পঞ্চম অধ্যায়
দেব-দেবী ও পূজা
দেব-দেবী, পূজা, পুজার উপকরণ ইত্যাদি সম্পর্কে অন্যান্য শ্রেণিতে আমাদের কিছুটা ধারণা হয়েছে। এ অধ্যায়ে আমরা পূজা, পুরোহিতের ধারণা ও যোগ্যতা, দেবী দুর্গা, কালী, শীতলা ও কার্তিকের পূজা নিয়ে আলোচনা করব। দেবী দুর্গা ঐশ্বরিক মাতা যিনি সকল দুঃখ-দুর্দশা দূর করে আমাদের পারিবারিক এবং সমাজ জীবনে সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন । দেবী কালী ঐশ্বরিক মহাশক্তি ও ত্রাণকর্ত্রীরূপে যে-কোনো ধরনের দুর্যোগের সময় আমাদের মাঝে আবির্ভূত হন। দেবী শীতলা লৌকিক দেবী হলেও গ্রাম বাংলায় তিনি ঠাকুরানি নামে পরিচিত। তিনি শান্তির দেবী হিসেবে সকলের কাছে অতি পরিচিত । কার্তিক ভগবান শিবের পুত্র এবং দেব সেনাপতি । হিন্দুধর্মাবলম্বীরা তাঁকে রক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে পূজা করে থাকেন। এ অধ্যায়ে উল্লিখিত দেব-দেবীর পরিচয়, পূজা পদ্ধতি, প্রণাম মন্ত্র ও সমাজ জীবনে এ সকল পূজার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব ।
এ অধ্যায় শেষে আমরা
পাঠ ১ : পূজা ও পুরোহিত
‘পূজা' শব্দের অর্থ প্রশংসা বা শ্রদ্ধা জানানো, যা পুষ্প কর্মের মধ্য দিয়ে অর্চনা বা উপাসনার মাধ্যমে করা হয় । হিন্দুধর্মে 'পূজা' শব্দটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয় । ঈশ্বরের প্রতীক বা তাঁর কোনো রূপকে (দেব-দেবী) সন্তুষ্ট করার জন্য ভক্তি সহকারে ফুল, দূর্বা, তুলসী পাতা, বিশ্বপত্র, চন্দন, আতপচাল, ধূপ, দীপ প্রভৃতি উপকরণ দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে পূজা করা হয় । পূজার উদ্দেশ্য হচ্ছে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে বা দেব- দেবীদের কাছে মাথা নত করা এবং তাঁদের সান্নিধ্য লাভের প্রয়াস। আমরা জানি, দেব-দেবীরা ঈশ্বরের গুণ বা শক্তির প্রকাশ। তাই দেব- দেবীদের সন্তুষ্ট করার জন্য যে অনুষ্ঠানাদি করা হয় তাকে ‘পূজা' বলে ।
পুরোহিত
পুরোহিত শব্দটি ‘পুরস্' (পুরঃ) এবং 'হিত' শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। পুরস্ শব্দের অর্থ সম্মুখে এবং হিত শব্দের অর্থ অবস্থান। সম্মুখভাগে যিনি অবস্থান করেন তিনি পুরোহিত। সাধারণ অর্থে পুরোহিত বলতে পূজা-অৰ্চনা কার্যাদি সম্পাদনকারীকে বোঝানো হয় এবং যিনি পূজার সময় সকলের অগ্রভাগে অবস্থান করেন। সাধারণভাবে
যিনি পূজা-অর্চনার অনুষ্ঠান পরিচালনায় প্রধান ভূমিকা পালন করেন এবং পূজার সময় সকলের অগ্রভাগে থাকেন, তাঁকে পুরোহিত বলে। এটা একটা পেশাও বটে । যার নামে সংকল্প করে পূজা করা হয় তাকে যজমান বলে । যজমান নিজেও পূজা করতে পারেন। তবে সাধারণত যজমান পুরোহিতকে পূজা করে দেয়ার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ করে আনেন । সাধারণত ব্রাহ্মণ বর্ণের লোকেরাই পৌরোহিত্য করে থাকেন। তবে পুরোহিত ও ব্রাহ্মণ এক কথা নয় । ব্রাহ্মণ বলতে যাঁদের ব্রহ্মবিদ্যা সম্পর্কে
সম্যক জ্ঞান ও ধারণা আছে বা যিনি ব্রহ্মবিদ, এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়। পৌরোহিত্য করার সময় সংস্কৃত ভাষাজ্ঞান ও শাস্ত্রজ্ঞান থাকা প্রয়োজন। যাঁরা অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, যজন যাজন করতেন, তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের। তাই পৌরোহিত্য ব্রাহ্মণ বর্ণেরই পেশা ছিল । একালে সংস্কৃত ভাষাজ্ঞান এবং শাস্ত্রজ্ঞান সকল বর্ণের মধ্যেই দেখা যায়। সুতরাং একালে সংস্কৃত ভাষা ও শাস্ত্রে অভিজ্ঞ এবং ধর্মনিষ্ঠ যেকোনো বর্ণের ব্যক্তিই পৌরোহিত্য করার যোগ্য। পুরোহিতের নিম্নলিখিত গুণাবলি থাকা প্রয়োজন :
পুরোহিতের গুণাবলি
পুরোহিত একজন সম্মানিত ব্যক্তি । তিনি পারিবারিক ও সামাজিক পূজা-অর্চনাদি পরিচালনা করে থাকেন। এ কারণেই তাঁকে নিম্নবর্ণিত গুণের অধিকারী হতে হয়-
১. হিন্দুধর্মাবলম্বী যে-কোনো বর্ণের মানুষের পৌরোহিত্য করার সামর্থ্য
২. সংস্কৃত ভাষা লেখা ও পড়ার মতো জ্ঞান ও দক্ষতা
৩. হিন্দুধর্ম সম্পর্কে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান
