তোমরা নিশ্চয়ই জান বিশ্বের সবকিছু তৈরি হয়েছে অণু দিয়ে। (অবশ্য অণু মৌলিক কণা নয়, অনু তৈরি হয়েছে পরমাণু দিয়ে, পরমাণু তৈরি হয়েছে ইলেকট্রন এবং নিউক্লিয়াস দিয়ে, নিউক্লিয়াস তৈরি হয়েছে প্রোটন এবং নিউট্রন দিয়ে, প্রোটন এবং নিউট্রন তৈরি হয়েছে কোয়ার্ক দিয়ে এবং বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন ইলেকট্রন কিংবা কোয়ার্ক তৈরি হয়েছে স্ট্রিং দিয়ো) যেহেতু একটা পদার্থের ধর্ম তার অণুতে বজায় থাকে তাই আমরা অণুকেই পদার্থের সবচেয়ে ছোট একক হিসেবে ধরে নিই। যেমন পানির অণুতে পানির সব ধর্ম আছে কিন্তু পানিকে তার পরমাণুতে ভেঙে নিলে সেটি আর পানি থাকে না। সেটা হয়ে যাবে একটা অক্সিজেন আর দুইটা হাইড্রোজেনের পরমাণুতে, দুটোই গ্যাস।
একটা পদার্থে তার অগুগুলো কীভাবে আছে তার ওপর নির্ভর করে সেটি কি কঠিন, তরল নাকি গ্যাস (চিত্র 5.13) । এর সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ হচ্ছে পানি, এটি কঠিন তরল কিংবা গ্যাস তিন রূপেই থাকতে পারে। তার অণুগুলো কীভাবে আছে তার উপর নির্ভর করছে এটি কি বরফ, পানি নাকি জলীয় বাস্প।
যখন কোনো পদার্থ গ্যাস অবস্থায় থাকে তখন তার অণুগুলো থাকে মুক্ত অবস্থায়, একটি থেকে অন্যটির মাঝে দূরত্ব অনেক বেশি। যখন তরল অবস্থায় থাকে তখন অণুগুলো তুলনামূলকভাবে কাছে হলেও একটার সাপেক্ষে অন্যটি নড়তে পারে। কঠিন অবস্থার অনুগুলো কাছাকাছি থাকে কিন্তু একটি অণু অন্য অর সাপেক্ষে নড়তে পারে না।
একটা গ্যাসের অণুগুলোর মাঝে দূরত্ব অনেক বেশি। সেগুলোর কোনো নিয়মিত আয়তন বা আকার নেই। তরল পদার্থের প্যাসগুলো কাছাকাছি, তাদের নির্দিষ্ট আয়তন থাকলেও কোনো নিয়মিত আকার নেই। কঠিন পদার্থের অণুগুলো প্রায় পায়ে পায়ে লেগে থাকে, তাই তাদের নির্দিষ্ট আয়তন এবং নিয়মিত আকার আছে।
গাসে অপুগুলো মুক্তভাবে ছোটাছুটি করতে পারে, তরলে অণুগুলো কাঁপে এবং একটার পাশ দিয়ে অন্যটি চলে যেতে পারে, কঠিন পদার্থে অণুগুলো নিজ অবস্থানে থেকে কাঁপলেও স্থান পরিবর্তন করতে পারে না।
এমনিতে আমরা কঠিন, তরল বা গ্যাস কোনোটিরই অণুকে দেখতে পাই না, এটাকে কঠিন, তরল বা গ্যাস হিসেবে দেখি। উপরে অণুগুলোর যে বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে, তাদের কঠিন, তরল বা গ্যাসীয় অবস্থাতেও সেটা প্রকাশ পায়। যেমন:
গাসঃ আণবিক ধর্ম | গ্যাসে তার প্রতিফলন |
অণুগুলো একটা আরেকটার পাশে ছুটতে পারে | যে পাত্রে রাখা হয় তার পুরো আয়তনে ছড়িয়ে পড়ে। |
অণুগুলোর মাঝে দূরত্ব বেশি, ফাঁকা জায়গা রয়েছে | গ্যাসকে চাপ দিয়ে সংকুচিত করা যায়। |
একটি অণু অন্য অণুর সাপেক্ষে ছুটতে পারে | গ্যাস সহজে প্রবাহিত হয় |
তরল: আণবিক ধর্ম | তরল পদার্থে তার প্রতিফলন |
অণুগুলো একটা আরেকটার পাশে দিয়ে যেতে পারে | সহজে প্রবাহিত হয়, যে পাত্রে রাখা হয় তার আকার ধারণ করে। |
অণুগুলো কাছাকাছি বলে ফাঁকা জায়গা নেই | তরলকে চাপ দিয়ে সংকুচিত করা যায় না। |
কঠিন: আণবিক ধর্ম | কঠিন পদার্থে তার প্রতিফলন |
অণুগুলো নিজ অবস্থানে দৃঢ় | নির্দিষ্ট আকার থাকে |
অণুগুলোর মাঝে দূরত্ব নেই | চাপ দিয়ে সংকুচিত করা যায় না। |
অণুগুলো নিজ অবস্থানে আটকা পড়ে থাকে | ঢেলে প্রবাহিত করা যায় না। |
