মানুষের ক্ষেত্রে পরিপাকতন্ত্র রয়েছে। এই পরিপাকতন্ত্র জটিল খাদ্য ভেঙে কোষের ব্যবহার উপযোগী পুষ্টি উপাদানে পরিণত করে যা রক্তে শোষিত হয়ে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
খাদ্য পরিপাকের বিষয়টি শুরু হয় আমাদের মুখ থেকে। আমরা যখন ভাত, রুটি বা মাছ খাই, তখন আমাদের দাঁতের মাধ্যমে সেগুলোকে ছোট ছোট টুকরা করি, আমাদের জিহ্বার নিচে অবস্থিত লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালা আমাদের খাবার পরিপাকে সহযোগিতা করে। এরপর খাবার আমাদের পাকস্থলিতে যায়। সেখানকার বিশেষ পরিবেশে খাদ্যাকে আরও ভালোভাবে পরিপাক করে। এসব ধাপ শেষে আমাদের গ্রহণ করা খাবার ভেঙে ছোট ছোট জৈব অণুতে পরিণত হয়। এই পাকস্থলি এবং তার পরের ক্ষুদ্রান্ত ও বৃহদন্ত্রে বিশেষ পরিশোষক কোষ আছে যেগুলো পরিপাক করা খাবার থেকে ওই সব ছোট ছোট পুষ্টি উপাদান শোষণ করে রক্তের মাধ্যমে পুরো শরীরে বরো নিয়ে যায়।
অনুশীলনী
১। পৃথিবীতে কোনো অণুজীব যদি না থাকত, মানুষের পুষ্টি গ্রহণ বা বিপাক ক্রিয়ায় কোনো সমস্যা হতো কি?
আরও দেখুন...