8. নিত্যকর্ম ও পূজাবিধি সম্পর্কে তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক জ্ঞান ও ধারণা
৫. ধর্মশাস্ত্রে এবং শাস্ত্রীয় রীতি-নীতি ও প্রথার উপর অভিজ্ঞতা
৬. সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মানুরাগী, প্রগতিশীল ও জনসাধারণের প্রতি মমত্ববোধ
৭. শুদ্ধভাবে মন্ত্র উচ্চারণের দক্ষতা
৮. বিভিন্ন পূজা ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, নিয়ম-নীতি সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা
৯. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
১০. আচরণগত দিক থেকে ধৈর্যশীল, সৎ, ন্যায়পরায়ণ এবং কথা ও কাজের সমন্বয়
১১. শিষ্টাচারসম্পন্ন ও আদর্শ ব্যক্তিত্বের অধিকারী
পাঠ ২ : দেব-দেবীর ধারণা
ঈশ্বর সীমাহীন গুণ ও ক্ষমতার অধিকারী । তিনি যখন নিজের কোনো গুণ বা ক্ষমতাকে কোনো বিশেষ আকার বা রূপে প্রকাশ করেন, তখন তাঁকে দেবতা বলে। দেবতারা আলাদা গুণ বা শক্তির অধিকারী হলেও ঈশ্বর নন । ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় । দেবতারা এক ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণ বা শক্তির প্রকাশ । ঋগ্বেদের একটি মন্ত্রে বলা হয়েছে-
‘একং সদ বিপ্রা বহুধা বদন্তি ।'
অর্থাৎ এক, অখণ্ড ও চিরন্তন ব্রহ্মকে বিপ্রগণ ও জ্ঞানীরা বহু নামে বর্ণনা করেছেন । দেবতাদের বিভিন্ন গুণ বা ক্ষমতার জন্য তাঁদের পূজা করা হয় । পূজার মাধ্যমে তাঁরা খুশি হন। মানুষ দেবতাদের কৃপা লাভ এবং সুখ-শান্তিতে বসবাস করার জন্য পূজা করে । দেবতাদের পূজা করলে ঈশ্বর সন্তুষ্ট হন এবং অভীষ্ট দান করেন।
দেব, দেৰী ৰা দেবতা শব্দ 'দি' ধাতু থেকে উৎপন্ন হয়েছে। দিবৃ + অ = দেব। স্ত্রীলিঙ্গে দেবী বলা হয় । দির্ ধাতুর অর্থ প্রকাশ পাওয়া । তাই বলা হয়েছে, যিনি প্রকাশ পান, যিনি ভাস্বর, তিনি দেবতা। দেব-দেবী ও দেবতা একই অর্থে ব্যবহৃত হয় । যিনি দান করেন তিনি দেবতা। আবার যিনি নিজে প্রকাশ পেয়ে অন্যকে প্রকাশ করেন তিনিও দেবতা । পুরাণে ধ্যানলব্ধ দেবতাদের বিগ্রহ বা প্রতিমা নির্মাণ করে পুজা করার বিধান উল্লিখিত হয়েছে । কিন্তু বেদে দেবতাদের দেহ মন্ত্রময় ।
দেবতাদের শ্রেণিবিভাগ
হিন্দুধর্মাবলম্বীদের আদি ধর্মগ্রন্থ বেদ। বেদের ওপর ভিত্তি করে 'পুরাণ' গ্রন্থসমূহ রচিত হয়েছে। বেদ ও পুরাণে বিভিন্ন দেব-দেবীর রূপ, শক্তি, প্রভাব, সামাজিক গুরুত্ব এবং পূজা-প্রণালি বর্ণনা করা হয়েছে। হিন্দুধর্ম গ্রন্থের উপর ভিত্তি করে দেব-দেবীদের নিম্নলিখিত ভাগ করা হয়েছে-
১. বৈদিক দেবতা
২. পৌরাণিক দেবতা এবং ৩. লৌকিক দেবতা ।
ক. বৈদিক দেবতা : বেদে যে-সকল দেবতার কথা বলা হয়েছে, তাঁদেরকে বৈদিক দেবতা বলা হয়। যেমন- অগ্নি, ইন্দ্র, মিত্র, রুদ্র, বরুণ, বায়ু, সোম প্রভৃতি। বৈদিক দেবী হিসেবে সরস্বতী, ঊষা, অদিতি, রাত্রির নাম উল্লেখ করা যায় । বৈদিক দেব-দেবীর কোনো বিগ্রহ বা মূর্তি ছিল না। তবে বৈদিক মন্ত্রে সকল দেবতার রূপ, গুণ ও ক্ষমতার বর্ণনা করা হয়েছে। বৈদিক পূজাপদ্ধতি ছিল যোগ বা হোম ভিত্তিক । বৈদিক উপাসনা রীতিতে প্রতিমা পূজা ছিল না। হোমানল বা অগ্নির মাধ্যমে বেদের মন্ত্র উচ্চারণ করে অন্যান্য দেবতাকে আহ্বান করা হতো। অগ্নিকে বলা হয়েছে- তিনি যজ্ঞের পুরোহিত, দীপ্তিময়, দেবগণের আহ্বানকারী ঋত্বিক।
যজ্ঞের জন্য প্রজ্বলিত অগ্নিতে বিভিন্ন দেবতার জন্য ধৃত, পিঠা, পায়েস, প্রভৃতি অর্পণ করা হতো । বৈদিক ঋষিরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কর্মকাণ্ডকে একটি বৃহৎ যজ্ঞ বলে মনে করতেন। তাই তাঁদের যজ্ঞকর্ম বিশ্বষজ্ঞের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এ সময় যজ্ঞই ছিল প্রধান ধর্মকর্ম । যজ্ঞের মাধ্যমে বৈদিক ঋষিরা দেব-দেবীর সান্নিধ্য লাভ করতেন।
খ. গৌরাণিক দেবতা : পুরাণে যে-সকল দেবতার বর্ণনা করা হয়েছে, তাঁদের পৌরাণিক দেবতা বলা হয় । যেমন, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, দুর্গা, সরস্বতী প্রভৃতি ।
পৌরাণিক যুগে বৈদিক দেবতাদের অনেকেরই রূপের পরিবর্তন ঘটেছে এবং অনেক নতুন দেবতার আবির্ভাব ঘটেছে। বেদে উল্লিখিত বিষ্ণুকে পুরাণে দেখা যায় শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারীরূপে। কিন্তু বেদে বিষ্ণুর