একটি কঠিন পদার্থ টেবিলে রাখা হলে কঠিন পদার্থটি টেবিলের যে অংশটুকু স্পর্শ করবে সেখানে এক ধরনের চাপ প্রয়োগ করবে। কঠিন পদার্থ না রেখে আমরা যদি একইভাবে টেবিলে তরল পদার্থ রাখতে চাই সেটি কাজ করবে না, তরলটি সারা টেবিলে গড়িয়ে যাবে। তরলটি রাখতে হবে কোনো একটা পাত্রে এবং তরলটি শুধু নিচে নয় চারদিকে পাত্রটির গায়ে চাপ দেবে। (পাত্রটির গায়ে একটা ফুটো করা হলে তরলের চাপে এই ফুটো দিয়ে তরল বের হতে থাকবে) আমরা যদি গ্যাস রাখতে চাই তাহলে সেটি আর পাত্রে রাখা সম্ভব না, তখন সেটি একটা আবদ্ধ জায়গায় রাখতে হবে এবং গ্যাস এই আবদ্ধ জায়গার চারদিকে চাপ প্রয়োগ করবে। একটা বেলুন ফুলিয়ে সেখানে গ্যাস রাখা হয় এবং বেলুনটা না ফাটিয়ে সেখানে একটা ফুটো করতে পারলে বাতাসের চাপে এই ফুটো দিয়ে বাতাস বের হতে থাকবে।
আমরা গ্যাসের চাপের কথা উল্লেখ করেছি কিন্তু এর কারণটি ব্যাখ্যা করিনি। পদার্থের আণবিক গতিতত্ত্ব দিয়ে আমরা চাপের কারণটি ব্যাখ্যা করতে পারব। আবদ্ধ জারগার গ্যাস রাখা হলে এটি পাত্রের গায়ে একধরনের চাপ দের, পদার্থের আণবিক গতিতত্ত্ব দিয়ে সেটি ব্যাখ্যা করা যায়। আবদ্ধ জায়গার ভেতর গ্যাসের অণুগুলো ছোটাছুটি করতে থাকে এবং প্রতিনিয়ত সেটি আবদ্ধ জায়গার দেয়ালে এসে আঘাত করে এবং প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যায়। অর্থাৎ গ্যাসের অণু একটি ভরবেগে দেয়ালে আঘাত করে অন্য ভরবেগে ফিরে যায়। তোমরা জানো ভরবেগের পরিবর্তন করতে হলে বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করতে হয়। গ্যাসের অণু দেয়ালে আঘাত করে বল প্রয়োগ করে, নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী পাত্রের দেয়াল একটি পাল্টা বল গ্যাসের অণুর উপর প্রয়োগ করে অণুটিকে প্রতিফলিত করে দেয়।
এভাবে অসংখ্য অণু আবদ্ধ পাত্রের দেয়ালে আঘাত করে বল প্রয়োগ করতে থাকে এবং এই সম্মিলিত ফলটিই গ্যাসের চাপ হিসেবে দেখা যায়। যদি গ্যাসের তাপ বাড়িয়ে দেওয়া হয় তাহলে অনুগুলোর গতিশক্তি বেড়ে যাবে এবং সেটি আরো জোরে দেয়ালে আঘাত করতে পারবে। অর্থাৎ চাপ বেড়ে যাবে। আমরা পরের অধ্যায়ে তাপ দিয়ে তাপমাত্রা বাড়ানোর সাথে চাপ বেড়ে যাওয়ার সম্পর্কটি নতুনভাবে দেখৰ।
কঠিন, তরল এবং গ্যাস এই তিনটি ভিন্ন অবস্থার বাইরেও পদার্থের চতুর্থ আরেকটি অবস্থা হতে পারে, এর নাম প্লাজমা। আমরা জানি অণু কিংবা পরমাণুর নিউক্লিয়াসে যে কয়টি পজিটিভ চার্জের প্রোটন থাকে তার বাইরের ঠিক সেই করটি নেগেটিভ চার্জের ইলেকট্রন থাকে। সে কারণে একটা অপু কিংবা পরমাণুর সম্মিলিত চার্জ শূন্য। বিশেষ অবস্থায় অণু কিংবা পরমাণুকে আয়নিত করে ফেলা যার, কিছু পরমাণুর এক বা একাধিক ইলেকট্রনকে মুগ্ধ করে ফেলা যায়, তখন আলাদা আলাদাভাবে পরমাণুগুলো আর চার্জ নিরপেক্ষ থাকে না। ইলেকট্রন এবং আয়নের এক ধরনের মিশ্রণ তৈরি হয়। এটি যদিও গ্যাসের মতো থাকে কিন্তু প্যাসের সব ধর্ম এর জন্য সত্যি নয়। যেমন আমরা জানি গ্যাসের কোনো নির্দিষ্ট আকার নেই কিন্তু চৌম্বক ক্ষেত্র দিয়ে প্লাজমার নির্দিষ্ট আকার তৈরি করে ফেলা যায়।
প্রচণ্ড তাপ দিয়ে গ্যাসকে প্লাজমা করা যায়, শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র প্রয়োগ করেও প্লাজমা করা যায়। আমাদের ঘরে টিউবলাইটের ভেতর প্লাজমা তৈরি হয়, নিয়ন লাইটের যে উজ্জ্বল বিজ্ঞাপন দেখা যায় সেগুলোর ভেতরেও প্লাজমা থাকে। বজ্রপাত হলে যে বিজলির আলো দেখা যায় সেটিও প্লাজমা আবার দূর নক্ষত্রের মাঝে যে পদার্থ সেটিও প্লাজমা অবস্থায় আছে। আমরা বর্তমানে ফিশান পদ্ধতিতে ভারী নিউক্লিয়াসকে ভেঙে নিউক্লিয়ার শক্তি ব্যবহার করি। হালকা নিউক্লিয়াসকে একত্র করে ফিউশান পদ্ধতিতে শক্তি তৈরি করার জন্য প্লাজমা ব্যবহার করার চেষ্টা করা হয় এবং এটি এখন পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র ।
আরও দেখুন...