সুনাগরিকতা অর্জনের ক্ষেত্রে রয়েছে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা। কারণ, সুনাগরিকের গুণগুলো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়। আমাদের সমাজে রয়েছে নানা ধরনের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা। এগুলো বাংলাদেশের নাগরিকদের সুনাগরিক হয়ে উঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। নিচে বাংলাদেশে বিরাজমান এ সংক্রান্ত কয়েকটি প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
নির্লিপ্ততা: সাধারণভাবে কাজের প্রতি নাগরিকদের উদাসীনতাকে বলে নির্লিপ্ততা। বিভিন্ন কারণে নির্লিপ্ততা তৈরি হয়। যেমন- নিরক্ষরতা, উপযুক্ত শিক্ষার অভাব, অলসতা, দারিদ্র্য ও কাজে অনীহা। আমাদের দেশের নাগরিকদের মধ্যে এ জাতীয় নির্লিপ্ততা লক্ষ করা যায়। এর ফলে তারা রাষ্ট্রের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করতে চায় না। এমনকি নাগরিক হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে না।
ব্যক্তিস্বার্থ: এটি সুনাগরিকতা অর্জনের পথে আরেকটি বড়ো অন্তরায়। ব্যক্তির স্বার্থপরতা এর ফলে ব্যক্তি নিজের স্বার্থকে দেশের স্বার্থের চেয়ে বড়ো করে দেখে। এর ফলে নাগরিক সহজেই দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতিত্ব করে থাকে। এ কারণেই নির্বাচনে অনেক সময় যোগ্য লোককে ভোট না দিয়ে দলীয় ও ব্যক্তিগত স্বার্থ বিবেচনা করে ভোট দেয়। উপযুক্ত প্রার্থীকে বাদ দিয়ে নিজ আত্মীয় বা পরিচিতজনকে চাকরি দেয়। স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক অনিয়ম করে। এ সব কিছুই সুনাগরিকতার প্রতিবন্ধকতা। এ ধরনের কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
দলীয় গোষ্ঠীতান্ত্রিক মনোভাব : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা রাজনৈতিক দল ছাড়া কার্যকর থাকে না। ফলে এ শাসনব্যবস্থায় এক ধরনের দলীয় মনোভাব কাজ করে। গণতন্ত্র আমাদেরকে ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়। কিন্তু একই ব্যবস্থায় আবার নিজ দলের বা গোষ্ঠীর প্রতি একরকম, বিরোধী দলের লোকদের প্রতি অন্যরকম আচরণ করলে তা সুনাগরিক হওয়ার পথে একটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
অজ্ঞতা ও নিরক্ষরতা : অজ্ঞ ও নিরক্ষর লোক অনেক কিছু জানতে ও বুঝতে পারে না। আমাদের দেশে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নাগরিক নিরক্ষর। যারা লেখাপড়া জানেন তাদের অনেকেই স্বল্প শিক্ষিত। ফলে তারা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়। তাদের উপর রাষ্ট্রের দেওয়া দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে না। অতএব, বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক নাগরিককে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তাদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে।
ধর্মান্ধতা : সুনাগরিকতার বিকাশে ধর্মান্ধতা একটি বিরাট অন্তরায়। ধর্মান্ধতা ব্যক্তিকে অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষী করে তোলে। এ ধরনের মনোভাব বিভিন্ন ধর্মের লোকের মধ্যে বিভেদ ও সংঘাত সৃষ্টি করে। এ ধরনের পরিস্থিতি দেশের সংহতি, উন্নতি ও প্রগতিকে বিনষ্ট করে।
দাম্ভিকতা: এটি একটি নেতিবাচক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এর ফলে ব্যক্তি নিজেকে অন্যের চেয়ে বড়ো করে দেখে। অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দেয় না। নিজের মতামত অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। এ ধরনের মানসিকতা সুনাগরিকতার পথে বিরাট বাধা।
সাম্প্রদায়িকতা: একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের আধিপত্য থেকে সাম্প্রদায়িকতার মনোভাব তৈরি হয়। সংখ্যালঘিষ্ঠ লোকদের মধ্যেও এ মনোভাব তৈরি হতে পারে যদি তারা তাদের ধর্মকে অন্যান্য ধর্মের চেয়ে একমাত্র সত্য হিসেবে বিশ্বাস করে। ফলে দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ ও অশান্তি বিরাজ করে।
অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা: বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশের ১৮.৭ ভাগ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে
বসবাস করে। দারিদ্র্যের কারণে আমাদের দেশে প্রায় এক-চতুর্থাংশ লোক লিখতে-পড়তে পারে না। ফলে তাদের বুদ্ধিমত্তার যথাযথ বিকাশ হয় না। তাদের বিবেকও সঠিকভাবে কাজ করে না। যা সুনাগরিকতা অর্জনের জন্য একটি অন্যতম বাধা।
১। উপযুক্ত শিক্ষাগ্রহণ করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। সকল ধরনের অলসতা ও নির্লিপ্ততা পরিহার করে দেশ গঠনে অংশগ্রহণ করতে হবে।
২। ব্যক্তির চেয়ে দেশকে বড়ো মনে করে ব্যক্তিগত স্বার্থ পরিত্যাগ করতে হবে।
৩। দলীয় মনোভাব পরিত্যাগ করে সর্বজনীন মনোভাব পোষণ করতে হবে।
৪। শুধু ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী ইত্যাদি ভেদে মানুষকে পৃথক না করে সকলের প্রতি সম-আচরণের মনোভাব জাগ্রত করতে হবে।
৫। দাম্ভিকতা পরিহার করে সকলের জন্য কল্যাণকর মতামতের উপর গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। একজন মানুষও যদি কল্যাণকর মতামত প্রদান করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তার মতামতকে স্তব্ধ করা যাবে না।
৬। অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা দূর করে সকলের জন্য সম-মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, সুশিক্ষা ও স্বশিক্ষায় শিক্ষিত নাগরিক সকল ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সক্ষম।
কাজ-১: সুনাগরিকতা অর্জনের প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে চিন্তা কর এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ খাতায় লেখ। একটি পোস্টার পেপারে পয়েন্টগুলো লিখে শ্রেণিকক্ষে ঝুলিয়ে দাও। |
Read more