আকৃতি ও প্রকৃতি মন্ত্রময় প্রাকৃতিক শক্তি মাত্র । বেদের বিষ্ণু মূলত সূর্য ।
গ. লৌকিক দেবতা : বেদে ও পুরাণে যে সকল দেবতার কথা বলা হয় নি, কিন্তু ভক্তগণ তাঁদের পূজা করেন, তাঁদের বলা হয় লৌকিক দেবতা। যেমন- মনসা, শীতলা, দক্ষিণ রায় প্রভৃতি। পরবর্তীকালে মনসা দেবীসহ আরও অনেক লৌকিক দেবতা পুরাণে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। দেব-দেবীর পূজা
সকল দেব-দেবীর পূজা একই সময় করা হয় না। অনেক দেব-দেবীর জন্য নির্দিষ্ট মাস, সময়, ভিখি রয়েছে। যেমন বিষ্ণু, শিব, লক্ষ্মীর পূজা প্রতিদিনই করা হয় । আবার ব্রহ্মা, কার্ত্তিক, সরস্বতী প্রভৃতি দেব- দেবীর পূজা বিশেষ বিশেষ তিথিতে করা হয় । সামাজিক অংশগ্রহণগত দিক থেকে পূজা দুইভাবে করা হয়- পারিবারিক পূজা ও সর্বজনীন পূজা। পারিবারিক সদস্যদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে যে পূজা করা হয় তাকে পারিবারিক পূজা বলে। সমাজের সকল মানুষের অংশগ্রহণে যে পূজা করা হয় তাকে সর্বজনীন পূজা বলে। মূলত সর্বজনীন পূজা উদযাপনের মাধ্যমে উৎসবের সৃষ্টি হয় ।
পাঠ ৩ : দেবী দুর্গা : দেবী দুর্গার পরিচয় ও রূপ
দেবী দুর্গা ঈশ্বরের শক্তির প্রতীক। তিনি অদ্যাশক্তি মহামায়া অর্থাৎ মহাজাগতিক শক্তি। তিনি জয়দুর্গা, জলন্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বনদুর্গা, চণ্ডী, নারায়ণী প্রভৃতি নামেও পূজিতা হন ।
দুর্গা নামের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ
দুঃ – গম্ + অ = দুর্গ। যে স্থানে গমন করা অত্যন্ত দুরূহ তাকে দুর্গ বলে। দুর্গ শব্দের সঙ্গে আ প্রত্যয় যোগ করে দুর্গা শব্দটি গঠন করা হয়েছে এবং স্ত্রীলিঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে । যিনি মহামায়া তিনি দুরধিগম্য - তাঁকে দুঃসাধ্য সাধনার দ্বারা পাওয়া যায়। তাই তিনি দুর্গা। তিনি ব্রহ্মের শক্তি বলেও দুরধিগম্য এবং সাধন সাপেক্ষ । আবার দুর্গম নামক অসূরকে বধ করেছেন বলেও তাঁকে দুর্গা বলা হয়। দুর্গা শব্দের আরেকটি অর্থ হলো দুর্গতিনাশিনী দেবী অর্থাৎ এ মহাবিশ্বের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট বিনাশকারিণী দেবী ।
একবার মহিষাসুর দেবরাজ ইন্দ্রের কাছ থেকে স্বর্গরাজ্য কেড়ে নিয়েছিল। তখন দেবতাদের সম্মিলিত তেজ থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন দেবী দুর্গা । দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। এজন্য দেবী দুর্গাকে মহিষমর্দিনী বলা হয় । হিন্দুরা প্রাচীনকাল থেকেই ভক্তিভরে তাঁর পূজা করে আসছে। দুর্গা পূজায় ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির জনসাধারণ নানাভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে । এ কারণেই দুর্গা পূজা হিন্দু সমাজে সর্ববৃহৎ উৎসব হিসেবে বিবেচিত ।
দেবী দুর্গার রূপ
দেবী দুর্গা দশভূজা । তাঁর দশটি ভুজ বা হাত বলেই তাঁর এই নাম। তাঁর দশটি হাত তিনটি চোখ রয়েছে। এ জন্য তাঁকে ত্রিনয়না বলা হয় । তাঁর বাম চোখ চন্দ্র, ডান চোখ সূর্য এবং কেন্দ্রীয় বা কপালের উপর অবস্থিত চোখ - জ্ঞান বা অগ্নিকে নির্দেশ করে। তাঁর দশ হাতে দশটি অস্ত্র রয়েছে যা শক্তির প্রতীক এবং শক্তিধর প্রাণী সিংহ তাঁর বাহন ।
সিংহ শক্তির ধারক । দেবী হিসেবে দুর্গার গায়ের রং অতসী ফুলের মতো সোনালি হলুদ । তিনি তাঁর দশ হাত দিয়ে দশদিক থেকে সকল অকল্যাণ দূর করেন এবং আমাদের কল্যাণ করেন। দেবী দুর্গার ডানদিকের পাঁচ হাতের অস্ত্রগুলো যথাক্রমে ত্রিশূল, খড়গ, চক্র, বাণ ও শক্তি। বামদিকের পাঁচ হাতের অস্ত্রগুলো হলো খেটক (ঢাল), পূর্ণচাপ (ধনুক), পাশ, অঙ্কুশ, ঘণ্টা, পরশু (কুঠার)। এ সকল অস্ত্র দেবী দুর্গার অসীম শক্তি ও গুণের প্রতীক ।
পাঠ ৪ : দুর্গাপূজা পদ্ধতি
উৎসবের সময় ও পুজার উপকরণ
দুর্গাপূজা বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব । বছরে দু'বার দুর্গোৎসবের প্রথা রয়েছে। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে শারদীয় এবং চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে বাসন্তী দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলায় মহালয়া উদ্যাপনের মাধ্যমে দেবীদুর্গার আগমনী ঘোষিত হয় । আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে প্রতিমা স্থাপন করে শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হয় এবং পাঁচ দিনব্যাপী চলতে থাকে । দশম দিনে দশমী পূজার মাধ্যমে শারদীয় উৎসবের সমাপ্তি ঘটে । কোনো কোনো স্থানে আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের প্রতিপদ তিথি থেকে দুর্গাপূজা শুরু করা হয় । তবে ষষ্ঠী তিথি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্গাপূজা শুরু করার রীতিই অধিক অনুসৃত ।
তিথি অনুসারে দুর্গাপূজার সময়কে নিম্নরূপে শ্রেণিবিভাগ করা হয়
প্রথম দিন : দুর্গার ষষ্ঠী-বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস;
দ্বিতীয় দিন : মহাসপ্তমী পূজা- নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপন, সপ্তম্যাদিকল্পারম্ভ, সপ্তমীবিহিত পূজা; তৃতীয় দিন : মহাষ্টমী পূজা, কুমারী পূজা, সন্ধিপূজা; চতুর্থ দিন : নবমীবিহিত পূজা; পঞ্চম দিন : দশমীপূজা,
বিসর্জন ও বিজয়া দশমী ।
বৃহৎ নন্দিকেশ্বর পুরাণ, দেবী পুরাণ ও কালিকা পুরাণে দুর্গাপূজার পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। দুর্গাপূজায়
বহু উপকরণ ব্যবহার করা হয় ।
পাঠ ৫ : দুর্গাপূজা পদ্ধতি : ষষ্ঠী ও সপ্তমী পূজা
ষষ্ঠীপূজা
মহালয়া অমাবস্যার পরে শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে ষষ্ঠী পূজার আয়োজনের মাধ্যমে দুর্গাপূজা শুরু হয়। সুষ্ঠুভাবে পূজা উদযাপন করার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার সংকল্প করা হয় । সন্ধ্যাকালে বোধন, তারপর অধিবাস ও আমন্ত্রণ অনুষ্ঠিত হয় ।
সপ্তমীপূজা
ষষ্ঠীর পর আসে মহাসপ্তমী । এ তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তমীবিহিত পূজা। মন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গাসহ সকল প্রতিমার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হয়। নানা উপকরণে ফুল, বেলপাতা, নৈবেদ্য, বস্ত্রাদি সাজিয়ে দেবীকে পূজা করা হয় । এদিনের পূজায় নবপত্রিকা প্রতিষ্ঠা অন্যতম ।
নবপত্রিক মূলত নয়টি গাছের সমাহার । এগুলো হলো—কদলী (কলা), দাড়িম্ব (ডালিম), ধান্য (ধান), হরিদ্রা (হলুদ), মানক (মানকচু), কচু, বিল্ব (বেল), অশোক এবং জয়ন্তী । একটি কলাগাছের সঙ্গে অন্য গাছের চারা বেঁধে দেয়া হয় । তারপর একটি শাড়ি কাপড় পরানো হয়। একে বলা হয় কলাবৌ । নবপত্রিকার মধ্যে দেবী দুর্গা নয়টি ভিন্ননামে অধিষ্ঠিত । মূলত নবপত্রিকা পূজার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের জীবনদায়ী
বৃক্ষকে পূজা করি। বৃক্ষকে সংরক্ষণ করি । আর এই বৃক্ষের মধ্যে আছে ঈশ্বরের শক্তি, দেবীর শক্তি। নবপত্রিকার মধ্য দিয়ে আমরা দেবী দুর্গাকেই পূজা করি। দেবীদুর্গাকে নির্দিষ্ট প্রণামমন্ত্রে প্রণাম করা হয়। প্রশम -
ওঁ সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে ।
শরণ্যে ত্র্যম্বক গৌরি নারায়ণি নমোহস্তুতে ॥ (শ্রীশ্রীচণ্ডী, ১১/১০/১১)
বাংলা অর্থ : হে দেবী সর্বমঙ্গলা, শিবা, সর্বার্থ সাধিকা, শরণযোগ্যা, গৌরি, ত্রিনয়না, নারায়ণি- তোমাকে নমস্কার ।
প্রণাম মন্ত্রের শিক্ষা
দেবী দুর্গা বিভিন্নরূপে আবির্ভূত হয়ে থাকেন এবং আমাদের মঙ্গল নিশ্চিত করেন। তাই তিনি সর্বমঙ্গলা । তিনি শিবা অর্থাৎ মঙ্গলময়ী। শিবের শক্তি বলেও তিনি শিবা। তিনি সকল প্রার্থনা পূরণ করেন, তাঁর অসাধ্য কিছুই নেই। তিনি শরণ্য। তিনি গৌরী। তাঁর কাছে শক্তি প্রার্থনা করে আমরাও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াব এবং নিজের ও সমাজের জন্য মঙ্গলজনক কাজ করব। দুর্গাপুজার প্রণামমন্ত্র আমাদের এ শিক্ষাই দেয়।
পাঠ ৬ ও ৭ : মহা অষ্টমী পূজা ও কুমারী পূজা
শারদীয় দুর্গা উৎসবে অষ্টমী পূজা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পূজা। এ দিনে দেৰী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করে বিজয় লাভ করেছিলেন। এ পূজার দিনে ভক্তবৃন্দ বিধিসম্মতভাবে অষ্টমীবিহিত পূজা করে দেবী দুর্গার কৃপা প্রার্থনা করেন। পূজার শেষে পূজারীগণ দেবীর উদ্দেশে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করে ।
কুমারী পুজা
অষ্টমী পূজার দিন কুমারী পূজা করা হয়। আমাদের দেশে কেবল রামকৃষ্ণ মঠে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয় । পশ্চিমবঙ্গেও প্রধানত রামকৃষ্ণ মিঠে কুমারী পূজা হয়। নারীকে মাতৃরূপে ঈশ্বরীরূপে ভাবনা হিন্দুসাধনা-পুজার একটা বড় দিক। কুমারীর মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গারই পুজা করা হয়। কুমারী পূজায় নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়।
এর মধ্য দিয়ে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি হয় । এভাবে পারিবারিক ও সমাজজীবনে প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়।
নবমী ও দশমী পূজা
নবমী পূজা
নবমী তিথিতে দেবী দুর্গার নবমীবিহিত পূজা করা হয়। অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধির সময় বিশেষভাবে সন্ধি পূজা অনুষ্ঠিত হয় । সন্ধি পূজায় ১০৮টি মাটির প্রদীপ প্রজ্বলন করে দেবীর পূজা করা হয় । এ সময় দেবী দুর্গাকে বিভিন্ন ধরনের উপকরণে ভোগ নিবেদন করা হয় এবং ভক্তদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করা হয় ।
দশমী পূজা
দশমী তিথিতে পূজাবিধি অনুসারে দেবী দুর্গার দশমীবিহিত পূজা করা হয়। দশমীর দিনে হয় দেবী দুর্গার প্রতিমা বিসর্জন । পূজার দশমীকে বলা হয় বিজয়া দশমী । দেবী দুর্গা যেন ঘরের মেয়ে । তিনি শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি আসেন । চারদিন থেকে তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে কৈলাস ভবনে যাত্রা করেন । দুর্গাপ্রতিমা নদী, পুকুর প্রভৃতি জলাশয়ে বিসর্জনের মাধ্যমে শারদীয় দুর্গা উৎসবের সমাপ্তি ঘটে ।
বিজয়া দশমীর আনুষ্ঠানিকতা ও আচার
বিজয়া দশমীকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা ও আচার পালন করা হয় । বিজয়া দশমীর আনুষ্ঠানিকতা ও প্রধান প্রধান আচারের মধ্যে আছে—
১. দেবীকে সিঁদুর পরানো, মিষ্টি মুখ করানো এবং বিদায় সম্ভাষণ জানানো । ২. সধবা নারীরা একে অন্যের কপালে সিঁদুর পরান ও দীর্ঘায়ু কামনা করেন ।
৩. পরস্পর আলিঙ্গন করা এবং মিষ্টিমুখের মাধ্যমে একে অপরকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধকরণ ।
৪. আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে মিছিল করে ঢাক, কাঁসর, সানাই ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে দেবীর প্রতিমা বিসর্জন ।
৫. বাড়িতে ফিরে ছেলেমেয়ে ও পাড়া-পড়শিদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় ও ধান- দূর্বা দিয়ে দীর্ঘায়ু কামনা । ৬. আত্মীয়স্বজন ও দরিদ্রদের মধ্যে নতুন জামা-কাপড় বা অর্থ ও উপহার প্রদান প্রভৃতি ।
৭. বিসর্জনের দিন বা পরের দিন কোন কোন অঞ্চলে মেলা অনুষ্ঠিত হয় ।
বিজয়া দশমীর তাৎপর্য
১. মহিষাসুরকে বধ করার মধ্য দিয়ে বিজয় উৎসব পালিত হয় । সুতরাং এ দশমী বিজয়ের দিন । অন্যায়কে প্রতিহত করে ন্যায় প্রতিষ্ঠার দিন ।
২. দেবী দুর্গা দেবতাদের সম্মিলিত শক্তির প্রকাশ । তাই দুর্গাপূজা তথা বিজয়া দশমী ঐক্যের প্রতীক ।
৩. বিজয়া দশমী পারিবারিক ও সামাজিক জীবন থেকে সকল প্রকার অশুভশক্তিকে দূর করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং পারস্পরিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় প্রেরণা দান করে ।
বিজয়া দশমীর প্রভাব
দুর্গাপূজার প্রভাবে অন্যায়-অবিচারকে প্রতিহত করার শক্তি জাগ্রত করে । সকলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি করে । দুর্গাপূজাকে অবলম্বন করে পত্র-পত্রিকায় পূজাসংখ্যা প্রকাশ করা হয়। বিভিন্ন পূজাসংগঠন শারদীয় পুজার স্মরণিকা প্রকাশ করে। পূজামণ্ডপে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। পূজামণ্ডপ এবং প্রতিমায় নানা নান্দনিক রূপকল্পনার প্রতিফলন হয় । সার্বিকভাবে দুর্গাপূজা এক মিলন মহোৎসব এবং আনন্দ ও সৃষ্টিশীলতার অপূর্ব সম্মিলন।
আর্থ-সামাজিক, পারিবারিক ও নৈতিক জীবনে দুর্গাপূজার প্রভাব
আবহমানকাল থেকেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সর্বাপেক্ষা বড় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। এ উৎসব তাদের প্রাণ । শারদীয় দেবীর পূজা মানে দেবী দুর্গার আরাধনা। তিনি বিশ্বের আদি কারণ এবং ঈশ্বরের শক্তির রূপ । দুর্গাপূজা আমাদের আর্থ-সামাজিক, পারিবারিক ও নৈতিক জীবনের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পাঠ ৮ ও ৯ : দেবী কালী - কালী দেবীর পরিচয়
দেবী কালী দুর্গাদেবীর মতো শক্তির দেবী । তিনি অসুর বিনাশে ভয়ঙ্করী । পৃথিবীর সকল অন্যায় ও অত্যাচার
দূর করার জন্য দেবী কালী অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করেন । কালী ভগবান শিবের সহধর্মিণী এবং বিশেষ শক্তি। তিনি কাল ও মৃত্যুর দেবীরূপে আত্মপ্রকাশ করার কারণে তাকে শ্মশান কালী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ ছাড়াও দেবী কালীর অনেক নাম রয়েছে । যেমন: ভদ্রকালী, দক্ষিণাকালী, মা তারা, শ্যামা, মহাকালী ইত্যাদি।
দেবী কালীর উৎপত্তি
দেবী কালী শিবের শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। হিন্দু পুরাণ অনুসারে কালী দেবীর নানা বর্ণনা আছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণে উল্লেখ আছে, তিনি বিভিন্ন রূপে অসুরদের ধ্বংস করে স্বর্গের দেবতাদের রক্ষা করেন । ইন্দ্রসহ সকল দেবতা, শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক অসুরের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য দেবী অম্বিকার কাছে প্রার্থনা করেন। অম্বিকা ক্রোধে উন্মত্ত হলেন। তখন দুই রূপ হলো তাঁর- অম্বিকা ও কালিকা বা কালী । শুম্ভ ও নিশুম্ভের অনুচর চণ্ড ও মুণ্ডকে দেবী কালী বধ করেন । এ কারণে তাঁর আর এক নাম হয় চামুণ্ডা ।
কালী পূজার সময় :
কালীপূজা সাধারণত অমাবস্যার রাতে করা হয় । কালীপূজা দুর্গাপূজার পর কার্তিক-অগ্রাহয়ণ মাসের অমাবস্যা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়। পূজার দিন সন্ধ্যার সময় দীপাবলির আয়োজন করা হয় যা দেয়ালী নামে পরিচিত । বিভিন্ন ধরনের মহামারীর (বসন্ত, কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব, ঝড়, বন্যা, খরা প্রভৃতির) সময় রক্ষা কালী বা শ্যামা কালীর পূজা করা হয় ।
কালীপূজা পদ্ধতি
দুর্গা পূজার মতো কালী পূজাও গৃহে বা মণ্ডপে প্রতিমা নির্মাণ করে সম্পন্ন করা হয় । দেবীর চক্ষু দান ও প্রাণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই কালী পূজা শুরু হয় । দেবী কালীকে ধ্যান, পূজা, আরতি, ভোগ প্রভৃতি কর্ম সম্পাদন করে সবশেষে প্রণাম করা হয় ।
কালীপূজার প্রণাম মন্ত্র, সরলার্থ ও শিক্ষা
কালী পূজার ধ্যান
ওঁ শবারূঢ়াং মহাভীমাং ঘোর-দংষ্ট্রাবরপ্রদাম্।
হাস্যযুক্তাং ত্রিনেত্রাঞ্চ কপালকর্তৃকাকরাম ॥ মুক্তকেশীং লোলজিহ্বাং পিবন্তীং রুধিরং মুহূঃ । চতুর্বাহুযুতাং দেবীং বরাভয়করাং স্মরেৎ ॥
সরলার্থ : দেবী কালী শবারূঢ়া, ভীমা ভয়ঙ্করী, তিনি ত্রিনয়নী, ভয়ানক তাঁর দাঁত, লোল জিহ্বা তাঁর । তিনি মুক্তকেশী, হাতে নরকপাল ও কর্তৃকা (কাটারি) । অপর দুহাতে বর ও অভয় মুদ্রা, দেবী আবার হাস্যময়ী । এখানে কোমল ও কঠোর রূপে দেবী কালীর রূপ বর্ণিত হয়েছে ।
শিক্ষা
১. দেবী কালী অন্যায় প্রতিরোধ করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি তাঁর ভক্তদের কল্যাণে নিয়োজিত। তাঁর
কাছ থেকে আমরা মঙ্গল সাধন করার শিক্ষা পাই। দেবী কালীর কাছে আমরা অন্যায়ের কাছে কঠোর, সহজের কাছে কোমল হওয়ার শিক্ষা পাই ।
২. অন্যায়কারীর কাছে দেবী রাগী, ভয়ংকরী । ভক্তের কাছে স্নেহময়ী জননী । আর্থ-সামাজিক, পারিবারিক ও নৈতিক জীবনে কালী পূজার প্রভাব
দেবী কালী ক্ষমতা ও শক্তির আধার । তিনি একাধারে কঠোর, অপরদিকে মমতাময়ী মা। তিনি এ বিশ্বের সকল অশুভ শক্তি ধ্বংস করে সকলের মধ্যে মঙ্গলবার্তা ছড়িয়ে দিয়ে থাকেন। হিন্দুধর্মাবলম্বীরা দেবী কালীকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে পূজা করে থাকেন। এ পূজার মাধ্যমে আমাদের আর্থ-সামাজিক, পারিবারিক ও নৈতিক জীবনে অনেক প্রভাব পরিলক্ষিত হয় ।
কাৰ্ত্তিক
পাঠ ১০ : কার্তিক দেবের পরিচয়, পূজার ধ্যান ও প্রণামমন্ত্র
কার্ত্তিক একজন পৌরাণিক দেবতা । তিনি ভগবান শিব ও মা দুর্গার পুত্র। দেবতা কাৰ্ত্তিক অত্যন্ত সুন্দর, সুঠাম দেহ এবং অসীম শক্তির অধিকারী । পুরাণে আছে, তারকাসুরের আধিপত্য থেকে স্বর্গরাজ্য উদ্ধার করার জন্য স্বর্গের দেবতারা তাঁকে সেনাপতিরূপে বরণ করেন । তাঁর দেহবর্ণ তপ্ত স্বর্ণের মতো ।
যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে কার্তিকের হাতে তীর, ধনুক ও বল্লম দেখা যায় । তার বাহন সুদৃশ্য পাখি ময়ূর । কাৰ্ত্তিক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। এ সকল যুদ্ধে তিনি জয়লাভ করেছিলেন। পুরাণ অনুসারে তারকাসুরকে বধ করার জন্য কার্তিকের জন্ম হয়েছিল। তিনি বলির পুত্র বাশাসুরকেও পরাজিত করেছিলেন । কার্তিকের অন্য নাম স্কন্দ, মহাসেন, কুমার গুহ ইত্যাদি । স্কন্দপুরাণ কার্তিককে নিয়ে রচনা করা হয়েছে ।
কাৰ্ত্তিক পূজা
কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে কাৰ্ত্তিক পূজার আয়োজন করা হয়। কার্ত্তিক পূজার মাধ্যমে দম্পতিরা সন্তান-সন্তুতি
প্রার্থনা করে থাকেন। কথিত আছে, দেবকী কার্তিকের ব্রত করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পুত্ররূপে লাভ করেছিলেন ।
কার্ত্তিক দেবতার ধ্যান
ওঁ কার্ত্তিকেয়ং মহাভাগং ময়ুরোপরিসংস্থিতম্ ।
তপ্তকাঞ্চনবর্ণাভং শক্তিহস্তং বরপ্রদম্ ॥ দ্বিভুজং শত্রুহন্তারং নানালঙ্কারভূষিতম্ ।
প্রসন্নবদনং দেবং কুমারং পুত্রদায়কম্ ॥
সরলার্থ : কার্ত্তিকদেব মহাভাগ, ময়ূরের উপর তিনি উপবিষ্ট । তপ্ত স্বর্ণের মতো উজ্জ্বল তাঁর বর্ণ । তাঁর দুটি হাতে শক্তি নামক অস্ত্র । তিনি নানা অলংকারে ভূষিত । তিনি শত্রু হত্যাকারী । প্রসন্ন হাস্যোজ্জ্বল তাঁর মুখ।
প্রণাম মন্ত্ৰ
ওঁ কাৰ্ত্তিকেয় মহাভাগ দৈত্যদর্পনিসূদন ।
প্রণোতোহং মহাবাহো নমস্তে শিখিবাহন রুদ্রপুত্র নমস্তুভ্যং শক্তিহস্ত বরপ্রদ । ষান্মাতুর মহাভাগ তারকান্তকর প্রভো । মহাতপস্বী ভগবান্ পিতুমাতুঃ প্ৰিয় সদা ॥ দেবানাং যজ্ঞরক্ষার্থং জাতস্ত্বং গিরিশিখরে । শৈলাত্মজায়াং ভবতে তুভ্যং নিত্যং নমো নমঃ
সরলার্থ : হে মহাভাগ, দৈত্যদলনকারী কার্তিক দেব তোমায় প্রণাম করি । হে মহাবাহু, ময়ূর বাহন, তোমাকে নমস্কার । হে রুদ্রের (শিব) পুত্র, শক্তি নামক অস্ত্র তোমার হাতে । তুমি বর প্রদান কর । ছয় কৃত্তিকা তোমার ধাত্রীমাতা । জনক-জননী প্ৰিয় হে মহাভাগ, হে ভগবান, তারকাসুর বিনাশক, হে মহাতপস্বী প্রভু তোমাকে প্রণাম । দেবতাদের যজ্ঞ রক্ষার জন্য পর্বতের চূড়ায় তুমি জন্মগ্রহণ করেছ । হে পার্বতী দেবীর পুত্র তোমাকে
সতত প্রণাম করি ।
কার্ত্তিক পূজার গুরুত্ব ও প্রভাব
১. কথায় বলে কার্তিকের মতো চেহারা । অর্থাৎ কার্তিকের দেহাকৃতি অত্যন্ত সুন্দর, সুঠাম ও বলিষ্ঠ । এ কারণে কার্ত্তিক পূজার মাধ্যমে দম্পতিরা সুন্দর, সুঠাম ও বলিষ্ঠ চেহারার সন্তানাদি প্রার্থনা করে থাকেন ।
২. কার্তিক দেবতাদের সেনাপতি । তিনি অসীম শক্তিধর দেবতা । এজন্য তাঁকে রক্ষাকর্তা হিসেবে পূজা করা হয় ।
কার্ত্তিক নম্র ও বিনয়ী স্বভাবের দেবতা । কিন্তু সমাজের ন্যায়, অন্যায় ও অবিচার নির্মূলে তিনি অবিচল যোদ্ধা। তিনি তারকাসুর পরাভূত করে স্বর্গরাজ্য উদ্ধার করে স্বর্গেও শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । আমরা কার্তিকের ন্যায় প্রতিষ্ঠার আদর্শ অনুসরণে নীতিবান হতে পারি । তাঁকে অনুসরণ করে বিনয়ী মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারি এবং আদর্শ সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারি ।
8. আমাদের সকলকেই কার্তিকের মতো নম্র ও বিনয়ী হওয়া উচিত এবং অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত।
পাঠ ১১ : দেবী শীতলা
শীতলা দেবীর পরিচয়
■ শীতলা লৌকিক দেবী । শীতলা পুরাণে গৃহীত হয়ে পৌরাণিক দেবীতে পরিণত হয়েছেন । সাধারণভাবে এ দেবী বসন্ত রোগের জ্বালা নিবারণ করে শীতল করেন বলে শীতলা নামে পরিচিত হয়েছেন। বসন্ত ও চর্মরোগ থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে শীতলা পূজা করা হয় ।
■ দেবী শীতলাকে ঠাকুরানি জাগরণী, করুণাময়ী, দয়াময়ী প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়। শীতলা কুমারী, মাথায় কূলাকৃতির মুকুট এবং গর্দভের উপর উপবিষ্ট । গর্দভ তাঁর বাহন। স্কন্দপুরাণে শীতলা দেবী শ্বেতবর্ণা ও দুহাত বিশিষ্ট । তাঁর দুহাতে রয়েছে পূর্ণকুল ও সম্মার্জনীধারণী । কথিত আছে সম্মার্জনীর মাধ্যমে তিনি অমৃতময় শীতল জল ছিটিয়ে রোগ, তাপ, শোক দূর করেন। কখনো কখনো তিনি নিমের পাতা বহন করে থাকেন। নিম রোগ প্রতিরোধকারী উদ্ভিদ ।
শীতলা পুজা
সাধারণত শ্রাবণ মাসের শুক্লা সপ্তমী তিথিতে দেবী শীতলার পূজা করা হয় । পূজামন্দিরে বা শীতলা পূজার নির্দিষ্ট স্থানে পূরোহিতের মাধ্যমে শীতলা পূজা করা হয়। পূজার পদ্ধতি অন্যান্য পূজার অনুরূপ হলেও এ পূজার সময় ঠাণ্ডা জাতীয় ফলের প্রয়োজন হয়। পেঁপে, নারিকেল, তরমুজ, কলা ও অন্যান্য মিষ্টিজাতীয় উপকরণ দেবীর উদ্দেশে সমর্পণ করা হয়। এ পূজায় সকল শ্রেণির ভক্ত অংশগ্রহণ করে থাকে ।
পূজার প্রণাম মন্ত্র
ওঁ নমামি শীতলাং দেবীং রাসভস্থাৎ দিগম্বরীম্ । মাৰ্জ্জনীকলসোপেডাং সূপালঙ্কৃতমস্তকাম্ ।
সরলার্থ : গর্দভ বাহন মার্জনী (ঝাঁটা) ও কলস- হস্তা শীতলা দেবীকে প্রণাম করি ।
শীতলা পূজার গুরুত্ব
১. শীতলা দেবী বসন্ত রোগ থেকে আমাদের মুক্ত করে আমাদের শীতল করেন। এ কারণে তিনি সকলের কাছে সমাদৃত হয়েছেন ।
২. দেবী শীতলাকে স্বাস্থ্যবিধি পালন বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দেবী বলা হয়। শীতলা পূজার মাধ্যমে আমরা স্বাস্থ্য বিধি ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতন হয়ে থাকি ।
৩. দেবী শীতলার দুই হাতে রয়েছে পূর্ণকুম্ভ ও সম্মার্জনী । কথিত আছে সম্মার্জনীর মাধ্যমে তিনি অমৃতময় শীতল জল ছিটিয়ে রোগ, তাপ, শোক দূর করে শীতল করেন। আমরাও বসন্তে আক্রান্ত রোগীদের সেবা করে তাদের শীতল করব । শীতলা পূজার মধ্য দিয়ে আমরা এ ধরনের সেবামূলক কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ হই । কখনো কখনো তিনি নিমের পাতা বহন করে থাকেন । নিম বৃক্ষ রোগ প্রতিরোধকারী উদ্ভিদ । আমরা বাড়ির অঙ্গিনায় রোগ প্রতিরোধের জন্য নিম গাছ রোপণ করতে পারি ।
অনুশীলনী
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :
১ । কোন্ দেবতাকে ষড়ানন বলা হয়?
ক. গণেশ
খ. অর্জুন
গ. কাৰ্ত্তিক
ঘ. শিব
২। কোন্ তিথিতে শীতলা দেবীর পূজা করা হয়?
ক. পঞ্চমী
খ. ষষ্ঠী
গ. সপ্তমী
ঘ. অষ্টমী
৩। দুর্গা স্নানের জন্য প্রয়োজন হয় কোন মিলিত স্থানের মাটি -
i. তিন রাস্তা
ii. দুই রাস্তা
iii. চার রাস্তা
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i
গ. iii
খ. ii
ঘ. i, ii ও iii
নিচের অনুচ্ছেদটি পড় এবং ৪ ও ৫ নং প্রশ্নের উত্তর দাও :
শুক্লা এ বছর বৃক্ষমেলা থেকে একটি বেল গাছের চারা ক্রয় করে বাড়ির আঙ্গিনায় রোপণ করে । প্রতিদিন
সে সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে গাছটি বড় করে তোলে ।
৪ । শুক্লার ক্রয়কৃত গাছটি কোন দেবতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট?
ক. কাৰ্ত্তিক
খ. শিব
গ. বিশ্বকর্মা
ঘ. গণেশ
৫। শুক্লার বৃক্ষ পরিচর্যার মধ্য দিয়ে মূলত প্রকাশ পেয়েছে –
i. ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা
ii. বৃক্ষপ্রীতি
iii. সৌন্দর্য বর্ধন
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i
খ. ii
গ. iii
ঘ. i, ii ও iii
সৃজনশীল প্রশ্ন :
পলাশপুর গ্রামে হঠাৎ বসন্ত ও কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় গ্রামবাসী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে । ফলে তারা একত্রিত হয়ে এক বিশেষ পূজার আয়োজন করে এবং ভক্তিপূর্ণ মনে বিভিন্ন উপচারে পুষ্পাঞ্জলি
ও প্রণাম মন্ত্রের মধ্য দিয়ে পূজার কাজ সম্পন্ন করে।
ক. দেবতা বলতে কী বোঝ?
খ. লৌকিক দেবতার ধারণাটি ব্যাখ্যা কর ।
গ. অনুচ্ছেদে বর্ণিত গ্রামবাসীরা কোন্ বিশেষ পূজার আয়োজন করে? উক্ত পূজার পদ্ধতি ব্যাখ্যা কর।
ঘ. সামাজিক, পারিবারিক ও নৈতিক জীবনে উক্ত পূজার প্রভাব বিশ্লেষণ
Read more